'অর্জুন,আমি একটুও ভাল নেই।
এই বন্দীখানায় আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।আমার বাসাটা তো বন্দীখানাই।
এখন আমি কলেজ পেরিয়ে ভার্সিটিতে পড়ি,অথচ বাবা মা এমনভাবে আমাকে চোখে চোখে রাখে যেন আমি কোন ফাঁসির আসামী।
বাবার সাথে ভার্সিটি যেতে হয়,ফিরতে হয় তাঁর সাথে।
আমার তাই কোন বন্ধু নেই।সবার কতো বন্ধু।সবাই কতো মজা করে,আড্ডা দেয়,হৈ চৈ করে বেড়াতে যায়।অথচ আমাকে চুপ করে বাবা-মার সাথে পা ফেলতে হয়।
বাইরে একা যাওয়া নিষেধ আমার।আমার ও যে একটা নিজস্ব জগত্ প্রয়োজন তা তাঁরা বুঝতেই চায়না।অথচ সারাজীবনে আমি তাদের কাছে কোন অবিশ্বাসের কাজ করিনি।তবু কেন এতো সন্দেহ আর অবিশ্বাস আমাকে ঘিরে?বলতে পারো অর্জুন?'বলতে বলতে গলা ভারী হয়ে এলো তিথির।জানালার গরাদে গাল ঠেকিয়ে নীরবে কাঁদতে লাগলো সে।
দক্ষিণের এই জানালাটা খুব প্রিয় তিথির।অবসর পেলেই এখানে এসে আকাশ দেখে তিথি।আকাশটাকে খুব আপন মনে হয় তার।সবচেয়ে আপন মনে হয় জানালার সামনে থাকা অর্জুন গাছটাকে,যে তিথির একাকী জীবনের একমাত্র সঙ্গী।তিথির যতো কথা সব অর্জুনের সাথেই।আজও অভিমানী কথাগুলো অর্জুনকে বলে হালকা হচ্ছে তিথি।
বাবা মার কাছে সন্তান আদরের,যাকে তারা স্নেহে আগলে রাখেন।কিন্তু সেটা যদি কখনো মাত্রা ছাড়িয়ে মিথ্যে সন্দেহ,ভয় আর অবিশ্বাসে পরিণত হয় তবে সে সন্তানকে যে কী অসহ্য বেদনায় নীল হতে হয় তার প্রমাণ তিথি।যখন থেকে সে বড় হয়ে উঠছে,তখন থেকেই টের পেয়েছে ওর চারদিকে সন্দেহ আর অবিশ্বাসের জাল ঘন হচ্ছে।
মাত্র কিছুদিন আগের ঘটনা।সেদিন তিথি বাবা-মার সাথে খেতে বসেছিল।হঠাত্ ওর মোবাইলে একটি মেসেজ আসার শব্দে বাবা-মার সন্দেহভরা দৃষ্টি এসে পড়লো তার উপর।তিথি দেখল ওটা ফোন কোম্পানী থেকে আসা মেসেজ।কিন্তু ওর বাবা'দেখি কার মেসেজ'বলে তার হাত থেকে ফোনটা একরকম কেড়েই নিলেন।মেসেজটি দেখে তাঁর সন্দেহ মিলেনি দেখে বাবা বিব্রত হলেন বটে,কিন্তু ততোক্ষণে তিথি কাঁদতে কাঁদতে উঠে চলে গেছে।সেদিনের পর সন্দেহের বিষ এড়াতে মোবাইল ব্যবহার ছেড়ে দিয়েছে তিথি।
রিমঝিম শব্দে কান্না থামিয়ে মুখ তুলে তিথি দেখল বৃষ্টি নেমেছে।ওদের দোতলা বাসার জানালাটা থেকে গেটের বাইরে রাস্তার পাশের বটগাছটা দেখা যায়।তিথি দেখতে পেল একটি তরুন বৃষ্টি থেকে বাঁচতে সেখানে দৌড়ে গিয়ে আশ্রয় নিল।ছেলেটার দৌড় দেখে কান্না ভুলে হেসে ফেলল তিথি।এপাশ ওপাশ তাকাতে তাকাতে ছেলেটার হঠাত্ চোখ পড়ল তিথির উপর।দেখলো তিথি হাসছে।তিথির হাসির কারণ বুঝতে পেরে তরুনের মুখটাও লজ্জ্বামাখা হাসিতে ভরে উঠল।
জীবনের পথচলায় ক্ষণিক আনন্দ।কিন্তু এটাই কাল হলো তিথির জন্য।ছেলেটার দিকে তাকিয়ে হাসছিলো সে,হঠাত্ মাথার চুলে প্রচন্ড টান অনুভব করে ঘুরে দাঁড়াল।মা দাঁড়িয়ে আছেন রক্তবর্ণ চোখে।তার এক হাত এখনো তিথির চুলে।
'জানালা খুলে তাহলে প্রতিদিন এসব করা হয়?তাই তো বলি জানালায় এতো কি!আজ ধরেছি হাতে নাতে।বল কে ওই ছেলেটা?কত দিন থেকে চলছে এসব?'তিথির কাঁধ ধরে ঝাঁকালেন মা।
'উহ মা!ব্যথা পাচ্ছি,'আর্তনাদ করল তিথি।'আমি জানি না ছেলেটা কে।আজ প্রথম দেখেছি।'
'সত্যি করে বল।'
'সত্যি আমি চিনি না।'
'ফের মিথ্যে কথা!'বলেই মা সশব্দে চড় বসালেন তিথির গালে।মাটিতে লুটিয়ে পড়ল তিথি।'না চিনলে এতো হাসাহাসি কিসের?আজ থেকে এই জানালা বন্ধ থাকবে।খবরদার খুলবি না।'
অশ্রুসজল ঝাপসা চোথে তিথি দেখলো মা দক্ষিণের জানালাটা বন্ধ করে দিলেন।তিথিকে বিচ্ছিন্ন করে দিলেন বাইরের জগত্ থেকে,একমাত্র বন্ধু অর্জুনের কাছ থেকে।
বাইরে বৃষ্টির তোড় তখন আরো বেড়েছে।সেটা সবাই দেখতে পাচ্ছে।কিন্তু এই বিশাল পৃথিবীর একটি ছোট্ট গৃহকোণে একটি মেয়ে তার দু চোখ দিয়ে যে অভিমানী বৃষ্টি ঝরাচ্ছে তা কী কেউ দেখতে পায়?দেখার কি চেষ্টা করে কেউ?
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুন, ২০১৫ দুপুর ১:৫৫