সুরেশ কুমার দাশ
বাস্তবে রোহিঙ্গাদের দিয়ে আমাদের কক্সবাজার উপকূলীয় অঞ্চলে যে বিশাল অপরাধের সা¤্রাজ্য বিস্তার ঘটেছে তার বড় অংশটা আমাদের সামনে উঠে এসেছে মানব পাচার বিষয় হিসাবে। এরপরও আমরা এ ব্যাপারে দৃষ্টি দিচ্ছি না। গোটা দুনিয়া যখন এ বিষয়টা জানল তখন আমরা যেন মিটি মিটি হাসছি। জাতি হিসাবে আমাদের লজ্জা শরম বলতে কিছু আছে তাও ভাবতে কষ্ট হচ্ছে। গোটা দুনিয়া জেনে গেছে আমাদের মানুষ দিনের পর দিন সাগরে ভাসছে। আমাদের কোনো নড়াচড়া নেই। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কিছু মানবপাচারকারিকে ধরছে। বন্দুকযুদ্ধে কয়েকজনের প্রাণ সংহার করা হয়েছে। বিভিন্ন সূত্র বলছে- পুলিশ আই ওয়াশ করছে। প্রকৃত পাচারকারীরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
মানব পাচারের সব দায় কি থাইল্যান্ডের। হিসাব করলে এর বেশিরভাগ দায় দায়িত্ব বাংলাদেশের। মিয়ানমারকে তো আমরা সেই অর্থে দায়িত্বশীল মনে করিনা। মানুষের বিরুদ্ধে যে অসভ্যতা মিয়ানমার করে যাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে অপারগ জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্র। যে কারণে মিয়ানমারের নাগরিক বলতে যা বোঝায় - তা তারা রোহিঙ্গা মুসলমানদের হিসাব করে না। তারা বলে আসছে রোহিঙ্গা মুসলমানরা বাংলাদেশের মানুষ। পুরনো কথা এটা। কিন্তু এটার ষোল আনাই কৈফিয়ৎ দিতে হবে বাংলাদেশকে। আর যারা এখানে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থকারী ছিল তাদেরকে। যেমন জাতিসংঘ। বাংলাদেশ যখন এসব রোহিঙ্গাদের জায়গা দিতে রাজী ছিল না-তখন অনেকটাই জোর করেছিল - জাতিসংঘ ও আমেরিকা। এদেশের ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’ পারলে রোহিঙ্গাদের ঘরে ডেকে এনে আঁচল দিয়ে মুখে মুছে দিতে প্রস্তুত। কেউ কেউ। সকলেই না। কিন্তু এই রোহিঙ্গাদের কারণেই কক্সবাজার পুরোটা অপরাধের স্বর্গরাজ্য হয়ে গেল। এটা একদিনের ঘটনা নয়, পুলিশ প্রশাসন এসব জানত। কিন্তু সেই জায়গাটা যারা সেখানে আইন শৃঙ্কলা রক্ষার দায়িত্বে আছেন তাদের জন্য একটি বিশাল ইনকাম সোর্স। ঢাকার এক একটি থানায় দায়িত্ব পাওয়ার জন্য পুলিশদের মধ্যে অনেক প্রতিযোগিতা হয়। এই পুলিশরা যদি এখন কক্সবাজারের কোন থানায় দায়িত্ব পায় তাহলে আর কথা নেই। তারা বগল বাজাবে। এতবড় ইনকামের জায়গা আর হয় না। আমি এ লেখায় যে কথাগুলো বলছি- পুলিশ অনেক অপরাধের জন্ম দেয়। এবং লালন পালন করে। এটার একটা কারণ টাকা কামানো। আমি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানি- ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে প্রায়ই পুলিশ জড়িত। যদিও তারা বলবে এ ব্যবসা তারা নির্মূল করতে চায়।
কিন্তু পুলিশ কিছুই না। ছাগল নাচে তো খুঁটির জোরে। কর্তা ঠিক থাকলে অপরাধে পুলিশ জড়িত থাকলেও অপরাধ বিস্তার লাভ করতে পারে না। কিন্তু আমাদের যারা কর্তা তারা বেশি দূর দেখেনা। তারা দেখতে চাই না। আমি বলছি- রোহিঙ্গা ইস্যুটাকে আমাদের যেভাবে সিরিয়াসভাবে নেয়া দরকার ছিল আমরা সেভাবে নিইনি। আমরা মানে - সরকার। একটা গা ছাড়া ভাব। মেনে নিলাম এটা। কিন্তু মানা তো যায় না।
গোটা পৃথিবী দেখছে বাংলাদেশ নামে যে দেশটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে চলেছে সেদেশের লোক দিনের পর দিন ভুখা-নাঙ্গা বুভুক্ষু অবস্থায় সাগরে ভাসছে। এমন দেশের এমন শক্তিশালী সরকার- যখন ইন্দোনেশিয়া আর মালয়েশিয়া তাদের উপকূলে ভিড়তে দিচ্ছে না - তখন সরকার ওইসব দেশের সরকারকে কোন অনুরোধও করছে না আমার লোকগুলো বাঁচাও। আমার দেশের লোক অসহায়- এতিমের মত পরিচয়হীন হয়ে সাগরে ভাসছে-আর সরকার অনেকটা নির্বিকার। একজন আর একজনকে দোষ দিচ্ছে। কিন্তু সব দায় জাতিসংঘের! শেষ পর্যন্ত জাতি সংঘের কথায় তারা কিছুটা রাজী হয়েছে।
আমরা বিশ্বের অর্থনৈতিক বিস্ময়। আমাদের নামে অমর্ত্য সেন গলাবাজি করে। অমুক পত্রিকা তমুক পত্রিকা আমাদের সম্ভাবনা নিয়ে রিপোর্ট করে। এগুলো আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদরা প্রায়ই বলেন। কিন্তু- আমাদের লোক সাগরে ভাসছে। এই অর্থনৈতিক বিস্ময়ের দেশের লোককে ইন্দোনেশিয়া আর মালয়েশিয়াও কোন সহানুভূতি ও পাত্তা দিচ্ছে না। তাদের সাগরে ডুবিয়ে মারতে তাদের কোন দ্বিধা নেই।
এই সাগরে ভাসমান লোকদের দেখে পৃথিবীর লোকের কাছে কি ধারণা হয়েছে। ইতালির উপকূল থেকে যে সব লোকগুলো অবৈধ অভিবাসী হিসাবে উদ্ধার করা হয়েছিল -তাদের কোন দেশ পরিচয় ছিল সামান্য কয়েকজনের। কিন্তু বেশিরভাগ আফ্রিকান লোক। সেখানে রাষ্ট্র হিসাবে কোন দেশকে হেয় প্রতিপন্ন হতে হয়নি। কিন্তু আমরা হেয় প্রতিপন্ন হলাম। দিনের পর দিন এ খবরগুলো বিশ্ব মিডিয়াগুলো ভালোমতই কাভার করেছে।
আমি ভাবছি। আমাদের তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ বলা হতো। এই যে সাগরে ভাসমান হাজার হাজার লোক দেখে- আমরা কি ভাবতে পারি। তলাবিহীন ঝুড়ি নাকি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার একটা মূলা। আসলে কোনটা সত্য। সত্য মিথ্যা বলার আগে বর্তমান বাস্তবতা সকলের সামনে উদ্ভাসিত। সবাই দেখল। যার মধ্যে দেশের মান সম্মানের চিন্তা আছে তাদের প্রত্যেকের এটা নিয়ে সোচ্চার প্রতিবাদ করা উচিত ছিল। কিন্তু আমাদের মান সম্মানের মাত্রা অতি নি¤œ পর্যায়ের। আমরা নিজেকে নিয়েই ভাবছি। ইজ্জত সম্মান শুধু নিজের জন্য। দেশের পরিচয়ও গৌণ। যারা বিদেশে থাকেন- তারা যখন এসব কথাগুলো বলাবলি করতে শুনবে তখন তো তাদের লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যাবার কথা।
আর এ ব্যাপারে দায় কেউ নিতে চায় না। না স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়, না পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, না কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। মালয়েশিয়া মানুষ পাঠানোর জন্য সরকার কথা বলে। এ ব্যাপারে কাজ করতে যাবে তখন কি কর্মসংস্থান মন্ত্রীর সঙ্গে মালয়েশিয়াদের মন্ত্রীদের নানা বিষয়ে কথা হবে না। তখনতো এ বিষয়টাও চলে আসবে। তখন উনার কি অবস্থা হবে। কতটুকু শিক্ষা গ্রহণ করলে শিক্ষিত হওয়া যায়। কতটা যোগ্যতা থাকলে রাষ্ট্রের দায়িত্ব নেয়া যায়। এগুলো খুবই ভাবার বিষয়। কারো পরিকল্পনায় কোন দূরদর্শিতা দেখা যায় না। আর মানবপাচার রোধের জন্য কোস্টগার্ডকে শক্তিশালী করার জন্য জলযান কেনার অনুমোদন দেয়া হয়েছে মন্ত্রীসভায়। সেটাই নাকি ব্যবস্থা। অর্থাৎ জলযান কেনা হবে। অতঃপর মানবপাচার বন্ধ হবে। এর আগ পর্যন্ত চালিয়ে যাও। কি চমৎকার দূরদর্শিতা।
অনেকেই খেয়াল করেছেন- মানবপাচার নিয়ে ইন্দোনেশিয়া আর থাইল্যান্ড যতটা সোচ্চার ছিল- তার জায়গায় বাংলাদেশের অবস্থানটা কি ছিল। বাংলাদেশের তৎপরতাটা কি ছিল। অথচ পাচারের শুরুটা বাংলাদেশ। বার্মা থেকে পাচার হয়েছে এমন কথা খুব কম শোনা গেছে। বার্মার রোহিঙ্গারা পাচার হয়েছে। যাদের তারা চাই না। বার্মার রোহিঙ্গাদের যে কোন দেশে যেতে চাওয়ার ইচ্ছাটা খুব স্বাভাবিক। যে দেশে তারা বসবাস করছে সেই দেশ তাদের জন্য ফুটন্ত কড়াই। সেখান থেকে অন্তত মালয়েশিয়া তারা যেতে না পারুক অন্তত সাগরে মরতে পারবে। তাহলে আমাদের মানুষ নিজদেশে পরবাসী রোহিঙ্গাদের ভাগ্য কেন বরণ করবে। আমাদের মানুষের সরকার আছে, রাষ্ট্র আছে। তারা বাংলাদেশের পরবাসী নয়। কিন্তু এটাই বাস্তবতা। এটাই আমরা দেখলাম। হিসাবে ধরলে এক অমোচনীয় লজ্জা। কিন্তু রাষ্ট্রেরে লজ্জা দেখা গেল না। কোন দায় নিয়ে কেউ কথা বলেনি। এখনো মালয়েশিয়া ইন্দোনেশিয়া থাইল্যান্ডের দিকে তাকিয়ে উদাসীন ভাব দেখাচ্ছে। এটা অন্যের ঘাড়ে বন্দুর রেখে শিকার করার মত। যেন বাংলাদেশ সরকার ওই সব দেশকে বুঝাতে চাইছে আমার দেশের মানুষের দেখভাল করার দায়িত্ব তোমাদেরও আছে।
আমাদের দায়িত্বহীনতার কথা বলতে গিয়ে পুলিশের কথা এসেছে। মানবপাচার এক দিন দুই দিনের ঘটনা মনে করার কোন কারণ নেই। এটা অন্তত ৩/৪ বছর ধরে তো চলছে। জানে না পুলিশ, কিংবা সরকার। থাইল্যান্ড জানার পর পরই তাদের ৪৫ জন অপরাধীকে গ্রেফতার করেছে। পুলিশসহ অন্যদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার ঘোষণা দিয়েছে।
কিন্তু যেখান থেকে শুরু সেখানকার অর্থাৎ বাংলাদেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কোন জবাবদিহিতা পর্যন্ত চাওয়া হয়নি। যারা পাচারকারি অপরাধী তাদের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি বা এরকম কিছু সরকার নিজের হেফজতে নেবে এ ধরনের কোন ব্যবস্থা পর্যন্ত নেয়নি। তাহলে ওইসব পাচারকারিরা কি সরকার খুঁজলেই এসে ধরা দেবে- এমন আশা দুরাশা। বিভিন্ন খবরে বলা হচ্ছে প্রকৃত পাচারকারীদের আড়াল করছে আইন শৃঙ্খলাবাহিনী। তারা চুনোপুটিদের ধরছে। কিন্তু পাচারের হোতারা নিরাপদেই আছে।
আর শুরু থেকেই রোহিঙ্গাদের নিয়ে এদেশের এক অংশ মানুষের সহানুভূতি ছিল। তারা যদি সচেতন হয়- তারা এখন একটা মাত্র কারণে বাস্তবতা বুঝবে। আর মিয়ানরমার সীমান্তের যে নানা অপরাধ তা বিস্তারে তারা কতটা সহজ করে তুলেছে তা সেখানকার লোকজন জানে। তারপরও একটা ভালো খবর আছে- এসব রোহিঙ্গারা মালয়েশিয়া পারি দিচ্ছে ভালোই করছে- জঙ্গীদের সঙ্গে ভয়ঙ্করভাবে গাঁটছাড়া বাধেনি। হয়তো এমন খবর আসলে তা এরকম ভয়াবহভাবেই আসবে।