somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

তাহমিদ রহমান
একজন অলস মানুষ; ভালোবাসি স্বপ্ন দেখতে, চিন্তা করতে, আর কবিতা লিখতে।পেশায় চিকিৎসক, তবে স্বপ্ন দেখি সাহিত্যের সাথে নিবিড় সখ্য গড়বার।ছাত্রজীবনে জড়িত ছিলাম স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে, ভবিষ্যতে কাজ করতে চাই কন্যাশিশু নিরাপত্তা ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ নিয়ে।

অনিকের গল্প (পর্ব ২)

২৩ শে নভেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



অধ্যায় ১ঃ হাসপাতালের নাইট শিফট (২য় খন্ড)

( পর্ব ১ এর পর)
...............


না। এসব লেখা যায় না। মা চিন্তা করবেন।
মোবাইল পকেটে রাখল অনিক। আবার কাজে ফিরে গেল।

পাঁচটা বাজে। আরও দুই ঘণ্টা। স্টাফ রুমে গিয়ে সোফায় বসল। চোখ বন্ধ করল। কিন্তু শুধু ক্লান্তি — শরীর ভারী, মাথা ঝিমঝিম করছে।
একজন জুনিয়র ডক্টর ঢুকল, নাম রাহুল। ভারতীয়। অনিকের সাথে একই সময়ে জয়েন করেছিল।

"অনিক, তোমাকে একদম বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে," রাহুল বলল।
"আমি ঠিক তা-ই," অনিক বলল।
"আমারও একই অবস্থা। বাড়ি যেতে পারলেই বাঁচি।"
"তুমি কাছেই থাকো?"
"না, ইলফোর্ডে। এক ঘণ্টা লাগে। তুমি?"
"স্ট্র্যাটফোর্ড। চল্লিশ মিনিট, দুটো বাস।"
রাহুল মাথা নাড়ল। "লন্ডন…স্বপ্নের লন্ডন, তাই না? ভীষণ খরুচে এবং ক্লান্তিকর, কিন্তু আমরা এখানেই থাকতে চাই।"
অনিক হাসল। "হ্যাঁ। এখানেই তো আছি।"
রাহুল কফি ঢালল। "এই উইকএন্ডে কিছু করছো?"
"তেমন কিছু না। সম্ভবত ঘুমিয়েই কাটাবো বেশিরভাগ সময়।"
"আমিও। অবশ্য জুনিয়র ডক্টরস ফোরামের কয়েকজন শনিবার রাতে বেরোচ্ছে। শোরডিচে একটা পাবে। আমি যেতে পারি। তুমি আসবে?"

অনিক একটু ভাবল। আগেও দুয়েকবার সে গেছে এসব মিটআপে।
পাব — বিয়ার কিংবা অতিরিক্ত দামে সফট ড্রিঙ্কস। আড্ডা।
কিন্তু কেমন যেন লাগে। সবাই নিজেদের মধ্যে মজা করছে, আর সে পাশে বসে আছে। আড্ডার ভিতরে ঠিক ঢুকতে পারছে না। ভাষার সমস্যা তেমন নেই, কিন্তু সংস্কৃতির একটা দেয়াল আছে। ব্রিটিশ ডাক্তাররা ফুটবল নিয়ে কথা বলে, টিভি সিরিজ নিয়ে কথা বলে, পাব কালচার নিয়ে কথা বলে। অনিক শোনে, হাসে, কিন্তু নিজে থেকে কিছু বলতে পারে না।

"হয়তো," সে বলল।
"ঠিক আছে। বিস্তারিত মেসেজ করে দিব তোমাকে।"

রাহুল চলে গেল। অনিক আবার নিজের মধ্যে ফিরে এল।

ঘড়িতে সময় ছয়টা। বাইরে আলো ফুটছে। ধূসর আলো। লন্ডনের নভেম্বরের ভোর এমনই — রোদ নেই, শুধু ধূসরতা। অন্ধকার থেকে আলোর দিকে যাওয়া, কিন্তু কখনো পুরোপুরি আলো হয় না।

অনিক শেষবারের মতো ওয়ার্ড রাউন্ড দিল। সব রোগী ঠিক আছে। মিসেস প্যাটারসন এখনও ঘুমাচ্ছেন। মিস্টার খলিল জেগেছেন, চোখ খুলে তাকিয়ে আছেন সিলিংয়ের দিকে। তরুণীটি এখনও ঘুমিয়ে।

অবশেষে অনিক ডিউটি হ্যান্ডওভার করল পরবর্তী শিফটের ডাক্তারের কাছে। একজন তরুণ ইংরেজ ডাক্তার, নাম টম। হাসিখুশি। তাজা। রাতভর না ঘুমিয়ে থাকার ক্লান্তি তার চোখেমুখে নেই।

"কেমন ছিল রাতটা?" টম জিজ্ঞেস করল।

"খুব একটা খারাপ না," অনিক বলল। "৭-বি-তে মিসেস প্যাটারসনের দিকে নজর রাখবে। হার্ট রেট এখনো একটু বেশি। আর ২২ নম্বরে মিস্টার খলিল — তার ECG-র দিকে চোখ রাখবে। ৩৫ নম্বরের মেয়েটি ঠিকঠাক আছে, কিন্তু প্রতি দুই ঘণ্টায় অক্সিজেন লেভেল চেক করবে।"
টম নোট নিল। "বুঝেছি। থ্যাংক ইউ। এবার বাড়ি যাও, রেস্ট নাও।"

অনিক মাথা নাড়ল। লকার রুমে গেল। হাসপাতালের পোশাক খুলে রাখল। ব্যাগ তুলে নিল। জ্যাকেট পরল। কালো, পুরোনো একটা বোম্বার জ্যাকেট। দুই বছর আগে Primark থেকে কিনেছিল। সস্তা, কিন্তু কাজ চলে।

হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে মূল প্রবেশপথে এল। বাইরে ঠান্ডা বাতাস — তাপমাত্রা ছয়-সাত ডিগ্রি। জ্যাকেটের জিপার টেনে হাত পকেটে ঢুকাল। বাস স্টপে গেল।

সকাল সাতটা দশ। বাস আসতে আরো দশ মিনিট লাগবে। দাঁড়িয়ে রইল। চোখ ঘুরিয়ে নিল — ভেজা রাস্তা, ফুটপাতে হলুদ-বাদামি পাতা। শরতের শেষ, শীতের শুরু।

একজন বৃদ্ধ মানুষ কুকুর নিয়ে হাঁটছেন। একজন তরুণী জগিং করছে, হেডফোন কানে। দুজন স্কুলছাত্র সাইকেল চালাচ্ছে। জীবন চলছে।
পকেট থেকে মোবাইল বের করে Instagram scroll করল। দেশে থাকা বন্ধুদের অনেকগুলো পোস্ট সামনে এল — কেউ বিয়ে করেছে, কারো বাচ্চা হয়েছে, কেউ নতুন চাকরি পেয়েছে। সবার জীবন এগিয়ে যাচ্ছে। আর সে? এখানে দাঁড়িয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করছে।

অবশেষে বাস এল। লাল ডাবল ডেকার বাস — লন্ডনের ঐতিহ্যের প্রতীক। অনিক Oyster Card ট্যাপ করে উপরের তলায় উঠল, সামনের সিটে বসল।

বাস চলতে শুরু করল। সকালের লন্ডন এখনও ঘুমঘুম — দোকান বন্ধ, রাস্তা ফাঁকা। পাতাহীন গাছ, ধূসর আকাশ, রোদ নেই। অনিক জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইল।

ঢাকায় এই সময় কেমন থাকত? নভেম্বর মানে শীত আসছে। সকালে হালকা কুয়াশা। রোদ উঠলে গরম। রাস্তায় ভিড়, গাড়ির হর্ন আর রিকশার ঘণ্টি। ব্যস্ত ফুচকার দোকান। ধোঁয়া ওঠা চায়ের স্টল।
এখানে? নীরবতা, শৃঙ্খলা, পরিচ্ছন্নতা — কিন্তু কোনো উষ্ণতা নেই।

বাস থামল Stratford Station-এ। অনিক নামল। আরেকটা বাসে উঠতে হবে। আরও পনেরো মিনিট অপেক্ষা।
স্টেশনের কাছে একটা ছোট্ট কফি শপ — Pret A Manger। খোলা। অনিক ঢুকল। লাইনে দাঁড়াল। সামনে দুজন — একজন স্যুট পরা মধ্যবয়সী পুরুষ, হাতে ব্রিফকেস। আরেকজন তরুণী, হেডফোন কানে, মোবাইলে ব্যস্ত।

অনিকের পালা এল। "আমেরিকানো, প্লিজ।"
ক্যাশিয়ার হাসল। "লার্জ নাকি স্মল?"
"লার্জ, প্লিজ।"
"সাড়ে তিন পাউন্ড, প্লিজ।"

অনিক কার্ড দিল। মেশিন বিপ করল। কফি হাতে নিয়ে বেরিয়ে এল।
বাস স্টপে ফিরে এল। কফিতে চুমুক — গরম, শরীরে উষ্ণতা ছড়াল।
ঠিক সময়মতো বাস এল। আবার উঠে পড়ল। এবার নিচের তলায় বসল, জানালার পাশে।

বাস চলছে। রাস্তার দুপাশে দোকান। কেউ হাঁটছে, কেউ সাইকেল চালাচ্ছে। জীবন ধীরে ধীরে জেগে উঠছে।
ফোন খুলে Facebook scroll করল। একটা পোস্ট চোখে পড়ল — মেডিকেল কলেজের এক সিনিয়র, যিনি নিজেও ইংল্যান্ডে থাকেন, তিনি লিখেছেন: "BMW কিনলাম। স্বপ্ন পূরণ হলো।" নিচে ছবি। গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে, হাসিমুখ।

কীভাবে? একই চাকরি, একই বেতন। তাহলে? হয়তো উনি বেশি সঞ্চয়ী। হয়তো তার স্ত্রীও চাকরি করে। কিন্তু...
মনে মনে প্রশ্ন করল অনিক — সে কি ব্যর্থ? অন্যরা সফল, আর সে?
নিজেকে বোঝাল — না, টাকা সব না। শান্তি চাই। মনের শান্তি।
কিন্তু শান্তি কোথায়?



..........(চলবে)

সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে নভেম্বর, ২০২৫ রাত ১০:০৮
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কোরআন-হাদিস অনুযায়ী তারা পাকিস্তান এবং অন্যরা অন্যদেশ

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:২১



সূরাঃ ৮ আনফাল, ৬০ নং আয়াতের অনুবাদ-
৬০। তোমরা তাদের মোকাবেলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ব-বাহিনী প্রস্তত রাখবে। এর দ্বারা তোমরা সন্ত্রস্ত রাখবে আল্লাহর শত্রুকে, তোমাদের শত্রুকে, এছাড়া অন্যদেরকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি আর এমন কে

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:১৩


যখন আমি থাকব না কী হবে আর?
থামবে মুহূর্তকাল কিছু দুনিয়ার?
আলো-বাতাস থাকবে এখন যেমন
তুষ্ট করছে গৌরবে সকলের মন।
নদী বয়ে যাবে চিরদিনের মতন,
জোয়ার-ভাটা চলবে সময় যখন।
দিনে সূর্য, আর রাতের আকাশে চাঁদ-
জোছনা ভোলাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

২০২৪ সালের জুলাই মাস থেকে যেই হত্যাকান্ড শুরু হয়েছে, ইহা কয়েক বছর চলবে।

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪৭



সামুর সামনের পাতায় এখন মহামতি ব্লগার শ্রাবনধারার ১ খানা পোষ্ট ঝুলছে; উহাতে তিনি "জুলাই বেপ্লবের" ১ জল্লাদ বেপ্লবীকে কে বা কাহারা গুলি করতে পারে, সেটার উপর উনার অনুসন্ধানী... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজাকার হিসাবেই গর্ববোধ করবেন মুক্তিযোদ্ধা আখতারুজ্জামান !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:১৮


একজন রাজাকার চিরকাল রাজাকার কিন্তু একবার মুক্তিযোদ্ধা আজীবন মুক্তিযোদ্ধা নয় - হুমায়ুন আজাদের ভবিষ্যৎ বাণী সত্যি হতে চলেছে। বিএনপি থেকে ৫ বার বহিস্কৃত নেতা মেজর আখতারুজ্জামান। আপাদমস্তক টাউট বাটপার একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টি দিল্লী থেকে।

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:১৫


((গত ১১ ডিসেম্বর ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ১ শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা নাকি ব্লগ রুলসের ধারা ৩ঘ. violation হয়েছে। ধারা ৩ঘ. এ বলা আছে "যেকোন ধরণের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×