সাদা পাজেরো গাড়ীটি থেকে যে লোকটি এইমাত্র নামল, যাকে ঋজু ভঙ্গিতে হেটে যেতে দেখে অফিসের পিয়ন করিম মিয়া ত্রস্তভাবে উঠে দাড়িঁয়ে ঠুক করে সালাম ঠুকল তাকে ঘিরেই আমাদের এ গল্প। যেহেতু তাকে নিয়েই গল্প, তার একটা নাম থাকা প্রয়োজন। ধরে নিই তার নাম আজিজুল হক। অফিসে তিনি হক সাহেব নামে পরিচিত অতএব গল্পেও আমরা উনাকে এ নামেই চিনব। হক সাহেবের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। আপাত সুখী দাম্পত্যজীবনে তিনি দু'সন্তানের গর্বিত জনক। এই নিয়েই উনার সংসার। না, এটুকু বললেই সব বলা হয় না, হক সাহেবের আরো একটি পরিচয় আছে। আমাদের হক সাহেব ভারুয়াকান্দি হাই স্কুলের ধর্মীয় শিক্ষক মৌলভী ইউনুচ আলীর সন্তানও বটে। ভারুয়াকান্দি গ্রামে আরো অনেকের মতো হক সাহেবের পিতা-মাতা, ভাই-বোনেরাও থাকেন; যাদের কথা হক সাহেবের প্রায়শই মনে থাকে না। হক সাহেবের মনে না থাকলেও তার বৃদ্ধ স্কুল শিক্ষক পিতা কিংবা চোখে ছানী পড়া বছরজুড়ে বাতের রোগী তার বৃদ্ধা মা কিন্তু এক মুহুর্তের জন্যও ভুলতে পারেন না তাদের এই বড় অপিচার সন্তানকে।
মৌলভী ইউনুচ আলী সারা জীবন অন্যের ছেলেমেয়েকে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি নীতি শিক্ষা দিয়ে গেছেন। তার নিজের সন্তানদেরও তিনি একই শিক্ষায় মানুষ করার চেষ্টা করেছেন। সিরাজুল হক আর মফিজুল হক না পারলেও তার বড় ছেলে আজিজুল হক ঠিকই তার শিক্ষায় মানুষ হয়েছেন। বাল্যকালে সততাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা- এই বাণীকে চিরজীবন সত্য মনে করা মৌলভী ইউনুচের অন্য দু'সন্তান গেরস্ত করেই চলে। এ নিয়ে তার মনে তেমন আফসোস নেই অন্তত একটা সন্তান যে মানুষ হয়েছেন এজন্যই তিনি আল্লাহপাকের কাছে শোকরিয়া জানান। মৌলভী ইউনুচের বড় ছেলে ডিস্টিক ফুড অফিসার। খাদ্য কর্মকর্তাদের নিয়ে নানা দূনীর্তির কথা শুনা গেলেও তার সন্তানকে নিয়ে তিনি নিশ্চিন্ত। তিনি ভাবতে ভালবাসেন তার সন্তান তারই আদর্শে মানুষ হয়ে দেশের সেবা করছেন। এমন সন্তানের জন্য কোন্ পিতামাতার না গর্ব হয়! মৌলভী ইউনুচ সুযোগ পেলেই তার ছেলের সততার কথা গ্রামের লোকদের বলে বেড়ান। এতে তিনি বড়ই তৃপ্তি বোধ করেন।
পাঠক হয়তো ভাবছেন এগল্প আসলে কার। সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আজিজুল হকের না গ্রামের স্কুল শিক্ষক মৌলভী ইউনুচের। গল্পকার নিজেও জানে না এগল্প আসলে কার। হয়তো এ গল্প হক সাহেবের কিংবা মৌলভী ইউনুচের অথবা কোন একক সময়ের।
মৌলভী ইউনুচের শরীরটা ইদানিং ভাল যাচ্ছে না। বড় ছেলের কথা খুব মনে পড়ে। কতদিন তাকে দেখেন না। গত দশ-বার বছর থেকে ঈদে-চাদেঁও ছেলে গ্রামে আসে না। তার খুব ইচ্ছে করে ঢাকা গিয়ে ছেলের সাথে দেখা করে আসে, কিন্তু শরীর সাহস কোনটাতেই কুলোয় না। এখনতো ঠিকমতো হাটঁতেই পারেন না। বাড়ী থেকে হেঁটে বটতলার মোড়ে গিয়ে গত দিনের বাসি পত্রিকা পড়া তার অতি প্রিয় একটি অভ্যাস। শারিরীক অসুস্থতার কারনে গত কয়েকদিনের পত্রিকা তিনি পড়তে পারেননি। ইজি চেয়ারের শুয়ে শীতের নরমরোদ পোহাতে পোহাতে পত্রিকার জন্য বিষন্নবোধ করছিলেন তিনি। এমন সময়ই পাশের বাড়ীর কলেজ পড়ুয়া ছেলে আমীন আলী দৌড়াঁতে দৌড়াঁতে এসে মৌলভী ইউনুচকে গতকালের পত্রিকাটি দিয়ে বলে- পত্রিকায় চাচাজানের ছবি ছাপসে, আর কি জানি লিখছে।
পত্রিকার শিরোনামটি মৌলভী ইউনুচ পড়েন, পড়েন এবং পড়তেই থাকেন। তিনি ঠিক বিশ্বাস করতে পারেন না। আবারো পড়েন, বারবার পড়েন। একসময় তার হাত থেকে পত্রিকাটি পড়ে যায় মাঠিতে। পত্রিকাটি মাঠিতে ভাজঁ হয়ে থাকে। মৃদু বাতাসে যদি পত্রিকার পাতা উল্টে যেতো তাহলে হয়তো শিরোনামটি আমরাও দেখতে পেতাম - দূনীর্তির অভিযোগে উচ্চপদস্থ খাদ্য কর্মকর্তা আজিজুল হক গ্রেপ্তার, বাড়ী তল্লাশী করে উদ্ধার অর্ধ কোটি টাকা।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জানুয়ারি, ২০১০ রাত ৯:৪৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




