শায়লাকে দেখতে পরীর মত লাগছে। যেন আকাশ থেকে একটি পরী নেমে এসে হলুদ শাড়ি পরে চুপটি করে বসে আছে। শায়লাকে ঘিরে ওর সব কাজিনরা বসে আছে। কেউবা ছুটোছুটি করছে। ছোট ছোট বাচ্চারা উঠোনে খেলা করছে। উঠোনের একপাশে চাচি মামীরা মেহেদি বাটছে, কেউবা হলুদ বাটছে
বিশাল উঠোনের আরেকপাশে বিরিয়ানি রান্না হচ্ছে। কিছুক্ষন পর শায়লার ‘গায়ে হলুদ’ অনুষ্ঠান শুরু হবে।
সজীব একদল ছেলেকে নিয়ে হলুদের ষ্টেজ সাজাচ্ছে। ওর চোখ বার বার আজ চিত্রার দিকে গিয়ে থেমে যাচ্ছে। ও বুঝতে পারছে না চিত্রাকে আজ অন্যরকম লাগছে কেন? শাড়ি পরাতে নাকি? ছোট্ট চিত্রা কবে এত বড় হয়ে গেল!
চিত্রা মহাব্যস্ত। কি নিয়ে এত ব্যস্ততা সে নিজেও জানে না। তবে বিয়ের অনুষ্ঠানে কিশোরী মেয়েদের ব্যস্ততাই বেশি থাকে। একবার হলুদ বাটতে বসেছে, মা এসে দিল এক ধমক। মায়ের স্বভাবই হচ্ছে অকারনে ধমক দেয়া। কিছুক্ষন মন খারাপ করে ঘুরে বেড়ানোর পর সজীব ভাইয়ার কথায় মন ভাল হয়ে গেছে। আজ নাকি তাকে ‘ফুল পরী’ মনে হচ্ছে।
সে রাত্রে চিত্রার নির্ঘুম কাটল। সজীব ভাইয়া তাকে প্রপোজ করেছে। অকল্পনীয় ব্যাপার। কথাটা শোনার সাথে সাথে তার সারা শরীর ঝিমঝিম করে উঠেছে। তার এত ভাল লাগছে কেন সে বুঝতে পারছে না। অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে সজীব ভাইয়ার চোখে চোখ পরলে সে লজ্জায় চোখ তুলে তাকাতেও পারছে না। এক নিমিষে যেন সব বদলে গেল। সজীব ভাইয়া বলেছে শায়লা আপুর বিয়ের দিনেও যেন সে শাড়ি পরে। তাকে নাকি শাড়িতে অদ্ভুত সুন্দর লাগে।
...........................
বড়’পার সাথে মা কি কথা হয়েছে কে যেন জানে, এরপর থেকে মা চিত্রার সাথে কথা বলছে না। মা মাঝে মাঝে এমন করে, এটা একটা মানসিক অত্যাচার। চিত্রার উপর রেগে গেলে মা এটা করে। চিত্রার খুব ভয় লাগছে, বড়’পা কি সজীবের ব্যাপারে কিছু টের পেল?
‘এই শোন’।
বড়’পা ডাক শুনে চিত্রার বুক কেঁপে উঠে।
বড়’পা রান্নাঘরে পেঁয়াজু ভাজছে। চিত্রা চুলার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।
‘তোর সাথে কি সজীবের যোগাযোগ আছে’?
‘না তো’।
মাথা নিচু করে চিত্রা জবাব দেয়।
‘মা, কার কাছে যেন কি শুনেছে। যাই হোক, তুই বড় হচ্ছিস। জানিস ই তো মা এসব পছন্দ করে না। এসব থেকে দূরে থাকিস’।
চিত্রা কিছু না বলে দাঁড়িয়ে থাকে। বড়’পা কড়াইয়ের পিঁয়াজু উল্টে দিতে দিতে বলে,
‘তোর রেজাল্টের পর তোকে আমি ঢাকায় নিয়ে যাব। অনার্সটা আমার কাছে থেকে করবি। আমি কি বলতে চাইছি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিস’।
চিত্রা এবারও কিছু বলে না। ওদের পরিবারে মা-র কথাই সব। মাকে সামলাতে পারে একমাত্র বড়’পা। সেই বড়’পা যদি রাজি না থাকে তাহলে ও কিভাবে কি করবে। ও আর ভাবতে পারে না।
শায়লার গায়ে হলুদের দিনটির কথা সজীব কখনই ভুলতে পারে না। মাঝে মাঝে সজীবের মনে হয় সেই দিনটি ওর জীবনে না এলেই ভাল হতো। চিত্রা এমনভাবে বদলে যাবে কে ভেবেছিল? আজ তিন দিন চিত্রার বড় বোনের বাসার সামনে সজীব দাঁড়িয়ে আছে, অপেক্ষায় আছে চিত্রাকে ভার্সিটি যাবার পথে ধরবে। প্রতিদিন চিত্রা ওকে দেখলেই পালিয়ে যায়। চিত্রা বি.আর.টি.সি বাসে উঠতেই সজীবও সেই বাসে উঠে পরে। কখন চিত্রা বাসের অন্য দরজা দিয়ে নেমে পরেছে, ও দেখেনি। ওর চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।
কি ভেবেছে, আর কি হয়েছে। ভেবেছিল চিত্রা ঢাকায় আসলে ওরা বিয়ে করে ফেলবে। পারিবারিকভাবে ওদের বিয়ে দু’পরিবার মেনে নেবে না। অথচ এখন চিত্রাই কি না বদলে গেল। কোন ঝগড়া না, কিছু না। এক কথায় সম্পর্ক শেষ!
........................
আজ চিত্রার বিয়ে। চারদিকে হৈ চৈ হচ্ছে, বিয়ে বাড়ির আয়োজন প্রায় সম্পন্ন। কিন্তু কোন কিছুর সাথেই নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারছে না চিত্রা। কাল রাতে এক ফোঁটা ঘুমাতে পারেনি। এক অজানা ভয় তাকে যেন গ্রাস করছে, ভয় পাওয়াটা অমূলক নয়। পাত্রপক্ষ তাকে আগে দেখেনি, আজই প্রথম দেখবে। যদি তাদের পছন্দ হয়, তাহলে আজকেই বিয়ে।
চিত্রা একমনে প্রাথর্না করে যেন পাত্রপক্ষের তাকে পছন্দ হয়। বেশ কিছুদিন ধরে বড়’পা খুব চেষ্টা করছেন চিত্রার বিয়ে দিতে। কিন্তু কোন পাত্রপক্ষেরই যেন চিত্রাকে পছন্দ হয় না। এদিকে বড়’পা ঘটকদের মুঠো মুঠো করে টাকা দিচ্ছেন, আরেকদিকে কবিরাজ বাড়ি থেকে পানি পড়া, চিনি পড়া আনছেন। চিত্রার হাতে তাবিজ বেঁধে দিয়েছেন। সব কিছুই ফেল করছে।
চিত্রার খুব অবাক লাগে সে যদি দেখতে এত খারাপই হবে, তাহলে কলেজে পড়ার সময়ে পাড়ার, কলেজের সব ছেলেরা তার সাথে প্রেম করতে চাইত কেন? তার একটুখানি মুখের হাসি দেখতে পেলে ছেলেরা নিজেকে ধন্য মনে করত। তখন সজীব ছাড়া তার মনে কেউই জায়গা করতে পারেনি। মনে হতো ওর পাশে শুধু সজীবকেই মানায়। কি এক অন্ধ ভালবাসা ছিল!
কি সব দিন ছিল! নিজেকে পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর ফুল মনে হতো, তাইতো তার চারপাশে মৌমাছির এত আনাগোনা।
ঢাকায় যাবার পর চিত্রপট যেন পাল্টে যায়। এত মেধাবী ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও সজীবের কোন চাকরি হচ্ছে না। চিত্রার পরিবারও সজীবের সাথে বিয়ে দিতে চাইছে না। ওর সাথে বাসার সবাই কথা বলা বন্ধ করে দেয়। একদিকে প্রেম, অন্যদিকে পরিবার। কি যে সময় পার করেছে চিত্রা। সেদিনের কথা মনে পরলে এখনো দীর্ঘশ্বাস পরে। সজীবকে ফিরিয়ে দেয়া ছাড়া কি ই বা করার ছিল ওর...।
বাহিরে হৈ চৈ শোনা যাচ্ছে। বরপক্ষ চলে এসেছে। চিত্রা ড্রইংরুমের পর্দা ফাঁক করে ছেলেটাকে দেখে। ছেলেটা একটা লাল রঙের শার্ট পরে এসেছে। তাকে দেখাচ্ছে একটা লালমুখো বাঁদরের মতো। চিত্রার মেজাজটাই খারাপ হয়ে যায়। ছেলেটাকে তার একটুও পছন্দ হয় নি।
কিছুক্ষন পর চিত্রাকে ড্রইংরুমে নিয়ে যায় তার চাচি। পাত্রপক্ষ চিত্রাকে এটা সেটা নানা প্রশ্ন করে। ও চলে আসার পর পাত্রপক্ষ নিজেরা আলোচনায় বসে।
চিত্রার বড়’পা জায়নামাজ নিয়ে বসে পরেন। মা রান্নাঘরে বসে একমনে বিড়বিড় করে পড়ছেন, মনে হয় দোয়া দুরুদ। এসব দেখে চিত্রা ঘাবড়ে যায়। মনে মনে প্রাথর্না করে, ‘আল্লাহ্, আমার মান সন্মান রক্ষা করো’।
অবশেষে পাত্রপক্ষের তাদের মতামত জানা যায়। ঐ লালমুখো বাঁদরেরও চিত্রাকে পছন্দ হয় নি। পাত্রপক্ষের চলে যাবার খবর শুনে চিত্রা চিৎকার করে কাঁদে। চিত্রার পাশে কেউ আসে না।
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০১৩ রাত ১২:৪৯