আজ বিকেলটা খুব এলোমেলো লাগে হিরণের । দুমদাম করে সন্ধ্যা ঢুকে পড়েছে বিকেলের মধ্যে । আলতোভাবে নেমে আসা আবছা অন্ধকারটা , ঘন অন্ধকারের আভাস দিচ্ছে। পার্টি অফিসের সামনে বাইকটা দাঁড় করিয়ে হালকা পথে ভিতরে ঢোকে হিরণ ।তাকে দেখেই কুটিল ভাবে হাসেন নীতিনদা । নীতিন রায় পার্টির ডাকসাইটে নেতা ।
ওনার চোখের দিকে সরাসরি চোখ রেখে হিরণ বলে ' যা বলার জলদি বলো নীতিনদা , আমার তাড়া আছে একটু ' । নীতিন রহস্যময় গলায় সুর টেনে বলেন ' কেনো রে ? এতো কিসের তাড়া ? আজও ওড়্বার কথা আছে নাকি ? উনি কথা শেষ করার আগেই ওনার দুতিন জন সাগরেদ বিশ্রীভাবে হেসে গেয়ে ওঠে ' লেড়কি বিউটিফুল কর গয়ি চুল '
তাদের দিকে তীক্ষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার ওনার দিকে চোখ ফেরায় হিরণ । নীতিনদা ওদের হাসিটা টেনে বলেন ' ব্ড্ড উড়ছিস আজকাল হিরু । আমার নজরে সব থাকে । ভালো মাছ গেথেছিস ছিপে! থুড়ি মৎস্যকন্যা! একেবারে মিল মালিকের মেয়ে! মনে রাখিস , আমার নজরে সব থাকে! ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাবি ভেবেছিস ? তোর মালিকের মেয়েকে কিছুতেই নতুন প্রজেক্ট করতে দেবো না ।এতোগুলো মিল শ্র্রমিকের ভাত মারতে দেবো না ........'
ওনাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই হিরণ কাটাকাটা ঠান্ডা স্বরে বলে ওঠে ' এখানে তোমার বক্তৃতা শুনতে আসিনি আমি । ওটা এখ্ন আমারও রপ্ত । তোমার দৌলতেই কলেজলাইফ থেকে করছি তো! তাই বক্তৃতার , বেস , টেম্পো ,পিচ ভালোমতো কন্ট্রোলে আছে আমার।আর শোনো , আরেকটা গ্রুপের কাছ থেকে টাকা খেয়ে বসে আছো । সেই খবরও আছে আমার কাছে । প্রথমে মানুষকে ক্ষেপিয়ে প্রজেক্টটা ভন্ডুল করবে , তারপর কিছুদিনবাদে মিলটা তুমিই বন্ধ করবে ! তোমার সব নীতি আমার জানা আছে নীতিনদা । সেটাই জানাতে এসেছি । তোমার তলবে আসিনি । আমাকে আর তলব করো না ।জানিয়ে গেলাম ।' তারপর পিছন ফিরে দরজার দিকে এগোয় সে । আর নীতিন প্রায় চেঁচিয়ে বলে 'বেশী বড় দাদা হতে যাস না । মনে রাখিস আমার চক্রবূহ্যে নিজের ইচ্ছায় আসা যায় কিন্তু বেরোনো যায় না । '
চকিতে ওয়ান শাটার জামার নীচ থেকে বের করে ধারালো গলায় হিরণ বলে ' তোমারই দেওয়া । আশাকরি ব্যবহারের প্রয়োজন পড়বে না!' এরপর হনহন করে বেরিয়ে যায় সে ।
বাইকে স্টার্ট দিতে দিতে সে অনুভব করে তার চোখ থেকে গরম বাষ্প বের হচ্ছে । এই সময় আকাশভাঙ্গা জল এসে মিশে যায় তার চোখের বাষ্পে । তারপর নীচে গড়িয়ে পড়ে , বইতে থাকে , বইতে বইতে পৌঁছে যায় কয়েক বছর পিছ্নে । সেদিনও এমনই ছিল বিকেলটা ঝড় আসতে পারে ভেবে ক্রিকেট প্র্যাকটিস থেকে একটু আগেই ফিরছিল সে ।
দূর থেকে দেখতে পেলো , তাদের একচালা বাড়ির সামনে একটা জটলা ।বাবা শ্রমিক ইউনিয়ন করেন, সর্বোচ্চ পদে না থাকলেও বেশীরভাগই ওনার কথা শোনে। দ্রুত পায়ে বাড়ির দিকে এগোল হিরণ। কাছে আসতে না আসতেই মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ শুনতে পেলো সে। সামনের ভিড়কে প্রায় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে যা দেখলো, সেই দৃশ্যর জন্য একবিন্দুও প্রস্তুত ছিল না হিরণ । সামনে তার বাবার দেহ পড়ে আছে। চারপাশ রক্তে ভেসে যাচ্ছে । তার আশপাশ থেকে কয়েকজন বললো, এলোপাথারি ছুরি চালিয়েছে। স্পটেই সব শেষ। ওই তো ডাক্তারবাবু আছেন। তুই জিজ্ঞেস কর। আমরা সব তোকেই ফোন করতে যাচ্ছিলাম। আমাদেরও মাথা কাজ করছে না রে!' সেদিন এসব কথার কোনো উত্তর দিতে পারেনি সে।
শুধু মনে আছে কেউ একজন বলেছিল ' আমরাও ছাড়বো না। দেখে নিস! '
যদিও ছাড়ার প্রয়োজন হয়নি!কারণ কেউ ধরাই পড়েনি। ক্ষতিপূরণ তো দূরে থাক বাবার প্রাপ্য টাকাই পুরোটা পায়নি তারা। তার বাবার নাকি ওনেক লোন ছিল । তা ঠিক! ক্রিকেট একাডেমীর জন্য আয়ের অতিরিক্ত খরচ করতে হতো হিরণের বাবাকে। তিনি সবসময় বলতেন ছেলের যখন ট্যালেন্ট আছে তখন যেভাবে হোক খরচ তিনি চালাবেনই। অনেকে তাই শুনে বলতো ' এ যে ডোবায় তিমির চাষ'! বাবা মৃত্যুর পর একথার মানে হাড়ে হাড়ে টের পেল হিরণ। একাডেমী কিছুটা কনসেশন তাকে দিয়েছিল ফি বাবদ। কিন্তু প্রতিদিন তাতে চলত না! সে তখন মাঝে মাঝে ভাবতো যে বাবা তার ডায়েটর জোগাড় কিভাবে করতেন! প্রাকটিস থেকে ফেরার পথে ভীষণ খিদের সময় খুব মনে হোতো কথাগুলো। তখন ১০টাকার মুড়ি খাওয়াটাও বিলাসিতা ছিল তার কাছে! ৫টাকা করে খেলে দুদিন খেতে পারবে এই হিসেবটাও করতে হোতো! প্রোটিন ডায়েট তো দূরে থাকুক ঘরে শাক ভাজার তেলেরও অভাব থাকতো, সেই সময়। অবশেষে একটা দোকানে কাজ পার্টটাইম ওয়েটারর কাজ নেয় সে। সাহায্য যে একদম পায়নি তা নয়। ক্লাব থেকে বলেছিল তোর কিটটা আর চলছে না। আমরা দেখবো কি করা যায় ।এবার স্পনসর আসা শুরু হবে। এসময়টা মন দিয়ে খেল।
কিন্তু ,বাস্তবের বাউন্সার সামলাতে গিয়ে মাঠের বাউন্সারের সাথে দেখা সাক্ষাৎ কমে এলোহিরণের । তখনই সবাই বলেছিল নিতীনদার কাছে যেতে। কারণ তার বাবারও নাকি ওনার সাথে ভালো সম্পর্ক ছিল। তাই, একদিন পৌঁছে গেছিল নীতিনদার কাছে। সুরাহার আশায়। স্পষ্ট মনে আছে তার। প্রথমে তো উনি বাবার খুব প্রশংসা করেছিলেন। তারপর তারিফ করতে থাকলেন হিরণের খেলার আর খেলার দৌলতে কলেজে ওর পপুলারিটির। এভাবে হঠাৎ করে উনি বলে উঠেছিলেন ' অপজিশন বড্ড ঝামেলা করছে। তোদের কলেজের হাওয়া ভালো ঠেকছে নাহ! তোর গ্রহণযোগ্যতা আছে। এবার তুই ইলেকশনে দাঁড়িয়ে যা!' হিরণ উত্তরে কি বলবে বুঝতে পারেনি। মৃদু স্বরে বলেছিল 'আমি? আমি তো কখনো.. তাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই নীতিনদা হাসি মিশিয়ে বলেছিল ' শুধু ট্যালেন্ট থাকলে হয় না। কাজে লাগাতে হয়। তোর এই জনপ্রিয়তাকে এনক্যাশ করতে শেখ। তবেই তো রিটার্ন দিতে পারবো। তুই আমাদের কাজে আসলে আমরাও তোর কাজে আসতে পারবো। সোজা কথা গিভ এন্ড টেক! আর এব্যাপারে তোকে কিছু করতে হবে না। যা করার আমরা করবো। তুই নেক্সট উইকে একটু মার খেয়ে নিস , বহিরাগতদের কাছে। চিন্তা নেই, আমি বলে দেবো। মেজর কিছু না।'
' মিঃ মিত্র , আপনি এখন কোথায় আছেন ?' নীতিনদার সেই মিল মালিকের মেয়ে পিয়া চ্যাটার্জ্জীর এই ফোনে , এক মুহূর্তে কয়েক বছর পিছন থেকে বর্তমানে চলে আসলো হিরণ ।
ক্রমশ .....।
( কয়েকদিন আগে একটা গল্প লিখেছিলাম । সেটা পড়ে - সাহসী সন্তান আরেকটি গল্প লেখার জন্য উৎসাহিত করেছিলেন । বিভিন্ন কারণে গল্প পোষ্ট করতে দেরী হোলো । তারউপর এটা গল্প বলে চিহ্নিত করার মতো মানসম্মত হয়েছে কিনা সেটাও জানিনা । তবু , এই লেখাটা ওনাকেই উৎসর্গ করলাম । )
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা এপ্রিল, ২০১৯ রাত ১১:৪৪