জীবনে সকল মানুষের দুঃখ বোধ আছে । যার যার দুঃখ বোধ তার তার কাছে । অন্য দুঃখ কে কেউ ছুঁতে পারে না । যে পারে সে মহামানব পর্যায়ের একজন মানব সন্তান । কিন্তু এই মানব সমাজের কিছু প্রজাতি আছেন তারা তাদের দুঃখ বোধ কে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারেন অনায়াসে । তাদের দুঃখ কথন শুনলে আপনার নিজেরে দুঃখ কে বড্ড ছেলে খেলা মনে হবে । সেই ব্যক্তির দুঃখ খানা কে মনে হবে পৃথিবীর একমাত্র দুঃখ , এর পরে আর অন্য কোন দুঃখ নাই । সেই ব্যক্তি আর কেউ নন, একজন লেখক । একজন লেখক পারেন তার দুঃখবোধ কে ইনিয়ে বিনিয়ে রাং তামাশায় পুর্ন করে মানুষের ভেতরে বীজ আঁকারে রোপণ করে তার দুঃখবোধ কে অন্যের দুঃখে পরিনিত করতে । আপনার বা আমার মনে হবে এমন একখানা আরামদায়ক দুঃখ সহজেই যা অনুভব করা যায় মাঝে মধ্যে ছুঁয়ে দেখা যায় (বইয়ের পাতায়) আপনার আশেপাশে দিবালোকের সূর্যের ন্যায় জ্বলমান থাকতে আপনি কি প্রয়োজনে নিজের দুঃখ কে এতো গুরুত্ব দিয়েছেন। আপনি নিজের কাছে নিজেই লজ্জায় পরে যাবেন । মনে মনে হয় তো তওবা আস্তাগফেরুল্লাহ পরে মাফ চেয়ে নেবেন । তারপর ব্যথিত হৃদয়ে লেখক দ্বারা রচিত দুঃখবোধ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবেন । দুফোটা আশ্রু বিয়গ করলেও অবাক হবো না । জাহান্নামে যাক নিজের তুচ্ছ দুঃখ।
যেহেতু লেখক কুলে প্রবেশাধিকার পাই নাই সেহেতু এমন সব রসগোল্লা মার্কা দুঃখবোধ নিজ ভান্ডে ভরপুর থাকা সত্বেও তা প্রকাশের ভংগির অভাবে কেবলি নিজেদের আস্তাকুরে বেচারারা ঠোক্কর খেয়ে মরছে । লেখক লেবেল খানা গায়ে লাগাতে পারি নাই তাই নিজ আয়েত্বে থাকা দুঃখবোধ কে পাঠকের মনের গভীরে শেয়াল কাটার মতো বা চোরা কাটার মতো বিধতে বা বিধাতে সম্পুর্ন অপারাগ হয়েছি । আজ তাই নিজের কিছু পায়ে ফোসকা পরা সম তিব্র ব্যাথা দায়ক বা গলায় কাটা বেধার মতো অসহ্য যন্ত্রনা দায়ক কিছু দুঃখ প্রকাশ করবো । যাহা পাঠক হৃদয়ে জায়গা করে না নিতে পারলেও কিঞ্চিত খোঁচা সম্ভাবত সৃষ্টির অপচেষ্টা করবে।
দুঃখবোধ নম্বর- একঃ
সময়টা ছিলো ১৯৯৩ সালের মাঝামাঝি । পিতা তার উপরে অর্পিত দায়িত্ব নিয়ে সাত সমুদ্র তেরো নদী পারে গেলেন । যাবার সময় সকল প্রান কে কাঁদিয়ে গেলেন কেবল আমি ছাড়া । কারন পিতার বহিরবিশ্বে গমন অর্থ আমার কিছু উপকৌঠন লাভের সমূহ সম্ভাবনা । আমি হাসিমুখে তাকে বিদায় দিতে যথা সম্ভব কম লম্ফযম্ফ দিয়ে বিমান অবতরন কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে গেলাম। সাথে যাহারা ছিলো তারা মনের সুখ মিটিয়ে কেঁদে গেলো । সে কি কান্না উথাল পাথাল কান্না । কারো আঁচল কারো জামার হাতা কারো মাফলার ভিজে গেলো । পিতা অবাক চোখে প্রস্থদেশ উর্ধে তুলে দুই পা কে যথাসম্ভব বিভিন্ন কারুকর্যে বেকিয়ে নাড়িয়ে আমার আজব নৃত্য চেষ্টা দেখে খানিক রুষ্ঠ হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন কি আনবো , উত্তর একদম প্রস্তুত। সেই সময় ছোট এক প্রকার টেপ রেকর্ডার পাওয়া যেতো । যার সাথে হেড ফোনের মতো কিছু একটা ছিলো যার কান গুলো বেশ গোল গোল আকর্ষনীয় ছিলো । বন্ধুদের অনেককেই দেখতাম তারা কানে হেডফোন গুঁজে জন ডেনভার বা মাইকেল জ্যাক্সান শুনতে শুনতে মাথা আর কোমড় দোলাতে । তাই বিনা চিন্তায় বলে দিলাম অমন একখানা রেকর্ডার চাই । ওমনি মেয়ে মহল থেকে তিব্র প্রতিবাদ এলো, না না ওতে কান নষ্ট হয়ে যায় এবং যথারীতি কার কার কান কি কি ভাবে নষ্ঠ হয়েছে তার বিবরন প্রকাশ পেয়ে গেলো । ফলাফল রেকর্ডার বাতিল । মুখ চুন করে চাইলাম ক্যামেরা । সময় টা ছিলো ক্যামেরার , ক্রেজ ছিলো আকশ ছোঁয়া। মেয়ে মহলে ক্যামেরা ম্যানের বেশ কদর আদর ছিলো ব্যপক মাত্রায় । আমারো এমন আদরের ভাগ বসাতে বেশ ইচ্ছে ইচ্ছে হলো । প্রথম আবদার বাতিল হবার পরে ক্যামেরা চেয়ে বসলাম । এতে অন্তত কর্ন কুহরের কোন অপঘাত হবার সম্ভাবনা নেই ।
বিঁধিবাম । মাতাশ্রী তারা কিন্নরকন্ঠ কে কাজে লাগিয়ে বলে দিলেন । দামি জিনিস এনে নষ্ট করার কোন মানে হয় না । অযথা টাকা নষ্ট । এর থেকে খেলনা গাড়ি আনলেই চলবে । আমার তখন প্রেমে হাবুডুবু খাবার বয়স খেলনা গাড়িতে কি আর মন ভড়ে ? শেষ চেষ্টা বলে দিলাম ক্রিকেট ব্যাট আনতে । যেহেতু দেশ খানা রাজার দেশ । উইলো গাছের ভরপুর উৎপাদন । এক খানা ব্যাটা তো আমার পাওয়াই উচিৎ । সময় নষ্ট না করে বলে দিলাম ক্রিকেট ব্যাট । এটাই ফাইনাল ডিসেশান । পিতার আমার খেলা ধুলার প্রতি তেমন মোহ কোন কালেই ছিলো না । তো ক্রিকেট ব্যাট চাওয়া যে বুমেরাং হবে এটা বুঝতে বুঝতে পিতা তার উড়ুক্কু যানে চড়ে রাজার দেশে চলে গেলেন ।
বুকের ভেতর আশা নিরাশা নিয়ে দিন কাটাচ্ছি । প্রতি মাসে এক খানা পত্র আসতে । তাতে কেবল বিভিন্ন উপদেশ মূলক বাক্যবান আর কুশল বিনিময়ের বাক্যমালায় সজ্জিত থাকতো । ক্রিকেট ব্যাটের কোন খবর নাই । বন্ধুদের কাছে বলে রেখেছি ক্রিকেট ব্যাট এলে পাশের বিল্ডিঙ্গের দলের সাথে ম্যাচ পাতাবো । সবাই মোটামুটি সমিহ করে চলছে । আস্ত একখানা উইলো গাছের ব্যাটের মালিক হওয়া চাট্টিখানি কথা নয় একদম । হাতে চিঠির খাম দেখলেই বন্ধুদের অনেকেই জিজ্ঞাস করতো ব্যাটের আগমনের সময় আর কতো দূর। পাশের বিল্ডিঙের দলের মুখ ভয়ে চুন হয়ে আছে । শুধু মাত্র এক খানা ভালো ব্যাটের অভাবে ওদের হারাতে পারি নাই কখনোই । এইবার হার নিশ্চিত । আড়ালে আবডালে শোনা গেলো তাদের কোন মামা রাজার দেশের থালাবাটি মাজে তার কাছে অনুরোধ করেছে একটা ব্যাটের । উইলো কাঠের হবে না নিশ্চিত । শিকড় বাকড়ের কিছু একটা হবে ।
লোক মুখে শোনা যায় । পিতা তার প্রতি দায়িত্বের ভাড় সফল ভাবে সম্পন্ন করে প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিচ্ছেন । তিন খানা নৌযান কে পরিচালনা করে তীরে ভেড়াবার কাজে ন্যাস্ত আছেন । আমার হৃদয় বন্দর ও অপেক্ষায় আছে উইলো গাছের ক্রিকেট ব্যাটের । আমার আগ্রহ বাড়ে আর প্রতিপক্ষের মুখে চুন জমে দৈ হয়ে যায় । কারন তাদের ব্যাটের কোন সংবাদ হাতে নাই । শোনা গেলো জাহাজ তিন খানার দুই খানায় পানি ঢুকে গেছে । সবাই বেশ চিন্তিত । আমিও চিন্তিত । ব্যাটে পানি লাগলে নষ্ট হয়ে যাবে । ব্যাটে যেনো কোন ভাবেই পানি না লাগে। তার উপরে নোনা পানি । পিতা তার সকল কলা কৌশল প্রয়গ করে নৌযান তিনখান কে নিজ দেশের বন্দরে ভিড়ালেন। সকলে আনন্দে উচ্ছাস প্রকাশ করতে লাগলো । কেউ কেউ আমাকে এসেও শুভেচ্ছা জানালো । আমি লোক দেখানো একটা মর্কট মার্কা হাসি দেখিয়ে দেখালাম আমিও খুশি ।
তরী তীরে ভেড়ার সাত দিন পর পিতা একখানা বিশাল বাক্স নিয়ে গৃহে প্রবেশ করলেন । মুহুর্তে আমার কর্ন গহব্বরে সংবাদ পৌছে গেলো । আমি ছিলাম খেলার মাঠে । বিনা বাক্য ব্যায়ে বাড়িতে নিজের দেহ খানা রাখলাম। যা এই আট মাসে কালে ভাদ্রে রেখেছি । পিতা এই গল্প তো সেই গল্প করেন । আসল কাজ করেন না । অনেক গল্প হবার পর যখন ধৈর্যের বাধ আর নিতে পারছিলো না তখন বাক্সের মুখ খুললেন । এর জন্য তার জন্য একটা একটা করে পন্যের আগমন হচ্ছে তারা খুশিতে হই হই করে উঠছে । অবশ্য তারা বলতে আমার ভাতৃ । তার উপহারের বন্যা জলচ্ছাস ভুমিকম্প সুনামি সাইক্লন বয়ে যাচ্ছে । আমার আশার বাতির আগুন একবারের জন্যও চামকাচ্ছে না । উপহার শেষ হতে হতে তলদেশ থেকে একখানা জ্যাকেট বের হলো যার সাইজ আমার থেকে দেড় গুন বড় । উহা আমার হাতে দিয়ে বলা হলো ইহাই আমার উপহার। চোখ বুক সব ফেটে কান্নার আইলা ছুটে গেলো । ভবিষ্যত অপমান অপদস্তের কথা ভেবে কান্নার মাত্রা বেড়ে গেলো আরো বেশি । তারপরেও পুরুষ মানুষের সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত হয়ে কান্না চেপে আশায় বুক বাধলাম এর পর হবে ক্রিকেট ব্যাট । কপাল খারাপ এরপর অনেক কিছুর আড়ালে বের হলো অদ্ভুত দর্শনের এক প্রকার জুতা । যা না চামড়ার তৈরী না রেক্সিনের এবং উহাই আমার ভাগ্যে স্থান নিয়ে দুই হাতে চমকাইতে লাগলো ।
গলার ভেতর তিব্র খেদ ও অভিমান নিয়ে স্বল্প স্বরে বলার চেষ্টা করলাম । ক্রিকেট ব্যাট কি নাই ? উত্তর ওখানে ক্রিকেট ব্যাট পাওয়া যায় না । কি পরিহাস , কি নির্মম পরিহাস, কি মর্মান্তিক বেদনা দায়ক উপহাস। ক্রিকেটের সুতিকাগারে ক্রিকেটের ব্যাট পাওয়া যায় না । ইংল্যান্ডে ক্রিকেট ব্যাট পাওয়া যায় না এটা কি ধরনের কথা , এমন কথা বলা মাত্রই মাতার পরিহাসের সাথে ধমক মিশ্রিত কান মোচর চুপ , পাওয়া যায় না ব্যাস পাওয়া যায় না । এতো কথা কিসের? অদ্ভুত দর্শন জ্যাকেট ও জুতা হাতে নিয়ে এক কোনায় বসে থেকে নিরবে আশ্রু ত্যাগের চেষ্টা করতে লাগলাম কিন্তু ওটাও হলো না দেখে ফেলার ভয়ে। পরে শুনেছিলাম টেপ রেকর্ডার ও ক্যামেরা আনা হয়েছিলো গোটা তিনেক যার সব আমার খালাতো ভাইরা নিয়ে ফুর্তি ফার্তি করছে। দুঃখবোধের সাথে বন্ধু কর্তৃক অপমানের বোঝা মাথায় নিয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দিলাম ।
চলবে ................।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে নভেম্বর, ২০২৩ রাত ২:৫১