somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি নীল মেঘের দেশের গল্প

১৪ ই আগস্ট, ২০১৪ রাত ১০:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


হাঁটতে-হাঁটতে হাঁটতে-হাঁটতে
একসময় যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানে পৌঁছুতে পারি
পথ তো একটা নয়,
তবু, সবগুলোই ঘুরে ফিরে ঘুরে ফিরে শুরু আর শেষের কাছে বাঁধা
নদীর দু – প্রান্তের মূল
একপ্রান্তে জনপদ অন্যপ্রান্ত জনশূণ্য
দুদিকেই কূল, দুদিকেই এপার-ওপার, আসা-যাওয়া, টানাপোড়েন!
খুব পরিচিত আর প্রিয় কবিতাটা অচেনা কারো ওয়ালে দেখে চোখ আটকে গেলো! এই কবিতাটা আমি সচরাচর পরিচিত মানুষজনদের ওয়ালে দেখি না,খুঁজে দেখলাম শৈলী নামে কেউ একজন কবিতাটা পোষ্ট করেছে। খানিকক্ষন টাইম লাইনে ঘুরে আসলাম,এই এক কবিতা ছাড়া আর কিছু দেখলাম না,সে আসলে কবিতা পড়ার মানুষ কি না তাও বুঝলাম না।
প্যাড থেকে চোখ তুলে একবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম,চমৎকার একটা আবহাওয়া চারপাশে,আকাশে চাঁদটা এখনো পরিপূর্ণ জোছনা হয়ে উঠেনি,দু’একদিনের মধ্যেই হবে। আচ্ছা,সব সুন্দর জায়গায় যাত্রাকালেই কি আবহাওয়া খুব সুন্দর থাকে? গল্পে-উপন্যাসে,মুভি-নাটকে সব সময়ই দেখা যায়,খুব চমৎকার একটা জায়গায় হয়তো যাওয়া হচ্ছে,তখন চারপাশের আবহাওয়াটাও অনেক সুন্দর থাকে!ইটস জাস্ট কো-ইন্সিডেন্স?
আপন মনেই হাসলাম! বাইরে থেকে চোখ সরিয়ে পাশের সীটে ফেরালাম। সহযাত্রীর ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে পড়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখার ইচ্ছে নেই বলে আবার চোখ সরিয়ে নিলাম। যেভাবে ঘুমে একদিকে কাঁত হয়ে আছে,যেকোন মূহুর্তে বাস ব্রেক কষলে কিছু একটা হবেই,আই থিংক আমার উচিত তাকে সতর্ক করা!উসখুঁস করতে করতে আবার তাকালাম,কিন্তু কিছু বলতে পারলাম না।
প্যাডটা ব্যাগে রেখে পুরনো ডায়রীটা বের করলাম। ভেতরের পাতায় খুব যত্ন করে অনেক পুরনো একটা চিঠি পিনাপ করে রেখেছি,বের করে সেটা পড়া শুরু করলাম। এই চিঠি টা যে আমি কতো হাজার বার পড়লাম,তার হিসেব নেই,প্রায় ৫বছরের বেশি সময় ধরে চিঠিটা আমার সাথেই আছে,নীল জলছ্বাপের পাতায় সবুজ কালিতে লেখা চিঠিটার প্রতিটা লাইন,শব্দই আমার মুখস্থ,এমনকি শব্দের সাথে জড়িয়ে থাকা লেখকের আবেগ গুলোও! কি যত্ন করেই না চিঠি টা লিখেছিলো আমাকে,তরু’পা…
তরু’পা কে চিনতাম ছোট বেলা থেকেই,তবে জানা শুরু হয়েছিলো কলেজ দিন গুলোতে। প্রায় দুপুরেই ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরে কোচিং এর জন্য বের হবার কালে দেখতাম,বারান্দায় বসে একমনে চিঠি পড়ছেন। কৌতুহল জাগতো খুব!রোজ অমন করে কার চিঠি পড়েন তিনি?আজকাল কে এমন আছে,যে রোজ চিঠি লিখতে পারে কাউকে!
ইয়ার ফাইনাল শেষ করে,এক বিকেলে খুব করে ধরেছিলাম,জানলাম চিঠি গুলো জামান ভাই মানে তরু’পার জামাই পাঠায় সুদুর সিয়েরালিওন থেকে। গল্প করতে করতে এক পর্যায়ে তরু’পা বলল,
-তুই ভাবছিস,খুব দীর্ঘ চিঠি লিখে সে?মোটেও নারে!আমার ৪/৬পাতা চিঠির জবাবে খুব বড়জোর দেড় পাতার একটা চিঠি আসে।
-আর তুমি সেটাই পড়ো দেড় সপ্তাহ লাগিয়ে?!
জবাব না দিয়ে হেসেছিলো তরু’পা। কি সুন্দর সে হাসি!আজো চোখ বন্ধ করলে দিব্যি দেখতে পাই।
চিঠি ইস্যুতেই রোজ বিকেলে জমে উঠতো আমাদের গল্প। কফির মগে চুমুক দিতে দিতে আমি অবাক হয়ে যেতাম,তরু’পা বলতে গেলে জামান ভাইয়ের সমস্ত চিঠিই মুখস্থ করে রেখেছেন,গল্প কথার সময় হুবহু তা বলতে পারতেন! কি আবেগরে বাবা! মাথায়ই ঢুকতো না,কেমনে পারে এতো আবেগি হতে,যেখানে কি না দু’জনের মাঝে হাজার হাজার মাইলের ব্যাবধান! আর জামান ভাই তো বিয়ের মাস তিনেকের মাথায় মিশনে চলে গেছেন,সেখানে এই মানুষটাকে এতো অল্প সময়ের মাঝে এমন পাগলের মতো ভালো কি করে বাসল তরু’পা?! আমার তখন চিন্তা করতে গেলে মাথা হ্যাং হয়ে যেতো,আর এখন ভাবতে গেলে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে!
প্রায় সময় রাত ১২টা, ১টার দিকে ঘুমে ভারি হয়ে আসা চোখের পাতা মেলে আমি যখন ম্যাথ করায় ব্যস্ত থাকতাম,চোখ তুলে বারান্দায় তাকালেই দেখতাম,এক হাতে মোবাইল নিয়ে উদাস নয়নে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে তরু’পা। ধীরে ধীরে এক সময় আশে-পাশের সব বাতি নিভে যেতো,শুধু তরু’পা জেগে থাকতো মোবাইলের বাতি টা জ্বলে উঠার অপেক্ষায়! কখনো সে অপেক্ষার অবসান ঘটতো আর বেশিরভাগ সময়ই রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে যেতো।

হর্নের শব্দে আমার ভাবনায় ছেদ পড়ল। মাথা তুলে আসে-পাশে একবার তাকালাম,সব ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে! বার কয়েক হাই তুলে ডায়রীটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলাম। পাশের জন এখনো সেই অবস্থায় ই ঘুমাচ্ছে!এই দৃশ্য দেখলে যে কেউ ই বুঝবে,পৃথিবীতে ‘বালিশ’ নামক বস্তুটা আল্লাহ কতটা রহমত স্বরুপ দিয়েছিলেন!
অফিসে আমার এক কলিগ আছে,জয়।বেশ সাংস্কৃতি মনা মানুষ, জীবনে শিল্পী হবার আশা থাকলেও বাস্তবতা তাকে বানিয়েছে ব্যাংকার,আর তাই সে এখন গুণ গুণ করতে করতে ক্লাইন্টদের অভার ডিউ হিসেব করে। আমার এই ট্যুর এর কথা শুনে সে খুব আফসোসের সুরে বলছিলো,
-ম্যাডাম,আপনার যাওয়া উচিত,পিরামিড দেখতে অথবা এর থেকে বেশি হইলে বিল-গেটসের বাড়ি!তা না যেয়ে আপনি যাচ্ছেন এমন জায়গায়,যেখানকার আসল স্বাদটা ই উপলব্ধি করতে পারবেন কি না সন্দেহ!
পাশ থেকে আরেক সুপ্ত কবি নিয়াজ ভাই বলে উঠল,
- আরে জয়,নিতু কি সেখানে আসলে বেড়াতে যাচ্ছে মনে হয়?আর যদি যায়ও দেখবা আল্টিম্যাটলি ব্যাংকেরই লাভ!এত্ত গুলো ক্লায়েন্ট নিয়ে আসবে,এবং ঐ জায়গায় প্রফিটেবল ইনভেষ্ট করার মতো কোন প্রজেক্ট আইডিয়া নিয়ে আসবে মাস্ট!
মুচকি হেসে মাথা দুলিয়ে বলেছিলাম,
-রাইট,হান্ড্রেড পার্সেন্ট রাইট!
কাজ কাজ করা মানুষদের সম্পর্কে সবারই এমন ধারনা থাকে,আর আমার কাছে এটাই প্রশান্তি! আমি তো জীবনে এমন কিছু সময়,আর নিজের সম্পর্কে এমন কিছু ধারনাই চেয়েছিলাম।
গাড়ির এসি টা অফ করে,জানালা খুলে দিতে ইচ্ছে করছে। বাইরে এতো সুন্দর বাতাস বইছে,আর সেখানে এই দম বন্ধ পরিবেশ বেড়ানোর মুডে ক্লান্তি বাড়াচ্ছে! পাশের মানুষটা কে এবার ডাকতেই হবে! আমার ডাক শুনে ঢুলু ঢুলু অবস্থায় ঘাড় ম্যাসাজ করতে করতে উঠে ড্রাইভার কে বলে এসি টা অফ করে এসে সীটে বসে বলল,
- টিকেট কাটার সময়,ম্যানেজার ব্যাটা কে এত্ত করে জিজ্ঞেস করলাম,যে ভাই আপনাদের বাসের সীটের অবস্থা কেমন?আরামে ঘুমানো যাবে তো?ব্যাটা কি সুন্দর দাঁত কেলিয়ে বলল,আরে ভাই,সীটে মাথা রাখলে মনে নিজের বিছানায় বালিশে মাথা রাখছেন!ব্যাটা মিথ্যুক,এমন জঘন্য সীটকে বালিশের সাথে তুলনা করছে!চিন্তা করছো?
আমি আইপ্যাডের দিকে চোখ রেখে বললাম,
- তোমার অবস্থা দেখে একটা গল্পের কথা মনে পড়ে গেলো! শুনবা?
-হুম,শোনাও!ঘুমের ভাবটা কাটুক,আর খাওয়ার কি আছে একটু দাও!
হায়রে খাওয়া! এমন ফালতু ঘুম দেয়ার পর মানুষের মাথা যন্ত্রণা করে,তার পানিটা খাওয়ারও ইচ্ছে থাকে না,আর এই মানুষের ক্ষুধাই লেগে গেছে!
খাওয়া হাতে ধরিয়ে দিয়ে আমি খুব সংক্ষেপে বললাম,
-এক বার এক ব্যাবসায়ী বিয়ের পর বউ নিয়ে সমুদ্র দেখতে গেছে,ধরো কক্সবাজার। ভদ্রলোক ব্যাবসায়ী হলেও,মনে মনে বেশ প্রকৃতি প্রেমিক ছিলেন, তখন ওখানে যাওয়া-থাকার ব্যাবস্থা এতো উন্নত ছিলো না,তারা খুব্বই কষ্ট করে খানিকটা বাসে তারপর পায়ে হেঁটে সমুদ্র দেখতে গেলেন,এবং থাকলেনও খুব কষ্টকর ভাবে। ফিরে এসে ভদ্রলোক কঠিন নিয়্যাত করলেন,এবং তিনি পরের ৫বছর তার বিজনেসে যা ইনকাম হলো টা দিয়ে ঐ সমুদ্র পাড়ে খুব সুন্দর একটা কটেজ তৈরী করলেন,এবং একটা বাস সার্ভিসও চালু করলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন,নিজের কষ্টটা উপলব্ধি করতে পারলে অন্যের কষ্ট লাঘব করা সম্ভব,আর তাই তিনি সমুদ্র দেখতে যেয়ে আর কেউ যেনো তার মতো কষ্ট না করে সেই ব্যাবস্থা করেছিলেন। দিস ওয়াজ স্টোরি,বুঝলা?
গল্প শুনে হাই তুলতে তুলতে বলল,
-ফিলিং ভাগ্যবান! তুমি এইজন্যই আসলে এতো কম সময়ে কাজে উন্নতি করতে পারছো,কি দারুন ভাবে তুমি এক ঢিলে এত্তো গুলা পাখি মেরে ফেললা! বিজনেস আইডিয়া,হিউমেন সার্ভিস,আবার সেলফ ড্রিমস!বাহ!!
আমি কি-প্যাডে আঙ্গুল চালাতে চালাতে বললাম,
-থ্যাংকস!এবার তুমি খাওয়া শেষ করে আবার ঘুমাতে পারো,তবে খেয়াল রেখো,যেনো গাড়ি হার্ডব্রেক কষলে ঘাড় ভেঙ্গে না যায়,যেখানে যাচ্ছি সেখানে ঘাড় ম্যাসাজ করতে থাকা লোকজন এর সাথে থাকার ইচ্ছে নাই আমার!
হুম হুম করতে করতে সে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো,আর আমি আমার কাজে।

‘নীলমেঘের দেশ’এর গল্পটা আমি প্রথম শুনেছিলাম তরু’পার মুখে। জন্ম থেকে শহরের গন্ডিতে বড় হওয়া আমার জানার জগতে ‘নীলমেঘ ছুঁয়ে দেখার’আনন্দ কি জিনিস টা বুঝার ক্ষমতা ছিলোই না বলা যায়। বড় জোর মাঝে-সাঝে সবুজ ঘাসের উপর খালি পায়ে হাঁটতে শিখেছিলাম। আমি যতবার এই ‘নীলমেঘের দেশ’এর গল্প শুনতাম ততোবারই মনে হতো,জীবনে বোধহয় তরু’পার আর কোন ইচ্ছেই শুধুমাত্র জামান ভাইয়ের হাত ধরে নীলমেঘের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া। তরু’পা তার প্রতিটা চিঠিতেও এই নীলমেঘের দেশের বেড়াতে যাবার প্ল্যান লিখতেন,চিঠি শুরু হতো সেই প্ল্যান দিয়ে আর শেষ হতো সেই প্ল্যান বাস্তবায়নের অপেক্ষা দিয়ে,এতোটা মন থেকে কেউ প্রিয়জনের সাথে কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে পুষতে পারে দিনের পর দিন,এটা আমার ধারনার বাইরে। একবার ঠাট্টাচ্ছলে বলেছিলাম,
-তুমি যেভাবে নীলমেঘ দেখতে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল,বেচারা জামান ভাই তো মনে হয় ওখান থেকে পারলে উড়েই চলে আসে!
তরু’পা তখন মলিন হাসি হেসে বলেছিলো,
-ইশ!যদি সত্যিই মানুষটা উড়ে আসতো!
সেই প্রথম,সেই দিনই প্রথম আমি তরু’পার চোখে অভিমানের মেঘ দেখেছিলাম। দূরে থাকা মানুষটার জন্য কেবল ভালোবাসাই নয়,অভিমানের শক্ত পাহাড়ও তৈরী হয়,কখনো ভালোবাসার বৃষ্টি সেই পাহাড় কে গুঁড়িয়ে দিতে পারে,আর কখনো পারে না।
দিন গেছে,মাস গেছে কতো-শত দিন গেছে,আমি শুধু নীরবে দেখে যেতাম তরু’পার অপেক্ষার দিন গুলো কতোটা অসহনীয় ভাবে কাটতো,কতোটা মলিন ছিলো সেই সময় গুলো। একটা সময় অবাক হতাম,অভিমানের সাথে যুদ্ধ করে কিভাবে মানুষ?এই যুদ্ধে কি ভালোবাসা জিততে পারে? তরু’পা কে দেখে বুঝেছিলাম,কঠিন সেই যুদ্ধ করাটা কতোটা কঠিন ছিলো।

শুভ্র খুব ভয়ে ভয়েই বেড়াতে যাবার প্রস্তাবটা আমাকে দিয়েছিলো। ওর ঠিক ধারনা নয়,বিশ্বাসই ছিলো যে আমি এক ঝাটকায় না করে দিবো!যেটা সচরাচর করি। কিন্তু আমি বেশ নির্বিকার ভঙ্গিতেই বললাম,
-কোথায় যাওয়ার প্ল্যান করেছো?
-তা এখনো ঠিক করিনি! তবে যেখানেই যাই,গুণে গুণে ৪দিন,যেতে-আসতে ২দিন আর থাকবো ২দিন,ব্যাস! ৪টা দিনের জন্য কি একটু কষ্ট করে ছুটি ম্যানেজ করা যাবে না?
আমি খাবারের প্লেট গুলো ধুয়ে রেখে এসে বললাম,
- ৪দিন না,আমরা যাবো ৭দিনের জন্য।
শুভ্র অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল!
-সাআআআত দিন!!বলো কি? দীর্ঘ ৪বছরে যেখানে ৪দিন আমরা কখনো ছুটি কাটাতে কোথাও যাইনি,সেখানে ৭দিনের জন্য যাবো??কেমনে কি হইলো? তোমার অফিসিয়াল কোন কাজ আছে নাকি ঢাকার বাইরে?
আমি কিছু বললাম না সাথে সাথে। যে মানুষ ছুটি কাটাইনি,তার হিসেব রাখে অথচ কেন কাটায়নি তার খবরের আগা-মাথাও জানে না,তাকে আর কি ব্যাখ্যা করবো! খানিক সময় পর বললাম,
-আমরা কোথায় যাচ্ছি বললে না তো?
-এখনো ঠিক করিনি,আমি তো ভেবেছি তুমি না বলবে!দু’দিন সময় দাও,আমি জায়গা ঠিক করে ফেলবো।
-ওকে। তবে আমি একটা জায়গা সাজেস্ট করতে পারি,বান্দরবান।
শুভ্র খানিকটা কিউরিয়াস টোনে জিজ্ঞেস করলো,
-বান্দরবান?তুমি আগে গিয়েছিলে কখনো?
-নাহ,তবে এখন গেলে যেতে পারি,’নীলমেঘের দেশে’।
শুভ্র আমার মুখের দিকে অনেকক্ষন তাকিয়ে থেকে বলল,
-’নীলমেঘের দেশ’! তুমি যে কখনো নীলমেঘ ছুঁতে পছন্দ করো জানতাম না!
তারপর খুব হালকা ভাবেই বলল,”ওকে,এটাই ফাইনাল থাকল। ইনশাআল্লাহ,ওখানেই যাচ্ছি আমরা।
আমি খানিকটা আপন মনেই হাসলাম! শুভ্র যদি ভুলেও কোনদিন আমার পারসোনাল ফ্লোডার বা কাবার্ডে লুকিয়ে রাখা এলবামটা দেখতো,তাহলে হয়তো আর এই কথা বলতো না। সে জানেও না,তার দেখা এই অফিস-বাসা,ব্যস্ত মানুষটা একটা সময় কতোটা দূরন্ত আর স্বপ্নবিলাসী ছিলো! এই শহরের অলি-গলি থেকে শুরু করে অখ্যাত,ভাঙ্গাচূড়া টং এর দোকানটা পর্যন্ত তার নখদপর্ণে ছিলো,মেয়ে বলে কোথাও বসলে লোকে কি ভাববে টা কোনদিন কেয়ার না করেই বর্ষা ছুঁতে ঘুরে বেড়ানো,শহর ছাড়িয়েও বহুদূর পর্যন্ত পূর্ণিমায় একলা সন্ধ্যায় হেঁটে বেড়ানো সেই মানুষটা কে তো শুভ্র কোনদিন জানেই নি!
পূর্ণিমার কথা মনে হতেই হঠাত বললাম,
-ঠিক আছে,তবে একটু খেয়াল করো,আমরা যখন যাচ্ছি সেই সময়টা যেনো পূর্ণিমার শেষ ৭/৮দিন হয়।কারণ,পূর্ণিমা ছাড়া ওখানে যেয়ে অতো আনন্দ নেই।
শুভ্র আবারো অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। আমি তখন ছোট্ট করে মুখে থ্যাংকস বললেও,ভেতরে তখন আমার ঝড়ের পূর্বাভাস শুরু করে গিয়েছিল!
‘নীলমেঘের দেশ’! পূর্ণিমা রাতে পাহাড়ের চূড়োয় দাঁড়িয়ে মেঘ ছুঁয়ে কবিতা পড়া! এই বাক্যগুলো তো আমি আর কোনদিন আমার চিন্তায় আনবো না বলেই পণ করেছিলাম!তীব্র স্রোতের ধাক্কায় আমি সেই কবেই ভাসিয়ে দিয়েছিলাম সব তা তো ভুলেই গিয়েছি!
নাহ,এই পণ শুধু তরু’পার জন্যেই করিনি,আসলে তখন এই পণ না করলে হয়তো আমার সময় গুলোও আটকে যেতো বহু আগে! এই পণের জালে নিজেকে না বাঁধলে হয়তো আজ আর আমি এই বর্তমান খুঁজে পেতাম না। যেখানে আমার আছে,আমাদের আছে কিন্তু কেবল ‘আমি’ই নেই!
আফসোস নেই আমার এ নিয়ে,আমি এমনটা ই চেয়েছিলাম। এমন একটা ব্যস্ত সময়,আর কিছু হালকা অনুভূতি,যা কখনো নাড়া দিবে না,জাগাবেও না। পেয়েছিও বলবো,এবং আমি এতেই খুশি তবে মাঝে মাঝে শুভ্র যখন দীর্ঘশ্বাস ফেলে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে,তখন কি যেনো ‘নেই’ মনে হয়! পেছন ফিরে তাকাতে ইচ্ছে হয় খুব কিন্তু তবুও আমি অনড়। মানুষ সব সময় নিজেকে মানুষ ভেবে সুখ পায় না,সুখ খুঁজে না,আর আমি যখন বুঝতে পেরেছি এটা,তখন থেকেই সুখের সংগা নিজের জন্য বদলে নিয়েছি। উপায়হীন সেই আমার জন্য তখন আর এখনো এটাই শ্রেয় ছিলো,আছে।

আর তাই,ল্যাগেজ গুছাতে গুছাতে ও আমি দ্বিধায় ভুগছিলাম,যে আমার আসলে বান্দরবান যাওয়া ঠিক হচ্ছে কি না! ফিরে এসে কি সব কিছু আগের মতো থাকবে? ডায়রীটা ব্যাগে ঢুকিয়ে নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতেই পথে বেড়িয়েছি। আজ অনেক বছর,সহস্র দিন পর আরেকবার মানুষ হয়ে সুখ খুঁজতে বের হচ্ছি! নিজেকে নিজের আয়নায় দেখার চেষ্টা করতে যাচ্ছি,সেই অনেক দিনের পুরনো আর কাংখিত নীলমেঘের দেশে।
গাড়ির ঝাঁকুনিতে চিন্তার জাল ছিঁড়ে বাস্তবে ফিরলাম। পাশে তাকিয়ে দেখি,আবারো আগের মতোই ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে পড়ে যাবার অবস্থায় আছে শুভ্র! ডেকে বললাম,
-তুমি চাইলে ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে ডান দিকে না যেয়ে বাম দিকে পড়ে যেতে পারো,তাতে অন্তত আর যাই হোক,ঘাড় ভাঙ্গার আশংকা থাকবে না!
হাই তুলতে তুলতে বলল,
-আর তুমিও চাইলে আইপ্যাডটা ব্যাগে রেখে গল্প করতে করতে আমার ঘুম তাড়াতে পারো!
আমি বিড়বিড় করে বললাম,
-এ কাজে আমি অভ্যস্ত নই!
শুভ্র শুনতে পায়নি,আর তাই উত্তরের অপেক্ষায় সে আবারো ঘুমিয়ে পড়লো! আমি আরো কিছুক্ষন বাইরে তাকিয়ে থেকে আবারো ডায়রি বের করে সেই চিঠিটা মেলে ধরলাম, যেখানে ক’টা লাইন ছিলো,
”আজকাল সবাই বলে,প্ল্যান ক্রাশে দেশে ফেরার পথে তোর জামান ভাই মারা গেছে!কিন্তু তুই কি জানিস,সেই মানুষটা আমার কাছে ফিরে এসেছে সবার অলোক্ষ্যে! আমি জানি,তুই সেটা জানিস। এবং এটাও জানিস,আমার নীলমেঘের দেশে ঐ মানুষটার সাথে এখনো রোজ যাওয়া হয়। আমার কেমন লাগে তুই বুঝতে পারিস নিতু?
জীবন টা কেমন তুই জানিস? নাহ,জানিস না আর তাই তোকে বলছি,নীলমেঘদের গল্পটা ভুলে যা,একেবারেই মুছে ফেল মন থেকে! তুই যদি কখনো শখের বাগান তৈরী করিস,তবে ভুলেও সেখানে নিজের প্রিয় বেলি ফুলের গাছ রাখবি না,কখনো যদি বিশাল খাঁচায় পাখি পুষার সুযোগ পাস,হাজার পাখি রাখলেও ময়না রাখবি না!কখনো যদি নিজের জন্য একটা ছোট্ট ফ্ল্যাট কেনার সুযোগ পাশ,অবশ্যই সেখানে কোন দক্ষিণ-পশ্চিম মুখো খোলা বারান্দা রাখবি না!
নিতু,সুখ ছুঁতে চাসনে কখনো,কখনোই না। কেবল ধরে নিস,কখনো না কখনো টা আসবেই,তবে কিভাবে জানতে চাসনে। আমি তোর মাঝে আমার প্রতিচ্ছবি দেখার ভয় করি!আর তাই বলছি,আজ না হলেও কাল তোকে ভুলে যেতেই হবে,কখনো কোথাও হাত বাড়ালেই মেঘ ছুঁয়ে দেখা যায়,চাইলে জোছনা ছুঁয়ে নিঃশ্বাস নেয়া যায়,দু’হাত মেলে নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। …… ”
তরু’পা ঠিকই বুঝেছিলো,আজ না হলেও কাল আমাকে ভুলে যেতেই হবে,কিন্তু ঘুরতে ঘুরতে যদি সেই ভুলে যাওয়া গল্পটাই সুখ হয়ে ধরা দিতে চায় তাহলে কি করতে হয়?! তা কি তরু’পা জানতো?
এই যে পাখির কিচির-মিচির শব্দ,চারপাশে ফুঁটে উঠা ভোর আর পাশে থাকা মানুষটা,যে অনেক দূরে থাকলেও হাত বাড়ালেই তাকে ছোঁয়া যায় এই সব কিছুই যদি সেই না চাওয়া সুখের গল্প হয়,তাহলে কি নীলমেঘ ছুঁতে চাওয়া যায় না? তরু’পা নিজেও হয়তো সে উত্তর জানে না,তবে আমার জানার বড্ড ইচ্ছে। আমার শুভ্র কে জানানোর ইচ্ছে,ভোরের শুদ্ধ সময়ে আর শেষ বিকেলের নীলপটে কি করে মেঘ ছুঁতে হয়,জোছনা রাতে মেঘের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে কি করে কবিতা পড়তে হয়,কি করে সুর সুরে বলে দেয়া যায়,জোছনা রাতে কান্নার জল ছুঁয়ে সেই ভুলে ভরা গল্প গুলো…

কবিতাঃ মনে মনে বহুদূর চলে গেছি-শক্তি চট্টোপাধ্যায়।
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×