আজকাল মা-বাবার আশা কেমন জানি অনেক বেড়ে গেছে। তাই একটু হোঁচট খেলে অনেক বড় ব্যথা পান। সব সময় সন্তানদের পরীক্ষার ফলাফল কেমন হবে? কতটা হবে? কীভাবে করা যায়? এ চিন্তায় মগ্ন। অনেকেই আবার নিজের শরীর স্বাস্থ্যের কথাও ভাবেন না। সন্তানের চিন্তায় নাওয়া-খাওয়াও বন্ধ। কিন্তু তাদের আশা কী? আশা তাদের সন্তান প্রথম হবে অথবা দ্বিতীয়। প্রত্যেক বিষয়ে, সব পরীক্ষায় একশতে একশ পাবে। দুই নম্বর কেন এক নম্বরও কম পাওয়া চলবে না। তাহলে সব শেষ। শ্রেণী শিক্ষকের কাছে যাওয়া, খাতা দেখা। সবার সামনেই দুই নম্বর কম পাওয়ার জন্য বকাঝকা আবার কোন কোন ক্ষেত্রে সন্তানের গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করেন না। সম্পূর্ণ রূপে ভুলে যান সন্তানটি ছোট হলেও তার একটা সম্মান আছে। বিশেষ করে শিক্ষক ও বন্ধুদের সামনে। এতে করে হিতে বিপরীতও হয় অনেক সময়। এমন সাজা পেতে পেতে সন্তান বিগড়ে যায়। দিন দিন লেখাপড়া খারাপ হতে থাকে।
আবার কোনো কোনো মা- বাবা মাসের পর মাস সন্তানের কোন খবর নেন না। শুধু পরীক্ষার ফলাফল আসলেই খবরদারি শুরু হয়। অনেক মা-বাবা আছেন সন্তানকে একা গৃহভৃাত্যের কাছে রেখে মাসের পর মাস দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়ান। আবার সন্তানের কাছে ভালো অথবা উত্তম ফলাফলও আশা করেন। কিন্তু একবারও ভাবেন না মা-বাবার অবর্তমানে সন্তান কতটা নিরাপদ অথবা মনোযোগী শিক্ষার্থী হতে পারে। তাদের মুখে মুখে শুধু একথাই শোনা যায় এবার প্রথম হতে পারলে না কেন? আমি তোদের কম খাওয়াই? তোদের জন্য কম টাকা খরচ করি? এমনতরো আরো কত কথা। একবার সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করার কথা ভাবেন না। নৈতিক শিক্ষা কতটা পেলো, মূল্যবোধ শিক্ষা অর্জন কতটা হলো? ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হলো কী না? এসব কখনো চিন্তা করেন না। শুধু পরীক্ষায় এ প্লাস। ডাক্তার হওয়া, প্রকৌশলী হওয়া, বর্তমানে কমার্স পড়ে ব্যবসায়ী, ব্যাংকার হওয়ার হিড়িক পড়েছে। কিন্তু ভালো মানুষ, সৎ মানুষ, সত্যিকারের মানুষ, পরিপূর্ণ অর্থে মানুষ হওয়ার কথা ভাবছেন না। তাই আমাদের সমাজও প্রকৃত মানুষ শূন্য হয়ে যাচ্ছে। হাতে গোনা ২/৪ জন মুরুব্বি সমাজ থেকে চলে গেলে আমাদের সমাজ অভিভাবক হারা হয়ে যাবে। কারণ আমরা পরবর্তী প্রজন্মকে তেমনভাবে গড়ে তুলছি না। আমি মা বাবাদের বলব এ প্লাস, ডাক্তার, শিক্ষক, প্রকৌশলী বানানোর চিন্তা থেকে বের হয়ে মানুষের মতো মানুষ করার ভাবনায় লিপ্ত হোন। আপনার সন্তান মানুষ হলে আপনার স্বপ্নের বাস্তবায়ন হবে নিঃসন্দেহে। যদি মানুষের মতো মানুষ না হয় তাহলে আপনার সাথে চোখ ফেরাতেও দেরি করবে না। যার জন্য বিনিদ্র রাত কাটিয়েছেন, না খেয়ে খাইয়েছেন তাদের কাছ থেকে এমন কষ্ট পেলে বেঁচে থাকাটাই দায় হবে। শুধু নিঃশ্বাসটা আসা যাওয়া করবে। আপনাদের কাঠামোটা ঠিক থাকবে ভেতরের মানুষটি মরে, পুড়ে ভস্ম হয়ে যাবে। এ দুঃখ কাউকে বলার মানুষও রাখার জায়গাও খুঁজে পাবেন না।
বহু মা-বাবা আছেন যাঁরা অপ্রাপ্ত ছেলেমেয়েদের আবদার মেটানোর জন্য তাদের হাতে জীবন ধ্বংসের অস্ত্র তুলে দিচ্ছেন। নিজের অজান্তেই ছেলেমেয়েকে ঠেলে দিচ্ছেন অন্ধকারের অতল গহ্বরে। আর সে মারণাস্ত্র হচ্ছে মোবাইল ফোন। সারাক্ষণ তাদের কানে লেগে থাকে। যা শারীরিকভাবে অসুস্থ করে তোলে, মেজাজ খিট খিটে করে, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণী কক্ষে না গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলা চলে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণী কার্যক্রমের বাইরের সময় কোন না কোন উছিলা ধরে বাসা থেকে বের হয় আর চলে ফোনে কথা বলা। ভিডিও দেখা (!) আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম বলে যাদের কাছে সমাজ ব্যবস্থাকে ছেড়ে দেয়ার চিন্তা করছি তারা অপরিপক্ব, দায়িত্বহীন সমাজ ব্যবস্থাকে হিসেবে গড়ে উঠছে। তারা নিজেদের ভালো মন্দ বুঝে না। অন্যের ভালো-মন্দ কেমন করে বুঝবে। অন্যকে কীভাবে সাহায্য সহযোগিতা করবে? একবারও ভেবেছেন কি আজকের মা-বাবা।
অনেক শিক্ষার্থীর বাবা দেশের বাইরে থাকেন। তাদের শ্রমে-ঘামে আর রক্তে ভেজা বৈদেশিক মুদ্রা হেলায় খরচ করে মোবাইল কার্ড আর অপ্রয়োজনীয় সিডি দেখায় খরচ করে। তারা ঐ টাকায় বিভিন্ন শপিং মল ও চাইনিজ রেস্তোরাঁ ভিজিট করে। তবে একথা সত্য তারা ক্লাসমুখী হয় না। প্রয়োজনে প্রাইভেট পড়ে, কোচিং সেন্টারে যায়, বিভাগের শিক্ষকদের চেনে না, নাম জানে না। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, কলেজের অধ্যক্ষ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নামও জানে না। কারণ তারা একদিন ভর্তি হতে যায় তারপর পরীক্ষা দিতে যায়। এ হলো আমাদের আগামী প্রজন্ম।
প্রসঙ্গত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন তাঁর ছেলের স্কুলের প্রধান শিক্ষককে লেখা পত্রটি উপস্থাপন করছি। কারণ তিনিও অভিভাবক, আমরা ও অভিভাবক। তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েও সন্তানকে যেভাবে তৈরি করতে চেয়েছেন তা আমাদের জানা দরকার। পত্রটি নিম্নরূপ-
মাননীয় মহাশয়,
আমার পুত্রকে জ্ঞানার্জনের জন্য আপনার কাছে প্রেরণ করলাম। তাকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবেন এটাই আপনার কাছে আমার বিশেষ দাবি। আমার পুত্রকে অবশ্যই শেখাবেন সব মানুষই ন্যায় পরায়ণ নয়, সব মানুষই সত্যনিষ্ঠ নয় তাকে এও শেখাবেন, প্রত্যেক বদমায়েশের মাঝেও একজন বীর থাকতে পারে, প্রত্যেক স্বার্থপর রাজনীতিকের মাঝেও একজন নিঃস্বার্থ নেতা থাকে। তাকে শেখাবেন, পাঁচটি ডলার কুঁড়িয়ে পাওয়ার চেয়ে একটি উপার্জিত ডলার অধিক মূল্যবান। এও তাকে শেখাবেন কীভাবে পরাজয়কে মেনে নিতে হয় এবং কীভাবে বিজয়োল্লাসে উপভোগ করতে হয়। হিংসা থেকে দূরে থাকার শিক্ষাও তাকে দেবেন। যদি পারেন নীরব গোপন সৌন্দর্য তাকে শেখাবেন। সে যেন আগেভাগেই একথা বুঝতে শেখে- যারা পীড়নকারী তাদেরকে সহজে কাঁবু করা যায়। বইয়ের মাঝে কী রহস্য লুকিয়ে আছে তাও তাকে বুঝতে শেখাবেন। আমার পুত্রকে শেখাবেন বিদ্যালয়ে নকল করার চেয়ে অকৃতকার্য হওয়া অনেক বেশি সম্মানজনক। নিজের ওপর তার যেন আস্থা থাকে। এমন কি সবাই যদি সেটাকে ভুলও মনে করে। তাকে শেখাবেন, ভদ্রলোকের প্রতি ভদ্র আচরণ করতে, কঠোরদের প্রতি কঠোর হতে। আমার পুত্র যেন হুজুগে মাতাল জনতার পদাংক অনুসরণ না করার শিক্ষা পায়। সে যেন সবার কথা শুনে তারপর সত্যের পর্দায় ছেঁকে যেন ভালোটাই শুধু গ্রহণ করে এ শিক্ষাও তাকে দিবেন। সে যেন শিখে, দুঃখের মাঝে কীভাবে হাসতে হয়। আবার কান্নার মাঝে লজ্জা নেই, এ কথাও তাকে বুঝতে শেখাবেন। যারা নির্দয়, নির্মম, তাদেরকে সে যেন ঘৃণা করতে শেখে, আর অতিরিক্ত আরাম আয়েশ থেকে দূরে থাকে। আমার পুত্রের প্রতি সদয় আচরণ করবেন কিন্তু সোহাগ করবেন না। কারণ আগুনে পুড়েই ইস্পাত খাঁটি হয় . . .
এভাবেই আরো অনেক কথা লিখেছেন তিনি। কোথাও শিক্ষার্থীকে প্রথম হওয়ার কথা, ডাক্তার হওয়ার কথা, বড় লোক হওয়ার কথা লিখা নেই। ইদানীং ছেলেমেয়ের পোশাকও আমাদের বেশ ভাবিয়ে তুলছে। তাদের যা খুশি, যেমন করে খুশি পোশাক পরছে, গয়না পরছে ছেলের অলংকার মেয়ে, মেয়ের অলংকার, পোশাক ছেলে পরছে। এটা আধুনিকতা না প্রজন্ম ধ্বংসের একটা নিদর্শন তা বুঝতে পারছি না। মা-বাবার কাছে আমার আরেকটা অনুরোধ দয়া করে আপনার ছেলেমেয়ের পোশাকের প্রতি একটু বিশেষ নজর দিবেন। পোশাকের মধ্যেও শালীনতা ভদ্রতা রয়েছে। আপনার সন্তানের শালীন, রুচিশীল পোশাক পরিচ্ছদ আপনার রুচির পরিচায়ক এবং অন্যের শ্রদ্ধা আর ঘৃণাও এখানে জড়িত। আজ আর নয় অন্য একদিন অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে লিখবো। পাঠক আপনারা ভালো থাকবেন। শুভেচ্ছা রইল।