somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রুমানা-সাঈদঃ এক দশকের দাম্পত্য পরিক্রমায় অন্ধত্ব আর পলায়নের ইতিবৃত্ত

১৪ ই জুন, ২০১১ রাত ১১:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সাড়ে পাঁচ বছরের অসম্ভব আদুরে আনুশা মেয়েটার জন্য আমি কষ্ট পাচ্ছি। ‘বাবা’- শব্দটা শুনলেই আমার মাথার ভেতরে একটা দারুন নিশ্চয়তার অনুভূতি বিরাজ করে। পরিবারের সবাইকে ছায়া দিয়ে, শাসন দিয়ে আগলে রাখা এক বিশাল পুরুষের নাম বাবা। আনুশা কি তার জীবনে কোনদিন এই অনুভূতিটুকু অনুভবে আনতে সক্ষম হবে? ‘বাবা’ নামটা শুনলেই তার মনে কি এক পাশবিক মানুষের চেহারা ভেসে উঠবে না, যে ওর সামনেই ছিঁড়েখুঁড়ে অন্ধ বানিয়েছে তারই মমতাময়ী মা’কে? এই শিশুর জন্য আমি কোন জবাব খুঁজে পাই না। আপনি পান?

আমাদের শহুরে ছোট্ট বাসার ঘুলঘুলিতে হঠাৎ হঠাৎ চড়ুই বাসা বাঁধে। প্রথম ক’দিন খুব একটা টের পাওয়া যায় না; কিংবা পেলেও আমলে নিই না। এরপরেই কিচিরমিচির শব্দে আর ঘরময় নোংরা লতা-পাতার উপদ্রবে বিরক্তি ধরে যায়। বাসা ভেঙে না দিয়ে উপায় নেই বোঝার পরেও তখন আর হাত ওঠে না। এ ক’দিনে যে ঐ জোড়া চড়ুইয়ের ছোট্ট সংসারের উপরে কেমন মায়া জন্মে গিয়েছে! মনে হয়, ‘আহা! থাকুক না! কদিন পরে তো এমনিতেই চলে যাবে।’

দিন দুয়েক আগে দৈনিক মানবজমিনে(এই পত্রিকায় আজাইরা খবর ছাড়া খুব একটা ভাল কিছু ছাপতে দেখি না- এটি ব্যতিক্রম) ঢাবির সম্মানিত শিক্ষক রুমানা মনজুরের উপর তাঁর স্বামীর নির্মম নির্যাতনের খবরটা পড়ে উপরের কথাগুলো মনে হচ্ছিল বারবার। একসাথে দু’দিন একটা চতুষ্পদ জন্তুর সাথে থাকলেও তো কেমন মায়া পড়ে যায়। আর দশটা বছর সংসার করে, নিজের সন্তানের মমতাময়ী মা’কে সন্তানের সামনেই মেরে অন্ধ করে- চেহারা বিকৃত করে দেবার জন্য কতদুর নির্মম-পাষন্ড হতে হয়? জঙ্গলের নখ-দন্তবিশিষ্ট হিংস্র পশুও বোধহয় আরেকটু বেশি মানবিক!

এরপর কাল আর আজ পত্রিকায় এবং টিভি চ্যানেলে ভদ্রমহিলার সাক্ষাৎকার পড়ে-শুনে মাথা ঠিক রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। এর সাক্ষ্য দিচ্ছে বিকল্প মিডিয়াগুলো। ব্লগে-ফেইসবুক জুড়ে রুমানার প্রতি সহমর্মিতা আর পলাতক সাঈদের বিরুদ্ধে ঘৃনার বহিঃপ্রকাশ। কত নির্মম উপায়ে পাষন্ডটাকে শায়েস্তা করা যায় তার অনুসন্ধান চলছে। কেউ কেউ প্রতিমন্ত্রীর আত্মীয় হওয়ার সুবাদে সুবিচার নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন। আবার, কোন কোন বিকৃত মনের মানুষ স্বতঃসিদ্ধভাবেই এতে ‘মেয়েটার নিশ্চয়ই কোন দোষ আছে’- বলে সিদ্ধান্ত দিয়ে ফেলছেন! (এদের জুতানো দরকার)। কেউ কেউ আবার চিরকালীন পুরুষতন্ত্রের যাঁতাকলে মেয়েরা এমন নির্যাতনের শিকার বলে রোল তুলেছেন।

ব্যক্তিগতভাবে, আমি অমানুষটার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী করছি। সে নিজেকে কোনরকমের সহানুভূতির যোগ্য রাখে নি। সেইসাথে, এমন দাম্পত্য নির্যাতনের বিরুদ্ধে ব্যাপক সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি।

এবার, কিছু নির্মম সত্য কথা(অন্ততঃ আমার বিবেচনায়) বলতে চাইছি।

আমরা- ১৭” মনিটর-কীবোর্ডে ঝড় তোলা সাদা কলারধারীরা, যারা প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছি অনেক বেশি, আজ বাদে কালই ব্যস্ত হয়ে যাব নিজেদের দুনিয়া নিয়ে। হয় উত্তেজনা কমে আসবে, নয়তো তদ্দিনে নতুন কিছু নিয়ে মেতে উঠব। আর এই প্রিন্ট আর ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া যারা ঘটনা ঘটার এক সপ্তাহ পর্যন্ত নিশ্চুপ ছিল- সরব হওয়ার পরও প্রথম দু’দিনে ঐ মানুষরূপী অমানুষটার একটা ছবি পর্যন্ত ছাপায় নি- তাদের কাছে এ খবরটি অন্য সব গরম খবরের মতই একটি পণ্যমাত্র; বিক্রি-বাট্টা বাড়াবার একটা ভাল উপায় আর ছাড়া কিছু নয়। প্রায় দুই সপ্তাহ পেরিয়ে যাওয়ার পরে তার গ্রেফতার না হওয়াটাও এমনই আশংকা রেখে যায় যে, ক্ষমতাসীন মহলের সাথে আত্মীয়তার বর্মের আড়ালে হয়তো সে বেঁচে যাবে। কে জানে, ইতিমধ্যেই এই ‘কীর্তিমান’ সুপুত্র দেশ ছেড়ে মার্কিন মুলুকে তার ‘গর্বিত’ বাপ-মায়ের কোলে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে কীনা!

বন্ধু-বান্ধব, ভাই-বেরাদরদের বিয়ের মওসুম চলছে। ফলে, গত দুই বছরে আমাদের দেশের মানুষের বিয়ে সংক্রান্ত চিন্তাভাবনা খুব ভাল করে পর্যবেক্ষনের সুযোগ পেয়েছি। আমি বুঝতে পারি না, দিন শেষে যেখানে এক জোড়া ছেলে-মেয়েই নিজেদের সংসার নিজেরাই চালাবে- সেখানে তাদের নিজেদের ভাল-মন্দের দিকে না দেখে শুধু পরিবার আর ক্যারিয়ার দেখে কিভাবে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা হয়! পয়সাওয়ালা ডিগ্রিওয়ালা কিংবা প্রবাসী ছেলে পাওয়া গেলে বাবা-মা’রা এবং ক্ষেত্রবিশেষে মেয়েরাও আর কিছুই দেখতে চান না!

আবার, সংস্কৃতি চর্চার নামে লোকসংস্কারের বাঁধন খুলে মেয়েরা যখন রুপসী গায়িকা হবার প্রতিযোগিতায় নামে তখন, শুরুতে গাঁইগুই করলেও শেষপর্যন্ত খুশীই হন; কেননা, এতে বিপুল অর্থযোগের সম্ভাবনা বর্তমান। আর ঐ একই মেয়ে যদি বিদ্যে অর্জনে ঘর ছেড়ে একটু বিদেশ-বিঁভুইয়ে যেতে চায়, তখন স্বামী-সংসার-সন্তান, বাবা-মা সবকিছুর দোহাই এসে পায়ে শিকল পড়াতে চায়; কেননা, ওতে সে পুরুষের চেয়েও এগিয়ে যাবে!

পত্রিকায় আর ব্লগে যা পড়লাম, তাতে আমেরিকা প্রবাসী বাপ-মায়ের সন্তান, প্রতিমন্ত্রীর ভাতিজা, বুয়েট পাস প্রকৌশলী ঘরজামাই ছাড়া আর কোন গুনই জানা গেল না সাঈদের। তারপরেও, দশ-দশটি বছর একে টেনে বেড়াবার পেছনে কেউ প্রেম-ভালবাসা খুঁজে পেতে পারেন- আমি বোকামী ছাড়া কিছুই পাই না।

এদেশের কৃতি শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা প্রদানে আমাদের কার্পন্যের শেষ নেই। সরকারী খরচে তাই বাইরে পড়তে যাওয়ার হার খুবই নগন্য। আর তাই, গরিব দেশের এই শিক্ষার্থীরা কত যন্ত্রনা সহ্য করে জিআরই-জিম্যাট-আইইএলটিএস-টোফেল এর মত কত অপমানজনক (শিক্ষাজীবনের পুরোটা সময় ইংরেজী দ্বিতীয় ভাষা হওয়া সত্ত্বেও, নিজেদের ইংরেজীবিদ প্রমানের এই পরীক্ষাগুলোকে আমার অপমানজনকই মনে হয়!) পরীক্ষায় উর্ত্তীর্ন হয়ে, তবেই একটা ভাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তি পাওয়া যায়। আবার, সেখানে পরাশোনা শেষ করে যাঁরা এই পোড়ার দেশে ফিরে আসতে চান- তাদের জন্য আমার সবসময় একটা অনন্য শ্রদ্ধা কাজ করে। এঁরা এদেশের সম্পদ। এই দৃষ্টিকোন থেকে, রুমানার অন্ধত্বকে নারীর অবমাননার চাইতে বেশি আমি এদেশের সম্পদের অপচয় বলে ভাবছি!

আর, শ্বশুরের অন্ন ধ্বংস করে বৌ পিটিয়ে পৌরুষ জাহির করা বুয়েট পাস গাধাটা কী করেছে! বেকার। শেয়ারবাজারে সাম্প্রতিক কারসাজীর সাথে জড়িত বলেও শুনি। কে একজন যেন বললেন, বুয়েট থেকে পাস করে এমন জানোয়ার হয় কী করে? আমি বলতে চাই, পুরো শিক্ষাজীবনে কোন পাঠ্য বইয়ে আমাদেরকে নৈতিকতা শেখানো হয় নি- কোথাও বলা হয় নি শিক্ষিত হবার চেয়ে ভাল মানুষ হওয়া বেশি জরুরী। আমাদের নৈতিকতা-মানবতাবোধ পুরোটাই আমাদের পরিবার আর সঙ্গী-সাথীদের কাছ থেকে আসে। ব্যতিক্রমকে গোনায় ধরছি না।

সবশেষে, একটা প্রশ্ন রেখে যাচ্ছি। নিজের বৌকে এমন দানবীয় অত্যাচারের পেছনে একটা কিন্তু না থেকেই যায় না। মানসিকভাবে সুস্থ কিংবা বিনা প্ররোচনায় কোন মানুষ এমন করে আরেকটা মানুষকে মারতে পারে কীনা- এর উত্তর আমার চেয়ে মনোবিজ্ঞানী আর অপরাধবিজ্ঞানীরা দিতে পারবেন ভাল। ঘটনার নির্মমতা আর আকস্মিকতায় আমরা এদিকটাও ভুলে যাচ্ছি কীনা- দেখা দরকার।

আমি শুধু কারনটা জানতে চাই। সমাজে সর্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া এই অপরাধপ্রবনতার প্রতিকারের আগে একে প্রতিরোধের ব্যবস্থা করতে চাই। আর আমাদের সবার উদার সহযোগিতা আর সচেতনতা ছাড়া এটি কোন মতেই সম্ভব নয়। আসুন, আমরা ক্ষনিকের উত্তেজনায় সামান্য ঢেউয়ের আলোড়ন তুলে দিয়েই মিলিয়ে না গিয়ে কলকলে নদীর ধারা হই- দুকূল ভাসানো অবিরাম স্রোতে সমাজের ক্লেদ মুছে দিয়ে একে উর্বরতায় ভরে তুলি। সময় হয়তো এখনো ফুরিয়ে যায় নি।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুন, ২০১১ রাত ১১:৪৭
২৩টি মন্তব্য ২৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×