টিপাইমুখ বাঁধের প্রভাব, ক্ষয়ক্ষতি ইত্যাদি বিষয়েগুলো নিয়ে এখনো পর্যন্ত স্বীকৃত গবেষণার উৎসগুলো হলো - ‘নর্থেস্ট রিজিওনাল ওয়াটার মেনেজমেন্ট প্ল্যান (FAP-6)’, টিপাইমুখ প্রকল্পের জন্য NEECOO এর EIA রিপোর্ট এবং ‘ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মেডেলিং (IWM)’ এর টিপাইমুখের উপর একটি (অপ্রকাশিত) স্টাডি [১]। এই সকল গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তর্থ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশে এই বাঁধের সম্ভাব্য প্রভাব বহুমূখী।
প্রথমতঃ পুরোপুরি পানি নির্ভর সিলেটের এই অঞ্চলের কৃষি হাওড় অঞ্চলের পানির স্বাভাবিক প্রবাহের ওপর নির্ভরশীল। বাঁধের ফলে চাষের মৌসুমে পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যাবেনা, সাথে ফুলেরতাল ব্যারেজের মিলিত প্রভাব এই পরিস্থিতির আরো মারাত্নক অবনতি ঘটাবে। বর্ষা মৌসুমে সুরমা ও কুশিয়ারার প্রাকৃতিক জলপ্রবাহ শুস্ক করার ফলে কমপক্ষে ৭টি জেলা- সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনার ধান উৎপাদন ব্যাহত হবে- যে জেলাগুলোতে দেশের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ধান উৎপাদন হয়। এর মধ্যে সিলেট ও মৌলভীবাজার এলাকাতেই প্লাবনভূমির পরিমাণ কমে যাবে যথাক্রমে ৩০,১২৩ হেক্টর (২৬%) এবং ৫,২২০ হেক্টর (১১%) [২]। এছাড়াও বাঁধের ফলে যেটুকু পানি আসবে ‘কম (ঠান্ডা) তাপমাত্রার’ ও ‘দ্রবীভূত নাইট্রোজেনে’র পরিমান বেশি হওয়াতে প্রাণহীন ও পলি বয়ে আনার অনুপযুক্ত হবে। এতে পাললিক ভূমির স্বাভাবিক উর্বরতা হ্রাস পাবে। মাছসহ জলজ প্রাণের অস্থিত্ব ধ্বংস হবে। পাশাপাশি এই হ্রাসপ্রাপ্ত গতির পানি মেঘনা নদীতে পড়ে ‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’ নদী ত্রয়ীর গতি হ্রাস করবে। ফলে নদীর তলদেশে পলি পড়ে উচু হয়ে ধানের জীবনচক্রের যেসময়ে পানিহীনতা প্রয়োজনীয়, সেসময়েও স্থায়ী জলাবদ্ধতা আকাড়ে জমে থাকবে।
দ্বিতীয়তঃ টিপাইমুখ প্রকল্পের অন্যমত উদ্দেশ্য ‘ফুলেরতাল ব্যারেজ’ নির্মাণ। এটি নির্মাণ করবে না এমন কোন নিশ্চয়তা ভারত দেয়নি বরং তাদের পত্র-পত্রিকায় এই বাঁধ পরির্বতিকালীন সেচসহ অন্যান্য সুবিধাদির খবর প্রকাশিত হয়েছে। টিপাইমুখের সাথে ‘ফুলেরতাল ব্যারেজ’ যুক্ত হলে বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের ব্যাপক অঞ্চলসহ ঢাকা বিভাগের বেশি কিছু অঞ্চলের মরুকরণ ঘটাবে। কারণ শুকনো মৌসুমে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর গতিপ্রবাহ মারাত্নকভাবে হ্রাস পাবে বাঁধে ও ব্যারেজের কারণে।
তৃতীয়তঃ বছররের অন্যান্য সময়ে শান্ত থাকলেও বরাক ও এর শাখা নদীগুলো মৌসুমী বৃষ্টিপাতের সময় স্রোতস্বী হয়ে ওঠে। ভূ-প্রকৃতিগত কারণেই বাংলাদেশের সিলেট ও পার্শ্ববর্তী মনিপুর অঞ্চলে বর্ষাকালব্যাপী অধিক পরিমানে বৃষ্টি হয়। সাধারণ ভাবে এই বৃষ্টিপাতের ৬০-৭০ ভাগ হয় জুন থেকে অক্টোবরের মধ্যে। উল্টোদিকে বছর জুড়ে কর্যক্ষম রাখতে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রকে মে-জুনের ভেতরে পূর্ণ পানি ধারণ ক্ষমতা বজায় রাখতে হবে। ফলে এই সময়ে বাঁধের ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দিতে হবে। সেক্ষেত্রে বাঁধের ভাটিতে মনিপুরের এলাকাগুলোসহ বাংলাদেশে বন্যা দেখা দেবে।
চতুর্থতঃ টিপাইমুখ বাঁধের ফলে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা কিম্বা ফুলেরতাল ব্যারেজের কারণে মরুকরণ যাই ঘটুক; উভয় ক্ষেত্রেই নদীর গতিপ্রবাহ হ্রাসের বিরূপ প্রভাব হিসেবে এই অঞ্চলের মাটির লবনাক্ততা বৃদ্ধিসহ উপকূল অঞ্চলব্যাপী লবনাক্ততার বিস্তার ঘটবে। সাধারণত জলাবদ্ধ অবস্থায় মাটিস্থ বায়ুর অক্সিজেন হ্রাসে অথবা অধিক শুকনো অবস্থা; উভয় ক্ষেত্রেই লবনাক্ততার বৃদ্ধি ঘটে। এদিকে নদীর পানি সমুদ্রে মিলিত হয়ে মিঠা পানির স্রোত লোনা পানির প্রবেশ রোধ করে, তাই মিঠা পানির স্রোত দুর্বল হওয়া মানে লোনা পানির স্থলভাগে ঢুকে পড়া এবং মাটির লবনাক্ততা বৃদ্ধি ঘটা। এতে বাংলাদেশের বিরাট এলাকার কৃষি প্রাণ প্রকৃতি ধ্বংস হবে।
পঞ্চমতঃ ‘হাওড়গুলো’ বাংলাদেশের উত্তরপূর্বাঞ্চল অর্থাৎ মেঘনা-সুরমা-কুশিয়ারা অববাহিকার সতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশের পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে ছোটবড় মোট ৪১১ টি হাওড় প্রায় ৮০০০ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে অবস্থিত, যা এই অঞ্চলের মোট ক্ষেত্রফলের শতকরা ২৫ ভাগ [৩]। এই হাওড়গুলির কিছু ‘রাইপেরিয়ান জলাভুমি’ অর্থাৎ যেগুলো প্লাবনভূমিতে অবস্থিত। এগুলো নদীর সাথে সরাসরি যুক্ত বলে নদীর প্রবাহ বৃদ্ধি বা হ্রাসে প্রভাবিত হয়। আবার কিছু আছে ‘নন-রাইপেরিয়ান জলাভূমি’ এদের পানির যোগান দেয় আশেপাশের নদী ও ভূগর্ভস্থ পানির প্রবাহ। এখন বর্ষাকালে পানির প্রবাহ কমে গেলে রাইপেরিয়ান হাওড়গুলিতে পানি যাবেনা এবং সেই সাথে ভূগর্ভস্থ প্রবাহ কমে যাওয়ায় নন-রাইপেরিয়ান হাওড়গুলিও পানি পাবেনা। এই হাওড় এলাকার রয়েছে এক বিচিত্র বাস্তুতন্ত্র। এই হাওড়গুলি বর্ষা মৌসুমে দেখতে অনেকটা সমুদ্রের মত হয় এবং বন্যার পানি সরে গেলে জলজ প্রাণী, বিশেষ করে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের অভয়াশ্রমে পরিনত হয়। মৎস শিকার জলপূর্ন এই হাওড় এলাকার মানুষদের অন্যতম প্রধান পেশা। বাঁধের কারণে বন্যার সময় পানি না আসায় এই হাওড়গুলি একসময় ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাবে, সেই সাথে বিলুপ্ত হবে বেশ কিছু প্রজাতি এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জীবিকা হারাবে এই এলাকার ২ কোটি মানুষ।
ষষ্ঠতঃ টিপাইমুখ বাঁধের কারণে শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে বলা হচ্ছে। FAP-6 এর রিপোর্ট অনুযায়ী অমলসিদে পানির সর্বোচ্চ প্রবাহ শতকরা ১০০ ভাগ থেকে ২০০ ভাগ বাড়বে এবং পানির পরিমান বাড়বে শতকরা ৬০ ভাগ। অন্যদিকে টিপাইমুখ প্রকল্পের EIA রিপোর্টেও বলা হয়েছে বাঁধের কারনে শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রবাহ ১১০% বেড়ে যাবে। FAP-6 এর রিপোর্টে বলা হচ্ছে যে, এই বর্ধিত প্রবাহ নৌচলাচল সেচ ও মৎস্য চাষে বৃদ্ধি ঘটবে। এবং ভয়াবহ বিষয় হলো বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের এই হাওড়গুলি শুষ্ক মৌসুমে যখন শুকিয়ে যায় কৃষকরা সেখানে অঞ্চলের একমাত্র ফসল বোরো ধান বপন করে। এই জনগোষ্ঠীর একমাত্র শর্করার যোগান এই ধান বর্ষার আগেই ঘরে উঠে। এখন বাঁধের কারনে শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রবাহ বেড়ে গেলে এই এলাকার চাষাবাদ ব্যহত হবে। এছাড়াও বিবেচনা করা উচিত এই জমিগুলো বন্যার সময় প্লাবিত হয়ে বিপুল পরিমান পলি জমে। এখন বর্ষা মৌসুমে পানি কমে গেলে আগের মত জমিগুলো আর প্লাবিত হবেনা, কমবে তাদের উর্বরতা।
সপ্তমতঃ জলাধারের নিদৃষ্ট ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশী পানি জমলে ‘স্পিলওয়ে’ বা বিকল্প পথ দিয়ে ভাটিতে প্রবাহিত করা হয়, যেমনটা আছে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে। বরাক অববাহিকায় যদি পরপর কিছু অতি বর্ষা মৌসুম আসে সেক্ষেত্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাত্রা আগের মত থাকলেও এই অতিরিক্ত পানি বিকল্প পথে বের করে দিতে হবে। বাঁধ হবার পর ভাটিতে মানুষ স্বাভবতই তাদের ঘরবাড়ি আগের মত উঁচু করে বানাবেনা এবং অনেকেই নিম্নাঞ্চলে বসবাস শুরু করবে। সেক্ষেত্রে এই জাতীয় অতি বর্ষা মৌসুমে বাঁধের নিরাপত্তার জন্য অধিক পানি ছেড়ে দিলে তা ভাটিতে হঠাৎ বন্যার সৃষ্টি করবে। এমন উদাহরন ভারতেই আছে। ১৯৭৮ সালে ‘ভকরা বাঁধ’ থেকে জরুরী ভিত্তিতে পানি অপসারনের কারণে পাঞ্জাবের প্রায় ৬৫,০০০ মানুষ গৃহহারা হয়েছিল [৪]। শোনা যায়, ‘ভেকরা বাঁধ’ প্রায় উল্টে পড়ার দশা হয়েছিল এবং ঐ সময় পানি না ছাড়া হলে বাঁধ ভেঙ্গে পাঞ্জাবের প্রায় অর্ধেক এলাকা প্লাবিত হত।
অষ্টমতঃ ভুমিকম্পে বাঁধ ভাঙ্গার ভয়াবহ পরিস্থিতির বর্ণনা কিছুটা FAP-6 এর রিপোর্টে আছে, তবে এর সবকিছুই তাত্ত্বিক। সত্যিকারের ভয়াবহতা চিন্তা করা সম্ভব নয়। এই জায়গা পৃথিবীর ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকাগুলোর একটি। একটি ভূতাত্ত্বিক প্লেটের চ্যুতির উপর অবস্থিত এই পুরো এলাকা। যেটি আবার সুরমা রক নামক নরম পাললিক শিলা দ্বারা গঠিত। এই অঞ্চলে গত ১৫০ বছরে রিক্টার স্কেলে ৭ এর অধিক মাত্রার দু’টি ভূমিকম্পে হয়েছে। যার মধ্যে শেষটি ছিল ১৯৫৭ সালে ৮ মাত্রার অধিক, যা কিনা টিপাইমুখ প্রকল্প থেকে পূর্ব-উত্তরপূর্ব দিকে মাত্র ৭৫ কিমি দূরে [৫]। এছাড়া ‘জলাধার আবেশিত ভূমিকম্প’ (Reservoir Induced Seismicity বা RIS) এর আশঙ্কাত আছেই। ভারতের টিপাইমুখ প্রকল্পের EIA রিপোর্ট অনুযায়ী এই বাঁধের ‘Full Reservoir Level’ সমুদ্র সমতল থেকে ১৭৫ মিটার উঁচুতে আর এর তলদেশের গড় উচ্চতা সমুদ্র সমতল থেকে ২২.৫ মিটার উচুতে; অর্থাৎ জলাধারের পানির গড় উচ্চতা ১৫২.৫ মিটার। গবেষণায় দেখা গেছে যে যেসব জলাধারের পানির উচ্চতা ১৫০ মিটারের বেশী তাদের ক্ষেত্রে এই RIS এর হার শতকরা ৩০ ভাগ [৬]। কাজেই এরকম একটি এলাকায় ১৬৮.২ মিটার উচ্চতার একটি জলাধার নির্মাণ করা মানে বাংলাদেশ ও ভারতের পুরো এলাকার জন্য সেধে ঘন ঘন ভূমিকম্প এবং তার ফলে বাঁধ ভাঙার বিপদ ডেকে আনা। আর বাঁধ ভেঙে গেলে ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে বাঁধের সঞ্চিত পানি মোটামুটি ৫ মিটার উচ্চতা নিয়ে বাংলাদেশে হাজির হবে এবং ২৪-৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পানি তার সর্বোচ্চ উচ্চতা ২৫ মিটারে পৌঁছবে যা প্লাবনভূমির উচ্চতার চেয়ে ৮ মিটার বেশি উঁচু, ফলে প্লাবনভূমিকে ৮ মিটার পানির নিচে তলিয়ে রাখবে ১০ দিন বা তারচেয়েও বেশি সময় ধরে [৭]!
তথ্যসূত্র:
০১. টিপাইমুখ বাঁধ ও বাংলাদেশ প্রক্ষাপট; জাহিদুল ইসলাম। ২০০৯। প্রকাশায়তন।
০২. টিপাইমুখ বাঁধ: আশ্বাস ও আশ্বস্ত হওয়ার রাজনীতি; কল্লোল মোস্তফা। ২৪-১১-২০১১, সাপ্তাহিক বুধবার।
০৩. টিপাইমুখ বাঁধ ও বাংলাদেশ প্রক্ষাপট; জাহিদুল ইসলাম। ২০০৯। প্রকাশায়তন।
০৪. টিপাইমুখ বাঁধ ও বাংলাদেশ প্রক্ষাপট; জাহিদুল ইসলাম। ২০০৯। প্রকাশায়তন।
০৫. টিপাইমুখ বাঁধ: মুনাফা আর আধিপত্যের গ্রাসে মানুষ-প্রকৃতি; আবুল হাসান রুবেল। প্রতিবেশ আন্দোলনের প্রকাশনা।
০৬. টিপাইমুখ বাঁধ ও বাংলাদেশ প্রক্ষাপট; জাহিদুল ইসলাম। ২০০৯। প্রকাশায়তন।
০৭. টিপাইমুখ বাঁধ: আশ্বাস ও আশ্বস্ত হওয়ার রাজনীতি; কল্লোল মোস্তফা। ২৪-১১-২০১১, সাপ্তাহিক বুধবার।
বাঁধ ও ব্যারেজ সর্ম্পকিত কিছু সাধারণ তথ্যের জন্য এই খানে ক্লিক করুন।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১১ দুপুর ১:৪৪