somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইসলামে মুসলিম-অমুসলিম সম্পর্কঃ একটি অ-কৈফিয়তমূলক আলোচনা পর্ব-১

০৭ ই আগস্ট, ২০১০ রাত ৯:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

“জীবনবিধান(দ্বীনের) ব্যাপারে কোন জোর-জবরদস্তি নেই.....”(আল-কুরআনঃ ২, ২৫৬)
“জীবনব্যবস্থা(দ্বীন) নিয়ে যারা তোমাদের সাথে লড়াইয়ে লিপ্ত হয় নি, তোমাদেরকে দেশ থেকে বের করে দেয় নি তাদের প্রতি সদাচরণ ও ইনসাফ করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেন না; নিশ্চয়ই আল্লাহ ইনসাফকারীদের ভালবাসেন। আল্লাহ কেবল তাদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপনে নিষেধ করেন, যারা জীবনব্যবস্থা(দ্বীন) নিয়ে তোমাদের সাথে লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছে, তোমাদেরকে দেশ থেকে বের করে দিয়েছে এবং বের করে দেয়ার কাজে সহায়তা করেছে.....”(আল-কুরআনঃ ৬০, ৮-৯)
“কোনো অমুসলিম নাগরিককে যে অত্যাচার করল বা তার অধিকার ক্ষুন্ন করল বা তাকে সাধ্যাতীত পরিশ্রম করাল বা তার অমতে তার থেকে কিছু নিল, কেয়ামতের দিন আমি হবো তার বিপক্ষে মামলা দায়েরকারী।” (আল-হাদিস)
“যে ব্যক্তি কোনো অমুসলিম নাগরিককে কষ্ট দিলো আমি তার পক্ষে বাদী হব। আর আমি যার বিরুদ্ধে বাদী হব কিয়ামতের দিনে আমি হব বিজয়ী।” (আল-হাদিস)

উপরের এ বাক্যগুলো দিয়েই ইসলামে মুসলিম-অমুসলিম সম্পর্কের মূলনীতি সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারনা লাভ করা যায়। অমুসলিমদের মৌলিক মানবীয় অধিকার রক্ষায় সচেতনতা প্রদর্শন, তাঁদের প্রতি সদাচরণের নির্দেশ এবং তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ পোষনের নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কিত এই মূলনীতি নিঃসন্দেহে ইসলামের সহনশীল মনোবৃত্তির পরিচায়ক, যা ইসলামের ব্যাপারে জানতে আগ্রহী কোন ব্যক্তিরই চোখ এড়িয়ে যাওয়ার কথা নয়।

কিন্তু, আমাদের সমকালীন বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলে। ইসলামের মূলনীতি ও ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞানতা, ভাসাভাসা জ্ঞান কিংবা একপেশে দৃষ্টিভঙ্গির কারনে অনেক অমুসলিম তো বটেই, বিপুল সংখ্যক মুসলিমও ইসলামের অমুসলিম নীতির ব্যাপারে সমালোচনায় মুখর। অনেককে অপরাধবোধেও ভুগতে দেখা যায়। তার উপর, ‘জিয্‌ইয়া কর’- এর কথা উঠলে তো কথাই নেই; ইসলাম যে অমুসলিমদের দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিকের বেশী কিছু ভাবে না-তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে এই করনীতিকে উপস্থাপন করে দেয়া হয়। আবার, এর সপক্ষে কিছু ব্যাখ্যা দিতে গেলে, সেটিকে কৈফিয়তমূলক বা অ্যাপলোজেটিক(Apologetic) অপচেষ্টা বলে অবজ্ঞা করা হয়।

এমতাবস্থায়, এই বিষয় নিয়ে নন-অ্যাপলোজেটিক বা অ-কৈফিয়তমূলক কিছু লেখা খুবই কঠিন। কিন্তু, একজন প্রায়োগিক(Practical) মুসলিম হিসেবে যেহেতু, ইসলামকে সকল মানুষের জন্যই ঐশী উৎস হতে উৎসারিত একটি যৌক্তিক ও সুষম জীবনব্যবস্থা হিসেবে মেনে নিতে হয়, সেহেতু ইসলামের কোন নীতিমালার ব্যাপারে অপরাধবোধে আক্রান্ত হয়ে কাউকে কৈফিয়ত দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এক্ষেত্রে যেটি করা যেতে পারে সেটি হচ্ছে, উক্ত বিতর্কিত নীতিমালাটিকে যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা এবং উদাহরণ সহকারে তুলে ধরে তা গ্রহন বা বর্জনের বিষয়টি শ্রোতার জন্যই ছেড়ে দেয়া।

এ দৃষ্টিভঙ্গিতেই ইসলামে মুসলিম-অমুসলিম সম্পর্কের কাঠামোটিকে ব্যাখ্যার পথে অগ্রসর হচ্ছি। মনে রাখা দরকার যে, ইসলামের যে কোন ধরণের মূলনীতির উৎস আল্লাহর বাণী (আল-কুরআন) এবং মুহাম্মাদের(স) কথা(হাদিস) ও কর্ম(সুন্নাহ্‌)। এছাড়া, মুহাম্মাদের(স) পরবর্তী চার খলিফার(খোলাফায়ে রাশেদুন) অনুসৃত নীতিসমূহকে ইসলামের যথার্থ প্রয়োগ বলে সকল যুগে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের ঐক্যমত রয়েছে। এ কারনে, এদেরকে সর্বোত্তম নজির হিসেবে সামনে রেখেই ব্যাখ্যার কাজ সম্পন্ন করার চেষ্টা করা হবে।

ইসলামের অন্য অনেক নীতিমালার মতই অমুসলিমের সাথে সম্পর্কেরও দুইটি দিক রয়েছে- একটি ব্যক্তিগত আর অপরটি সামষ্টিক।

ব্যক্তিগত পর্যায়ে মানুষ হিসেবে ইসলামে মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সকলের মৌলিক মানবীয় অধিকার স্বীকৃত। তাঁদের এই অধিকারের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনের বিরুদ্ধে মুহাম্মাদের(স) হুঁশিয়ারী তো আমরা এই লেখার শুরুতেই দেখেছি। এর বাইরেও তিনি মানুষ হিসেবে তাদের সমানাধিকারের ঘোষনা দিয়েছেন এভাবে, “তাদের রক্ত আমাদের রক্তের মতো এবং তাদের ধনসম্পদ আমাদের ধনসম্পদের মতো”। তিনি এবং তাঁর নিকটতম অনুসারীরা(সাহাবীরা) এই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন। সন্দেহ নেই, ধর্ম হিসেবে একজন অমুসলিম যা কিছুর উপর বিশ্বাস রাখেন, ইসলামে সেগুলোকে পছন্দ করে না। কিন্তু, কুরআনে, “তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন এবং আমাদের জন্য আমাদের দ্বীন”- এ কথা বলে তাঁর ঐ ধর্ম পালনের অধিকারের প্রতি পূর্ণাঙ্গ শ্রদ্ধা দেখানো হয়েছে। এমনকি মদ্য উৎপাদন এবং শুকর পালনের মত ইসলামে চিরতরে নিষিদ্ধ কাজগুলোও অমুসলমানদের নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে করতে দেয়ার পূর্ণ অধিকার রয়েছে এবং এ সবের ক্ষতিসাধনকারী অন্যান্য ব্যবসার মতই এর পূর্ণ ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য। কুরআনে অন্য ধর্মের উপাস্যদের নিন্দা করার ব্যাপারেও কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। নবম হিজরী সনে নাজরান প্রদেশের খৃষ্টান প্রতিনিধিদল মুহাম্মাদের(স) সাথে সৌজন্য সাক্ষাতে এলে তাদের উপাসনার জন্য তিনি মসজিদে নববীর একটি কোণ ছেড়ে দিয়েছিলেন। উমর(রা) জেরুজালেমের সহস্তে নিয়ন্ত্রনভার গ্রহনকালীন সময়ে একটি গীর্জা সামনে অবস্থান করা অবস্থায় নামাযের সময় উপস্থিত হয়। গীর্জা কর্তৃপক্ষের শত অনুরোধেও তিনি সেখানে নামায পড়তে রাজি হন নি, যাতে পরবর্তীকালে মুসলিমরা ঐ গীর্জাকে মসজিদে পরিণত করার নূন্যতম অজুহাতও না পান। মুহাম্মাদের(স) মৃত্যুশয্যায় যে কয়টি ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন, তাদের মাঝে অমুসলিমদের সাথে সদাচরণের কথাও ছিল। এমনকি, উমর(রা) তাঁর শেষ সময়ে তাঁর উত্তরসূরীর উদ্দেশ্যে যে নির্দেশনামা রেখে গিয়েছিলেন তাতে তিনি বলেছিলেন, “নতুন খলিফার প্রতি আমার নির্দেশ, তিনি যেন নীতিমালা এবং চুক্তি অনুযায়ী সেই সব অমুসলিমের দেখাশোনা করেন যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের(রা) আশ্রয়ে রয়েছে, তাদের সম্মান ও সম্পদের রক্ষায় প্রয়োজনে যুদ্ধ করেন এবং তাদের সামর্থ্যের অতিরিক্ত করের বোঝা না চাপিয়ে দেন।” এ সকল কিছুর ভিত্তিতে ইসলামী আইনে বুৎপত্তিসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ এই ঐক্যমতে পৌছে গিয়েছেন যে, অমুসলিম নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান মুসলিমদের জন্য ওয়াজিব(অবশ্য পালনীয়) এবং তাদের কোনরূপ কষ্ট প্রদান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তাঁদের মতে, “অমুসলিম নাগরিককে যদি কেউ কষ্ট দেয়, একটি খারাপ কথাও বলে, এমনকি অসাক্ষাতেও তাদের সম্মানের উপরে বিন্দুমাত্র আক্রমন চালায় কিংবা তার সাথে অকারণ শত্রুতার ইন্ধন যোগায়, তাহলে সে আল্লাহ, তাঁর রাসূলের(স) এবং দ্বীন ইসলামের দায়িত্বকে লংঘন করলো।”

(সম্প্রতি কুরআনের বর্ণিত কুরবানী সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে রীট আবেদনকারী বিপক্ষে কথা বলতে গিয়ে যে সব 'একনিষ্ঠ' মুসলিম ঐ ব্যক্তির সম্প্রদায় তুলে অশ্লীল গালিগালাজ করেছেন তাদেরকে উপরের কথাগুলো ভেবে দেখার অনুরোধ রইল।)

উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে একজন ব্যক্তি অমুসলিমের সাথে অপর ব্যক্তি মুসলিমের সম্পর্কের রূপরেখা স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা। মানুষ হিসেবে তাঁর কোন অধিকারের প্রতিই ইসলামে অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হয় নি এবং তাঁর মানবীয় মর্যাদাকে সমুন্নত রাখার ব্যাপারে মুসলিমদের বারেবারে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।

এবারে, আসা যাক, সামষ্টিক পর্যায়ে মুসলিম-অমুসলিম সম্পর্কের নীতিমালা বিষয়ে। কিন্তু, সে আলোচনায় যাওয়ার আগে দুইটি প্রশ্নের গ্রহনযোগ্য মীমাংসা হয়ে যাওয়ার অতীব প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়।

এক. ব্যক্তিগত পর্যায়ে একজন অমুসলিমের মৌলিক মানবীয় অধিকারের প্রতি ইসলামের পূর্ণ শ্রদ্ধা থাকা সত্ত্বেও কেন তাঁকে শুধুমাত্র মানুষ না বলে 'অমুসলিম' অভিধায় অভিহিত করা হচ্ছে?
দুই. মানুষ হিসেবে মুসলিম-অমুসলিমের জীবন ও সম্পদের মূল্য সমান ঘোষনা দেয়া সত্ত্বেও তাঁকে ‘জিম্মী’ নামে অভিহিত করে আলাদাভাবে ‘জিয্‌ইয়া কর’ চাপিয়ে দিয়ে কেন তাঁকে দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিকে পরিণত করা হচ্ছে?

সে সব নিয়ে আলোচনা নিয়ে আসছি এর পরের পর্বে।
২৬টি মন্তব্য ২২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

সচিব, পিএইচডি, ইন্জিনিয়ার, ডাক্তারদের মুখ থেকে আপনি হাদিস শুনতে চান?

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৪৫


,
আপনি যদি সচিব, পিএইচডি, ইন্জিনিয়ার, ডাক্তারদের মুখ থেকে হাদিস শুনতে চান, ভালো; শুনতে থাকুন। আমি এসব প্রফেশানেলদের মুখ থেকে দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, বাজেট,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×