''বাবা আমি বাচতে চাই, তুমি আমাকে বাচাও। এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে আমি কোথাও যেতে চাইনা, আমি তোমাদের সাথে থাকতে চাই।''
হাসপাতালের ক্যান্সার ইউনিট এ শুয়ে বাবার হাতটা জড়িয়ে এই ভাবেই চিৎকার করছিলাম, বাবার অসহায়ের মত আমার দিকে তাকিয়ে শুধু চোখের পানি ফেলছে কিছুই বলছেনা।
অনেক কষ্টে নিজেকে ঘুছিয়ে নিয়ে একটু কঠিন স্বরে বল্লেন ''তকে কে বলেছে ক্যান্সার হলে নিশ্চিত মৃত্যু?''
যদিও বাবা আমাকে শন্তনা দেবার জন্য এই কথাটা বলছে কিন্তু বাবা জানে অল্প কিছু দিনের মধ্যেই আমি মারা যাচ্ছি।
আমার ব্রেইন ক্যান্সারটা লাষ্ট স্ট্যাপে উঠে এসেছে, এখান থেকে ফিরার কোন পথ পৃথিবীর চিকিৎসা বিজ্ঞানে নেই। হইত একটু উন্নত চিকিৎসা দিলে কয়েকটা দিন একটু ভাল রাখা যাবে, কিন্তু এই অবস্থা থেকে ফেরা কিছুতেই সম্ভব না।
বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি, এই মানুষটা নিজেকে লুকানোর জন্য কত চেষ্টা করছে। আমাকে একটু শান্তনা দেবার জন্য নিজেকে আড়াল করছে। ভিতরে কান্নার একটা স্রুত আর উপরে কত কঠিন একটা ভাব ফুটিয়ে তুলেছে।
বাবার মলিন মুখটা কেমন জানি চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে উঠছে, মাথার ব্যাথাটা তীব্র থেকে তীব্র হচ্ছে। অসহ্য এক যন্ত্রনা, বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছেন এতটুকুই মনে আছে এর পর আর কিছুই বলতে পারছিনা।
যখন চোখ খুলেছি প্রথমেই চোখ পরল দেয়ালে টানানো ঘড়িটার দিকে, এখন বিকাল পাঁচটা।
একটু পরেই মা আসবে বাহারি রকমের খাবার সাজিয়ে টিফিন বাটিটা হাতে নিয়ে, কত কি যে থাকবে সেই বাটিতে সব কিছুর কি আর নাম জানি
মাকে এখনো বলা হয়নি আমার রোগের কথা, শুধু বলা হয়েছে সামান্য একটু সমস্যা কিছুদিন হাসপাতালে থাকতে হবে। কতবড় মিথ্যা কথাটা বলা হল এই মায়ের সাথে, কিন্তু মায়ের মন সব কিছুই সবার আগে জানে।
গতকাল হঠাৎ আমাকে বল্ল আচ্ছা সত্যি করে বলত তর কি সমস্যা, সবাই আমার সাথে কিছু লোকাচ্ছে আমি জানি তুই কখনোই আমাকে মিথ্যা বলবিনা।
এই পবিত্র একটা মুখের দিকে তাকিয়ে কি আর মিথ্যা বলা যায়, ভাবছি সত্যিটাই বলেদেই। হয়ত দু চার দিন কান্না কাটি করে আমার মৃত্যুর পর অন্য ছেলেকে নিয়ে শোক ভুলে নতুন করে বাচবে।
এমন সময় তনি এসে শারমিন এসে হাজির, কিছুটা হকচকিয়ে মায়ের পাশে এসে বসল।
- কেমন আছেন আন্টি?
- ভাল, মা তুমি কেমন আছ?
- জ্বি আন্টি আমিও ভাল আছি। কখন আসলেন?
- এইত কিছুক্ষন হল।
যাক শরমিন আসাতে মায়ের সাথে মিথ্যাটা আমাকে বলতে হলনা, যা বলার সেই গোছিয়ে বলবে আমি শুধু দর্শক এর ভূমিকাই।
- শরিফ কি খবর তর? মনে হয় আগামী সপ্তাহে রিলিজ পাবি। বাসায় গিয়ে আরাম করে ঘুমাতে পারবি। এই কইটা দিনত ভালই ছিলাম অন্ত্যত দিনে একবার দেখা হয়েছে, কিছুটা সময় তর পাশে বসে থাকতাম মায়ের হাতের খাবার নিজে না খেয়ে আমাকে দিয়েছিস।
এই কথা গুলি বলতেই শরমিনের চোখে পানি এসে গেল, সে দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে মায়ের সাথে অন্য বিষয় নিয়ে কথা বলতে শুরু করল।
শরমিন কিছুদিন হল এমবিবিএস পাশ করেছে, কিন্তু অন্য দশজনের মত চাকরি খুজতে সময় নষ্ট করতে হয়নি। তার বাবা মা ভাই ভাবী সব মিলিয়ে পরিবারের পাচ জন ডাক্তার। নিজেদের একটা হসপিটাল আছে ধানমন্ডিতে যে খানে আমি শুয়ে আছি। তাই কোর্স শেষ করার সাথে সাথে শরমিন নিজের হসপিটালেই কাজ শুরু করে। আমার জীবনের সবচেয়ে ভাল বন্ধু এই শারমিন, কেন জানি মেয়েটা আমার জন্য এত কিছু করে কিছুই বুঝে উঠতে পারিনা। কখনো কোন সমস্যা হলে সে অবশ্যই আমার পাশে থেকে সমস্যাটা সমাধান করবে।
আমরা দুজন সহপাঠি সেই অ আ ই ঈ থেকে, এক সাথে স্কুলে যাওয়া এক সাথে আসা।
প্রথম যে দিন আমার মাথায় সমস্যাটা শুরু হয় ভাগ্য গুনে আমি শরমিনের অফিসে ছিলাম, হঠাৎ করে মাথার ব্যাথাটা তীব্র হচ্ছে সহ্য করতে অনেক কষ্ট হচ্ছে চার পাশ অন্ধকার লাগছে।
- শরিফ তর কি হয়েছে?
- কিছুই বুঝতে পারছিনা, প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করছে। প্লিজ আমাকে একটু শোবার জায়গা দে আমি বসে থাকতে পারছিনা।
দ্রুত সে আমাকে তার চেম্বারের বিছানায় শুয়ে দিল, কেমন জানি একটু নিদ্রা ভাব লাগছে এর পর কিছুই মনে নেই।
শুয়ে আছি একটা কেবিনে, প্রথম দিন শারমিন আমাকে তার হসপিটালটার সব কিছু দেখিয়ে ছিল। যে কেবিনে আমাকে শুয়িয়ে রাখা হয়েছে তার প্রতিদিনের ভাড়া ৫০০০ টাকা।
চোখ মেলতেই শারমিন বল্ল কিরে কেমন লাগছে, একে বারে ভয় পায়ে দিয়েছিলি। সন্ধ্যায় আব্বু এসে তোকে দেখবে তারপর তর ছুটি।
- তনি কি দরকার এই সবের? হয়ত কোন কারনে মাথা ব্যাথা করেছে, সব ঠিক হয়ে যাবে। তাছাড়া তুই যে ক্যাবিনে আমাকে রেখেছিস জীবন থাকতে এর বিল আমি শোধ করতে পারবনা, তার চেয়ে বরং আজ চলি কাল বিকালে এসে চাচার সাথে দেখা করব।
- চুপ করে বসে থাক, বিল নিয়ে তর চিন্ত করতে হবে না। আজ যদি এই হসপিটাল তর হত আর আমার অসুখে তুই কি চিকিৎসা করতিনা?
বন্ধুত্বের কাছে টাকা পয়সা একটা তুচ্ছ বিষয়।
বিকাল ৫টার পর চাচাজান হসপিটালে আসলেন প্রথমেই আমার ক্যাবিনে, আজো উনার ঠোটের কোনাই একটা হাসি লেগে আছে। এই মানুষটাকে কখনোই আমার সামনে বেজার থাকতে দেখিনি, উনার শত সমস্যার মাঝেও যখন আমি আসতাম উনি একটা হাসি দিয়ে বলত '' আরে বেটা শরিফ, কেমন আছ''
অনেকক্ষন উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখার পর উনার মুখের হাসিটা একটু নিভে আসল, কয়েকটা টেষ্ট লিখে দিলেন দ্রুত করার জন্য।
আমার নিজের মনেই কেমন যেন একটু ছোট্ট ভয় কাজ করছে, বড় কোন সমস্যা নাতো?
টেষ্ট রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর উনি আবার পাঠালেন টেষ্ট করার জন্য, এবার আর পাঠানোর কোন চিন্তা করলেন না। উনার চশমাটা বারবার খুলছেন আর পরছেন।
- শরিফ কতদিন যাবত তোমার এই সমস্যাটা?
- ব্যাথাটা এজকেই প্রথম তীব্র অনোভব করলাম, তবে অনেক দিন থেকেই ছেড়ে ছেড়ে ব্যাথা করছে।
- তাখলে এতদিন ডাক্তার দেখাওনি কেন?
- অল্প মাথা ব্যাথা তাই তেমন গুরুত্ব দেইনি।
- তোমার বাবাকে একটা ফোন কর, উনার সথে কিছু কথা আছে। আর মনে রাখবে সব সময় নিজের যত্ন নিবে।
- আসলে আমার যদি কোন বড় সমস্যা হয়ে থাকে প্লিজ আমাকে বলেন, বাবা শুনলে অনেক সমস্যা হতে পারে।
অনেক কাকুতি মিনতির পর উনি আমার রোগ সম্পর্কে বল্লেন, কি যেন একটা রোগের নাম বল্লেন মনে রাখা অনেক কষ্টের ব্যাপার। যতটুকু রোগের বিবরন দিলেন তার সারমর্ম হল - ব্রেইনে নাকি কি ধরনের একটা ঝর্ণার মত পানি প্রবাহিত হয়, আমার ব্রেইনে কোন একটা সমস্যাই সচ্ছ পানি গুলি কেমন আঠালো হয়ে গেছে। এই পর্যায় থেকে ফিরে আসার কোন পথ নেই, মৃত্যু খুব নিকটে।
আর উনাকে কিছুই বল্লাম না রিপোর্ট গুলি ফেলেই আমি চলে আসলাম,
- শরিফ রিপোর্ট গুলি নিয়ে যাও।
- চাচাজান এই রিপোর্ট গুলি নিয়ে কিছুই করতে পারবনা, আমার সাধ্য নেই এই রোগের চিকিৎসা করানোর। যত তারাতারি মারা যাব ততই মঙ্গল।
চাচাজানের মিষ্টি হাসিটা কোথায় যেন হারিয়ে গেল, কেমন মলিন হয়ে আছে সুন্দর এই মুখহানি।
দরপাশেই শারমিন দারিয়ে আছে, রুম থেকে বাহিরে আসতেই জড়িয়ে দরে কান্না শুরু করল। কেন এইরকম পাগলামি করলি? প্রথম অবস্থায় আসলে আজ এমন হত না।
তারপর কিছুদিন মাঝে মাঝেই শরমিন আমাকে নিয়ে আসত কয়েকটা টেষ্ট করাত, কিছু ঔষধ দিত খাবার জন্য। বাবা মা প্রায় প্রশ্ন করত ''কিসের ঔষধ?'' আমি তেমন কোন উত্তর দিতে পারতামনা।
দুই সপ্তাহ পর অবস্থা খুব খারাপের দিকে চলে গেল, একপ্রকার জোড় করে শারমিন আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিল। তারপর বাবাকে খবর দিল আস্তে আস্তে সব কিছু বুঝিয়ে বল্ল, আত্বীয় স্বজন সবাই আসতে থাকল। শুধু মাকে জানতে দেওয়া হলনা আমি কিছুদিনের মধ্যেই মারা যাচ্ছি।
সেই থেকে আজো এই হাসপাতালে, দিন গুনছি কবে মারা যাচ্ছি।
অনেক সময় মায়ের সাথে গল্প করার পর মাকে বিদায় দিয়ে শারমিন এসে আমার বিছানায় বসল, অনেকগুলি মিথ্যা বলেছত তাই হয়ত চুপকরে আছে।
- কিরে শারমিন, মায়ের সমনে যে বল্লি এক সাপ্তার মধ্যেই বাসাই যাচ্ছি। তাকি হাটিয়া করে নাকি পায়ে হেটে?
- তুই কি চুপ করবি?
- কেন? যা সত্যি তাই বল্লাম।
- শরিফ আজ চাদের আলোয় আমার সাথে বেড়াবি?
- কোথায়?
- এই লেগের পাশে।
- কিন্তু চাচাজান কি আমাকে বাহিরে যেতে দেবে?
- আমি আব্বুর সাথে কথা বলব, তুই যাবি কিনা বল?
- আমার পক্ষথেকে কোন আপত্তি নেই, তর মত সুন্দর একটা মেয়ের সাথে পাশাপাশি হাটতে পারা একটা ভাগ্যের ব্যাপার।
- তুই সব সময় মজা করতে পছন্দ করিস।
আনোমানিক রাত্র ১টা বাজে শারমিন আমাকে ঘুমথেকে ডেকে উঠাল, এখন নাকি খুব সন্দর জোৎস্না।
আমি শারমিন পাশা পাশি হাটছি, চাদের আলো কিছুটা লেগের পানিতে পরেছে চকচক করছে। শারমিন আমার হাতটা ধরে আছে, আমি উর পাশে হাটছি।
বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে নিজেকে কেন জানি মনে হচ্ছে একটু আগেই চলে যাচ্ছি এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে। আর কয়েকটা দিন থেকে গেলে অনেক ভাল হত, বাচার জন্য মনটা কেমন ছটফট করছে।
আলোচিত ব্লগ
আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা
২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন
যেভাবে শরণার্থীরা একটি দেশের মালিক হয়ে গেলো!
এবার একটি সেমিনারে প্রথমবারের মতো একজন জর্ডানির সাথে পরিচয় হয়। রাসেম আল-গুল। ঘনকালো মাথার চুল, বলিষ্ট দেহ, উজ্জ্বল বর্ণ, দাড়ি-গোঁফ সবই আছে। না খাটো, না লম্বা। বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। প্রতিটি সেশন... ...বাকিটুকু পড়ুন
নিউ ইয়র্কের পথে.... ২
Almost at half distance, on flight CX830.
পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১
হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন
সামুতে আপনার হিট কত?
প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন
ল অব অ্যাট্রাকশন
জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন