somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কখনো আমার মা'কে............যা যা করতে দেখি নি।

০৯ ই মে, ২০০৯ রাত ১০:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কখনো আমার মাকে কোনো গান গাইতে শুনিনি৷
সেই কবে শিশু রাতে ঘুম পাড়ানিয়া গান গেয়ে
আমাকে কখনো ঘুম পাড়াতেন কি না আজ মনেই পড়ে না৷....
..........মাছ কোটা কিংবা হলুদ বাটার ফাঁকে
অথবা বিকেলবেলা নিকিয়ে উঠোন
ধুয়ে মুছে বাসন-কোসন
সেলাইয়ের কলে ঝুঁকে, আলনায় ঝুলিয়ে কাপড়,
ছেঁড়া শার্টে রিফু কর্মে মেতে
আমাকে খেলার মাঠে পাঠিয়ে আদরে
অবসরে চুল বাঁধবার ছলে কোনো গান গেয়েছেন কি না
এতকাল কাছাকাছি আছি তবু জানতে পারিনি৷....
(কখনো আমার মাকে)- শামসুর রাহমান


খুব একটা অস্বচ্ছলতায় না কাটলে ও আমার মা'য়ের জীবন অনেক সুখে কেটেছে- এমন ও বলা যায় না। একেবারেই সাধারন মধ্যবিত্ত আমাদের পরিবারে বাবা এখনো চাকরি করেন। বছর খানেক ধরে আমি ও চাকরি করছি। হয়তো অঢেল টাকা-পয়সা কামাই করি না, তবু আমার ব্যক্তিগত খরচ কম বলে কিছু টাকা থেকেই যায়। প্রেমিকা নেই, চা-সিগারেটের নেশা নেই; ভাবি মা'র জন্য কিছু খরচ করি। সে উপায় আছে?

অন্য অনেক মহিলার মত শাড়ি নিয়ে আমার মায়ের কোন মোহ নেই। মা'কে নিয়ে কোথাও বাইরে যাবো, সেখানেও খরচের কোন উপায় নেই। মা' এসি গাড়িতে চড়তে পারেন না- অসুস্থ হয়ে যান। ঢাকা যাবার সময় মা'কে নন-এসিতেই নিয়েযেতে হয়। বাইরে কোথাও বসে কিছু খেতে আমি আমার জীবনে ও দেখি নি। দূরে কোথাও যাবার সময় ব্যাগে করে শুকনো খাবার নিয়ে যান। জোর করে ও কিছু খাওয়াতে পারি না। বাসায় ভালো রান্না হলেও খুব একটা চেখে দেখেন না। হাড়-গোড় আর পা ছাড়া অন্য কোন মুরগীর মাংস খেতে আমি কখনো তাঁকে দেখি নি।

কী দিয়ে শুধবো তবে এ জন্মের ঋণ!

আরো অনেকের মত শামসুর রাহমানের অনেক কবিতাই আমার খুব প্রিয়। তারপরেও, উপরের ঐ কবিতাটার আবেদন আমার কাছে সব সময় অন্য রকম। কেমন একটা আটপৌরে গন্ধ আছে; জীবনের সাথে মিলে যায়। তাহলে, একটু পেছনে ফিরে তাকাই?

আমার মা'য়ের জন্ম, বেড়ে ওঠা গ্রামেই। গ্রামের স্কুল থেকেই মাধ্যমিক পরীক্ষায় উর্ত্তীর্ণ হয়েছিলেন। এমন কোন আহামরি ফলাফল নয়; বরং সোজা কথায় টেনেহেঁচড়ে পাস। এরপর আর কলেজের দিকে পা মাড়ান নি। সুতরাং, প্রচলিত অর্থে আমার মা' একজন অল্পশিক্ষিত মহিলা। তখনো পর্যন্ত আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে দু'চারদিনের বেড়ানো বাদ দিলে কখনো শহরে থাকেন নি। বাবা কর্মসুত্রে থাকতেন চট্টগ্রাম। আর মা' বিয়ের পর ও প্রথম চার বছর গ্রামে আমার দাদা বাড়িতেই ছিলেন। যৌথ পরিবার ছিল তখন। সে সময়ই আমার জন্ম এবং সে সূত্রে জীবনের প্রথম দু'বছর আমার গ্রামেই কেটেছে। আশ্চর্য্য হয়ে ভাবি, এতোকিছুর মধ্য দিয়ে এমন আধুনিক স্বচ্ছ চিন্তা-ভাবনা তাঁর মনে কিভাবে বাসা বাঁধতে পেরেছিল?!

বাবা-মা'র প্রথম সন্তান হিসেবে আমার প্রতি তাঁর একটা আলাদা টান আমি সব সময়ই টের পাই। একেবারে শিশু অবস্থায় মা'কে কাছে পাওয়াতেই বোধহয় বাবার চাইতে তাঁর প্রতি আমার টান একটু দৃষ্টিকটু রকমের বেশি। আমার পরে জন্মানো অন্য দুই ভাই কিন্তু উলটা, বাবার দিকে বেশি ঝুঁকে পড়া। গ্রামে থাকলে আমার পড়াশোনা হয়তো তেমন হবে না, শুধুমাত্র এই আশংকায় মা’ আমার দাদা-দাদীকে রাজি করিয়ে চলে আসেন বাবার কাছে শহরে।

এসব ক্ষেত্রে বিধি মোতাবেক শ্বশুর-শ্বাশুড়ি বৌয়ের উপর নাখোশ থাকেন, ভাবেন ছেলেটাকে 'পর করে নিয়ে গেলো। নিজের মা' বলে বলছি না, সত্যিই জীবনে এই একটাই ব্যতিক্রম পেলাম! আর সব চাচীদের মধ্যে আমার দাদা-দাদী আমার মা'কেই বেশী ভালোবাসতেন। আমার দাদী তো এক রকম আমার মায়ের হাতের উপরে মারা যান।

সাড়ে চার বছর বয়সে আমাকে বাসার কাছের একটা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া হলো। স্কুলের মাষ্টারেরা খুব রাগী হন আর পড়া না পারলেই মারেন এই ভয় কিভাবে যেন আমার ছোট্ট মনে বাসা বেঁধে ছিল! ফলে, ক্লাসে স্যার ঢূকলেই আমি ভয়ে কাঁপতে থাকতাম আর সুযোগ পেলেই পালাতাম (বড় বড় মানুষের জীবনাদর্শ অনুসরণ আর কী! ;) )। শুরু হল মায়ের নতুন কষ্ট। আমার ছোট ভাইটা তখন দু' বছরের। কখনো ওকে কোলে করে আবার কখনো বাসায় কাজের মেয়েটার কাছে ওকে রেখে এসে বসে থাকতেন আমার ক্লাসের পাশেই। মা' একটু চোখের আড়াল হলো তো আমি এক দৌড়ে বাসায়! এভাবে চললো মাস দুয়েক। কী পরিমান কষ্ট দিয়েছি তখন মা'কে- ভাবতেই নিজের উপর রাগ হয় এখন। ইতোমধ্যে ক্লাসে কিছু বন্ধু জুটে গেলো। ভয় ও কমলো। স্কুল পালানো বন্ধ হল। মা' হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন।

তখন মা’য়ের কাছেই পড়তাম। ভালো ফল করেই দ্বিতীয় শ্রেনীতে উঠলাম। এ সময় একটু দুরেই আরেকটা ভালো স্কুলে ভর্তি করানোর ভুত(!) তাঁর মাথায় চাপলো। জীবনে প্রথম ভর্তি পরীক্ষা দিলাম। ভয়ে কিছুই লিখতে পারি নি, তার পরেও কিভাবে যেন ভর্তির সুযোগ পেয়ে গেলাম। সম্ভবতঃ মা' আমাকে দিন রাত কষ্ট করে যা পড়িয়েছিলেন তার জোরেই পার পেয়ে গিয়েছিলাম সেবার।

এবার, শুরু হলো তাঁর নতুন যুদ্ধ। নতুন স্কুলটা শুরু হত সকাল আটটায়। সে সময় আবার আমার দাদীর একেবারে শেষ অবস্থা। বাড়ি থেকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে। ডাক্তাররা জবাব দিয়ে দিয়েছেন। তাঁর সেবা-শ্রুশুষা, তাঁকে দেখতে আসা মেহমানদের সামলানো, এরই ফাঁকে আমাকে সকাল বেলা তুলে দিয়ে ঘুমে ঢুলতে থাকা আমায় রেডি করে খাইয়ে স্কুলে পাঠানো, দুপুরে নিয়ে আসা আবার রাতে পড়ানোর মত দুরহ কাজগুলো মা' এক হাতে কেমন করে সামাল দিতেন- আমার কাছে আজো এ এক অমিমাংসিত রহস্য! বিধাতা এতোটা প্রানশক্তি এ বিশ্ব চরাচরে কেবল মাত্র মা'য়েদেরই দিয়েছেন বোধহয়।

শুধু মাঝে মাঝে একটা কথাই ভাবি, কী দিয়ে শুধবো তবে এ জন্মের ঋণ!

শুনতে পেলাম কাল মা' দিবস। অনুষ্ঠান করে কখনোই এ সব পালন করি নি। কাল ও সে রকম আদিখ্যেতা করবার ইচ্ছে নেই। এমনিতেই লিখতে গিয়ে অনেক বড় কাসুন্দী টেনে ফেলেছি। অথচ, দেখছি, এর পরেও আরো অনেক কিছু লিখার ছিলো! আজকের মত ক্ষান্ত দিলাম। অন্য কোনদিন হবে? এখন মা’কে নিয়ে আরেকটা লেখার লিঙ্ক দিয়ে শেষ করছি।

এটি কোন নারীবাদী রচনা নয়; পুরুষবাদী ও নয়!
ধন্যবাদ।
১১টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আইনের ফাঁকফোকর-০৩

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪২

যেকোনো চাকরির নিয়োগের পরীক্ষা চলছে। সেটা পাবলিক সার্ভিস কমিশন, বিভিন্ন সংস্থা, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক বা উপজেলা পর্যায়ের কোনো কার্যালয়ে হতে পারে। এই নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হতে পারে। একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সিকান্দার রাজার চেয়ে একজন পতিতাও ভালো।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৭

সিকান্দার রাজা কোকের বোতল সামনে থেকে সরিয়ে রাতারাতি হিরো বনে গেছেন! কিন্তু তাকে যারা হিরো বানিয়েছেন, তারা কেউ দেখছেন না তিনি কত বড় নেমকহারামি করেছেন। তারা নিজেদেরকে ধার্মিক বলে দাবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×