মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটা বাস্তব গল্প শোনাই। গল্পটা আমার একটা বন্ধুর যুদ্ধফেরত চাচার কাছ থেকে শোনা , এই গল্পে উনিও ছিলেন ।।
স্থানটা ময়মনসিংহের ভালুকার কাছাকাছি কোথাও। মুক্তিযোদ্ধাদের ছোট্ট একটা দলের দায়িত্ব ছিলো সেখানকার একটা ব্রিজ উড়িয়ে দেয়া। কারণ পাকিস্তানি বাহিনী বেশ বড়সড় একটা দল আর সাঁজোয়া বহর নিয়ে এগোচ্ছে ওপারে ক্যাম্প ফেলবে বলে। সবকিছু দেখেশুনে রেকি করে ব্রিজ ওড়ানোর পরিকল্পনা করে ফেললো মুক্তিযোদ্ধারা। যে রাতে পাকবাহিনী আসবে, তার বেশ খানিক আগে ব্রিজে ডিনামাইট পাতার কাজ শেষ। পাকবাহিনীর মোটামুটি বেশিরভাগ অংশটা ব্রিজে উঠলে সেটা উড়িয়ে দেয়া হবে - ক্ষয়ক্ষতি যতটা বেশি হয় আরকি।
গভীর রাতে গাড়ির শব্দ শোনা গেল। সবাই যার যার জায়গা নিয়ে তৈরি। আস্তে আস্তে পুরো বহরটা দেখা গেল। ঠিক করা হলো - প্রথম সাঁজোয়া গাড়িটা ব্রিজের মাঝখানটা পার হলেই ব্রিজটা উড়িয়ে দেয়া হবে। কিন্তু প্রথম গাড়িটা যখন ব্রিজের কাছে চলে এসেছে, তখনই লাগলো গোলমাল। হঠাৎ করেই ক্ষেতের মাঝখান থেকে এক বুড়ি উদয় হলো, রাস্তা পার হয়ে অন্যদিকে যাবার বদলে সোজা ব্রিজের উপর উঠলো। এবার সবার মাথায় হাত। গাড়িগুলিও ব্রিজের খুব কাছে চলে এসেছে; এদিকে থুড়থুড়ে বুড়ি দেখেই কিনা কে জানে, পাকবাহিনীও বুড়িকে না থামিয়ে যেতে দিচ্ছে।
এদিকে ঐপারে চাপা গলায় তর্ক শুরু হয়ে গেছে কি করা যায় তা নিয়ে। কারণ বুড়ির যে হাঁটার গতি, তাতে বোঝাই যাচ্ছে বুড়ি ব্রিজ পার হতে হতে পাকবাহিনীও পগাড় পার হয়ে যাবে। কমবয়সী একজন পরামর্শ দিলো - যেহেতু এই বহরটাকে থামাতে না পারলে মুক্তিযোদ্ধাদের বড় রকম ঝামেলায় পড়তে হবে, কাজেই বুড়ি থাকলেও কিছু করার নেই, উড়িয়ে দেয়া হোক ব্রিজ।
কিন্তু বেঁকে বসলেন কমান্ডার স্বয়ং। পাকবাহিনীকে থামানো কর্তব্য, তাই বলে নিরপরাধ এক বৃদ্ধ মানুষকে মেরে ফেলবো? সেটা হবে না। তর্ক আরো ঘোরালো হয়ে উঠলে কমান্ডার শেষমেষ হুমকি দিলেন - কেউ একাজ করার চেষ্টা করলে তিনি তাকে সোজা গুলি করবেন, এরপর যা হয় হোক। বাধ্য হয়ে অন্যরা মেনে নিলো। যাই হোক - দেখা গেল অনুমান ঠিক, বুড়ি ব্রিজ পার হয়েছে আর পাকবাহিনীও প্রায় পার হয়ে এসেছে। এখন আর খামোখা ডিনামাইট ফাটিয়ে লাভ নেই। প্রবল হতাশায় মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে সবাই।
সেই বুড়ি ব্রিজ পার হয়ে তাদের খুব কাছে চলে এসেছে। হাতে কিছু একটা আছে পুঁটলির মতো। দেখে মনে হলো কাউকে খুঁজছে। ঝটপট তাকে ঘিরে ফেলা হলো। বুড়িকে দেখে অবশ্য মনে হলোনা ভয় পেয়েছে। জিজ্ঞেস করলো-
"বাবারা তোমরা মুক্তিবাহিনীর পোলা?"
কমান্ডারের পাল্টা প্রশ্ন করলো -"ক্যান, আপনের কি দরকার?" এবার বুড়ির উত্তর দিলো - "কালকে হুনছি এইপারে মুক্তির পোলারা আহে, অনেক কষ্ট কইরা পোলাগুলি যুদ্ধ করে, খাইতে পায়না ঠিকমতো। মনে করসি ঘরে যা আসে নিয়া যাই। দিনে তো পারিনা বাবারা। রাইতে কেউ দেহে না, এইজন্য বাইর হইসি খাওয়া নিয়া, এইদিকে কোন জায়গায় কাউরে পাইলে খাওয়াগুলান দিতাম।"
কমান্ডার এবং যোদ্ধারা এবার নীরব, কারও মুখে ভাষা নেই। একটু আগে কিনা এই বুড়িকেই তারা ব্রিজসহ উড়িয়ে দিতে চেয়েছিল। বুড়ির ঐ পুঁটলিতে বেশ কিছু খাবারদাবার - না দেখা না চেনা কোন মায়ের সন্তানের জন্য, যারা যুদ্ধ করছে দেশের জন্য। কোথা থেকে এলো এই মমতা? কেন পরের সন্তানের জন্য নিজের সন্তানের খাবার নিয়ে অন্ধকার পথে কোনো মা ছুটে আসে? কমান্ডার বহু বছর পরেও এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি। শুধু চোখ মুছে বলেছিলেন - "আমরা সবাই ঐদিন থেকেই জানতাম - যে দেশে এমন মা আছে, ঐ দেশের মানুষকে দুনিয়ার কেউ আটকাতে পারবে না। আজ হোক কাল হোক স্বাধীন আমরা হবোই। যুদ্ধে আমরা জিতবোই!"