somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রেলওয়ে দূর্নীতির উপর প্রথম আলোর প্রতিবেদন: গতি পাচ্ছে না রেলওয়ে

০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সকাল ৯:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



গতি পাচ্ছে না রেলওয়ে—১ এত বিনিয়োগ তবু লোকসান:

বিপুল বিনিয়োগ সত্ত্বেও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছে না রেলওয়ে। গত সাত বছরে ৩১ হাজার কোটি টাকা খরচ করেও গতি বাড়েনি রেলের। সেবা না বাড়লেও সাম্প্রতিক সময়ে দুই দফা ভাড়া বেড়েছে। এরপরও বাড়ছে লোকসান।
দীর্ঘদিন ধরে রেলে বিনিয়োগের হাহাকার ছিল। ছিল লোকবলের স্বল্পতা। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠনের পর থেকে রেলে অর্থায়ন বাড়তে থাকে। গত পাঁচ-ছয় বছরে ১০ হাজারের বেশি লোক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। রেলওয়ের বিভিন্ন নথি থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
উন্নয়ন প্রকল্পসংক্রান্ত নথি অনুসারে, বর্তমানে রেলে উন্নয়ন প্রকল্প চলমান আছে ৪৮টি। এসব প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৯৮ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্পগুলোর কিছু কিছু বাস্তবায়ন হওয়ার পথে। কিছু মাঝপথে আছে, আর কিছু কিছু প্রকল্প অনুমোদন হয়ে আছে। গত সাত বছরে ৪০টি প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে।
২০১৫-১৬ অর্থবছরে রেলের আয় হয়েছে ১ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। এ সময় শুধু রেল পরিচালনার জন্য ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে পরিচালন লোকসানই হয়েছে ১ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। আর প্রকল্পের ব্যয় ধরলে লোকসান বেড়ে যাবে কয়েক গুণ।এত বিনিয়োগ সত্ত্বেও রেলওয়ের সেবা বাড়ছে না, বাড়ছে লোকসান। কেন? জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও বহুমুখী পরিবহন ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, রেলওয়ের এই বিনিয়োগ পরিকল্পিত নয়। যাত্রী বৃদ্ধি, আয়বর্ধক ও লাভজনক—এই তিন বিবেচনায় প্রকল্প নেওয়া হয়নি। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নানা বিবেচনা কাজ করেছে। তা ছাড়া আয়ের যে বিপুল সম্ভাবনা, তা ধরার কোনো উদ্যোগই নেই। দেশে এখন বছরে ২৩ লাখ কনটেইনার মালামাল পরিবহন হয়। এর ৯৩ শতাংশই হয় সড়কপথে। রেলওয়ে কেন পারবে না? এভাবে একটা প্রতিষ্ঠান মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে না।
তবে লোকসানের বিষয়ে মোটেও বিচলিত নন রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, রেল একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। লোকসানের কথা বিবেচনা না করে শতভাগ সেবা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। তাঁর আশা, চলমান ৯৮ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে লোকসান কমে আসবে। ২০১৮ সালের মধ্যে রেলের উন্নতি দৃশ্যমান হবে। আর ২০২০ সালের মধ্যে রেলের চেহারা পাল্টে যাবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রেলে ব্যয় হয় দুই ধরনের। একটি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে, অন্যটি অনুন্নয়ন খাতে অর্থাৎ রেল পরিচালনায় দৈনন্দিন খরচ। উন্নয়ন বাজেটের অধীনে যে প্রকল্প সমাপ্ত হয়েছে এবং চলমান আছে—এর বেশির ভাগই নতুন রেললাইন ও সেতু নির্মাণ, ইঞ্জিন-বগি ক্রয়, অবকাঠামো নির্মাণ-সংক্রান্ত। অনুন্নয়ন খাতে বেশির ভাগ ব্যয় হয় রক্ষণাবেক্ষণ ও বেতন-ভাতায়।
২০০৯ সালের জুলাই থেকে গত বছরের জুন পর্যন্ত সাত বছরে রেলে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হয়েছে ১৭ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা। এসব অর্থ এসেছে বিদেশি ঋণ-সহায়তা ও সরকারের বাজেট থেকে। বিদেশি ঋণ ও সহায়তাদানকারী দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভারত। চীন অর্থ ছাড় না করলেও প্রস্তাবিত প্রকল্প ধরলে সবার ওপরে চলে যাচ্ছে চীন। আর এ সময় ট্রেন পরিচালনায় দৈনন্দিন ব্যয় হয়েছে ১১ হাজার ৬২৩ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে এই সাত বছরে রেলে ব্যয় হয়েছে ২৯ হাজার ৭৪ কোটি টাকা। এই সময় রেল আয় করেছে ৫ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা। ঘাটতি প্রায় ২৩ হাজার ৭০৩ কোটি টাকা।

রেলওয়ে সূত্র বলছে, ঋণ নিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রকল্পের পেছনে ব্যয় করা হচ্ছে। এগুলো সুদে-আসলে ফেরত দিতে হবে। যখন ঋণের কিস্তি বেড়ে যাবে, তখন দেখা যাবে রেলের আয়ের চেয়ে ঋণের কিস্তির পরিমাণ বেশি।

গত পাঁচ বছরে রেলের ভাড়া দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। এখন রেলের আন্তনগর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত (এসি) শ্রেণির ভাড়া ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনা পথে চলাচলকারী বিলাসবহুল বাসের প্রায় সমান।

রেল কর্তৃপক্ষ প্রতিবছরই আয়-ব্যয়ের হিসাবসহ নানা তথ্যসংবলিত একটি বই প্রকাশ করে। ঋণ ও সরকারের খরচে যেসব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়, এর ব্যয় বইয়ে উল্লেখ করা হয় না। শুধু রাজস্ব খাতের ব্যয় এবং আয়ের হিসাব দিয়ে লাভ-লোকসান দেখানো হয়। এটাকে তারা বলে পরিচালন মুনাফা। কিন্তু স্বাধীনতার পর রেল পরিচালন মুনাফা দেখাতে পারেনি।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, বিপুল বিনিয়োগের পরও রেলে ইঞ্জিন-বগির সংকট যায়নি। বর্তমানে রেলে ২৭৮টি ইঞ্জিন রয়েছে। এর ৫৪ শতাংশের বয়স ৩৫ থেকে ৬৩ বছর। একই অবস্থা বগিরও।

২০০৫ থেকে ২০১১—এই সাত বছরে কোনো ইঞ্জিন কেনা হয়নি। গত পাঁচ বছরে কেনা হয়েছে ৪৬টি ইঞ্জিন। অন্যদিকে ২০০৬ সালের পর প্রায় এক দশক বগি কেনা হয়নি। ইন্দোনেশিয়া ও ভারত থেকে ২৭০টি নতুন বগি কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ বগি এসেছে।

তবে রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমান সরকার যেভাবে রেলে বিনিয়োগ করছে, সেই তুলনায় ইঞ্জিন-বগি কেনার প্রকল্পগুলোতে গুরুত্ব কমই দেওয়া হয়েছে। একাধিক প্রকল্প চলমান থাকলেও আগামী দুই বছর নতুন ইঞ্জিন-বগি পাওয়ার সম্ভাবনা কমই। কারণ, এসব প্রকল্পের বেশির ভাগেরই অর্থায়ন নিশ্চিত হয়নি। যেগুলোর হয়েছে, সেগুলোতে ঠিকাদার নিয়োগ হয়নি।

সূত্র আরও জানায়, প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে শুধু অবকাঠামো উন্নয়নে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আর এসব অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের ৮০ শতাংশেরই ঠিকাদার দুটি প্রতিষ্ঠান। এগুলো হচ্ছে ম্যাক্স ও তমা গ্রুপ। তমা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান ভূঁইয়া গত বছর নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হয়েছেন।

রেলের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিপুল অর্থ পেয়ে রেলের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড় হয়ে গেছে। এ জন্যই সাধারণ ইঞ্জিন ও বগির সংকট দূর না করে সবার আগে চীন থেকে ডেমু ট্রেন কেনা হয়েছে। পরে ডেমু একটি অজনপ্রিয় ট্রেনে পরিণত হয়। প্রকল্প নেওয়া থেকে শুরু করে নতুন ট্রেন চালু, এমনকি কোন স্টেশনে ট্রেন থামবে—সবকিছুই রাজনৈতিক ও ব্যক্তি বিবেচনা থেকে নেওয়া হয়েছে।
সেবা কি বেড়েছে?

শুধু কি লোকসান? রেলমন্ত্রী রেলকে সেবামূলক বললেও সেবা বাড়েনি মোটেও। সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেন ২০০০ সালে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাতায়াত করত পাঁচ ঘণ্টায়। ১৬ বছর পর এখন ওই ট্রেনের নির্ধারিত সময় ছয় ঘণ্টা। কখনো কখনো এই সময়ও মেনে চলে না। নতুন কোচ দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম পথে চালু করা সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ট্রেনেরও নির্ধারিত সময় পৌনে ছয় ঘণ্টা। উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ট্রেনের যাত্রা সময় তো আরও বেশি।

ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা খরচ করে নতুন লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। চট্টগ্রামের চিনকি আস্তানা থেকে আশুগঞ্জ পর্যন্ত বিদ্যমান রেলপথ সংস্কারের ৩০০ কোটি টাকার প্রকল্প প্রায় শেষ। অথচ এই পথ দিয়ে চলা কোনো ট্রেনের গতি বাড়েনি।

রেল পরিচালনার টাইম-টেবিল বই অনুসারে, ২০০১ সালে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের প্রায় পুরোটাতেই ৮০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচল করত। শুধু কুমিল্লার সদর রসুলপুর এলাকার কিছু অংশে ৭২ কিলোমিটার গতি ছিল। এখন পুরো পথেই ৭২ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলে।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, সম্প্রতি টঙ্গী-ভৈরব পথে নির্মাণ করা নতুন রেললাইন দিয়ে ট্রেন চালিয়ে গতি পরীক্ষা করেন রেলের কর্মকর্তারা। ওই ট্রেনে রেলের মহাপরিচালক নিজেই অবস্থান করছিলেন। এই পথে ট্রেন ৮০ কিলোমিটার গতিতে চালানোর নির্দেশনা দিলেও সেই গতি তোলা যায়নি। একজন কর্মকর্তা বলেন, বর্তমান ইঞ্জিন দিয়ে চালালে ৮০ কিলোমিটার গতি তোলা কঠিন। আবার রেলের লাইন মেরামতে এতই ফাঁকিবাজি হয়েছে যে, গতি তুলতে গেলেই ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, ১৮০ কোটি টাকায় ময়মনসিংহের গৌরীপুর থেকে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইন সংস্কার করা হয় ২০১৩ সালে। প্রকল্প নেওয়ার সময় বলা হয়েছিল, বাস্তবায়ন শেষে এই পথে ৬৫ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলবে। কিন্তু এখন চলে ৫০ কিলোমিটারেরও কম গতিতে।

লাকসাম থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত বিদ্যমান রেললাইন পুনর্বাসনে ১৭০ কোটি টাকার প্রকল্প চলছে। ৮০ শতাংশ কাজ শেষ। কিন্তু ওই পথে ট্রেনের গতি বাড়েনি, বরং কমানোর চিন্তা করা হচ্ছে।

রেলের নথিপত্রে আন্তনগর ট্রেনের ৯০ শতাংশ সময় মেনে চলছে বলে দেখানো হয়েছে। আসলে প্রতিটি ট্রেনেরই চলাচলের সময় বৃদ্ধি করা হয়েছে। ফলে দেরিতে চললেও তা পুষিয়ে নেওয়া যায়। এ ছাড়া বাস্তবতা হচ্ছে, আধা ঘণ্টা দেরিতে চলা ট্রেনকে সময় মেনে চলা হিসেবেই গণ্য করে রেল কর্তৃপক্ষ।

ট্রেন পরিচালনা-সংক্রান্ত দৈনন্দিন হিসাব থেকে দেখা গেছে, ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা ঘটলে পুরো সপ্তাহের ট্রেন চলাচলের সময়সূচি উল্টে যায়। তখন আট ঘণ্টা পর্যন্ত দেরিতে ট্রেন চলে। আর রেলে দুর্ঘটনার ৯০ শতাংশই লাইনচ্যুতির ঘটনা। চলতি বছরের প্রথম ১১ মাসে রেলের পূর্বাঞ্চলেই ৪৮টি লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে। বিপুল বিনিয়োগের পরও এভাবে লাইনচ্যুতির ঘটনাকে অস্বাভাবিকই মনে করেন রেলের অনেক কর্মকর্তা।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি যাত্রী হিসেবে বলতে পারি, রেলে সেবা বাড়েনি। গতিও আগের মতোই আছে। বিপুল বিনিয়োগের পরও এক জায়গায় আটকে থাকার কারণ হতে পারে, বিনিয়োগ পরিকল্পিত হয়নি। আবার লুটপাটের কারণেও এমনটা হতে পারে। কারণ, বাংলাদেশে বড় প্রকল্প মানে বড় দাঁও মারা। রেলেও এমনটা হয়ে থাকতে পারে।

এ বিষয়ে রেলমন্ত্রী বলেন, বিএনপি-জামায়াতের আমলে রেলপথে কোনো বিনিয়োগ হয়নি। এখনো অনেক লাইন জরাজীর্ণ। ফলে গতি বাড়াতে গেলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকে যায়। এখন সময়মতো ট্রেনের যাতায়াত নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে। গতিও বাড়বে আস্তে আস্তে।

কেন এগোচ্ছে না?

রেলের কর্মকর্তা, রেল নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে রেলের এই দুরবস্থার পেছনে তিনটি বড় কারণ পাওয়া যায়। এগুলো হচ্ছে দুর্নীতি, অদক্ষতা ও অপরিকল্পিত প্রকল্প গ্রহণ।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, রেলে গত কয়েক বছরে যে পরিমাণ বিনিয়োগ ও প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়নের মতো দক্ষ কর্মকর্তার অভাব রয়েছে। আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে, যাত্রী সুবিধা বা আয়বর্ধক প্রকল্প না নিয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ কেনাকাটার প্রকল্প নেওয়া। এ ক্ষেত্রে রাজনীতিক, ঠিকাদার ও কর্মকর্তাদের ব্যক্তিস্বার্থ কাজ করেছে।

প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে পরিকল্পনার যে অভাব রয়েছে, তা রেলওয়ের যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের চিত্র থেকেই স্পষ্ট। রেল পরিচালনা-সংক্রান্ত বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, গত অর্থবছরে রেল যাত্রী পরিবহন করেছে সাত কোটি। আগের বছরের তুলনায় ৫ শতাংশ বেশি। যা রেলের নিজেরই ঠিক করা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৬ শতাংশ কম।

রেলের হিসাব বলছে, গত বছর যে পরিমাণ যাত্রী বেড়েছে, তা গতানুগতিক। কারণ, গত এক দশকে রেলের যাত্রী ৫-৬ শতাংশ কম-বেশি হচ্ছে। কখনো এক বছর বেড়েছে, আবার পরের বছর কমেছে। কখনো দুই বছর বৃদ্ধির পর এক বছর কমে গেছে। একই অবস্থা মালামাল পরিবহনের ক্ষেত্রেও। তবে মালামাল পরিবহনের বৃদ্ধির চেয়ে কমার প্রবণতাই বেশি।

রেলের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে যাত্রী ও মালামাল পরিবহনে বড় অর্জন না হওয়ার পেছনে কতগুলো কারণ পাওয়া গেছে। মূল সমস্যা ইঞ্জিন ও বগির স্বল্পতা। ২০১৪ সালের আগে প্রায় এক দশক ইঞ্জিন ও বগি কেনা হয়নি বললেই চলে। এখন অবশ্য ইঞ্জিন-বগি আসছে, তবে পুরোনো ইঞ্জিন-বগি অকেজো হওয়ার পর। ২০০৯ সাল থেকে বিপুল পরিমাণ বাজেট বরাদ্দ করলেও শুরুতে যেসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, এর বেশির ভাগই রেললাইন ও সেতু নির্মাণ, স্টেশন আধুনিকায়ন আর মেরামতের কাজে।

একমাত্র ইঞ্জিন ও বগি কেনার একটি প্রকল্পই দ্রুততার সঙ্গে করা হয়েছে, তা হচ্ছে ডেমু প্রকল্প। চীন থেকে প্রায় ৬০০ কোটি টাকায় ২০টি ডেমু কেনা হয়েছে। এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে রেলেই তুমুল বিতর্ক আছে।

রেলের টিকিট বিক্রির পদ্ধতিও যাত্রীবান্ধব নয় বলে মনে করেন যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলো। রেলের কর্মী, সেনাবাহিনী ও বিচারপতির জন্য ১০ শতাংশ টিকিট সংরক্ষণ করে রেলওয়ে। তবে এই ঘোষিত সংরক্ষণের বাইরে প্রায় অর্ধেক টিকিটই কম্পিউটারে ব্লক করে রাখা হয় ভিআইপি ও ভিভিআইপিদের জন্য।

রেলমন্ত্রীর দাবি, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ, ঢাকা-চট্টগ্রাম পথের পুরোটা দুই লাইন এবং আরও কিছু নতুন লাইন নির্মাণ সম্পন্ন হলে যাত্রী ও মালামাল পরিবহন বেড়ে যাবে।

রেল যোগাযোগের অবস্থা

স্বাধীনতার পর উত্তরাধিকারসূত্রে বাংলাদেশ যে রেললাইন পেয়েছে, ৪৫ বছরে তা বেড়েছে মাত্র ১৯ কিলোমিটার। রেলের পথকে বলা হয় রুট কিলোমিটার বা মোট রেলপথ। আর রেলপথের কোথাও কোথাও একাধিক লাইন রয়েছে। রেলপথে থাকা সব লাইনের যোগফলকে বলে গজ কিলোমিটার বা রেললাইন। স্বাধীনতার পর রেললাইন কমেছে ৩৫৫ কিলোমিটার। মূলত সরকারি গুদাম ও বন্দর-ঘাটের সঙ্গে সংযোগকারী অনেক রেলপথ বন্ধ হয়ে গেছে।

স্বাধীনতার সময় রেলপথ ছিল ২ হাজার ৮৫৮ কিলোমিটার। এখন রেলপথ আছে ২ হাজার ৮৭৭ কিলোমিটার। আর বর্তমানে রেললাইন আছে ৪ হাজার ৯৩ কিলোমিটার। স্বাধীনতার সময় রেললাইন ছিল ৪ হাজার ৪৪৮ কিলোমিটার।

বর্তমানে দেশের ৪৪ জেলায় রেল যোগাযোগ রয়েছে। এর মধ্যে ৭টি জেলায় ১০০ কিলোমিটারের বেশি রেলপথ আছে। এই জেলাগুলো হচ্ছে চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, মৌলভীবাজার, লালমনিরহাট, জামালপুর ও কুমিল্লা। এসব জেলায় স্টেশনও বেশি।

রেলে তিন ধরনের ব্যবস্থা চালু আছে। এগুলো হচ্ছে মিটারগেজ, ব্রডগেজ ও মিশ্রগেজ। প্রতিটির কারিগরি দিক আলাদা। ফলে রেল পরিচালনায় সমন্বয় করা কঠিন। রেলের পূর্বাঞ্চলের প্রায় পুরোটাই মিটারগেজে চলে। আর পশ্চিমাঞ্চলে মিটারগেজ ও ব্রডগেজ ট্রেন চলে। ভারতসহ বিভিন্ন দেশে মিটারগেজ লাইন তুলে দেওয়া হচ্ছে।

করণীয় সম্পর্কে অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, রেলকে বাঁচাতে হলে মালামাল পরিবহন বাড়াতেই হবে। এখন সব চাপ পড়ছে সড়কে। এভাবে সড়কে চাপ বাড়লে সড়কও ভেঙে পড়বে। তাই রেলে মালামাল পরিবহন বৃদ্ধির জন্য অবকাঠামো নির্মাণের পাশাপাশি দ্রুত একটি করপোরেশন গঠন করতে হবে। পাশাপাশি সরকারের এমন কিছু নীতি-সুবিধা ঘোষণা করতে হবে, যাতে রেলে মালামাল পরিবহনে সবাই উৎসাহী হয়। আর যাত্রী পরিবহন বাড়ানোর একটাই পথ, তা হচ্ছে সেবা বৃদ্ধি। এ জন্য কিছু কিছু সেবা সরকারি-বেসরকারি যৌথ ব্যবস্থাপনার ওপর ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে।

ইঞ্জিন-বগির সংকটে ট্রেন চলছে ধুঁকে ধুঁকে : ট্রেনের চলা–থামা যেন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে

নতুন ট্রেন কোথায় চলবে আর কোন স্টেশনে কোন ট্রেন থামবে—এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে নির্ধারণ হয়ে থাকে। মন্ত্রী-সাংসদদের চাহিদা মেনে ট্রেন নামানো ও থামানোর সিদ্ধান্তের কারণে লোকসানের পাল্লা আরও ভারী হচ্ছে।
সম্প্রতি ঢাকা-সিরাজগঞ্জ পথে চলাচলকারী সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটির পুরোনো বগি ফেলে ভারত থেকে আমদানি করা দুটি এসি বগিসহ একে নতুন করে সাজানো হয়েছে। আগে ট্রেনটি চলত সাতটি বগি নিয়ে, এখন ১২টি। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ও প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম উপস্থিত ছিলেন।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটি এত দিন একটি শোভন চেয়ার ও ছয়টি শোভন শ্রেণির বগি নিয়ে চলত। আসন ছিল ৪৭৪টি। গত বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত রেলের হিসাবে দেখা যায়, শোভন চেয়ারের ১০০ আসনের ৩০ শতাংশই খালি চলেছে। আর শোভন শ্রেণির বগিগুলোতে যাত্রী চলেছে ৯৭ শতাংশ। এখন ৪৮টি ঘুমানোর বার্থ ও ৭৪টি এসি আসন যুক্ত হচ্ছে। শোভন শ্রেণি বাদ দিয়ে পুরোটাই শোভন চেয়ার করা হয়েছে। আসন দাঁড়িয়েছে ৯৬৬টি। টিকিটের দামও বেড়েছে। নতুন এই ট্রেন ওই পথে চালানো দরকার ছিল কি না, তা নিয়ে বিতর্ক আছে রেলের কর্মকর্তাদের মধ্যেই।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, ট্রেনটি চালু করার ক্ষেত্রে সিরাজগঞ্জের প্রভাবশালী রাজনীতিকদের ভূমিকা ছিল। রেলওয়ের বর্তমান মহাপরিচালকের বাড়িও সিরাজগঞ্জে।
রেলের কর্মকর্তারা জানান, ট্রেনটি অলাভজনক হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। প্রথমত, সিরাজগঞ্জ বাজার পর্যন্ত অনেক আগে থেকেই রেললাইন ছিল। কিন্তু ঢাকা থেকে সরাসরি ট্রেন যেতে পারে না। ঢাকা থেকে বগুড়ার কাছাকাছি জামতৈলে গিয়ে ইঞ্জিন পরিবর্তন করে সিরাজগঞ্জ বাজারে যেতে হয়। সেখানে যাত্রী নামিয়ে পুনরায় ইঞ্জিন ঘুরিয়ে জামতৈল হয়ে ঢাকায় ফিরে আসে। এতে জ্বালানি ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচের পাশাপাশি চলাচলের সময়ও বেড়ে যায়।
রেলের পশ্চিমাঞ্চলের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, সম্প্রতি সিরাজগঞ্জ বাজারে কিছু অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। রাতে ট্রেনটি সেখানেই রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এরপরও দুবার ইঞ্জিন ঘোরানোর ধকল থাকছে। এতে ঘোরাঘুরির ঝামেলা কিছুটা মিটলেও ঈশ্বরদীর যাত্রীরা বঞ্চিত হচ্ছে। এই ট্রেনে গত অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে ঈশ্বরদী থেকে গড়ে দুই হাজার যাত্রী যাতায়াত করেছে।
রংপুর থেকে ঢাকাগামী আন্তনগর ট্রেন চালু ও রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেনের আধুনিকায়নের দাবিতে গতকাল রংপুর রেলস্টেশনে অবরোধ কর্মসূচি পালিত হয় l ছবি: মঈনুল ইসলামসিরাজগঞ্জের ক্যাপ্টেন মনসুর আলী রেলস্টেশনে উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে আসা প্রায় সব আন্তনগর ট্রেন থামে। এই স্টেশনে প্রায় সব ট্রেনই থামে। এখানে বেশি টিকিট বরাদ্দেরও পরামর্শ ছিল রেল কর্মকর্তাদের। কিন্তু রাজনৈতিক চাপে নতুন ট্রেন চালু করতে হয়েছে।
ট্রেন পরিচালনা-সংক্রান্ত প্রতিবেদন অনুসারে, ঢাকা-জামালপুর পথে ট্রেনের যাত্রী এমনিতেই একটু বেশি। এই পথের আন্তনগর তিস্তা এক্সপ্রেস ট্রেনটিতে সারা বছরই আসনের অতিরিক্ত যাত্রী যাতায়াত করে। অপেক্ষাকৃত কম আয়ের মানুষের যাতায়াত বেশি বলে ট্রেনটিতে এসি কামরা দেওয়া হয়নি। এরই মধ্যে গত নভেম্বরে ট্রেনটির পুরোনো বগি বাদ দিয়ে নতুন বগি সংযোজন করা হয়েছে। আগে এসি কামরা না থাকলেও নতুন করে এসি কামরা দেওয়া হয়েছে। এতে ভাড়াও বেড়েছে। এখন আগের তুলনায় যাত্রী কম।
রেলওয়ের দৈনন্দিন ট্রেন পরিচালনা-সংক্রান্ত তথ্য বলছে, গত বছরই এই ট্রেন ১৩০ শতাংশের বেশি যাত্রী পরিবহন করেছে। অর্থাৎ, আসন পরিপূর্ণ হওয়ার পর ৩০ শতাংশ যাত্রী আসনবিহীন টিকিটে ভ্রমণ করেছে। কিন্তু এখন এসি আসনের অনেকগুলো ফাঁকা যাচ্ছে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, সম্প্রতি ভারত ও ইন্দোনেশিয়া থেকে ২২০টি বগি আমদানি করা হয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম পথে নতুন একটি ট্রেন চালু করা হয়েছে। বাকি বগিগুলো পুরোনো ট্রেনে সংযোজন করা হচ্ছে। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ তাঁর নিজ এলাকা জামালপুরের এই ট্রেনে এসি কামরা সংযোজনের অনুরোধ করেন। তাঁর অনুরোধ রক্ষা করতে গিয়ে রেল কর্তৃপক্ষ জনপ্রিয় ট্রেনটির যাত্রী কমিয়ে দিয়েছে। এই পথে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় মেইল ও কমিউটার ট্রেন চলে। এখন এই দুটি ট্রেনে উপচে পড়া ভিড় শুরু হয়েছে।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রেলমন্ত্রী হওয়ার পর সিলেটের পথে কালনী এক্সপ্রেস নামে একটি আন্তনগর ট্রেন চালু করেন। এই পথে পারাবত, জয়ন্তিকা ও উপবন—এই তিনটি ট্রেনের একাধিক যাত্রা রয়েছে প্রতিদিন। এর মধ্যেই কালনী চালু করেন সুরঞ্জিত। শুরুতে ট্রেনটিকে এতই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে যে, খুব কম স্টেশনে এটি থামত এবং অধিকাংশ বগি ছিল শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মন্ত্রিত্ব যাওয়ার পর ট্রেনটি গুরুত্ব হারাতে শুরু করে। এখন এই ট্রেনে কোনো এসি আসন নেই।
ঢাকা-নেত্রকোনা পথে হাওর এক্সপ্রেস ট্রেন চালু করা হয় ২০১৩ সালে। এই ট্রেনে বেশ যাত্রী হয়। সম্প্রতি ওই পথে আরেকটি আন্তনগর ট্রেন চালু করা হয়েছে। এতে যাত্রী কম হচ্ছে বলে রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে।
ট্রেন থামে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে
মহানগর প্রভাতি, তূর্ণা নিশিতাসহ বেশ কয়েকটি আন্তনগর ট্রেনের যাত্রাবিরতি আছে ভৈরববাজারে। কিন্তু প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের ইচ্ছায় সেখানে ঢাকা-সিলেট পথের পারাবত ট্রেনেরও যাত্রাবিরতি দেওয়া হয় ২০১১ সালে। একইভাবে রেলমন্ত্রী থাকা অবস্থায় ওবায়দুল কাদের আগ্রহ দেখান উপকূল এক্সপ্রেস ট্রেনটি যেন নোয়াখালীর বজরা স্টেশনে থামে। তাঁর ইচ্ছা মেনে ওই স্টেশনে বিরতি দেওয়া হয়।
বিশেষ অনুরোধে যেসব স্টেশনে ট্রেন থামানো হচ্ছে, এর একটা তালিকা রয়েছে রেলওয়ের পরিচালন বিভাগে। এই তালিকা থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। ট্রেন পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, প্রচুর মেইল ট্রেনের যাত্রাবিরতি দেওয়া হয়েছে সাংসদদের ইচ্ছায়। অনেক মন্ত্রী ও সাংসদ নিজ নিজ এলাকায় আন্তনগর ট্রেনের যাত্রাবিরতির জন্য চিঠি দিয়ে রেখেছেন।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, মহানগর প্রভাতি ট্রেনটি লাকসামে থামানো শুরু হয় সাংসদ আ হ ম মুস্তফা কামাল ও তাজুল ইসলাম চৌধুরীর সুপারিশে।
ঢাকা-দিনাজপুর পথের একতা ও দ্রুতযান ট্রেন দুটি চিরিরবন্দরে যাত্রাবিরতি দেওয়া হয় রাজনৈতিক সুপারিশে। কুষ্টিয়ার মিরপুরে চিত্রা ট্রেনের যাত্রাবিরতি দেওয়া হয় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফের ইচ্ছায়। শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ানের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে খুলনার দৌলতপুরে যাত্রাবিরতি দেওয়া হয় সুন্দরবন ট্রেনের।
রেলের কর্মকর্তারা জানান, স্টেশন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ওই স্টেশনের জন্য আসন বরাদ্দও করতে হয়। একপর্যায়ে আন্তনগর ট্রেনগুলো লোকাল ট্রেনে পরিণত হয় এবং যাত্রীসেবা বিঘ্নিত হয়।
এ বিষয়ে রেলের মহাপরিচালক আমজাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আগে কিছু স্থানে অনুরোধের ভিত্তিতে ট্রেন থামানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু এখন আর অনুরোধ রাখা হয় না। কারণ, এভাবে ট্রেন থামালে গতি কমে যায় এবং ট্রেনের যাত্রার সময় বেড়ে যায়।
ইঞ্জিন-বগির সংকটে রেল চলছে যেনতেনভাবে
এমনিতেই রেলে ইঞ্জিন-বগির সংকট প্রকট। এর সঙ্গে রাজনৈতিক বিবেচনায় ট্রেন চালানোর কারণে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও সারা দেশে অন্তত ৩০টি মেইল ও লোকাল ট্রেন চলছে চার-পাঁচটি বগি দিয়ে। আর আন্তনগর ট্রেনও চলছে আগে থেকে ঠিক করা সংখ্যার চেয়ে কম বগি নিয়ে।
রেলওয়ে সূত্র বলছে, মিটারগেজের ইঞ্জিন ও বগির সংকট সবচেয়ে বেশি। এ জন্য আন্তনগর ট্রেনের বগি শেষ মুহূর্তে অকেজো হয়ে পড়লে বিকল্প বগি যোগ করা যায় না। এই সংকট নিত্যদিনের।
দেশে রেলপথ আছে ২ হাজার ৮৭৭ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৪৩ শতাংশই মিটারগেজ। ব্রডগেজ মাত্র ২৩ শতাংশ। বাকি পথে মিটারগেজ ও ব্রডগেজ দুই ধরনের ট্রেনই চলতে পারে।
রেলওয়ের দৈনন্দিন পরিচালনা-সংক্রান্ত তথ্য বলছে, সারা দেশে যাত্রীবাহী ও মালবাহী মিলে ট্রেন চলে ৩৪৭টি। আর মোট ইঞ্জিন রয়েছে ২৭৮টি। এর মধ্যে সব সময় ব্যবহারের জন্য পাওয়া যায় ২০০-এরও কম ইঞ্জিন। বাকি ইঞ্জিনগুলো খুবই পুরোনো, অনেকগুলো প্রায় অচল। কিছু কিছু ইঞ্জিন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে মেরামতের জন্য রাখতে হয়। ফলে এক ইঞ্জিন একবার ব্যবহারের পরই পুনরায় যাত্রা শুরু করে। গত নভেম্বরে ২৬টি ইঞ্জিন বিকল হয়। ডিসেম্বরের প্রথম তিন সপ্তাহে বিকল হয় ১৫টি।
সূত্র জানায়, সারা দেশে প্রায় ৩০০ যাত্রীবাহী ট্রেন চলে। বগি আছে ১ হাজার ৬০০টি। কিন্তু সব সময় ব্যবহারের উপযোগী বগি পাওয়া যায় ১ হাজার ৫০টি। ব্রডগেজে বড় সমস্যা না হলেও মিটারগেজে ৫০০ বাড়তি বগি দরকার।
জানতে চাইলে রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় ৭০০ কোচ ও ৭০টি ইঞ্জিন কেনার প্রক্রিয়া চলমান আছে। এসব ইঞ্জিন-বগি আমদানি করা হলে আর সংকট থাকবে না।
তবে রেলওয়ে সূত্র জানায়, মন্ত্রী যেসব ইঞ্জিন-কোচ আমদানির কথা বলছেন, এর বেশির ভাগই পণ্য কেনার শর্তে, ঋণ নেওয়ার শর্তে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের নানা পর্যায়ে ঝামেলা হয়। ফলে সহজেই ইঞ্চিন-বগি পাওয়া কঠিন।
রেলের হিসাবে দেখা গেছে, পূর্বাঞ্চলে চলাচলকারী আন্তনগর ট্রেনে যাত্রী চলাচলের হার ১৮৭ শতাংশ। আর পশ্চিমাঞ্চলে ব্রডগেজ ট্রেনে যাত্রী চলাচলের হার ৮৬ শতাংশ। পশ্চিমাঞ্চলে মিটারগেজে যাত্রী চলে ৭৪ শতাংশ। প্রথম শ্রেণি ও শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কামরাগুলোতে পূর্বাঞ্চলে আসন পাওয়া যায় না। পশ্চিমাঞ্চলে আবার আসন ফাঁকা থাকে।
কম বগিতে ট্রেন চালানো অপচয়
রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, চার-পাঁচটা বগি নিয়ে ট্রেন চালানো পুরোপুরি অপচয়। যাত্রীর চাহিদা, ইঞ্জিন-লাইন ও পুরো ব্যবস্থার সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হলে ৮ থেকে ১০টি বগির কমে ট্রেন চালানো উচিত নয়। এ জন্য একটি ট্রেন কতগুলো বগি নিয়ে চলবে, তা বছরের শুরুতেই ঠিক করে দেওয়া হয়। এটাকে রেলওয়ের ভাষায় বলা হয় ‘স্ট্যান্ডার্ড কম্পোজিশন’।
রেল সূত্র জানায়, আন্তনগর, মেইল ও লোকাল—কোনো ট্রেনই এই স্ট্যান্ডার্ড কম্পোজিশন মেনে চলে না। বিশেষ করে, মিটারগেজ ট্রেনে এই সমস্যা প্রকট।
আন্তনগর ট্রেনের টিকিট বিক্রি শুরু হয় ১০ দিন আগ থেকে। ফলে যাত্রীদের আসন সংরক্ষিত থাকে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বগি অকেজো হয়ে গেলে যাত্রীদের বেকায়দায় পড়তে হয়।
রেল সূত্র জানায়, ঢাকা-সিলেট পথের সুরমা মেইল চলে দুবার। প্রতিবারই ট্রেনটিতে নয়টি করে বগি থাকার কথা। কিন্তু এখন ট্রেনটি চারটি করে বগি নিয়ে চলে। এর বাইরে রেলের পূর্বাঞ্চলে ভাওয়াল এক্সপ্রেস, নোয়াখালী এক্সপ্রেস, মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস, দেওয়ানগঞ্জ এক্সপ্রেস, ধলেশ্বরী এক্সপ্রেস, কুশিয়ারা, ভৈরববাজার লোকাল ট্রেনগুলোরও একই অবস্থা। পশ্চিমাঞ্চলে কম বগি নিয়ে চলা ট্রেনগুলোর মধ্যে রাজশাহী এক্সপ্রেস, রকেট মেইল, উত্তরা এক্সপ্রেস, পোড়াদহ-গোয়ালন্দ লোকাল উল্লেখযোগ্য। এসব দিনে জোড়ায় জোড়ায় দুই দিক থেকেই ট্রেন চলাচল করে।

দুই ঠিকাদারের প্রাধান্য : কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে বেশি মনোযোগ

দরকারি প্রকল্পে অর্থায়ন না করে দীর্ঘদিন ঝুলিয়ে রাখার ঘটনা ঘটছে রেলওয়েতে। আবার কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নে তোড়জোড় দেখা গেছে। এভাবে অপরিকল্পিত প্রকল্প বাস্তবায়নের কারণে বিনিয়োগের পুরো সুফল পাচ্ছে না রেল।
এর বড় উদাহরণ চীন থেকে প্রায় ৬০০ কোটি টাকায় ডেমু ট্রেন ক্রয়। ইঞ্জিন-বগির প্রকট সংকটের সময় নিজস্ব অর্থায়নে ২০ সেট ডেমু ট্রেন কেনা হয়। তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন দায়িত্ব নিয়েই এই প্রকল্প গ্রহণ করেন। এই ট্রেন নামানোর পরই দেখা যায়, এতে পর্যাপ্ত বাতাস প্রবেশের সুযোগ নেই। আসনের অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পথে এটি চালুর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে রেল কর্তৃপক্ষ। অথচ এই প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল ঢাকার যানজট নিরসনের কথা বলে।
এখন দুই সেট ডেমু জোড়া দিয়ে একটি করে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পথে চলছে। দিনে আসা-যাওয়া মিলে চলে ছয়বার। বেশির ভাগ ডেমু ট্রেন চলছে ঢাকার বাইরে, দূরের পথে। এ অবস্থায় আবারও ২০ সেট ডেমু ট্রেন কেনার প্রাথমিক দরপত্র আহ্বান করেছে রেলওয়ে। এগুলো গাজীপুরের হাইটেক পার্কের আশপাশে চালানো হবে বলে সূত্র জানায়।
রেলওয়ে সূত্র বলছে, প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় সবচেয়ে বেশি বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, ঠিকাদারের স্বার্থ ও কমিশন-বাণিজ্য। রেললাইন নির্মাণ ও অবকাঠামো উন্নয়নের ৮০ শতাংশ কাজের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এগুলো হচ্ছে তমা ও ম্যাক্স গ্রুপ। তমার চেয়ারম্যান আতাউর রহমান ভূঁইয়া নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। আর এই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে একজন প্রতিমন্ত্রী জড়িয়ে আছেন বলে সূত্র জানায়। আর ম্যাক্সের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ আলমগীরের বাড়িও নোয়াখালী জেলায়। তিনি অবশ্য দীর্ঘদিন ধরেই রেলে কাজ করছেন। এই দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে রেলের সাবেক অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা চাকরি করেন।
বর্তমানে সবচেয়ে দ্রুতগতিতে রেললাইন নির্মাণের কাজ চলছে গোপালগঞ্জ ও পাবনায়। ২০১০ সালের দিকে রাজস্ব খাত থেকে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকায় কালুখালী-ভাটিয়াপাড়া পথের লাইন সংস্কার ও কাশিয়ানী-গোপালগঞ্জ ও টুঙ্গিপাড়া পথে নতুন রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প নেওয়া হয়। এখন পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ ৬০ শতাংশের বেশি শেষ হয়েছে। প্রায় একই সময়ে ১ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকায় ঈশ্বরদী থেকে ঢালারচর পর্যন্ত নতুন রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প নেওয়া হয়। এটিও রাজস্ব খাতের প্রকল্প। বাস্তবায়নও করা হয়েছে দ্রুত। ইতিমধ্যে ৭৭ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
রেলের একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, এসব প্রকল্প নেওয়ার আগে যাত্রী চাহিদা কিংবা লাভ-লোকসানের বিষয়টি কমই বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এগুলোর চেয়েও জরুরি ছিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পথে নতুন রেললাইন নির্মাণ ও ইঞ্জিন-বগি কেনা। কারণ, এই পথে যাত্রী চলাচল সবচেয়ে বেশি।
রেলের অভ্যন্তরীণ হিসাবে দেখা গেছে, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পথে এখন দিনে ৩২ বার ট্রেন আসা-যাওয়া করে। যাত্রী যাতায়াত করে দৈনিক গড়ে ২৫ হাজার। এই পথে আরেকটি রেললাইন নির্মাণের পরামর্শ দিয়েছিলেন রেলের অনেক কর্মকর্তা। কিন্তু সময়ক্ষেপণ করে শেষমেশ ২০১৪ সালে আরেকটি মিশ্রগেজ লাইন নির্মাণে ৩৭৯ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। দুই বছরের বেশি সময় পর এখন ঠিকাদার নিয়োগ হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ থেকে বগুড়া পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ করলে উত্তরবঙ্গের সঙ্গে দূরত্ব কমে যায় প্রায় ১৩০ কিলোমিটার। অথচ এই প্রকল্প বাস্তবায়নে রেলের আগ্রহ কম।
জানতে চাইলে রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যেসব প্রকল্প প্রয়োজন মনে করেছি, সেগুলো আগে নিয়েছি। এখানে রাজনৈতিক কোনো কারণ নেই। আগের সরকারগুলো কাজই করেনি। আমরা তো করছি।’ ডেমু আমদানির বিষয়ে তিনি বলেন, শুরুতে এর কিছু কারিগরি সমস্যা ছিল। এখন আর সমস্যা নেই।
আগ-পিছ না ভেবে প্রকল্প
ঢাকা-চট্টগ্রাম পথে ১২৫ কিলোমিটার মিটারগেজ রেললাইন নির্মাণ শেষ হয়েছে গত বছর। এখন এই রেলপথটি ব্রডগেজ ট্রেনের চলার উপযোগী করার জন্য তোড়জোড় শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে আখাউড়া থেকে লাকসাম অংশে মিশ্রগেজ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। বাকি পথও মিশ্রগেজ করার প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন আছে।

তমা ও ম্যাক্স বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে মিলে কাজ করছে। তাদের সুবিধা দেওয়ার সুযোগ নেই
মুজিবুল হক, রেলমন্ত্রী
রেলওয়ে সূত্র বলছে, আসলে এই পথে এখন মিশ্রগেজ লাইন করা অনেকটাই বিলাসিতা। কারণ, রেলের পূর্বাঞ্চলের কোথাও ব্রডগেজের অবকাঠামো নেই। আর যদি ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করতেই হয়, তাহলে ১২৫ কিলোমিটার নতুন মিটারগেজ লাইনের প্রকল্প নেওয়ার সময়ই তা মিশ্রগেজের জন্য নেওয়া উচিত ছিল। এতে খরচ কম হতো।
২০১৩ সালের দিকে রেল কর্তৃপক্ষ ভারত থেকে ২২০টি কনটেইনার আমদানি করে। আরও কিছু যন্ত্রপাতিসহ কনটেইনার ক্রয় প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। মালামাল পরিবহন কমে যাওয়ার কারণে অধিকাংশ কনটেইনার এখন অলস পড়ে থাকছে।
ইঞ্জিন-বগি কেনায় ঢিলেমি
রেলে ইঞ্জিনের সংকট প্রকট। ২০১০ সালে ভারতীয় ঋণে ২৬৪টি মিটারগেজ বগি কেনার জন্য প্রকল্প নেয় রেলওয়ে। ২০১২ সালে প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু ছয় বছরে একটি বগিও কিনতে পারেনি রেলওয়ে। নিজেদের অর্থ বা অন্য কোনো সংস্থা থেকে ঋণ নিয়েও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি প্রকল্পটি।
একই অবস্থা ৭০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন কেনার ক্ষেত্রেও। ২০১১ সালে নেওয়া এই প্রকল্পের একচুলও অগ্রগতি নেই। সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে নেওয়া এই প্রকল্পের মেয়াদ আগামী জুনে শেষ হওয়ার কথা। এর মধ্যে খুলনা স্টেশন আধুনিকায়নে ৭৯ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়ে তা দ্রুত বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
দুই ঠিকাদারই সব
রেলওয়ে সূত্র জানায়, রেলের নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে তমা ও ম্যাক্স গ্রুপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ। রেললাইনে ব্যবহারের জন্য সুনামগঞ্জের ছাতকে রেলের একটি নিজস্ব কংক্রিট স্লিপার তৈরির কারখানা রয়েছে। কিন্তু এটি এখন প্রায় অকেজো করে রাখা হয়েছে। এই সুযোগে ম্যাক্স ও তমা গ্রুপ নিজেরা স্লিপার তৈরির কারখানা স্থাপন করে ফেলেছে। এখন রেলের প্রকল্পে এই দুই প্রতিষ্ঠানের স্লিপার ব্যবহার করা হয়। তমার স্লিপার কারখানা জামালপুরে আর ম্যাক্সেরটি পঞ্চগড়ে। বর্তমানে বছরে প্রায় ১০০ কোটি টাকার স্লিপার দরকার হয় রেল কর্তৃপক্ষের। রেলের স্লিপার কারখানা নির্মাণ করা হয় ১৯৮৮ সালে। কারখানার সহযোগী হিসেবে ভোলাগঞ্জে রয়েছে পাথর সংগ্রহের কারখানা। সংগ্রহ করা পাথর স্লিপার কারখানায় আনার জন্য রয়েছে রূপওয়ে (তারের পথ)। এখন এর সম্পদ বেহাত হয়ে যাচ্ছে।
রেলের দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দুটির স্বার্থেই কর্তৃপক্ষ এই কারখানাটি অকেজো করে রেখেছে।
তমা ও ম্যাক্স অবাধে রেলের সম্পদ ব্যবহার করছে। সেনানিবাস রেলস্টেশনের পাশে রেলের জায়গায় দীর্ঘদিন অফিস নির্মাণ করে তা ব্যবহার করে ম্যাক্স। ঢাকা উড়ালসড়ক প্রকল্পের পথে হওয়ার কারণে সম্প্রতি এই অফিস সরিয়ে নেওয়া হয়। তমাকে গোপীবাগে রেলের জায়গায় নির্মাণ যন্ত্রপাতি রাখার অনুমতি দিয়েছে রেলওয়ে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে তমা গ্রুপের মূল কাজ ছিল সড়ক খাতে। এখন প্রতিষ্ঠানটি রেলের কাজ বেশি করছে। জোট সরকারের আমলে বাণিজ্য উপদেষ্টা বরকতউল্লার সঙ্গে তমার চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। এখন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজমের সঙ্গে। মির্জা আজম প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে তা স্বীকার করেন।
জানতে চাইলে তমার চেয়ারম্যান আতাউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মির্জা আজম আমার ২৫-৩০ বছরের পুরোনো বন্ধু। ব্যবসায়িক সম্পর্কের কোনো বিষয় নেই। আর রেলের কাজ করার জন্য যে যন্ত্রপাতি কিনেছি, তা রেলেও নেই। এই বিনিয়োগ করার কারণেই তো টাকা দেশে থাকছে। নতুবা বিদেশে চলে যেত।’ বিএনপির বরকতউল্লার সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ব্যবসা করলে সবার সঙ্গেই সম্পর্ক থাকতে হয়। বরকতউল্লা আমার নিজ এলাকার সাংসদ ছিলেন।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে থারেলমন্ত্রী মুজিবুল হক বলেন, তমা ও ম্যাক্স গ্রুপ বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে মিলে কাজ করছে। তাদের প্রতি বিশেষ কোনো নজর নেই। বাড়তি সুবিধা (ফেভার) দেওয়ার সুযোগ নেই। দরপত্রের শর্ত পূরণ যারা করবে তারাই কাজ পাবে। এখানে রাজনৈতিক পরিচয় কোনো বিবেচনায় কে না।

গতি পাচ্ছে না রেলওয়ে—১ এত বিনিয়োগ তবু লোকসান:

বিপুল বিনিয়োগ সত্ত্বেও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছে না রেলওয়ে। গত সাত বছরে ৩১ হাজার কোটি টাকা খরচ করেও গতি বাড়েনি রেলের। সেবা না বাড়লেও সাম্প্রতিক সময়ে দুই দফা ভাড়া বেড়েছে। এরপরও বাড়ছে লোকসান।
দীর্ঘদিন ধরে রেলে বিনিয়োগের হাহাকার ছিল। ছিল লোকবলের স্বল্পতা। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠনের পর থেকে রেলে অর্থায়ন বাড়তে থাকে। গত পাঁচ-ছয় বছরে ১০ হাজারের বেশি লোক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। রেলওয়ের বিভিন্ন নথি থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
উন্নয়ন প্রকল্পসংক্রান্ত নথি অনুসারে, বর্তমানে রেলে উন্নয়ন প্রকল্প চলমান আছে ৪৮টি। এসব প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৯৮ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্পগুলোর কিছু কিছু বাস্তবায়ন হওয়ার পথে। কিছু মাঝপথে আছে, আর কিছু কিছু প্রকল্প অনুমোদন হয়ে আছে। গত সাত বছরে ৪০টি প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে।
২০১৫-১৬ অর্থবছরে রেলের আয় হয়েছে ১ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। এ সময় শুধু রেল পরিচালনার জন্য ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে পরিচালন লোকসানই হয়েছে ১ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। আর প্রকল্পের ব্যয় ধরলে লোকসান বেড়ে যাবে কয়েক গুণ।এত বিনিয়োগ সত্ত্বেও রেলওয়ের সেবা বাড়ছে না, বাড়ছে লোকসান। কেন? জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও বহুমুখী পরিবহন ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, রেলওয়ের এই বিনিয়োগ পরিকল্পিত নয়। যাত্রী বৃদ্ধি, আয়বর্ধক ও লাভজনক—এই তিন বিবেচনায় প্রকল্প নেওয়া হয়নি। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নানা বিবেচনা কাজ করেছে। তা ছাড়া আয়ের যে বিপুল সম্ভাবনা, তা ধরার কোনো উদ্যোগই নেই। দেশে এখন বছরে ২৩ লাখ কনটেইনার মালামাল পরিবহন হয়। এর ৯৩ শতাংশই হয় সড়কপথে। রেলওয়ে কেন পারবে না? এভাবে একটা প্রতিষ্ঠান মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে না।
তবে লোকসানের বিষয়ে মোটেও বিচলিত নন রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, রেল একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। লোকসানের কথা বিবেচনা না করে শতভাগ সেবা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। তাঁর আশা, চলমান ৯৮ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে লোকসান কমে আসবে। ২০১৮ সালের মধ্যে রেলের উন্নতি দৃশ্যমান হবে। আর ২০২০ সালের মধ্যে রেলের চেহারা পাল্টে যাবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রেলে ব্যয় হয় দুই ধরনের। একটি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে, অন্যটি অনুন্নয়ন খাতে অর্থাৎ রেল পরিচালনায় দৈনন্দিন খরচ। উন্নয়ন বাজেটের অধীনে যে প্রকল্প সমাপ্ত হয়েছে এবং চলমান আছে—এর বেশির ভাগই নতুন রেললাইন ও সেতু নির্মাণ, ইঞ্জিন-বগি ক্রয়, অবকাঠামো নির্মাণ-সংক্রান্ত। অনুন্নয়ন খাতে বেশির ভাগ ব্যয় হয় রক্ষণাবেক্ষণ ও বেতন-ভাতায়।
২০০৯ সালের জুলাই থেকে গত বছরের জুন পর্যন্ত সাত বছরে রেলে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হয়েছে ১৭ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা। এসব অর্থ এসেছে বিদেশি ঋণ-সহায়তা ও সরকারের বাজেট থেকে। বিদেশি ঋণ ও সহায়তাদানকারী দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভারত। চীন অর্থ ছাড় না করলেও প্রস্তাবিত প্রকল্প ধরলে সবার ওপরে চলে যাচ্ছে চীন। আর এ সময় ট্রেন পরিচালনায় দৈনন্দিন ব্যয় হয়েছে ১১ হাজার ৬২৩ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে এই সাত বছরে রেলে ব্যয় হয়েছে ২৯ হাজার ৭৪ কোটি টাকা। এই সময় রেল আয় করেছে ৫ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা। ঘাটতি প্রায় ২৩ হাজার ৭০৩ কোটি টাকা।

রেলওয়ে সূত্র বলছে, ঋণ নিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রকল্পের পেছনে ব্যয় করা হচ্ছে। এগুলো সুদে-আসলে ফেরত দিতে হবে। যখন ঋণের কিস্তি বেড়ে যাবে, তখন দেখা যাবে রেলের আয়ের চেয়ে ঋণের কিস্তির পরিমাণ বেশি।

গত পাঁচ বছরে রেলের ভাড়া দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। এখন রেলের আন্তনগর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত (এসি) শ্রেণির ভাড়া ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনা পথে চলাচলকারী বিলাসবহুল বাসের প্রায় সমান।

রেল কর্তৃপক্ষ প্রতিবছরই আয়-ব্যয়ের হিসাবসহ নানা তথ্যসংবলিত একটি বই প্রকাশ করে। ঋণ ও সরকারের খরচে যেসব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়, এর ব্যয় বইয়ে উল্লেখ করা হয় না। শুধু রাজস্ব খাতের ব্যয় এবং আয়ের হিসাব দিয়ে লাভ-লোকসান দেখানো হয়। এটাকে তারা বলে পরিচালন মুনাফা। কিন্তু স্বাধীনতার পর রেল পরিচালন মুনাফা দেখাতে পারেনি।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, বিপুল বিনিয়োগের পরও রেলে ইঞ্জিন-বগির সংকট যায়নি। বর্তমানে রেলে ২৭৮টি ইঞ্জিন রয়েছে। এর ৫৪ শতাংশের বয়স ৩৫ থেকে ৬৩ বছর। একই অবস্থা বগিরও।

২০০৫ থেকে ২০১১—এই সাত বছরে কোনো ইঞ্জিন কেনা হয়নি। গত পাঁচ বছরে কেনা হয়েছে ৪৬টি ইঞ্জিন। অন্যদিকে ২০০৬ সালের পর প্রায় এক দশক বগি কেনা হয়নি। ইন্দোনেশিয়া ও ভারত থেকে ২৭০টি নতুন বগি কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ বগি এসেছে।

তবে রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমান সরকার যেভাবে রেলে বিনিয়োগ করছে, সেই তুলনায় ইঞ্জিন-বগি কেনার প্রকল্পগুলোতে গুরুত্ব কমই দেওয়া হয়েছে। একাধিক প্রকল্প চলমান থাকলেও আগামী দুই বছর নতুন ইঞ্জিন-বগি পাওয়ার সম্ভাবনা কমই। কারণ, এসব প্রকল্পের বেশির ভাগেরই অর্থায়ন নিশ্চিত হয়নি। যেগুলোর হয়েছে, সেগুলোতে ঠিকাদার নিয়োগ হয়নি।

সূত্র আরও জানায়, প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে শুধু অবকাঠামো উন্নয়নে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আর এসব অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের ৮০ শতাংশেরই ঠিকাদার দুটি প্রতিষ্ঠান। এগুলো হচ্ছে ম্যাক্স ও তমা গ্রুপ। তমা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান ভূঁইয়া গত বছর নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হয়েছেন।

রেলের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিপুল অর্থ পেয়ে রেলের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড় হয়ে গেছে। এ জন্যই সাধারণ ইঞ্জিন ও বগির সংকট দূর না করে সবার আগে চীন থেকে ডেমু ট্রেন কেনা হয়েছে। পরে ডেমু একটি অজনপ্রিয় ট্রেনে পরিণত হয়। প্রকল্প নেওয়া থেকে শুরু করে নতুন ট্রেন চালু, এমনকি কোন স্টেশনে ট্রেন থামবে—সবকিছুই রাজনৈতিক ও ব্যক্তি বিবেচনা থেকে নেওয়া হয়েছে।
সেবা কি বেড়েছে?

শুধু কি লোকসান? রেলমন্ত্রী রেলকে সেবামূলক বললেও সেবা বাড়েনি মোটেও। সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেন ২০০০ সালে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাতায়াত করত পাঁচ ঘণ্টায়। ১৬ বছর পর এখন ওই ট্রেনের নির্ধারিত সময় ছয় ঘণ্টা। কখনো কখনো এই সময়ও মেনে চলে না। নতুন কোচ দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম পথে চালু করা সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ট্রেনেরও নির্ধারিত সময় পৌনে ছয় ঘণ্টা। উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ট্রেনের যাত্রা সময় তো আরও বেশি।

ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা খরচ করে নতুন লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। চট্টগ্রামের চিনকি আস্তানা থেকে আশুগঞ্জ পর্যন্ত বিদ্যমান রেলপথ সংস্কারের ৩০০ কোটি টাকার প্রকল্প প্রায় শেষ। অথচ এই পথ দিয়ে চলা কোনো ট্রেনের গতি বাড়েনি।

রেল পরিচালনার টাইম-টেবিল বই অনুসারে, ২০০১ সালে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের প্রায় পুরোটাতেই ৮০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচল করত। শুধু কুমিল্লার সদর রসুলপুর এলাকার কিছু অংশে ৭২ কিলোমিটার গতি ছিল। এখন পুরো পথেই ৭২ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলে।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, সম্প্রতি টঙ্গী-ভৈরব পথে নির্মাণ করা নতুন রেললাইন দিয়ে ট্রেন চালিয়ে গতি পরীক্ষা করেন রেলের কর্মকর্তারা। ওই ট্রেনে রেলের মহাপরিচালক নিজেই অবস্থান করছিলেন। এই পথে ট্রেন ৮০ কিলোমিটার গতিতে চালানোর নির্দেশনা দিলেও সেই গতি তোলা যায়নি। একজন কর্মকর্তা বলেন, বর্তমান ইঞ্জিন দিয়ে চালালে ৮০ কিলোমিটার গতি তোলা কঠিন। আবার রেলের লাইন মেরামতে এতই ফাঁকিবাজি হয়েছে যে, গতি তুলতে গেলেই ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, ১৮০ কোটি টাকায় ময়মনসিংহের গৌরীপুর থেকে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইন সংস্কার করা হয় ২০১৩ সালে। প্রকল্প নেওয়ার সময় বলা হয়েছিল, বাস্তবায়ন শেষে এই পথে ৬৫ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলবে। কিন্তু এখন চলে ৫০ কিলোমিটারেরও কম গতিতে।

লাকসাম থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত বিদ্যমান রেললাইন পুনর্বাসনে ১৭০ কোটি টাকার প্রকল্প চলছে। ৮০ শতাংশ কাজ শেষ। কিন্তু ওই পথে ট্রেনের গতি বাড়েনি, বরং কমানোর চিন্তা করা হচ্ছে।

রেলের নথিপত্রে আন্তনগর ট্রেনের ৯০ শতাংশ সময় মেনে চলছে বলে দেখানো হয়েছে। আসলে প্রতিটি ট্রেনেরই চলাচলের সময় বৃদ্ধি করা হয়েছে। ফলে দেরিতে চললেও তা পুষিয়ে নেওয়া যায়। এ ছাড়া বাস্তবতা হচ্ছে, আধা ঘণ্টা দেরিতে চলা ট্রেনকে সময় মেনে চলা হিসেবেই গণ্য করে রেল কর্তৃপক্ষ।

ট্রেন পরিচালনা-সংক্রান্ত দৈনন্দিন হিসাব থেকে দেখা গেছে, ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা ঘটলে পুরো সপ্তাহের ট্রেন চলাচলের সময়সূচি উল্টে যায়। তখন আট ঘণ্টা পর্যন্ত দেরিতে ট্রেন চলে। আর রেলে দুর্ঘটনার ৯০ শতাংশই লাইনচ্যুতির ঘটনা। চলতি বছরের প্রথম ১১ মাসে রেলের পূর্বাঞ্চলেই ৪৮টি লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে। বিপুল বিনিয়োগের পরও এভাবে লাইনচ্যুতির ঘটনাকে অস্বাভাবিকই মনে করেন রেলের অনেক কর্মকর্তা।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি যাত্রী হিসেবে বলতে পারি, রেলে সেবা বাড়েনি। গতিও আগের মতোই আছে। বিপুল বিনিয়োগের পরও এক জায়গায় আটকে থাকার কারণ হতে পারে, বিনিয়োগ পরিকল্পিত হয়নি। আবার লুটপাটের কারণেও এমনটা হতে পারে। কারণ, বাংলাদেশে বড় প্রকল্প মানে বড় দাঁও মারা। রেলেও এমনটা হয়ে থাকতে পারে।

এ বিষয়ে রেলমন্ত্রী বলেন, বিএনপি-জামায়াতের আমলে রেলপথে কোনো বিনিয়োগ হয়নি। এখনো অনেক লাইন জরাজীর্ণ। ফলে গতি বাড়াতে গেলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকে যায়। এখন সময়মতো ট্রেনের যাতায়াত নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে। গতিও বাড়বে আস্তে আস্তে।

কেন এগোচ্ছে না?

রেলের কর্মকর্তা, রেল নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে রেলের এই দুরবস্থার পেছনে তিনটি বড় কারণ পাওয়া যায়। এগুলো হচ্ছে দুর্নীতি, অদক্ষতা ও অপরিকল্পিত প্রকল্প গ্রহণ।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, রেলে গত কয়েক বছরে যে পরিমাণ বিনিয়োগ ও প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়নের মতো দক্ষ কর্মকর্তার অভাব রয়েছে। আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে, যাত্রী সুবিধা বা আয়বর্ধক প্রকল্প না নিয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ কেনাকাটার প্রকল্প নেওয়া। এ ক্ষেত্রে রাজনীতিক, ঠিকাদার ও কর্মকর্তাদের ব্যক্তিস্বার্থ কাজ করেছে।

প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে পরিকল্পনার যে অভাব রয়েছে, তা রেলওয়ের যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের চিত্র থেকেই স্পষ্ট। রেল পরিচালনা-সংক্রান্ত বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, গত অর্থবছরে রেল যাত্রী পরিবহন করেছে সাত কোটি। আগের বছরের তুলনায় ৫ শতাংশ বেশি। যা রেলের নিজেরই ঠিক করা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৬ শতাংশ কম।

রেলের হিসাব বলছে, গত বছর যে পরিমাণ যাত্রী বেড়েছে, তা গতানুগতিক। কারণ, গত এক দশকে রেলের যাত্রী ৫-৬ শতাংশ কম-বেশি হচ্ছে। কখনো এক বছর বেড়েছে, আবার পরের বছর কমেছে। কখনো দুই বছর বৃদ্ধির পর এক বছর কমে গেছে। একই অবস্থা মালামাল পরিবহনের ক্ষেত্রেও। তবে মালামাল পরিবহনের বৃদ্ধির চেয়ে কমার প্রবণতাই বেশি।

রেলের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে যাত্রী ও মালামাল পরিবহনে বড় অর্জন না হওয়ার পেছনে কতগুলো কারণ পাওয়া গেছে। মূল সমস্যা ইঞ্জিন ও বগির স্বল্পতা। ২০১৪ সালের আগে প্রায় এক দশক ইঞ্জিন ও বগি কেনা হয়নি বললেই চলে। এখন অবশ্য ইঞ্জিন-বগি আসছে, তবে পুরোনো ইঞ্জিন-বগি অকেজো হওয়ার পর। ২০০৯ সাল থেকে বিপুল পরিমাণ বাজেট বরাদ্দ করলেও শুরুতে যেসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, এর বেশির ভাগই রেললাইন ও সেতু নির্মাণ, স্টেশন আধুনিকায়ন আর মেরামতের কাজে।

একমাত্র ইঞ্জিন ও বগি কেনার একটি প্রকল্পই দ্রুততার সঙ্গে করা হয়েছে, তা হচ্ছে ডেমু প্রকল্প। চীন থেকে প্রায় ৬০০ কোটি টাকায় ২০টি ডেমু কেনা হয়েছে। এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে রেলেই তুমুল বিতর্ক আছে।

রেলের টিকিট বিক্রির পদ্ধতিও যাত্রীবান্ধব নয় বলে মনে করেন যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলো। রেলের কর্মী, সেনাবাহিনী ও বিচারপতির জন্য ১০ শতাংশ টিকিট সংরক্ষণ করে রেলওয়ে। তবে এই ঘোষিত সংরক্ষণের বাইরে প্রায় অর্ধেক টিকিটই কম্পিউটারে ব্লক করে রাখা হয় ভিআইপি ও ভিভিআইপিদের জন্য।

রেলমন্ত্রীর দাবি, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ, ঢাকা-চট্টগ্রাম পথের পুরোটা দুই লাইন এবং আরও কিছু নতুন লাইন নির্মাণ সম্পন্ন হলে যাত্রী ও মালামাল পরিবহন বেড়ে যাবে।

রেল যোগাযোগের অবস্থা

স্বাধীনতার পর উত্তরাধিকারসূত্রে বাংলাদেশ যে রেললাইন পেয়েছে, ৪৫ বছরে তা বেড়েছে মাত্র ১৯ কিলোমিটার। রেলের পথকে বলা হয় রুট কিলোমিটার বা মোট রেলপথ। আর রেলপথের কোথাও কোথাও একাধিক লাইন রয়েছে। রেলপথে থাকা সব লাইনের যোগফলকে বলে গজ কিলোমিটার বা রেললাইন। স্বাধীনতার পর রেললাইন কমেছে ৩৫৫ কিলোমিটার। মূলত সরকারি গুদাম ও বন্দর-ঘাটের সঙ্গে সংযোগকারী অনেক রেলপথ বন্ধ হয়ে গেছে।

স্বাধীনতার সময় রেলপথ ছিল ২ হাজার ৮৫৮ কিলোমিটার। এখন রেলপথ আছে ২ হাজার ৮৭৭ কিলোমিটার। আর বর্তমানে রেললাইন আছে ৪ হাজার ৯৩ কিলোমিটার। স্বাধীনতার সময় রেললাইন ছিল ৪ হাজার ৪৪৮ কিলোমিটার।

বর্তমানে দেশের ৪৪ জেলায় রেল যোগাযোগ রয়েছে। এর মধ্যে ৭টি জেলায় ১০০ কিলোমিটারের বেশি রেলপথ আছে। এই জেলাগুলো হচ্ছে চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, মৌলভীবাজার, লালমনিরহাট, জামালপুর ও কুমিল্লা। এসব জেলায় স্টেশনও বেশি।

রেলে তিন ধরনের ব্যবস্থা চালু আছে। এগুলো হচ্ছে মিটারগেজ, ব্রডগেজ ও মিশ্রগেজ। প্রতিটির কারিগরি দিক আলাদা। ফলে রেল পরিচালনায় সমন্বয় করা কঠিন। রেলের পূর্বাঞ্চলের প্রায় পুরোটাই মিটারগেজে চলে। আর পশ্চিমাঞ্চলে মিটারগেজ ও ব্রডগেজ ট্রেন চলে। ভারতসহ বিভিন্ন দেশে মিটারগেজ লাইন তুলে দেওয়া হচ্ছে।

করণীয় সম্পর্কে অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, রেলকে বাঁচাতে হলে মালামাল পরিবহন বাড়াতেই হবে। এখন সব চাপ পড়ছে সড়কে। এভাবে সড়কে চাপ বাড়লে সড়কও ভেঙে পড়বে। তাই রেলে মালামাল পরিবহন বৃদ্ধির জন্য অবকাঠামো নির্মাণের পাশাপাশি দ্রুত একটি করপোরেশন গঠন করতে হবে। পাশাপাশি সরকারের এমন কিছু নীতি-সুবিধা ঘোষণা করতে হবে, যাতে রেলে মালামাল পরিবহনে সবাই উৎসাহী হয়। আর যাত্রী পরিবহন বাড়ানোর একটাই পথ, তা হচ্ছে সেবা বৃদ্ধি। এ জন্য কিছু কিছু সেবা সরকারি-বেসরকারি যৌথ ব্যবস্থাপনার ওপর ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে।

ইঞ্জিন-বগির সংকটে ট্রেন চলছে ধুঁকে ধুঁকে : ট্রেনের চলা–থামা যেন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে

নতুন ট্রেন কোথায় চলবে আর কোন স্টেশনে কোন ট্রেন থামবে—এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে নির্ধারণ হয়ে থাকে। মন্ত্রী-সাংসদদের চাহিদা মেনে ট্রেন নামানো ও থামানোর সিদ্ধান্তের কারণে লোকসানের পাল্লা আরও ভারী হচ্ছে।
সম্প্রতি ঢাকা-সিরাজগঞ্জ পথে চলাচলকারী সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটির পুরোনো বগি ফেলে ভারত থেকে আমদানি করা দুটি এসি বগিসহ একে নতুন করে সাজানো হয়েছে। আগে ট্রেনটি চলত সাতটি বগি নিয়ে, এখন ১২টি। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ও প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম উপস্থিত ছিলেন।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটি এত দিন একটি শোভন চেয়ার ও ছয়টি শোভন শ্রেণির বগি নিয়ে চলত। আসন ছিল ৪৭৪টি। গত বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত রেলের হিসাবে দেখা যায়, শোভন চেয়ারের ১০০ আসনের ৩০ শতাংশই খালি চলেছে। আর শোভন শ্রেণির বগিগুলোতে যাত্রী চলেছে ৯৭ শতাংশ। এখন ৪৮টি ঘুমানোর বার্থ ও ৭৪টি এসি আসন যুক্ত হচ্ছে। শোভন শ্রেণি বাদ দিয়ে পুরোটাই শোভন চেয়ার করা হয়েছে। আসন দাঁড়িয়েছে ৯৬৬টি। টিকিটের দামও বেড়েছে। নতুন এই ট্রেন ওই পথে চালানো দরকার ছিল কি না, তা নিয়ে বিতর্ক আছে রেলের কর্মকর্তাদের মধ্যেই।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, ট্রেনটি চালু করার ক্ষেত্রে সিরাজগঞ্জের প্রভাবশালী রাজনীতিকদের ভূমিকা ছিল। রেলওয়ের বর্তমান মহাপরিচালকের বাড়িও সিরাজগঞ্জে।
রেলের কর্মকর্তারা জানান, ট্রেনটি অলাভজনক হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। প্রথমত, সিরাজগঞ্জ বাজার পর্যন্ত অনেক আগে থেকেই রেললাইন ছিল। কিন্তু ঢাকা থেকে সরাসরি ট্রেন যেতে পারে না। ঢাকা থেকে বগুড়ার কাছাকাছি জামতৈলে গিয়ে ইঞ্জিন পরিবর্তন করে সিরাজগঞ্জ বাজারে যেতে হয়। সেখানে যাত্রী নামিয়ে পুনরায় ইঞ্জিন ঘুরিয়ে জামতৈল হয়ে ঢাকায় ফিরে আসে। এতে জ্বালানি ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচের পাশাপাশি চলাচলের সময়ও বেড়ে যায়।
রেলের পশ্চিমাঞ্চলের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, সম্প্রতি সিরাজগঞ্জ বাজারে কিছু অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। রাতে ট্রেনটি সেখানেই রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এরপরও দুবার ইঞ্জিন ঘোরানোর ধকল থাকছে। এতে ঘোরাঘুরির ঝামেলা কিছুটা মিটলেও ঈশ্বরদীর যাত্রীরা বঞ্চিত হচ্ছে। এই ট্রেনে গত অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে ঈশ্বরদী থেকে গড়ে দুই হাজার যাত্রী যাতায়াত করেছে।
রংপুর থেকে ঢাকাগামী আন্তনগর ট্রেন চালু ও রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেনের আধুনিকায়নের দাবিতে গতকাল রংপুর রেলস্টেশনে অবরোধ কর্মসূচি পালিত হয় l ছবি: মঈনুল ইসলামসিরাজগঞ্জের ক্যাপ্টেন মনসুর আলী রেলস্টেশনে উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে আসা প্রায় সব আন্তনগর ট্রেন থামে। এই স্টেশনে প্রায় সব ট্রেনই থামে। এখানে বেশি টিকিট বরাদ্দেরও পরামর্শ ছিল রেল কর্মকর্তাদের। কিন্তু রাজনৈতিক চাপে নতুন ট্রেন চালু করতে হয়েছে।
ট্রেন পরিচালনা-সংক্রান্ত প্রতিবেদন অনুসারে, ঢাকা-জামালপুর পথে ট্রেনের যাত্রী এমনিতেই একটু বেশি। এই পথের আন্তনগর তিস্তা এক্সপ্রেস ট্রেনটিতে সারা বছরই আসনের অতিরিক্ত যাত্রী যাতায়াত করে। অপেক্ষাকৃত কম আয়ের মানুষের যাতায়াত বেশি বলে ট্রেনটিতে এসি কামরা দেওয়া হয়নি। এরই মধ্যে গত নভেম্বরে ট্রেনটির পুরোনো বগি বাদ দিয়ে নতুন বগি সংযোজন করা হয়েছে। আগে এসি কামরা না থাকলেও নতুন করে এসি কামরা দেওয়া হয়েছে। এতে ভাড়াও বেড়েছে। এখন আগের তুলনায় যাত্রী কম।
রেলওয়ের দৈনন্দিন ট্রেন পরিচালনা-সংক্রান্ত তথ্য বলছে, গত বছরই এই ট্রেন ১৩০ শতাংশের বেশি যাত্রী পরিবহন করেছে। অর্থাৎ, আসন পরিপূর্ণ হওয়ার পর ৩০ শতাংশ যাত্রী আসনবিহীন টিকিটে ভ্রমণ করেছে। কিন্তু এখন এসি আসনের অনেকগুলো ফাঁকা যাচ্ছে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, সম্প্রতি ভারত ও ইন্দোনেশিয়া থেকে ২২০টি বগি আমদানি করা হয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম পথে নতুন একটি ট্রেন চালু করা হয়েছে। বাকি বগিগুলো পুরোনো ট্রেনে সংযোজন করা হচ্ছে। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ তাঁর নিজ এলাকা জামালপুরের এই ট্রেনে এসি কামরা সংযোজনের অনুরোধ করেন। তাঁর অনুরোধ রক্ষা করতে গিয়ে রেল কর্তৃপক্ষ জনপ্রিয় ট্রেনটির যাত্রী কমিয়ে দিয়েছে। এই পথে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় মেইল ও কমিউটার ট্রেন চলে। এখন এই দুটি ট্রেনে উপচে পড়া ভিড় শুরু হয়েছে।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রেলমন্ত্রী হওয়ার পর সিলেটের পথে কালনী এক্সপ্রেস নামে একটি আন্তনগর ট্রেন চালু করেন। এই পথে পারাবত, জয়ন্তিকা ও উপবন—এই তিনটি ট্রেনের একাধিক যাত্রা রয়েছে প্রতিদিন। এর মধ্যেই কালনী চালু করেন সুরঞ্জিত। শুরুতে ট্রেনটিকে এতই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে যে, খুব কম স্টেশনে এটি থামত এবং অধিকাংশ বগি ছিল শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মন্ত্রিত্ব যাওয়ার পর ট্রেনটি গুরুত্ব হারাতে শুরু করে। এখন এই ট্রেনে কোনো এসি আসন নেই।
ঢাকা-নেত্রকোনা পথে হাওর এক্সপ্রেস ট্রেন চালু করা হয় ২০১৩ সালে। এই ট্রেনে বেশ যাত্রী হয়। সম্প্রতি ওই পথে আরেকটি আন্তনগর ট্রেন চালু করা হয়েছে। এতে যাত্রী কম হচ্ছে বলে রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে।
ট্রেন থামে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে
মহানগর প্রভাতি, তূর্ণা নিশিতাসহ বেশ কয়েকটি আন্তনগর ট্রেনের যাত্রাবিরতি আছে ভৈরববাজারে। কিন্তু প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের ইচ্ছায় সেখানে ঢাকা-সিলেট পথের পারাবত ট্রেনেরও যাত্রাবিরতি দেওয়া হয় ২০১১ সালে। একইভাবে রেলমন্ত্রী থাকা অবস্থায় ওবায়দুল কাদের আগ্রহ দেখান উপকূল এক্সপ্রেস ট্রেনটি যেন নোয়াখালীর বজরা স্টেশনে থামে। তাঁর ইচ্ছা মেনে ওই স্টেশনে বিরতি দেওয়া হয়।
বিশেষ অনুরোধে যেসব স্টেশনে ট্রেন থামানো হচ্ছে, এর একটা তালিকা রয়েছে রেলওয়ের পরিচালন বিভাগে। এই তালিকা থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। ট্রেন পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, প্রচুর মেইল ট্রেনের যাত্রাবিরতি দেওয়া হয়েছে সাংসদদের ইচ্ছায়। অনেক মন্ত্রী ও সাংসদ নিজ নিজ এলাকায় আন্তনগর ট্রেনের যাত্রাবিরতির জন্য চিঠি দিয়ে রেখেছেন।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, মহানগর প্রভাতি ট্রেনটি লাকসামে থামানো শুরু হয় সাংসদ আ হ ম মুস্তফা কামাল ও তাজুল ইসলাম চৌধুরীর সুপারিশে।
ঢাকা-দিনাজপুর পথের একতা ও দ্রুতযান ট্রেন দুটি চিরিরবন্দরে যাত্রাবিরতি দেওয়া হয় রাজনৈতিক সুপারিশে। কুষ্টিয়ার মিরপুরে চিত্রা ট্রেনের যাত্রাবিরতি দেওয়া হয় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফের ইচ্ছায়। শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ানের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে খুলনার দৌলতপুরে যাত্রাবিরতি দেওয়া হয় সুন্দরবন ট্রেনের।
রেলের কর্মকর্তারা জানান, স্টেশন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ওই স্টেশনের জন্য আসন বরাদ্দও করতে হয়। একপর্যায়ে আন্তনগর ট্রেনগুলো লোকাল ট্রেনে পরিণত হয় এবং যাত্রীসেবা বিঘ্নিত হয়।
এ বিষয়ে রেলের মহাপরিচালক আমজাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আগে কিছু স্থানে অনুরোধের ভিত্তিতে ট্রেন থামানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু এখন আর অনুরোধ রাখা হয় না। কারণ, এভাবে ট্রেন থামালে গতি কমে যায় এবং ট্রেনের যাত্রার সময় বেড়ে যায়।
ইঞ্জিন-বগির সংকটে রেল চলছে যেনতেনভাবে
এমনিতেই রেলে ইঞ্জিন-বগির সংকট প্রকট। এর সঙ্গে রাজনৈতিক বিবেচনায় ট্রেন চালানোর কারণে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও সারা দেশে অন্তত ৩০টি মেইল ও লোকাল ট্রেন চলছে চার-পাঁচটি বগি দিয়ে। আর আন্তনগর ট্রেনও চলছে আগে থেকে ঠিক করা সংখ্যার চেয়ে কম বগি নিয়ে।
রেলওয়ে সূত্র বলছে, মিটারগেজের ইঞ্জিন ও বগির সংকট সবচেয়ে বেশি। এ জন্য আন্তনগর ট্রেনের বগি শেষ মুহূর্তে অকেজো হয়ে পড়লে বিকল্প বগি যোগ করা যায় না। এই সংকট নিত্যদিনের।
দেশে রেলপথ আছে ২ হাজার ৮৭৭ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৪৩ শতাংশই মিটারগেজ। ব্রডগেজ মাত্র ২৩ শতাংশ। বাকি পথে মিটারগেজ ও ব্রডগেজ দুই ধরনের ট্রেনই চলতে পারে।
রেলওয়ের দৈনন্দিন পরিচালনা-সংক্রান্ত তথ্য বলছে, সারা দেশে যাত্রীবাহী ও মালবাহী মিলে ট্রেন চলে ৩৪৭টি। আর মোট ইঞ্জিন রয়েছে ২৭৮টি। এর মধ্যে সব সময় ব্যবহারের জন্য পাওয়া যায় ২০০-এরও কম ইঞ্জিন। বাকি ইঞ্জিনগুলো খুবই পুরোনো, অনেকগুলো প্রায় অচল। কিছু কিছু ইঞ্জিন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে মেরামতের জন্য রাখতে হয়। ফলে এক ইঞ্জিন একবার ব্যবহারের পরই পুনরায় যাত্রা শুরু করে। গত নভেম্বরে ২৬টি ইঞ্জিন বিকল হয়। ডিসেম্বরের প্রথম তিন সপ্তাহে বিকল হয় ১৫টি।
সূত্র জানায়, সারা দেশে প্রায় ৩০০ যাত্রীবাহী ট্রেন চলে। বগি আছে ১ হাজার ৬০০টি। কিন্তু সব সময় ব্যবহারের উপযোগী বগি পাওয়া যায় ১ হাজার ৫০টি। ব্রডগেজে বড় সমস্যা না হলেও মিটারগেজে ৫০০ বাড়তি বগি দরকার।
জানতে চাইলে রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় ৭০০ কোচ ও ৭০টি ইঞ্জিন কেনার প্রক্রিয়া চলমান আছে। এসব ইঞ্জিন-বগি আমদানি করা হলে আর সংকট থাকবে না।
তবে রেলওয়ে সূত্র জানায়, মন্ত্রী যেসব ইঞ্জিন-কোচ আমদানির কথা বলছেন, এর বেশির ভাগই পণ্য কেনার শর্তে, ঋণ নেওয়ার শর্তে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের নানা পর্যায়ে ঝামেলা হয়। ফলে সহজেই ইঞ্চিন-বগি পাওয়া কঠিন।
রেলের হিসাবে দেখা গেছে, পূর্বাঞ্চলে চলাচলকারী আন্তনগর ট্রেনে যাত্রী চলাচলের হার ১৮৭ শতাংশ। আর পশ্চিমাঞ্চলে ব্রডগেজ ট্রেনে যাত্রী চলাচলের হার ৮৬ শতাংশ। পশ্চিমাঞ্চলে মিটারগেজে যাত্রী চলে ৭৪ শতাংশ। প্রথম শ্রেণি ও শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কামরাগুলোতে পূর্বাঞ্চলে আসন পাওয়া যায় না। পশ্চিমাঞ্চলে আবার আসন ফাঁকা থাকে।
কম বগিতে ট্রেন চালানো অপচয়
রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, চার-পাঁচটা বগি নিয়ে ট্রেন চালানো পুরোপুরি অপচয়। যাত্রীর চাহিদা, ইঞ্জিন-লাইন ও পুরো ব্যবস্থার সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হলে ৮ থেকে ১০টি বগির কমে ট্রেন চালানো উচিত নয়। এ জন্য একটি ট্রেন কতগুলো বগি নিয়ে চলবে, তা বছরের শুরুতেই ঠিক করে দেওয়া হয়। এটাকে রেলওয়ের ভাষায় বলা হয় ‘স্ট্যান্ডার্ড কম্পোজিশন’।
রেল সূত্র জানায়, আন্তনগর, মেইল ও লোকাল—কোনো ট্রেনই এই স্ট্যান্ডার্ড কম্পোজিশন মেনে চলে না। বিশেষ করে, মিটারগেজ ট্রেনে এই সমস্যা প্রকট।
আন্তনগর ট্রেনের টিকিট বিক্রি শুরু হয় ১০ দিন আগ থেকে। ফলে যাত্রীদের আসন সংরক্ষিত থাকে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বগি অকেজো হয়ে গেলে যাত্রীদের বেকায়দায় পড়তে হয়।
রেল সূত্র জানায়, ঢাকা-সিলেট পথের সুরমা মেইল চলে দুবার। প্রতিবারই ট্রেনটিতে নয়টি করে বগি থাকার কথা। কিন্তু এখন ট্রেনটি চারটি করে বগি নিয়ে চলে। এর বাইরে রেলের পূর্বাঞ্চলে ভাওয়াল এক্সপ্রেস, নোয়াখালী এক্সপ্রেস, মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস, দেওয়ানগঞ্জ এক্সপ্রেস, ধলেশ্বরী এক্সপ্রেস, কুশিয়ারা, ভৈরববাজার লোকাল ট্রেনগুলোরও একই অবস্থা। পশ্চিমাঞ্চলে কম বগি নিয়ে চলা ট্রেনগুলোর মধ্যে রাজশাহী এক্সপ্রেস, রকেট মেইল, উত্তরা এক্সপ্রেস, পোড়াদহ-গোয়ালন্দ লোকাল উল্লেখযোগ্য। এসব দিনে জোড়ায় জোড়ায় দুই দিক থেকেই ট্রেন চলাচল করে।

দুই ঠিকাদারের প্রাধান্য : কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে বেশি মনোযোগ

দরকারি প্রকল্পে অর্থায়ন না করে দীর্ঘদিন ঝুলিয়ে রাখার ঘটনা ঘটছে রেলওয়েতে। আবার কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নে তোড়জোড় দেখা গেছে। এভাবে অপরিকল্পিত প্রকল্প বাস্তবায়নের কারণে বিনিয়োগের পুরো সুফল পাচ্ছে না রেল।
এর বড় উদাহরণ চীন থেকে প্রায় ৬০০ কোটি টাকায় ডেমু ট্রেন ক্রয়। ইঞ্জিন-বগির প্রকট সংকটের সময় নিজস্ব অর্থায়নে ২০ সেট ডেমু ট্রেন কেনা হয়। তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন দায়িত্ব নিয়েই এই প্রকল্প গ্রহণ করেন। এই ট্রেন নামানোর পরই দেখা যায়, এতে পর্যাপ্ত বাতাস প্রবেশের সুযোগ নেই। আসনের অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পথে এটি চালুর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে রেল কর্তৃপক্ষ। অথচ এই প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল ঢাকার যানজট নিরসনের কথা বলে।
এখন দুই সেট ডেমু জোড়া দিয়ে একটি করে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পথে চলছে। দিনে আসা-যাওয়া মিলে চলে ছয়বার। বেশির ভাগ ডেমু ট্রেন চলছে ঢাকার বাইরে, দূরের পথে। এ অবস্থায় আবারও ২০ সেট ডেমু ট্রেন কেনার প্রাথমিক দরপত্র আহ্বান করেছে রেলওয়ে। এগুলো গাজীপুরের হাইটেক পার্কের আশপাশে চালানো হবে বলে সূত্র জানায়।
রেলওয়ে সূত্র বলছে, প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় সবচেয়ে বেশি বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, ঠিকাদারের স্বার্থ ও কমিশন-বাণিজ্য। রেললাইন নির্মাণ ও অবকাঠামো উন্নয়নের ৮০ শতাংশ কাজের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এগুলো হচ্ছে তমা ও ম্যাক্স গ্রুপ। তমার চেয়ারম্যান আতাউর রহমান ভূঁইয়া নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। আর এই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে একজন প্রতিমন্ত্রী জড়িয়ে আছেন বলে সূত্র জানায়। আর ম্যাক্সের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ আলমগীরের বাড়িও নোয়াখালী জেলায়। তিনি অবশ্য দীর্ঘদিন ধরেই রেলে কাজ করছেন। এই দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে রেলের সাবেক অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা চাকরি করেন।
বর্তমানে সবচেয়ে দ্রুতগতিতে রেললাইন নির্মাণের কাজ চলছে গোপালগঞ্জ ও পাবনায়। ২০১০ সালের দিকে রাজস্ব খাত থেকে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকায় কালুখালী-ভাটিয়াপাড়া পথের লাইন সংস্কার ও কাশিয়ানী-গোপালগঞ্জ ও টুঙ্গিপাড়া পথে নতুন রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প নেওয়া হয়। এখন পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ ৬০ শতাংশের বেশি শেষ হয়েছে। প্রায় একই সময়ে ১ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকায় ঈশ্বরদী থেকে ঢালারচর পর্যন্ত নতুন রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প নেওয়া হয়। এটিও রাজস্ব খাতের প্রকল্প। বাস্তবায়নও করা হয়েছে দ্রুত। ইতিমধ্যে ৭৭ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
রেলের একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, এসব প্রকল্প নেওয়ার আগে যাত্রী চাহিদা কিংবা লাভ-লোকসানের বিষয়টি কমই বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এগুলোর চেয়েও জরুরি ছিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পথে নতুন রেললাইন নির্মাণ ও ইঞ্জিন-বগি কেনা। কারণ, এই পথে যাত্রী চলাচল সবচেয়ে বেশি।
রেলের অভ্যন্তরীণ হিসাবে দেখা গেছে, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পথে এখন দিনে ৩২ বার ট্রেন আসা-যাওয়া করে। যাত্রী যাতায়াত করে দৈনিক গড়ে ২৫ হাজার। এই পথে আরেকটি রেললাইন নির্মাণের পরামর্শ দিয়েছিলেন রেলের অনেক কর্মকর্তা। কিন্তু সময়ক্ষেপণ করে শেষমেশ ২০১৪ সালে আরেকটি মিশ্রগেজ লাইন নির্মাণে ৩৭৯ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। দুই বছরের বেশি সময় পর এখন ঠিকাদার নিয়োগ হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ থেকে বগুড়া পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ করলে উত্তরবঙ্গের সঙ্গে দূরত্ব কমে যায় প্রায় ১৩০ কিলোমিটার। অথচ এই প্রকল্প বাস্তবায়নে রেলের আগ্রহ কম।
জানতে চাইলে রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যেসব প্রকল্প প্রয়োজন মনে করেছি, সেগুলো আগে নিয়েছি। এখানে রাজনৈতিক কোনো কারণ নেই। আগের সরকারগুলো কাজই করেনি। আমরা তো করছি।’ ডেমু আমদানির বিষয়ে তিনি বলেন, শুরুতে এর কিছু কারিগরি সমস্যা ছিল। এখন আর সমস্যা নেই।
আগ-পিছ না ভেবে প্রকল্প
ঢাকা-চট্টগ্রাম পথে ১২৫ কিলোমিটার মিটারগেজ রেললাইন নির্মাণ শেষ হয়েছে গত বছর। এখন এই রেলপথটি ব্রডগেজ ট্রেনের চলার উপযোগী করার জন্য তোড়জোড় শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে আখাউড়া থেকে লাকসাম অংশে মিশ্রগেজ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। বাকি পথও মিশ্রগেজ করার প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন আছে।

তমা ও ম্যাক্স বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে মিলে কাজ করছে। তাদের সুবিধা দেওয়ার সুযোগ নেই
মুজিবুল হক, রেলমন্ত্রী
রেলওয়ে সূত্র বলছে, আসলে এই পথে এখন মিশ্রগেজ লাইন করা অনেকটাই বিলাসিতা। কারণ, রেলের পূর্বাঞ্চলের কোথাও ব্রডগেজের অবকাঠামো নেই। আর যদি ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করতেই হয়, তাহলে ১২৫ কিলোমিটার নতুন মিটারগেজ লাইনের প্রকল্প নেওয়ার সময়ই তা মিশ্রগেজের জন্য নেওয়া উচিত ছিল। এতে খরচ কম হতো।
২০১৩ সালের দিকে রেল কর্তৃপক্ষ ভারত থেকে ২২০টি কনটেইনার আমদানি করে। আরও কিছু যন্ত্রপাতিসহ কনটেইনার ক্রয় প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। মালামাল পরিবহন কমে যাওয়ার কারণে অধিকাংশ কনটেইনার এখন অলস পড়ে থাকছে।
ইঞ্জিন-বগি কেনায় ঢিলেমি
রেলে ইঞ্জিনের সংকট প্রকট। ২০১০ সালে ভারতীয় ঋণে ২৬৪টি মিটারগেজ বগি কেনার জন্য প্রকল্প নেয় রেলওয়ে। ২০১২ সালে প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু ছয় বছরে একটি বগিও কিনতে পারেনি রেলওয়ে। নিজেদের অর্থ বা অন্য কোনো সংস্থা থেকে ঋণ নিয়েও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি প্রকল্পটি।
একই অবস্থা ৭০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন কেনার ক্ষেত্রেও। ২০১১ সালে নেওয়া এই প্রকল্পের একচুলও অগ্রগতি নেই। সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে নেওয়া এই প্রকল্পের মেয়াদ আগামী জুনে শেষ হওয়ার কথা। এর মধ্যে খুলনা স্টেশন আধুনিকায়নে ৭৯ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়ে তা দ্রুত বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
দুই ঠিকাদারই সব
রেলওয়ে সূত্র জানায়, রেলের নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে তমা ও ম্যাক্স গ্রুপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ। রেললাইনে ব্যবহারের জন্য সুনামগঞ্জের ছাতকে রেলের একটি নিজস্ব কংক্রিট স্লিপার তৈরির কারখানা রয়েছে। কিন্তু এটি এখন প্রায় অকেজো করে রাখা হয়েছে। এই সুযোগে ম্যাক্স ও তমা গ্রুপ নিজেরা স্লিপার তৈরির কারখানা স্থাপন করে ফেলেছে। এখন রেলের প্রকল্পে এই দুই প্রতিষ্ঠানের স্লিপার ব্যবহার করা হয়। তমার স্লিপার কারখানা জামালপুরে আর ম্যাক্সেরটি পঞ্চগড়ে। বর্তমানে বছরে প্রায় ১০০ কোটি টাকার স্লিপার দরকার হয় রেল কর্তৃপক্ষের। রেলের স্লিপার কারখানা নির্মাণ করা হয় ১৯৮৮ সালে। কারখানার সহযোগী হিসেবে ভোলাগঞ্জে রয়েছে পাথর সংগ্রহের কারখানা। সংগ্রহ করা পাথর স্লিপার কারখানায় আনার জন্য রয়েছে রূপওয়ে (তারের পথ)। এখন এর সম্পদ বেহাত হয়ে যাচ্ছে।
রেলের দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দুটির স্বার্থেই কর্তৃপক্ষ এই কারখানাটি অকেজো করে রেখেছে।
তমা ও ম্যাক্স অবাধে রেলের সম্পদ ব্যবহার করছে। সেনানিবাস রেলস্টেশনের পাশে রেলের জায়গায় দীর্ঘদিন অফিস নির্মাণ করে তা ব্যবহার করে ম্যাক্স। ঢাকা উড়ালসড়ক প্রকল্পের পথে হওয়ার কারণে সম্প্রতি এই অফিস সরিয়ে নেওয়া হয়। তমাকে গোপীবাগে রেলের জায়গায় নির্মাণ যন্ত্রপাতি রাখার অনুমতি দিয়েছে রেলওয়ে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে তমা গ্রুপের মূল কাজ ছিল সড়ক খাতে। এখন প্রতিষ্ঠানটি রেলের কাজ বেশি করছে। জোট সরকারের আমলে বাণিজ্য উপদেষ্টা বরকতউল্লার সঙ্গে তমার চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। এখন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজমের সঙ্গে। মির্জা আজম প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে তা স্বীকার করেন।
জানতে চাইলে তমার চেয়ারম্যান আতাউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মির্জা আজম আমার ২৫-৩০ বছরের পুরোনো বন্ধু। ব্যবসায়িক সম্পর্কের কোনো বিষয় নেই। আর রেলের কাজ করার জন্য যে যন্ত্রপাতি কিনেছি, তা রেলেও নেই। এই বিনিয়োগ করার কারণেই তো টাকা দেশে থাকছে। নতুবা বিদেশে চলে যেত।’ বিএনপির বরকতউল্লার সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ব্যবসা করলে সবার সঙ্গেই সম্পর্ক থাকতে হয়। বরকতউল্লা আমার নিজ এলাকার সাংসদ ছিলেন।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে থারেলমন্ত্রী মুজিবুল হক বলেন, তমা ও ম্যাক্স গ্রুপ বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে মিলে কাজ করছে। তাদের প্রতি বিশেষ কোনো নজর নেই। বাড়তি সুবিধা (ফেভার) দেওয়ার সুযোগ নেই। দরপত্রের শর্ত পূরণ যারা করবে তারাই কাজ পাবে। এখানে রাজনৈতিক পরিচয় কোনো বিবেচনায় কে না।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সকাল ৯:৪৩
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×