লেখার শুরুতে বন্ধু মাঞ্জুরা খান পলি কে ধন্যবাদ জানাই...কারন আগের লেখাটা পড়ে ও একটা কথা বলেছিলো...তাহলো কিসের টানে আমরা আমাদের প্রিয় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাঝে মাঝে ফিরে যাই?।যারা কিছু কাজের জন্যে ফিরে যায় তারাও যেমন কিছু মানুষ কে মিস্ করে তেমনি যারা কাজ ছাড়াই যায় তারাও কিছু মানুষ কে মিস্ করে তাই ফিরে যায়।এই মানুষ গুলো আমাদের ক্যাম্পাস জিবনে আমদের সাথেই জড়িয়ে ছিলো।ছোট ছোট অথচ বিশাল মাপের সেই মানুষ গুলো কে নিয়ে আমার এই লেখা...
তপন দাঃ সদা হাস্যময় তপন দা কে কেউ কখনও রাগতে দেখছে বলে শুনিনাই।কেউ ডাকলেই...হাসিমুখে তপন দা বলবেন..."জি দাদা...বলেন।এইতো দাদা দিচ্ছি দাদা।আমাদের সিনিয়র অনেক আপু এবং ভাইয়াও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে তপন দা কেই আগে খুজবেন।ছাত্র জিবনে অনেকের বাকির ফোল্ডার হয়তো এখনও মুছে যায়নি...কিন্তূ তপন দা আছেন আগের মতই।নাহ্ ভুল হলো উনি আর আগের মতো নেই।মুক্তিযুদ্ধ ভাস্কর্য্য হবে তাই তপন দার আগের স্থান পরিবর্তন হয়ে গেছে।পটপানার মতো তপন দা তার দোকান নিয়ে একরাশ হতাশার মাঝে আছেন।বিশ্ববিদ্যালয়ের মাষ্টার প্লান নামক তথাকথিত মারপ্যাচে তপন দা নাকি তার বর্তমান স্থানেও থাকতে পারবেন্না।যারা জানেন না তাদের জন্যে বলি, এক সময় আমাদের এই তপন দা বিশ্ববিদ্যালয় কে তিন লাখ টাকা দিয়ে জায়গা লিজ নিয়ে ছিলেন যখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিরা মঞ্জুরী কমিশনের টাকা চেয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসতেন।এখন আমাদের অনেক টাকা আসে তাই তপন দা কে কতৃপক্ষের প্রয়োজন নেই।একদল ধুমপান নিষিদ্ধকারী দল তার দোকানে রেড দিয়ে ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেয়।এই দলের নেতৃত্বদানকারী শাহ্ নেওয়াজ(ডিন অব আর্টস এন্ড হিউম্যানিসটিকস...এবং ইকোনোমিকস্ ডিসিপ্লিনের শিক্ষক) স্যারের কাছে জানতে চাই...আপনার নিজ ডিসিপ্লিনের একজন মোল্লা শিক্ষক আপনার ই একজন ছাত্রী কে শ্লীলতাহানী করার দায়ে ফেসে গিয়েছিলেন...তার বিচার কি হয়েছে?...কিভাবে এখনো ক্লাস নিচ্ছেন তিনি?একটু বলবেন?অনেক কিছুর বদলে যাবার দরকার সুতরাং এসব নিতান্ত গরিব মানুষের পিছে লাগবেন্না।আপনারা মাস গেলে অনেক টাকা পান যা তপন দা হয়তো সারা বছরও চিন্তা করে না।আর আইন যেন শুধু ছাত্রদের জন্যেই না হয়...সেটা যেন সবার জন্যে সমান হয়।ধুমপান নিষিদ্ধ করতে হলে আগে ধুমপায়ীদের জন্যে নির্দিষ্ট জায়গা করে দিন তারপর দেখুন কয়জন সেটা না মানে।ব্যবসায়িক পলিসির জোরে রেজিষ্টার বিল্ডিং এ ঢুকে গেছে ডাচ্ বাংলা ব্যাংকের বুথ কিন্তু হচ্ছেনা আমাদের প্রিয় তপন দার একটা স্থায়ী জায়গা।
মুজিব ভাইঃ যারা প্রথম মুজিব ভাই কে দেখবে তাদের কখনই মনে হবেনে উনার পেশা কি?।বিশাল দেহী মুজিব ভাই,ঠিক কুচকুচে কালো বললে ভুল হবে...আর চোখের চশ্মার এতই পাওয়ার যে চশ্মার বাইরে থেকে দেখতে ঠিক বড় সাইজের রসগোল্লার মতো লাগে।মুজিব ভাই আগে বসতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন রাস্তার মোড়ে জেনারেটর রুমের পাশে।অবশ্য মুজিব ভাই কে প্রথম দেখেছি নিরালার মোড়ে যখন তার পাশে ছিল আমাদের সবার প্রিয় নানী।এই নানীকে নিয়ে যে কত ফাজলামী করেছি...যা হোক নানী হারিয়ে গেছেন।তাকে খোজার ইচ্ছা হয়নি...কারন তা আর সম্ভব না।উনার চা এর মান কখনই বলার মতো ছিলো না।তবুও বসতাম উনার দোকানে।এর পিছনে একটা কারন ছিলো...তা হলো লাইফ সাইন্স স্কুলের মেয়েরা দুরত্ব এবং সময়ের কারনে মুজিব ভাইয়ের দোকান কেই বেছে নিতো...সুতরাং এক পলকের একটু দেখা ইকোনোমিক্সের কাকলী কে দেখে নিতাম।মুলত এখান থেকেই আমার আর লিটনের কাকলীর জন্যে ভালবাসা পরিষদ খোলা...যার সদস্য সংখ্যা কখনও ২ জন থেকে বৃদ্ধি পায়নি।মুজিব ভাইয়ের অবস্থাও খুব ভালনা।উনিও আছেন স্থান পরিবর্তনের হুমকিতে।আর ব্যাবসা না চলার অন্যতম একটা কারণ তার আলসেমি...যাহোক আর সবার মতো আমারও চাওয়া মুজিব ভাইয়ের একটা স্থায়ী জায়গা হোক।
লিটন ভাইঃ আমার খুব ভাললাগা একজন মানুষ।কেন ভাল লাগতো জানিনা...দিন নাই রাত্রী নাই তার দোকানে বসে থাকতাম।সাব্বির মামা আমাকে খেপাতো...এটা নিয়ে।খুব টেনশনে ছিলাম লিটন ভাই আছেনতো...?।হ্যা...লিটন ভাই আছেন।আছে উনার বিখ্যাত বাংলা বার্গারও।পাঊরুটির মাঝখান দিয়ে কেটে তার মাঝে দিয়ে দিতেন আস্ত একটা ডিম ভাজি...তার উপরে থাকতো হাল্কা করে কাঁচা পেঁয়াজ আর মরিচ কুচি ভাজা...।এটা ছিলো লিটন ভাইয়ের প্রতিভার লেট নাইট শো।রাত দশটার পরে শুরু হতো পরোটা ভাজা...কখনও রাত একটা বা তারও বেশি...।গরমে লিটন ভাইয়ের নানান ধরণের ফলের শরবত...দাম কতো ?...সর্ব্বোচ্চ পাঁচ টাকা।এখন যখন শরবত নামক ঈষৎ মিষ্টি পানি খাই তারও দ্বীগুন দামে তখন মনে হয় লিটন ভাই আপনি কি করে তিন প্রকারের ফলের শরবত দিয়ে পাঁচ টাকা রাখতেন?।ছিলো লিটন ভাইয়ের শীতের রাতে খেজুরের রস...যা আমি আমার নানী বাড়ী যেয়েও পাইনি।খেজুরের রসের খবর দিতেন এভাবে..."ভাই...চইল্লে আইসেন কিন্তু...দেরি করলে রাখতে পারবো না...পরে রাগ করতে পারবেন্না"।লিটন ভাই, ভিষন একা আমি আপনার এই ডাক টা শুনতে চাই...।
পেয়ারা চাচাঃ উনার নাম জানতাম না।এবার যেয়ে আমড়া,মুড়ি মাখা খেলেও উনার নামটা শোনা হয়ে উঠেনি।আসলে উনার কথাটা বলা প্রিয় বন্ধু সেতুর জন্যে।সেতুর আইটেম চাচাই রাখতেন।পায়রার ডিম সাইজের আমড়া দেখিয়ে যদি জিজ্ঞেস করতাম চাচা দাম কতো?...চাচা পান চিবাতে চিবাতে বলতেন পাঁচ টাকা।আমরা মজা করে বলতাম চাচা আপনার আমড়া খেয়ে কি কখনও হিরা পাবার সম্ভবনা আছে নাকি?।চাচা আছেন আগের মতোই...এবং তার জিনিসপত্রের দাম আগের মতোই বিরক্তি ধরা আকাশ ছোয়া টাইপের।
আলেক চাচাঃ কেমন চলছে চাচা আপনার ব্যবসা?...জিজ্ঞেস করতেই চাচা বল্লেন..."দুঃখির কতা কি কবো...আপনেরা যাবার পরে আর ব্যবসা নাই।পোলাপান এখন সালুনি চা খায়...আর রাত আটটা বাজলে সব অন্ধকার"।ছাত্ররা যেন বিশৃংক্ষলা না করে তাই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ছাত্র হলের গল্লামারী সাইডের ফটক।ফল এখন আর ছাত্ররা মুল্লুক ঘুরে ওপাশে যেতে চায়না।চাচাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনার সেই লেবুর শরবত বানান না?চাচা বললেন কেউ চায় ই না...বানাবো কি?।বাংলাদেশের সব জায়গায় চিনির দাম আকাশ ছোয়া হলেও আলেক চাচার শরবত বানানো দেখলে অবাক হতে হবে...এত চিনি আর লেবু দিয়ে বানান শরবত এর দাম তিন টাকা কিভাবে হয়?আমরা প্রশ্ন করলে চাচা তার মিষ্টি হাসিটাই শুধু দিতেন।উন্ন্যয়নের বাতাসের ঝাপটা চাচার ব্যবসাকে অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে।
পানি চাচাঃ আমরা শুধু জানতাম উনি হেমায়েত ভাইয়ের আব্বা।নাম জানতাম না।খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি হলে থাকা ছাত্র-ছাত্রীরা যার কল্যানে কষ্ট না করে রুমের পাশের কলসিতে পানি পায়।প্রচন্ড গরম,কি অঝর বৃষ্টি...অথবা কনকনে ঠান্ডা চাচা পৌছে যান পানি নিয়ে।হোক সে যত উচু ভবনই...।চাচার লাগেনা গরম...লাগেনা ঠান্ডা কিংবা ক্লান্তি।ঘুম থেকে উঠেই দেখতাম ঝকঝকা কলসিতে পরিস্কার ঠান্ডা পানি।বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শুরুতে উনার বড় হোটেল ছিলো যা তৎকালিন বড় ভাইয়া এবং আপুদের রসনা মেটাতো...।কেনো হোটেল মালিক চাচা এখন এই বয়সে পানি টানেন তা বলে নিজেদের ছোট করতে চাইনা।অসম্ভব বিনয়ী চাচা কে শুধু জিজ্ঞেশ করলেই বলতেন তার কষ্টের কথা।এবারো চাচাকে দেখলাম তার ঠেলা গাড়িতে করে পানি দিচ্ছেন...বয়স হচ্ছে কিন্তু মনের জোরে উনি আমাদের থেকেও ইয়ং।
গোলক দাঃ এখনকার ছাত্র-ছাত্রীরা গোলক দা কে চিনবে না।কিন্তু গোলক দা আমাদের কাছের একজন মানুষ।নিরালা কাঁচা বাজারে একটা হোটেলে সব সময় ভীড় থাকতো...ছাত্র-ছাত্রীরা যে হোটেল ছাড়া বুঝতো না কিছুই...তা হলো গোলক দার হোটেল।গোলকের মতো গোলগাল গোলক দা কে দেখে আমি অবাক হতাম...রাত তিনটায় গেলেও পাবেন...কিংবা দুপুরে।দাদাকে এক হাজার বার ডাক দাও...উত্তর নিবেনই।আমরা আমাদের খাওয়ার অনিয়ম নির্দ্বিধায় চালায় যেতে পারতাম...কারণ ভরসা নামক ব্যক্তি আর কেউ নয় আমাদের গোলক দা।নিরালা কাঁচা বাজার উঠে গেলেও গোলক দা ছিলেন।এর কিছুদিন পরে স্থায়ী ভাবে তার হোটেল উঠে গেলো...আমাদের অনেকের প্রিয় গোলক দা বিপন্নপ্রায় প্রানীর মতো হারিয়ে গেলেন।শুনেছি গোলক দা এখন বর্তমান পাইকারী কাঁচা বাজারের কোন এক হোটেলে আছেন।ইচ্ছা আছে একবার যেয়ে খেয়ে আসব গোলক দার ওখানে...দেখে আসবো গোলক দা কে।
ফারুক ভাইঃ নিরালার মোড়ে একজন আছেন যিনি কথা না বলে হাজার হাজার কাপ বানাতে থাকেন।হাজার কাপ চা বানান বলে কি উনার চা যাচ্ছেতাই?...একদম না।ঝকঝকা কাপে মাথা নষ্ট করা চা।নিরালার মোড়ে যেয়ে ফারুক ভাইয়ের চা খাবেনা এমন ব্যাক্তি খুজে পাওয়া কঠিন।উনার পরিবেশনা বলে দেয় চা বানানো একটা শিল্প।বয়স হয়েছে ফারুক ভাইয়ের...থুতনিতে উকি দিচ্ছে দাড়ী...কিন্তূ তার চা?...একটা চুমুক দিয়ে হারিয়ে গেছিলাম ২০০৩-০৪ সালের বিশ্ববিদ্যালয় জিবনের প্রথম দিকে।
হারুন ভাইঃ ফারুক ভাইয়ের ই আরেক ভাই হারুন ভাই।ডাক দিলে যিনি বলতেন..."শুনতেছি বলেন..."।এবার যেয়ে হারুন ভাইকে দেখে এসেছি...।বেশি রাত বলে বল্লেন..."এটা কোন সময় আইলেন...এখন চা দিতে পারবোনা..."।না এটা ছিলো তার আভিমানের কথা...।পরে নানা কারনে আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। অসম্ভব ভাল লাগা মানুষ গুলোর মধ্যে একজন আমাদের হারুন ভাই।
যাদের চোখ এরিয়ে প্রবেশ করতে পারেনা কেউঃ ছয় ফুট লম্বা মাছিদুল মামাকে দেখে সবসময়ই মনে হয় উনি বাংলাদেশের যেকোন বাহিনীর একজন চৌকস অফিসার হলে মন্দ হতো না।বিশেষ করে উনি যখন কালো পোষাক পরতেন।এমন অনেক প্রহরী যারা আমাদের নিরাপত্তায় ছিলেন সদা সজাগ।আমাদের সবার প্রিয় গার্ড নানার চোখ এড়িয়ে একটা ফকিরও ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারত না।মজার মজার সব কাহিনী বলাতে উনার জুড়ি মেলা দায়।এতদিন বাদে ক্যাম্পাসে গেছি...এক পলক দেখেই আর এগুলেন না...মিষ্টি হাসি দিয়ে বললেন "মামা...ভাল আছেন?"।নাম না জানা আরও অনেক প্রহরী মামারা সামান্য বেতনে নিষ্ঠার সাথে দ্বায়ীত্ব পালন করে গেছেন।আমার অবাক লাগে তাদের স্মৃতি শক্তি দেখে...হাজার হাজার মানুষের মধ্যে ঠিক ঠিক বলে দিবেন কে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী।তারা জানেন না আমরা তাদেরও এক পলক দেখতে যাই।তারাও যে আমাদেরই অস্তিত্বের অংশ।
আরও আছেন শাহিন ভাই,সিদ্দিক ভাই,খোকন ভাই,সাগর ভাই,রোকন ভাই,লতা ভাই,দেলোয়ার মামা...যারা তাদের জাদুর হাত দিয়ে কখনও চা বা সুস্বাদু খাবার বানিয়ে খাওয়াতেন...অথবা কেঊ ফ্লেক্সি বা ফটোকপি করে আমাদের সাহায্য করেছেন।আমরা বিশ্ববিদ্যালয় জিবন শেষ করে কেউ প্রতিষ্ঠিত হয়েছি বা প্রতিষ্ঠিত হবার প্রান্তে।যেই মানুষ গুলো সামান্য অর্থের বিনিময়ে আমাদের বিপুল সাহায্য করেছেন তাদের যেন ভুলে না যাই।এদের কেঊ মুখ ফুটে বলবেনা তাদের দুঃখের কথা অথবা অভাব অনটনের কথা তাই তাদের প্রতি সাহায্যের হাত যেন থেমে না যায়।তারা আমাদের জিবনেরই একটা অংশ।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




