জুম্মার নামাজ শেষ করে ডাঃ আজমল ডিউটিতে এসে শুনলেন ৯নং বেডের রোগী মারা গেছেন। তিনি ডেথ সার্টিফিকেট লিখতে বসলেন। নার্সকে বললেন, রোগীর একজন আত্মীয়কে ডেকে দিতে। খানিক পরেই মেয়েটি তার সামনে এসে দাঁড়ায়। মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে মেয়েটি রোগীর সন্তান। ডাঃ আজমলের খুব খারাপ লাগে। চল্লিশ বছর ধরে চিকিৎসা পেশায় থেকেও তার খারাপ লাগা একটুও কমেনি। কিভাবে মেয়েটির সাথে কথা শুরু করবেন বুঝতে পারেন না।
ঃ মা, রোগী তোমার কে হন?
ঃ আমার বাবা। -মেয়েটির চোখে আবার পানি জমতে শুরু করেছে।
একটু কেশে আজমল সাহেব গলা পরিস্কার করলেন যেন, “মা, তোমার বাবার শরীর তো ভাল না, ওনার ব্যাপারে তোমার সাথে একটু কথা ছিল”।
মেয়েটি চমকে ৯নং বেডের দিকে তাকায়। তিনি মেয়েটির চোখে স্পষ্ট বিস্ময় দেখতে পান। পরক্ষনেই তার দিকে তাকিয়ে মেয়েটি প্রশ্ন করে, “তাহলে কি আব্বু বেঁচে আছে”(!)
ডাঃ আজমল থতমত খেয়ে যান। তার খুব কষ্ট লাগে মেয়েটির জন্য। খুব দ্রুত তিনি মেয়েটির আশা ভগ্ন করে দেন। বলেন, “না, মা, তিনি বেঁচে নেই। আমি তোমাকে ডেকেছি তোমার আব্বুর ডেথ সার্টিফিকেট লেখার জন্য আমার ওনার সম্পর্কে কিছু তথ্য লাগবে। এই সার্টিফিকেটটি তোমাদের অনেক কাজে লাগবে”।
মেয়েটি দ্রুত নিজেকে সামলে নেবার জন্য চোখ নামিয়ে ফেলে। সে আবার তার বাবার দিকে তাকায়। দেখে ২ জন ওয়ার্ড বয় তার বাবার পায়ের বুড়ো আঙ্গুলে একসাথে করে সুতো প্যাঁচাচ্ছে। সে বেডের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়, কাতর কণ্ঠে অনুরোধ করে, একটু আস্তে করে ওনাকে ধরবেন, যাতে ব্যাথা না পায়। ওয়ার্ড বয়রা খুব বিরক্ত হয়। এখন কত কাজ, বেড খালি করতে হবে, নতুন রোগী আসবে...।
বারডেম হাসপাতালের মর্গের সামনে রোগীকে (নাকি লাশকে, তাকে কি এখন রোগী বলা যায়, একটু আগেই তো লোকটা রোগী থেকে লাশ হয়ে গেল) শুইয়ে রাখা হয়েছে। লাশের স্ত্রী তার শিয়রে বসে কাঁদছে। মেয়েটি তার মাকে ধরে রেখেছে। মেয়েটির মা এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না তার স্বামী বেঁচে নেই। তিনি তার স্বামীর চোখের পাতা টেনে ধরেন। সবাই হয়ত ভুল করছে, হয়ত মানুষটি ঘুমাচ্ছে, নিশ্চয়ই চোখের মনি নড়বে। না, নড়ছে নাতো। হায় আল্লাহ্, মানুষটি সত্যি সত্যি মারা গেছে? মেয়েদের বেঁচে থাকার অবলম্বন নাকি সন্তানরা। কিন্তু তার দুই সন্তান যখন পড়ার জন্য ঢাকায় চলে এলো, তিনি টের পেলেন তার সমস্ত জীবন যাপন এই মানুষটার জন্য। ছেলেমেয়েকে ছাড়াও তিনি থাকতে পারেন, কিন্তু মানুষটাকে ছাড়া এক মুহূর্তও না। এই একুশটা দিন তিনি হাসপাতাল ছেড়ে এক মুহূর্তের জন্য সরেননি। কারো কথা কানে নেননি, মেঝেতে ঘুমিয়েছেন, হাসপাতালেই খাবার খেয়েছেন, ভুলে গেছেন তার শুচিবায়ু আছে। এখন আর কোনো কিছুতেই তার শুচিবায়ু নেই। তিনি আবার তার স্বামীর বুকে হাত দেন, নিশ্চয়ই শ্বাস ফেলছেন। খুব আস্তে ফেলছেন বলে সবাই ভুল করছে। একপর্যায়ে মেয়েটি তার মাকে সরিয়ে দেয়। বলে, “আম্মু, আমি আব্বুর কাছে আছি। তুমি যাও, আমি আব্বুকে দেখবো”।
ঘোর লাগা চোখে তিনি মেয়ের দিকে তাকান। কোন কিছু বুঝতে পারেন না। কেউ একজন এসে তাকে লাশের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়।
লাশের পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে কিছু আত্মীয় স্বজন মৃত্যু সংক্রান্ত কথাবার্তা বলছে। মেয়েটি তার বাবাকে এখন গোসল দিতে চাইছে না। সে চাইছে যত দ্রুত সম্ভব তার বাসায় নিয়ে যেতে। লোকটার বাড়ী চাঁদপুরে। যেতে যেতে তো অনেক সময় লাগবে। লাশের গোসল যত দ্রুত হবে, তত ভালো। মেয়েটি আত্মীয়দের বলে উঠে, “আপনারা একটু আস্তে কথা বলেন, আমার আব্বুর কষ্ট হচ্ছে”।
লোকগুলো খুবই ইতস্তত বোধ করেন। এরা কেউই লাশের নিকট আত্মীয় না। লাশের কাছে জোরে জোরে কথা বলবেন এটাই স্বাভাবিক। মেয়েটা এত বেয়াদব। যাক, কি আর করা বিরক্ত হয়ে তারা দূরে সরে যান। বরফ আর চা পাতা দিয়ে লাশটাকে যখন কফিনে রাখছে, কফিনটাকে জোরে জোরে নাড়াচাড়া করতে হচ্ছে, যাতে করে চা পাতা আর বরফ কুচি লাশের নিচেও চলে যায়। মেয়েটি এখানেও বাগড়া দেয়। ওয়ার্ড বয়দের বলে একটু আস্তে নাড়াচাড়া করতে। আরে বাবা, লাশের আবার ব্যাথা বেদনা কি! লাশ তো লাশ-ই।
এ্যাম্বুলেন্সটা যখন চাঁদপুরে পৌঁছায়, তখন রাত ৯ টা বেজে গেছে। মেয়েটি দেখে সাদা পাঞ্জাবি পরে সবাই তার বাবার জন্য অপেক্ষা করছে। সে খানিকটা নিশ্চিন্ত বোধ করে। তার বাবার স্বপ্নভূমিতে বাবাকে আনতে পেরেছে। সরকারের কাছে লিজ নিয়ে লোকটি ব্যবসা শুরু করেছিলেন এখানে। জীবনের বেশীরভাগ অর্জিত টাকা আর শ্রম এখানেই দিয়েছেন তিনি। সরকারের কাছে থেকে কিনে নিয়েছেন জমিটা। তার আবাসস্থল, কাঠের ব্যবসা, স’মিল সবই এখানে। সবাই মিলে সেই স্বপ্নের স’মিলেই খাটিয়ায় করে রাখলেন তাকে। কিচ্ছুক্ষণ পর নিয়মানুযায়ী এডভোকেটরা (ভদ্রলোক বহু পেশাজীবী ছিলেন, অর্থনীতির অধ্যাপক, সরকারী আইনজীবী, কাঠের ব্যবসা ইদানিং ছেড়ে দিয়েছিলেন, সময় দিতে পারছিলেন না বলে) মেয়েটির হাতে দশ হাজার টাকা দিতে এলেন। কোন ল’ইয়ার মারা গেলে তার সৎকারের জন্য দশ হাজার টাকা দেয়া হয়। মেয়েটি হাত দিয়ে টাকাটা ছুঁতে পারেনা। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। তার মনে পড়ে যায়, তার বাবার শেষ সময়ে টাকার জন্য যখন সে আপন মানুষগুলোর কাছে গিয়েছে। কেমন করে পরিচিত মুখ গুলো অচেনা হয়ে যাচ্ছিল। আই.সি.ইউ-র বেড ভাড়া প্রতিদিন বিশ হাজার টাকা, তাই সব কিছু মিলিয়ে মেয়েটির প্রতিদিন ত্রিশ হাজার টাকার প্রয়োজন ছিল। তার কাছের(!) মানুষগুলোর কাছে টাকা ধার চাইলে কেউ কেউ তার বাবার স্বপ্নভূমিকে বিক্রি করতে বলেছে। আজকেই সে ঠিক করেছিল বিক্রি করে দিবে স্বপ্নভূমিকে, তবু যদি বাবাকে আর ক’টা দিন বাঁচিয়ে রাখা যায়। হয়ত মেয়ের মনের কথা টের পেয়েই লোকটি চলে গেলেন, হয়ত... !
খুব সকালে লোকটিকে যখন খাটিয়ায় করে জানাজার জন্য নিয়ে যাচ্ছে, মেয়েটি দেখছিল, তার ভাই খাটিয়ার একপ্রান্ত ধরে রেখেছে। তার বাবা সবসময় ছেলে সন্তান পছন্দ করতেন, বলতেন, “ছেলেরা আর কিছু না করুক মরে গেলে তো খাটিয়া ধরবে”।
তার বাবার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে, তার ভাই আজ তার বাবাকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মেইন রোড থেকে মেয়েটি দেখছে, তার বাবা একে একে স’মিল, সারিবদ্ধ কাঠের দোকান, সবশেষে বাসাটাকে পার করে চলে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে, তাদেরকে ছাড়া কি করে থাকবে তার বাবা? মেয়েটির ইচ্ছেমত খুব সকালে চাঁদপুরের জাতীয় ঈদগাহে ভদ্রলোকের প্রথম জানাজা হয়। মেয়েটির ভাই গো ধরে সে এখানে জানাজায় শরিক হবে। ইমাম সাহেব বলেন, “বাবা, তুমি একবার তোমার বাবার জানাজায় শরিক হতে পারবে। তুমি তোমার বাবার শেষ জানাজায় শরিক হও”।
ছেলেটি ইমাম সাহেবের কথা মেনে নেয়। ভদ্রলোকের দ্বিতীয় জানাজা হয় গ্রামের বাড়ীতে। ভদ্রলোককে তার ছেলে কবরে শুইয়ে দেয়, কবরের উপর প্রথম মাটিও ছেলেকে দিতে হয়, এটাই নাকি নিয়ম(!)।
এই মাটি দেয়া নিয়েও মেয়েটি ঝামেলা করে, একজন হুজুর সবার কাছ থেকে এক মুঠো মাটি যখন আনতে যায়, মেয়েটি বলে সেও একমুঠো মাটি দিবে, কিন্তু মেয়েদের তো মাটি দেবার নিয়ম নেই। মেয়েটি চিৎকার করতে থাকলে সবাই হুজুরকে বলে ওর কাছ থেকে এক মুঠো মাটি নিতে।
..................
২০ দিন পর...
ভদ্রলোকের চেম্বারে তার স্ত্রী এবং ছেলে বসে আছে। তারা বিভিন্ন কাগজের মাঝে একটা দলিল খুঁজে পেয়েছে। দলিল পড়ে তার স্ত্রী কান্না ধরে রাখতে পারছে না। তার মনে পড়ে বাসাটা তার নামে দেয়ার জন্য ভদ্রলোককে কত অনুরোধ করেছেন, অভিমানও করেছেন মাঝে মাঝে। দলিলের সারমর্ম, “আমি মারা গেলে আমার স্থাবর অস্থাবর সব সম্পত্তির মালিক হবে আমার স্ত্রী। যদি সে আবার বিবাহ করে তাহলে এসবের মালিক হবে আমার দুই সন্তান”।
ভদ্রলোকের কবরের পাশেই একটা কবরের জায়গা রাখা আছে। কবরের জায়গায় শুধু একটা লাশ আর নেমপ্লেট লাগানো বাকি। ভদ্রলোকের স্ত্রী বলে রেখেছেন, এখানে তার স্বামীর পাশে যেন তাকে কবর দেয়া হয়। মারা যাবার পর যেন তারা একসাথে থাকতে পারেন(!)
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুলাই, ২০১৩ রাত ১২:১৪