somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জীবনে যা পড়েছি-৭ (নিমাই ভট্টাচার্যের মেমসাহেব)

২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সকাল ১০:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বইটার কথা আমি প্রথম শুনি সম্ভবতঃ উচ্চ মাধ্যমিক পড়াকালীন সময়ে। বন্ধুদের মাঝে কেউ কেউ পড়ে অতিমাত্রায় আবেগতাড়িত হয়ে ট্র্যাজিক প্রেমের কাহিনী সম্বলিত এ বইয়ের বেশ গুনগান করেছিল। কিন্তু, দূর্ভাগ্যবশতঃ বইটা সংগ্রহ করতে না পারায় পড়া হয় নি। (সে সময় নিজের পয়সায় বই কেনার সামর্থ্য ছিল না, এদিক-ওদিক হতে যোগাড়যন্ত্র করে তবেই পড়তে হোত।)

যাই হোক, ভার্সিটিতে পড়বার সময় এক বন্ধুকে দেখলাম, সদ্য বুয়েটে চান্স পাওয়া ছোট ভাইকে এই বইটা উপহার দিল! (বন্ধুটি এখন স্বামী-সন্তান নিয়ে অষ্ট্রেলিয়া প্রবাসী- স্মৃতি তুমি বেদনা। :(( ) সদ্য কৈশোর পেরুনো ভাইকে যখন এ বই উপহার হিসেবে দেয়া সম্ভব, মনে হলো, "ইসকা আন্দার কুছ তো হ্যায়!"। খোঁজাখুঁজি করে একটা কপি যোগাড় করে পড়তে গিয়েই হোঁচট খেলাম। দুই-তিন পৃষ্ঠার বেশী পড়তে পারি নি, ক্ষান্ত দিয়েছি।

তবে, এত সহজে দমে যাবার পাত্র আমি নই। সবাই যখন ভাল বলছে তখন নিশ্চয়ই আমারই কোথাও গলদ আছে। মাস ছয়েক আগে নীলক্ষেতের মোড়ে ঘোরাঘুরি করার সময় ফুটপাতের উপর থেকে বইটা কিনে আনলাম। বাসায় আসতে না আসতেই এলাকার এক বন্ধুবর "আবার একটু পড়ে দেখি" বলে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল। (ইদানিং চতুষ্কোন নিক ধারন করে তিনি ব্লগের দুনিয়ায় পা দিয়েছেন।) এরপর, দিন যায়, মাস যায়, বইয়ের হদিস নেই! ফেরত চাইলে জানা গেল, "আমি পড়েছি, এখন ভাইয়া পড়ছে, আব্বুও পড়বে বলছে!" কী আর করা? X(

ঈদের দিন ভদ্রলোকের বাসায় বেড়াতে গিয়ে প্রথম ও প্রধান কর্তব্য হিসেবে বইটা বগলদাবা করে বাসায় ফিরলাম এবং একটানে শেষ করে তবেই উঠলাম।

ঘটনা মোটামুটি এরকম। বাচ্চু দিল্লীতে কর্মরত এক শীর্ষস্থানীয় বাঙ্গালী সাংবাদিক- অবিবাহিত। দোলাবৌদি আর খোকনদা কোলকাতা নিবাসী দম্পতি- বাচ্চুর নিকট জন। বাচ্চুকে বিয়ে দেবার জন্য উতলা দোলাবৌদিকে বাচ্চু নিজের জীবনের জ্ঞাত-অজ্ঞাত অতীত একে একে বর্ণনা করে চিঠির মাধ্যমে। আর চিঠিগুলো নিয়েই খন্ডে খন্ডে গড়ে উঠেছে সুবিখ্যাত 'মেমসাহেব' উপন্যাসের শরীর।

শৈশবে মা'হারা বাচ্চু অনাদরে-অবহেলায় বেড়ে উঠেছে আর কলেজ শেষ করবার পরই তাকে নেমে যেতে হয়েছে জীবিকার সন্ধানে। এই সময়ের মাঝে তার জীবনে নন্দিনী, নীলিমারা এসেছে, কিন্তু ক্ষনিক আবেগের অবসানে সেইসব ভালবাসাও উড়ে চলে গিয়েছে। এ জীবনকে সে মখমুর দেহলভীর একটা শের দিয়ে বর্ণনা করে এভাবে, "মুহাব্বাত জিস্কো দেতে হ্যায়, উসে ফির কুছ নেহী দেতে; উসে সব কুছ দিয়ে হ্যায়, জিসকো ইস্‌ কাবিল নেহী সামঝা" । স্থানীয় একটি পত্রিকার সাব-এডিটর হিসেবে সাত-আট বছর উদয়াস্ত পরিশ্রম করবার পরেও যখন জীবনে কোন পরিবর্তন এল না, সুখ কিংবা সাচ্ছন্দ্যের মুখদর্শন হল না, তখনই তার জীবনে এল চরম নিস্পৃহতা, কাজে-কর্মে ফাঁকি দিয়ে আড্ডাবাজিতে মেতে উঠলো সে। মেনে নিল অমোঘ ভবিতব্য।

কিন্তু, বিধাতা পুরুষের পরিকল্পনা ছিল অন্য। শান্তি নিকেতন হতে কোলকাতা আসবার পথে তার কালো মেমসাহেবের দেখা পেয়ে গেল সে। দু'দিন পরেই এক আর্ট এক্সিবিশনে পরিচয়। সেই শুরু। লক্ষ্যহীন নিস্পৃহ বাচ্চুর জীবনে কোমল বাতাস হয়ে দেখা দিল মেমসাহেব। সেই মৃদু বাতাসেই বাচ্চুর জীবনে রঙ এল, বসন্তের আগমনধ্বনি শোনা যেতে থাকল।

মেমসাহেব বাচ্চুর জীবনে এনে দিলো স্বপ্ন। এখানে এই বন্ধঘরে পড়ে থাকলে চলবে না, আলস্যে সময় নষ্ট করা যাবে না, তাকে যেতে হবে বহুদুর! সে ও বুঝে গেল অন্ততঃ মেমেসাহেবের জন্য হলেও তাকে শক্ত পায়ে দাঁড়াতে হবে। ভবিতব্য পালটে দেবার মিশনে নামল সে। বিধাতা পুরুষকে যেন সে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে দিয়ে বললো, "এ খুদা, তেরি খুদায়ি পলট্‌ দুঙ্গা, জরা লব্‌ তক শরাব আনে দে। মরণে আওর জিনে কা ফয়সালা হোগা, জরা উনকা জওয়াব আনে দে" । তাই, সুদীর্ঘ বছর ধরে দিকভ্রান্ত স্থানীয় পত্রিকার সাব-এডীটর বাচ্চু ক'দিনের মাথায় দিল্লীতে চলে গেলো স্পেশাল করেস্পন্ডেন্সের চাকরি নিয়ে। পেছনে রয়ে গেল মেমসাহেব। তাদের ভালবাসা কিন্তু পেছনে পড়ে রইল না। সেই হাজার মাইলের বস্তুগত দুরত্ব, ক্ষনিক বিরহ- যেন তাদের প্রেমের বাঁধনকে আরো অটুট করে তুললো।

কদিন পর, পারিবারিক সিদ্ধান্তেই তাদের বিয়ে ঠিক হলো। আসছে ফাল্গুনেই বিয়ে। দুদিকেই সাজসাজ রব। মেমসাহেবকে চমকে দেবার জন্য বাচ্চু দিল্লীতেই নতুন বাড়ি সাজায়। এদিক-ওদিক হতে এটা-ওটা যোগাড় করে একটু একটু করে গড়ে তুলতে থাকে তাদের স্বপ্নপুরী। ওদিকে, মেমসাহেবও সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে দিল্লী পাড়ি দিতে তৈরী হয়। ফীরাক গোরাখপুরীর ভাষায়, "নিদ আয়ে তো খোয়াব আয়ে, খোয়াব আয়ে তো তুম আয়ে, পর তুমহারি ইয়াদ মে, না নিদ আয়ে না খোয়াব আয়ে।"

কিন্তু, ভবিতব্য বুঝি খন্ডানো যায় না! আবারো বিধাতা পুরুষের পরিকল্পনার কাছে হেরে যায় বাচ্চু। বিয়ের মাত্র অল্প কদিন আগেই কোলকাতার অশান্ত রাজনৈতিক পরিবেশের অসহায় বলি হতে হয় মেমসাহেবকে। দিকভ্রষ্ট একটি বুলেট এসে নিভিয়ে দেয় অভাগিনীর জীবন। বোধ করি, সেই সাথে বাচ্চুর জীবনের সবকিছুই শেষ হয়ে যায়। আজো সারাদিনের সব কাজ শেষে মেমসাহেবের জন্য নেয়া গ্রীন পার্কের সেই বাড়িটাতে সে চলে আসে; যেন শুন্যতায় হাতড়ে ফিরে পেতে চায় ফেলে আসা দিন! বাচ্চু চিঠিটা শেষ করে Tennyson এর দু’টি লাইন দিয়ে-
"Time marches on but memories stays,
Torturing silently the rest of our days."


বইটা পড়ার পর খুব বেশী ভাল লেগেছে সে দাবি করব না। নিমাই ভট্টাচার্য এখানে যেন তার নিজের জীবনেরই কাহিনী লিখছেন খানিকটা কল্পনা আর অনেকটা বাস্তবের মিশেলে। কিন্তু, বর্ণনায় এত বেশী আবেগের ছড়াছড়ি এতে যে, অনেক সময়ই কাহিনী এলিয়ে গিয়েছে। ১৮-১৯ বছর বয়েসে এটি পড়তে পারলে হয়তো যে মৌতাতটি পেতাম, জীবনের কোয়ার্টার সেঞ্চুরী পার করে সেটা আর পাই নি। পড়তে গিয়ে অনেকক্ষেত্রেই, মনে হয়েছে বাচ্চু নিজের জীবনের গল্প বলবার সময় নিজের রিপোর্টার সত্ত্বাটিকে প্রেমিক সত্ত্বার সাথে বারবার গুলিয়ে ফেলছে। এছাড়া, প্রথম দর্শনেই প্রেম, কথায় কথায় জড়িয়ে ধরে একটু আদর আর হঠাৎ বুকে গুলি লেগে নায়িকার নাটকীয় মৃত্যু, নায়কের বোহেমিয়ান জীবন- সব কিছু মিলে যেন গত শতকের ষাট-সত্তর দশকের বাঙলা-হিন্দির সিনেমার তুমুল জনপ্রিয় মেলোড্রামার কথা মনে করিয়ে দেয়। এছাড়া, নিজেকে অনেক নারীর আরাধ্য হিসেবে জাহির করতে গিয়ে লেখক এখানে চিরাচরিত পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যবাদী মনমাসিকতা হতে বেরিয়ে আসতে পারেন নি। তার পরেও দেশ নিয়ে তার নিজস্ব চিন্তাধারা ফুটে উঠেছে এ বইয়ে। এমনকি, পঞ্চাশ দশকের পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও একটু করে উঠে এসেছে এখানে। সর্বোপরি, চিঠির মাঝে হঠাৎ হঠাৎ বাঙলা-উর্দু-ইংরেজী কবিতার পংক্তিগুলোও বেশ উপভোগ্য।

প্রাসঙ্গিক তথ্যঃ নিমাই ভট্টাচার্যের মূল জীবিকা সাংবাদিকতা। শুরুতে কয়েক বছর কোলকাতায় কাজ করবার পর দিল্লীতে সুদীর্ঘ ২৫ বছর তিনি রাজনৈতিক-কূটনৈতিক-সংসদীয় সংবাদদাতা হিসেবে সুনামের সাথে কাজ করেছেন। এখন আবার কোলকাতা নিবাসী। দিল্লিতে অবস্থানকালেই ১৯৬৮ সালে "মেমসাহেব" বাজারে আসে এবং অল্পদিনেই পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে। পরবর্তীতে(১৯৭২) এ কাহিনী স্বনামেই চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়। নামভুমিকায় অভিনয় করেন উত্তম কুমার এবং অপর্ণা সেন। মুভীটা দেখে উঠতে পারিনি। তবে ইউ টিউবে ছয় মিনিটের একটা ক্লিপ দেখে মনে হয়েছে, মুভীটি মুল কাহিনীর চেয়েও ভাল হয়েছে।

ইউটিউব লিঙ্ক



মেমসাহেবকে নিয়ে লেখা আরো দু'টি ব্লগ পোষ্ট।

ফারিহান মাহমুদের পোষ্ট

মেমসাহেব, আমার মেমসাহেব

……………………………………………………………………………………………..
আগের লেখা।

জীবনে যা পড়েছি-৬ (শীর্ষেন্দুর দূরবীন)

জীবনে যা পড়েছি-৫ (মানিকের পুতুল নাচের ইতিকথা)

জীবনে যা পড়েছি-৪ (তারাশংকরের কবি)

জীবনে যা পড়েছি-৩ (পথের পাঁচালী)

জীবনে যা পড়েছি-২ (লোটাকম্বল)

জীবনে যা পড়েছি-১ (লা মিজারেবল)

সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সকাল ১০:২৪
৩৬টি মন্তব্য ৩৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে; ভাবতে ভালই লাগে

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৩


বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। একই বছরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ১ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×