ফরমালিন আমাদের রাষ্ট্র ও ভবিষ্যত প্রজন্মকে ধ্বংস করছে। আমাদের ধ্বংস করছে সেটা আপাতত বাদই দিলাম। মাদকের বিরুদ্ধে কথা বলা হয়। ধূমপানের বিরুদ্ধেও। কিন্তু এসবের কোনটাই ফরমালিনের চেয়ে মারাত্মক নয়।
গতকাল ফরমালিন উদ্ধারের ঘটনাটা অত্যন্ত ভয়াবহ। যেখানে ৫০ ড্রামের চেয়ে বেশি ফরমালিন। আজ বৃহস্পতিবার এসব ফরমালিন চানখাঁরপুল এলাকার সিলগালা করা নাদিকা কেমিক্যাল স্টোরের তালা ভেঙে ভ্রাম্যমাণ আদালত উদ্ধার করে। সেখান থেকে ৫০ ড্রাম এবং একশ’ কার্টন ফরমালিন উদ্ধার করা হয়েছে। প্রতি ড্রামে দুইশ লিটার ফরমালিন রয়েছে। প্রতি কার্টনে ১২ থেকে ২৮ বোতল ফরমালিন। এই বিশাল পরিমাণ ফরমালিন পাওয়ার বিষয়টি খুবই ভয়ঙ্কর। এছাড়া গত কিছুদিন থেকে পুলিশ ফরমালিন যুক্ত ফলমূল জব্দ করছে এবং বড় বাজারগুলোয় প্রবেশে বাধা দিচ্ছে। অনেককিছুর মধ্যে পুলিশের এই উদ্যোগটা চমৎকার। যদিও বহু বছর ধরে ফরমালিনযুক্ত খাদ্যে বাজার ছেয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছিল খুব কম। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এখনও কমই বলা যায়। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বা দাবি-দাওয়া বা সাধুবাদ থাকলে যে কারো কাজের গতি উদ্যম বা আগ্রহ বাড়ে। কিন্তু উদ্যম বাড়ানোর কোন দায়িত্ব আমরা নাগরিকরা পালন করি না। যতটা না আওয়ামী লীগ-বিএনপি খেলায় মেতে থাকি। আর ব্যবসায়িরা স্বার্থে টান পড়লে ‘সব শেয়ালের এক রা’।
পুলিশের ফরমালিন চেকপোস্ট বসানোর পর কয়েকদিন ধরে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয় রাজধানী ফলমূল প্রবেশে তখন ডেইলি ইভেন্টস হিসাবে খবরটা মিডিয়াগুলো প্রচার করেছে। এর চেয়ে বেশি খুব কম দেখা গেছে। পক্ষান্তরে কোন কোন মিডিয়া ফরমালিন চেকপোস্ট বসানোর কারণে ফল ব্যবসায়িরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এমন এমন স্পেশাল রিপোর্টও করেছে। এ সময়ে এমন স্পেশাল রিপোর্টের মানেটা কি। রিপোর্টে বলা হচ্ছে গড়পড়তা অভিযান চালানোর কারণে দুষ্ঠু ব্যবসায়িদের পাশাপাশি দুষ্ঠু নয় এমন ব্যবসায়িরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মারহাবা। যেসব ফল ব্যবসায়িরা শয়তান নয় তারা কেন প্রায় এক যুগ ধরে চলে আসা ফরমালিনযুক্ত ব্যবসা প্রতিরোধে কোন প্রতিকার নেয়নি। এখন যখন অভিযান শুরু হয়েছে তারা আবোল তাবোল বকছে। আসলে যারা সৎ ব্যবসার কথা বলছেন তারা কেউ সৎ নয়। তারা সততার ভান করছে ইস্যু সৃষ্টি করার জন্য। ফরমালিনযুক্ত ফলমূল বিক্রি জায়েজ করার জন্য। এটাই হলো বাংলাদেশের চোরদের ভালো সুযোগ। বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যেখানে চোর-ডাকাত লুটেরেরা তাদের অন্যায়-অবিচার-জুলুম করাকে অধিকার বলে মনে করে। আবার বড় গলায় কথা বলে। একেবারে নিলর্জ্জ-বেহায়া- দেশের চোরের গোষ্ঠি। আমরা যারা সুবিধাবাদী অর্থাৎ তথাকথিত সচেতন নাগরিক তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিরব ভ’মিকা পালন করি। এভাবে এদেশে সর্বক্ষেত্রে চোরের গোষ্ঠি- অন্যায়কারিরা বার বাড়ন্ত।
সর্বশেষ ফল ব্যবসায়িরা ফলের দোকান বন্ধ রাখার সিদ্বান্ত নিয়েছে। এই খবরের প্রতিক্রিয়ায় কেউ বলেছেন- ফলের দোকান বন্ধ হয়েছে মানে বিষের দোকান বন্ধ করা। বেশ খুশি ফল বিক্রেতাদের এমন সিদ্ধান্তে। আর চোরেরা বলে -তারাও নাকি ফরমালিনমুক্ত ফল বিক্রি করতে চাই। যে কারণে তারা অনির্দিষ্টকালের জন্য ফলের দোকান বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয়। এবং ফরমালিন যুক্ত ফলের বিরুদ্ধে অভিযানকে তারা ব্যবসায়িদের হয়রানি করা হচ্ছে বলেও দাবি করেছে।
ফল ব্যবসায়িদের এসব কথাবার্তা দাবি-দাওয়া-কর্মসূচী যারা ফরমালিনের বিরুদ্ধে কাজ করছে তাদের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া। তাদের বিরুদ্ধে সন্দেহ তৈরি করা।
আর আমরা যারা নাগরিক সম্প্রদায় বছরের পর বছর ধরে এভাবে ফরমালিনযুক্ত ফল বেচা বিক্রি হলেও আমরা কেউ ফল খাওয়া বন্ধ করতে পারিনি। অনেকেই বলছেন - তারা ফল খান না। ফল যদি না খাওয়া হয় তাহলে এত ফল বিক্রি কিভাবে হয়। বিক্রি হচ্ছে না বলে ফল বিক্রেতারা তো কোন হতাশা প্রকাশ করেনি। ফরমালিনের বিষে জর্জর হওয়ার পরও ফল ব্যবসায় ধ্বস নেমেছে শোনা যায়নি।
আমাদের বাস্তবতা হচ্ছে -খাদ্যের নামে আমরা কোন বাছ-বিচার করিনা। শুধু ফরমালিন বলেই নয় এদেশের হোটেল-রেস্তোঁরার খাবার পরিবেশন-রান্নার পরিবেশ, রান্নার স্বাদ আমরা দীর্ঘদিন ধরেই ছেঁকে আসছি। রীতিমত খাবার খেয়ে তারিফ তারিফ করতে আমরা বগল বাজাই। খাবার বিপদে পড়ে খাওয়া আর হাউশ করে রেস্তোঁরায় দিনের পর দিন খাওয়া পার্থক্য আছে। আমরা কি যুগ যুগ ধরে এমন খাবার খেয়ে আসছি না। আমাদের কারো কোন প্রশ্ন আসেনি। বাস্তবতা হচ্ছে এদেশের অধিকাংশ মানুষ যেসব রেস্তোঁরায় খায় সেসব হোটেল কারা চালায়। তারাই চালায় যাদের হয়তো নিজেদের খাদ্য ক্রয় করে খাওয়ার ক্ষমতা নেই। খাদ্য ক্রয় করে খাওয়ার ক্ষমতা না থাকলে খাবার রান্না, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা, মানসম্পন্ন খাদ্য তৈরি করার অভ্যাস পারিবারিকভাবে গড়ে উঠে না। বাস্তবতা হচ্ছে আমরা যারা রাস্তা ঘাটে ঘুরে খেঁটে খুটে তারা এ খাবারই খেয়ে থাকি। এটা শুধু পকেটে কম পয়সা থাকার কারণেই নয় এসব অপরিস্কার অপরিচ্ছন্ন খাবার খেতে আমরা বিন্দুমাত্র নাকও সিটাকায় না। শুধু কোন চা দোকানে গিয়ে চার কাপটা পরিস্কার পানিতে ধুয়ে দিতে বললে চা দোকানি উত্তপ্ত হয়ে উঠে। অথচ টাকার বিনিময়ে আমার চাহিদামতই তারা দিতে বাধ্য। কিন্তু তারা তাদের রুচিসম্মত খাওয়াতে অভ্যস্থ বলেই আমরা চাইতে পারি না। কারণ আমাদের বেশিরভাগ মানুষের খাদ্য সচেতনতা নি¤œ পর্যায়ের। শুনেছি পৃথিবীর অনেক দেশেই ফুটপাতে খাবারের দোকান আছে। সেখান থেকে সব সামর্থ্যরে মানুষেরা খাবার কিনে খেতে আগ্রহ দেখায়। আর আমাদের ফুটপাতের খাবারের মান কোন পর্যায়ের। আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থান ও রুচির কারণে এসব তৈরি হলেও আমরা বদলাতে পারিনি। টাকা হয়েছে অনেকের রুচির বদল হয়নি। রমজান মাসে ফুটপাতে যে পরিবেশে ইফতারি বেচাবিক্রি সেটা খায় কারা। সেটা খায় এদেশের অন্তত ৯০ শতাংশ মানুষ। একই কারণে ফরমালিন যুক্ত ফল কিংবা ভেজাল খাবারে আমাদের কোন জোর আপত্তি আজও নেই। নিকট অতীতে এদেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতা আমাদের বলে দেয়- আমরা যেমন পেরেছি খেয়ে বেড়ে উঠেছি। বস্তুত কোন খাদ্যাভ্যাস আমাদের গড়ে উঠেনি। অখাদ্য কুখাদ্য আমরা না বলব, প্রত্যাখ্যান করব তা নয়। একটা তেল চকচকে, টসটসে খাবার দেখলেই অনেকের জিহ্বায় জল এসে যায়। জল আসা স্বাভাবিক। খাদ্যে রুচি থাকা চাই। আর আমাদের অনেকেই ইতিমধ্যে খুব কম সময়ে টাকা পয়সার বাড় বাড়ন্ত। শুধু টোকাই অমুক আর টোকাই তমুকই নয় কত টোকাইয়ের নাম মিডিয়ায় আসেনি যারা ফুটপাত থেকেও হয়ত খাবার কুড়িয়ে খেয়েছে। কিন্তু আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। কিন্তু খাদ্যে রুচির কোন পরিবর্তন হয়নি। তারা আজ জনগণের বৃহত্তর অংশ টাকা খরচের দিক থেকে যারা ফরমালিনের ফল কিনে খাচ্ছেই। ফরমালিন ওয়ালা ও ফল বিক্রেতাদের ২ নম্বরি ব্যবসার সুযোগ করে দিয়েছে। আর বিষের ব্যবসায় গোটা দেশ ছেঁয়ে গেছে। শুধু ফরমালিন ওয়ালারা কেন এদেশের প্রাণ কোম্পানির মত প্রতিষ্ঠান যাদের খাদ্য বিদেশ থেকে ফেরত আসে। আর তারা এখানে বেশ আদর কদর পাচ্ছে। রমরমা ব্যবসা করছে। তাদের আমে ফরমালিন, কার্বাইড পাওয়া যাচ্ছে। শুধু ফল বিক্রেতারাই কেন, বড় বড় দুধ বিক্রেতা কোম্পানি যারা ফরমালিন দিয়ে দুধ সংরক্ষণ করছে। কই, দুধের বেচা তো বন্ধ হয়নি। আমরা কেউ না করিনি। যাচাই করিনি কিনতে গিয়ে। দাবি করি না আমাদের টাকার বিনিময়ে ভেজাল ও বিষমুক্ত খাদ্যের। এমন কি এমন সব বিষাক্ত ফল বাজার থেকে কিনে ফল উৎসব করছে সচেতন মানুষ। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছুই হতে পারে না।
যে কারণে বাইরে বিষের কোন লক্ষণ চোখে না দেখলেই আমরা বগল বাজিয়ে কিনে খাচ্ছি। টোকাই অমুক থেকে উচ্চ পদস্থ চোরা আমলা সকলে। অশিক্ষিত টোকাই অমুক-তমুকের সঙ্গে দুর্নীতিবাজ শিক্ষিত আমলার মধ্যে বোধ-বিবেচনাগত কোন পার্থক্য নেই। আর ছোট শিশুদের জীবন ও ভবিষ্যত ধ্বংস করছি এসব কোমল ও স্বাদু পানীয়ের নাম। অথচ শিশুরাই তো এদেশের ভবিষ্যত।
আমরা টাকা কামাতে গিয়ে কেউ কারো কথা ভাবছি না। দেশের কথা ভাবছি না। ভাবছি না নিজের নীতির কথা। ধর্মের কথা। যে যাকে যেভাবে পারছে ভেতরে ভেতরে ক্ষতি করছে। নিজে বাঁচার চেষ্টায় কিংবা অন্যের চেয়ে বেশি টাকা বানানোর চেষ্টায়। আর মারহাবা ! রাষ্ট্র তো নিধিরাম সর্দার। কারণ । যেমন জনগণ তেমন সরকার। জনগণের ডিমান্ড যেমন হয়, তার সরকার তেমন চাহিদাই পূরণ করে। কথায় বলে শিশুর কান্না না করলে মাও দুধ দেয় না।