বর্তমান সরকারকে জনগণ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু সরকারের নীতি নির্ধারকরা তা বুঝতে পারছে না। এমনকি বিরোধীদল বিএনপিও পরোক্ষভাবে সরকারকে সমর্থন যুগিয়ে যাচ্ছে এটা বললেও অত্যুক্তি হবে না। কিন্তু সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মো. নাসিম সরকারকে বৈধ বলার জন্য আর্তি জানাচ্ছে বিরোধী দলের কাছে। এতে সরকারের আত্মবিশ্বাসের ঘাটতিটা দিন দিন চাউর হয়ে উঠছে। হত্যা খুনের মত ঘটনাগুলো নৈমিত্তিক হয়ে উঠছে। মিরপুরের অবাঙালি কলোনিতে আগুন দিয়ে কে বা কারা একই পরিবারের ১০ জনকে পুড়িয়ে মেরেছে। যেখানে ২ জন শিশুও ছিল। বর্বরতার যেন শেষ নেই।
ঝগড়া বিবাদ হতেই পারে। দু’পক্ষের ঝগড়াতে হতাহতের ঘটনাও ঘটতে পারে। কিন্তু ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে, তালা দিয়ে পুড়িয়ে হত্যাকা- মানে পরিকল্পিত ও সংগঠিত হত্যাকা- কেবল নিন্দা ও প্রতিবাদের বিষয় নয়। তারা অবাঙালি বলেই এ হত্যার সাহস করেছে মনে করারও কারণ নেই। যারা হত্যাকারি তারা অন্য যে কাউকে হত্যার মত বর্বরতা লালন করে। তা বুঝতে কোন অসুবিধা হবার কথা নয়। কারণ ঘরের দরজায় তালা দিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়া তারপর নির্র্মমভাবে মৃত্যু এটা ভাবতেই আমাদের গা শিউরে উঠে। এমন নির্মম মৃত্যুফাঁদ মানুষ মানুষের জন্য তৈরি করতে পারে না। মানুষের বাইরে জন্তু জানোয়ারের স্বভাবও এমন দেখা যায়না।
বার বার এমন নির্মম মৃত্যুর গল্পগুলো তৈরি করা হচ্ছে। চমৎকার উদাহরণ সৃষ্টি হচ্ছে হত্যাকা-ের। বীভৎস হত্যাকা-। কি কারণে হত্যাকারিরা রাষ্ট্রে কোন আইন ও বিচার নেই এমন ভাবনা লালন করে নির্ভাবনায় হত্যা-খুন ও অরাজকতায় মেতে উঠেছে তা বোধগম্য নয়। অতীতে আমরা দেখেছি -নতুন সরকার ক্ষমতায় এলে জনগণের মধ্যে স্বস্তির মাত্রা বাড়ে। যারা অপরাধী তারাই অস্বস্তি বা আতঙ্কে ভোগে। এমন কি অপরাধীরাও গা ঢাকা দেয়। অথবা অপরাধ করার জন্য সময় নেয়। সময়টা অনেক সময় ২/৩ বছরও গড়ায়। সরকার যত দুর্বল হয় তত অপরাধের মাত্রা বাড়তে দেখা গেছে।
সরকার কিভাবে দুর্বল হয় সেই প্রশ্নটি আসতে পারে। আসতে পারে এ কারণে সরকার যত নির্বাচনের দিয়ে এগিয়ে যায় তাদের লোকজনের দুর্নীতিগুলো ধীরে ধীরে জনগণের মধ্যে জানাজানি হয়ে পড়ে। আর সরকারের মানসিক শক্তি যখন দুর্বল হয়ে পড়ে তখন অপরাধিরা বেরিয়ে উল্লাস করে। খুন-হত্যার সুযোগ পেয়ে যায়। তাই আমরা দেখি- শেষ সময় পর্যন্ত সরকার চালিয়ে নিতে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়। যদিও তারা যারা ক্ষমতার হালুয়া-রুটি নিয়ে ব্যস্ত থাকে তারা এসব ভোগান্তি বলে মনে করে না। বাস্তবতা হচ্ছে দুর্নীতি যতক্ষণ পর্যন্ত বন্ধ না হচ্ছে সরকারের মনোবল কোন মতেই দৃঢ় হবে না। সেটা আমরা দেখে আসছি।
কিন্তু বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসতে না আসতেই চারপাশে খুনিরা অনেক বেশি চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। যে যেমনভাবে পারছে প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। কেন আইন আদালতকে পরোয়া না করে নিজেরা এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে তা বোঝা দুরূহ। নারায়ণগঞ্জে ৭ খুনের ঘটনায় যদি ইন্ডিয়া থেকে আসামি গ্রেফতার করা সম্ভব হয় তাহলে সাংবাদিক দম্পত্তি সাগর-রুনি হত্যার আসামি কেন ধরা সম্ভব হয়নি তা সেই প্রশ্নটাও যুক্তিযুক্ত। এমনি অনেক হত্যার কথা আমরা বলতে পারি।
কিছু বিষয় আমাদের কাছে পরিস্কার সরকার চাইলে অনেক কিছুই সম্ভব হয়। কিন্তু সরকার সেই আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করছে না অধিকাংশ ক্ষেত্রে। এসব ক্ষেত্রে সুযোগটা নিচ্ছে অপরাধীরা । অপরাধীদের ধরতে বেগ পেতে হয় কিংবা ধরা অসম্ভব করে তোলা হয়- জনগণ কেন বুঝবে না সরকারের প্রশাসন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় আন্তরিক নয়। কিংবা অপরাধ সংগঠিত করার ক্ষেত্রে তাদের কারো যোগসাজস থাকতে পারে। আশ্রয়-প্রশ্রয় থাকতে পারে। সরকারের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে তারা অপরাধকে উৎসাহিত করতে পারে। অন্যের কাছে যেচে বৈধতা চাইলে এটা আরও বাড়বে।
নারায়ণগঞ্জের ৭ খুনের পর ফেনির উপজেলা চেয়ারম্যান একরাম হত্যা-এরপর গুম ও অপহরণের নানা খবর কান ঝালাপালা হয়ে উঠেছিল দেশের মানুষের। এরপরও খুন বন্ধ হয়নি। প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের আগুন থেমে নেই। মিরপুরের ঘটনা হত্যার ধারাবাহিকই যেন।
কিন্তু বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা চলার কারণে মিরপুরের ১০ জনকে পুড়িয়ে মারার বিষয়টি খুব একটা জানাজানি হয়নি। সমালোচনাও হয়েছে কম। খবরটা প্রায় সাধারণের চোখ এড়িয়ে গেছে। মিরপুরের হত্যাকা-ে পূর্ব শত্রুতা ছিল কিনা আমরা এখনো জানতে পারিনি। খবরে জানা গেছে, বিহারি -বিহারি ও বিহারি -বাঙালিদের সংঘাত। সংঘাতের এক পর্যায়ে নির্দিষ্ট একটি পরিবারের ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে তাদের ঘরে আগুন দিয়ে পুরো পরিবারের সদস্যদের হত্যা করা হয়।
বিহারি বলেই এ ঘটনা থেকে আমরা চোখ ফেরাতে পারি না। আমরা চোখ ফেরাতে পারিনা ঘরে তালা দিয়ে নারী ও শিশু হত্যার। আর আমরা যদি এটা বিহারি বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করি তাহলে আমরা কতটা ভয়ঙ্কর অপরাধ সংগঠনে পারঙ্গম সেটাও প্রমাণ করে এ ঘটনা। আর এমন অপরাধীরা শুধু বিহারিদের ঘরে আগুন দেবে না তারা নিজেদের আপন- জন, পাড়া -প্রতিবেশির ঘরেও আগুন দিতে পিছ পা হবে না হীন স্বার্থে। কারণ কোন স্বার্থজনিত বিষয় না থাকলে শুধু আতশবাজি পোড়ানোর ঘটনা এতটা বর্বরতায় যেত না। বীভৎস হত্যাকা-ে কারা জড়িত তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আমরা কেউ নিহতদের অভিসম্পাতের আশায় নেই। আর এ ধরনের অপরাধীরা যে সরকার ও প্রশাসনকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে তাতে বিরোধীদল সরকারকে সমর্থন করলেও কোন ফলাফল আসবে না। কারণ মানুষ সুশাসনের গ্যারান্টি চাই। যে কোন সরকারের কাছ থেকে জনগণ এটাই চাই।
এদেশে নানা কারণে অবাঙালিরা তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের শিকার। তারও ইতিহাস আছে। তারাও যে খুব একটা বাঙালিদের বিশ্বাস করে তা নয়। পরিস্থিতির কারণে তারা আজ নিরীহ। অনেকটা মানবেতর জীবন যাপন করছে। তাদের পক্ষ হয়ে কথা বলারও কেউ নেই। কেউ নেই- সেই কারণে আমরা আমাদের আইন ও বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারি না। যদি হত্যাকারিদের খুঁজে বের করা না যায়, রাষ্ট্র যদি মনে করে নিহতদের আত্মার অভিসম্পাত হত্যাকারিরা ভোগ করবে। তাহলে আমরা অপরাধীদের কাছে কতটা দুর্বল সেটা আর বোঝানোর কিছু নেই।