somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জীবনে যা পড়েছি-৩ (বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী)

০৪ ঠা জুন, ২০০৯ দুপুর ২:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তখন বোধ হয় ক্লাস ফাইভের বার্ষিক পরীক্ষা দিয়েছি। বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে দেশের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছি। পড়ার মত কিছুই না পেয়ে চাচাত বোনের বইপত্র ঘাঁটছি। হুট করেই একটা বাঙলা সহপাঠ পেলাম, নাম- পথের পাঁচালী। (যদি ভুল না করি তখন এটি নাইন-টেনের বাঙলা সহপাঠ হিসেবে পড়ানো হোত)। কঠিন সাধু ভাষায় লেখা ওটা পড়বো কি পড়বো না এই করতে করতে কখন যে পড়া শুরু করে দিয়েছি টের ও পাই নি। এরপর তো আর কী? পরের দু”দিনে নাওয়া-খাওয়া ভুলে গোগ্রাসে গিলে ফেললাম। কী করবো? অপুর মাঝে যে বারবার নিজেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম!

যাই হোক, বাঙলা ভাষাভাষী যাঁরা বাঙলা সাহিত্যের অল্প-স্বল্প খোঁজখবর রাখেন তাঁদের কাছে পথের পাঁচালী নিয়ে কথা বলা ধৃষ্টতার নামান্তর। অমর কথাশিল্পী বিভূতিভুষন তাঁর প্রতিটি পাঠকের হৃদয়ে পথের পাঁচালী (১৯২৯) গেয়ে এমনই এক অলঙ্ঘনীয় স্বপ্নভূবন তৈরী করে দিয়ে গিয়েছেন যে অন্য কারো সাধ্য নেই সেখানে পৌঁছে! "অপু"-সকল বাঙালীর সরল শৈশবের এতটাই নিঁখুত চিত্রণ- কার সাধ্য আছে তাকে ছুঁয়ে দেখে! প্রয়াত ভাষাবিদ হুমায়ুন আজাদের ভাষায়, "বিভূতিভুষন পথের পাঁচালীতে একবার ও চিরকালের জন্য একটি কাজ করে গেছেন; তিনি পল্লীর অমল সরল কল্পনামথিত রোম্যান্টিক কোন বালককে নিকে উপন্যাস লেখার সমস্ত পথ বন্ধ করে গেছেন। অপু একবারই সৃষ্টি হতে পারে, তাকে আমরা ফিরে ফিরে পেতে পারি না।" তারপরও বুকে সাহস নিয়ে দুটি কথা লেখার চেষ্টা করছি।

যে বয়সে পথের পাঁচালী প্রথম পড়েছি তখনো পর্যন্ত দুধের দাঁত পড়েনি, আক্কেল দাঁত ওঠে নি (অর্থাৎ কীনা সবকিছু বোঝার বয়স হয় নি)। তাই, ইন্টারমিডিয়েটে পরাকালীন সময়ে আবার পড়লাম। জানলাম, আমি আগের বারে আসলে উপন্যাসের মাঝের অংশ (আম-আঁটির ভেঁপু) পড়েছিলাম। মূল উপন্যাসটা তিন ভাগ- বল্লালী-বালাই, আম-আঁটির ভেঁপু, অক্রুর সংবাদ। আরো জানা গেলো, এ উপন্যাসের ঘটনা পরম্পরা পরবর্তীতে "অপরাজিত" এবং "অপুর সংসার" নামে আরো দুইটি পূর্নাঙ্গ উপন্যাসে বিস্তৃত হয়েছে। ফলাফল হিসেবে বাঙলা সাহিত্য (একই সঙ্গে বাংলা চলচ্চিত্রি) পেয়েছে এক অবিস্মরণীয় ত্রয়ী (Apu Trilogy)।

সন্দেহাতীত ভাবেই, উপন্যাসের নায়ক "অপু"। নায়িকা নেই। কিংবা বলা যায়, অপুর জন্মস্থান যে নিশ্চিন্দিপুর গ্রাম- সেই অপুর নায়িকা। নিশ্চিন্দিপুরে জন্মে এখানেই বেড়ে উঠেছে সে। নিশ্চিন্দিপুরের আলো-হাওয়া-জল, ঝোপঝাড়-জঙ্গল, ইছামতী নদী তার শিশু মনের বিকাশ ঘটিয়েছে। মা সর্ব্বজয়া, পিতা হরিহর, বোন দূর্গা কিংবা ইন্দির ঠাকুরণ সকলের কাজ যেন একটাই, অপুকে আগলে রাখা, তার চরিত্রকে বিকশিত করা। তারপরেও যেন দূর্গা একটু আলাদা হয়ে ফুটে আছে । দূর্গার মৃত্যুতে একটুক্ষণের জন্য থমকে যায় নি এমন পাঠক বিরল।

উপন্যাস পথের পাঁচালী নিয়ে কথা বলতে গেলে চলচ্চিত্র পথের পাঁচালীও সামনে চলে আসে। ১৯৫০ সালে বিভূতিভূষন লোকান্তরিত হলে আর সত্যজিত রায় চলচ্চিত্র (জীবনের প্রথম চলচ্চিত্র) বানালেন ১৯৫৫ এ। এই এক চলচ্চিত্রই সত্যজিতকে এনে দিল আন্তর্জাতিক খ্যাতিও সম্মান আর পথের পাঁচালী পেরিয়ে গেলো ভারতবর্ষের ছোট্ট গন্ডি; পেল সর্বকালের অন্যতম সেরা চলচ্চিত্রের স্বীকৃতি। সে বছরেই কান চলচ্চিত্র উৎসবে এটি নির্বাচিত হলো "মানবতার শ্রেষ্ঠ দলিল" (Best Human Document) হিসেবে। ("The first movie from independent India to attract major international critical attention, Pather Panchali won "Best Human Document" at the 1956 Cannes Film Festival, establishing Satyajit Ray as a major international filmmaker. Pather Panchali is today considered one of the greatest films of all time")

এখানে আমি একটা কথা বলতে চাই। পথের পাঁচালীর স্রষ্টা বিভূতিভূষণ, অথচ সত্যজিত রায় যতটা পরিচিত বিভূতি ততটা নন। এছাড়া, পথের পাঁচালীর সরলতা-মানবিকতা-প্রকৃতি প্রেমের অনেক কিছুই উঠে আসে নি চলচ্চিত্রে। সত্যজিত নিজেও সেটা স্বীকার করেছেন। কিন্তু, এটাও সত্য যে, যতটুকু উঠে এসেছে তা কেবল সত্যজিত বলেই সম্ভব হয়েছে। অন্য কেউ এর ধারে কাছেও যেতে পারতেন বলে আমার মনে হয় না!

যাই হোক, দুঃখ-দারিদ্র, অপমান-অনাদর-মৃত্যু বারেবারে হানা দিয়েছে অপুর জীবনে। তবু কেমন করে যেন ছেলেটা সহজ সরলই থেকে যায়, পাঠককে ডেকে বলে,"আমার মত হও।" কিন্তু আমরা জানি, অপুর মত হওয়া সহজ নয়। তাইতো অপুকে এত ভালো লাগে, আপনা বলে মনে হয়! পৃথিবীর পথ যাকে আপন করেছে, তার আর পথ হারাবার ভয় কী?

সবশেষে, পথের পাঁচালীর শেষ ক'টা কথা দিয়েই শেষ করছি।
"পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন " মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে, ঠাঙাড়ে বীরু রায়ের বটতলায় কি ধলচিতের খেয়াঘাটের সীমানায়? তোমাদের সোনাডাঙা মাঠ ছাড়িয়ে, ইছামতী পার হয়ে, পদ্মফুলে ভরা মধুখালি বিলের পাশ কাটিয়ে, বেত্রবতীর খেয়ায় পাড়ি দিয়ে, পথ আমার চলে গেল সামনে, সামনে, শুধুই সামনে… দেশ ছেড়ে বিদেশের দিকে, সুর্যোদয় ছেড়ে সূর্যাস্তের দিকে, জানার গন্ডি এড়িয়ে অপরিচয়ের উদ্দেশ্যে...।
দিনরাত্রি পার হয়ে, জন্ম মরণ পার হয়ে, মাস, বর্ষ, মনন্তর, মহাযুগ পার হয়ে চলে যায়.... তোমাদের মর্মর জীবন-স্বপ্ন শেওলা-ছাতার দলে ভরে আসে, পথ আমার তখনো ফুরোয় না... চলে... চলে... চলে... এগিয়েই চলে....
অনির্বাণ তার বীণা শোনে শুধু অনন্ত কাল আর অনন্ত আকাশ....
সে পথের বিচিত্র আনন্দ-যাত্রার অদৃশ্য তিলক তোমার ললাটে পরিয়েই তো তোমাকে ঘরছাড়া করে এনেছি!...
চল এগিয়ে যাই।
"


যাঁরা পড়েন নি, পড়ে ফেলুন! আর যাঁরা দেখেন নি দেখে ফেলুন আজই!

আগের দু'টি লেখা।

সঞ্জীবের লোটাকম্বল

ভিক্টর হুগোর লা মিজারেবল
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ডিসেম্বর, ২০০৯ রাত ১০:৪৮
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×