ইমদাদুল হক মিলন
সইয়ের বাড়িতে বসে খবরটা মা পেয়ে গেল।
আমাদের বাড়ি লুট হয়ে গেছে। গ্রামে মিলিটারি এসেছে, জ্বালাও পোড়াও করেছে, মানুষ মেরেছে। কিন্তু আমাদের বাড়িটা মিলিটারিরা লুটপাট করেনি।
কে করেছে?
লুট হয়ে যাওয়া বাড়িতে ফিরেই আমি তা জেনে গিয়েছিলাম।
তখনও দুপুর হয়নি।
লুট হয়ে যাওয়া বাড়ির আঙিনায় বসে শিশুর মতো কাঁদছি। অদূরে লুটের হাত থেকে বেঁচে থাকা আমাদের একমাত্র সম্পদ মায়ের কোরআন শরীফটা রেহালের ওপর রাখা।
আমি কাঁদছিলাম সেই দিকে তাকিয়ে।
দুপুরের পর পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে এলো মা। চার পাঁচমাইল দূরের পুম্বাইলে গ্রাম থেকে ছুটতে ছুটতে এসেছে। ঈশ্বরগঞ্জে মিলিটারি এসেছে, যেকোনও আপদ হতে পারে রাচ্চায়, মা সেইসব কেয়ারই করেনি। তার পরনে সস্তা ধরনের একটা প্রিন্টের শাড়ি। বাড়িতে ঢুকে দেখে মাটিতে অসহায় ভঙ্গিতে বসে কাঁদছি আমি। প্রথমেই আমার দিকে তাকালো না মা। চারদিক তাকিয়ে ফাঁকা শূন্য বাড়িটা দেখলো। রেহালের ওপর রাখা কোরআন শরীফটা দেখে ছুটে গিয়ে সেই কোরআন শরীফ বুকে চেপে ধরল।
তারপর তাকালো আমার দিকে।
একহাতে বুকে ধরা কোরআন শরীফ, অন্যহাত রাখল আমার মাথায়। কান্দিস না বাজান, কান্দিস না। ধৈর্য ধর, ধৈর্য ধর।
মাকে দেখে আমার কান্না আরও বেড়ে গেছে। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললাম, আমগ কিছু নাই মা। আমরা পথের ফকির হইয়া গেছি।
মা আবার সেই কথা বলল, ধৈর্য ধর।
পথে আসতে আসতে মা বোধহয় খবর পেয়ে গিয়েছিল কে লুট করেছে আমাদের বাড়ি।
সেই বদমাশ কেরামত আলীর ভাই। লোকটার নাম আক্কাস আলী।
কোরআন শরীফ বুকে নিয়ে আক্কাসের বাড়িতে গেল মা। গিয়ে দেখে আমাদের বাড়ির টিন কাঠ খাট চৌকি চেয়ার টেবিল এমনকি হাঁড়িপাতিল থালাবাসন পর্যন্ত আক্কাসের বাড়ির উঠানে। আক্কাস আর তার বড়ভাই কেরামত দুজনে আমাদের দুটো চেয়ার নিয়ে বসে আছে।
মা গিয়ে তাদের সামনে দাঁড়াল। আক্কাস এইটা তুমি কি করছ? আমার বাড়ির ঘরদুয়ার সব লুট করলা?
আক্কাস না, কেরামত কেলানো একটা হাসি হাসল। আমরা তো লুট করি নাই। লুটের হাত থিকা বাঁচাইছি।
কেমনে বাঁচাইলা? আমার বাড়ির সব জিনিস দেখি তোমগ উঠানে পইড়া রইছে।
সব আপনের না মামানী।
তয় কার?
এই উঠানে যেইসব জিনিস দেখতাছেন, এইসব জিনিস এই পাড়ার আরও কয়েকজন মাইনষের। যাগো যাগো বাড়ি লুট হইতেছিল, সেইসব বাড়িতে গিয়া লুটতরাজ করা মানুষগ আমরা ঠেকাইছি। তাগো হাত থিকা জিনিসপত্র যতটা রক্ষা করতে পারছি, সব এই বাড়িতে লইয়া আইছি।
কও কী?
এবার কথা বলল, আক্কাস। হ মামানী, আমার আপনের লগে মিছাকথা কই না।
মা চোখের ওপর দেখতে পাচ্ছে আমাদের বাড়ির সব জিনিস আক্কাসের বাড়ির উঠানে। তারপরও তারা বলে ওইসব জিনিস নাকি আমাদের না!
মা অনেকক্ষণ তর্ক বিতর্ক করল তাদের সঙ্গে। কাজ হলো না, মার কথা ওরা পাত্তাই দিল না।
শেষপর্যন্ত মা বলল, তোমরা কী কইতে চাও উঠানের এইসব জিনিসের মধ্যে কিছুই নাই আমার?
কেরামত বলল, আছে।
কী আছে?
আপনের বাড়ির ছয়খান টিন আছে।
মাত্র ছয়খান টিন?
হ। লুটতরাজকারীদের হাত থিকা আপনের বাড়ির মাত্র ছয়খান টিনই আমরা বাঁচাইতে পারছিলাম। আপনের ছয়খান টিন আপনে লইয়া যান।
মা আর কোনও কথা বলল না, বাড়িতে এসে আমাকে ডেকে নিয়ে গেল। মা আর আমি চোখের জলে ভাসতে ভাসতে ধরাধরি করে ছয়টা টিন নিয়ে এলাম বাড়িতে। ওই ছয়খানা টিনই তখন আমাদের সম্বল, আর কিচ্ছু নেই। মার পরনে প্রিন্টের সচ্চা একটা শাড়ি। আমার পরনে হাঁটুর কাছে ছেঁড়া ফুলপ্যান্ট, আর কোড়া রঙের অতি পুরনো একটা স্যান্ডোগেঞ্জি।
মনে আছে, ছেঁড়া প্যান্টটার রঙ ছিল খয়রি।
ততোক্ষণে বিকেল হয়ে গেছে।
আমাদের খাওয়া হয়নি কিছুই। কোত্থেকে হবে, বাড়ির কোথাও তো কিছু নেই। সবই তো লুট হয়ে গেছে। আমার চোখের পানি আর ফুরায়ই না, শুধু ভাইয়ের কথা মনে হয়। কোথায় আছে আমার বড় ভাই, ভাবী আর ছোটবোন? কোথায় আছে আমার সেই বাউণ্ডুলে মেজোভাই, কে জানে? বেঁচে আছে , না মরে গেছে সবাই তাই বা কে জানে? যে বাড়িতে, যে ঘরের চার দেয়ালের মাঝখানে, মাথার ওপর রোদ বৃষ্টি ঠেকাবার চালা ছিল যে ঘরে, সেই ঘরের ভিতর জড়াজড়ি করে বড় হওয়া, জড়াজড়ি করে বেঁচে থাকা মানুষগুলো আজ কে কোথায়? পাকিস্তানী জন্তুগুলো হামলার পর হামলা চালিয়ে কোথায় কীভাবে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে আমাদেরকে। তাদের হামলার সুযোগে আমাদের কিছু নিজস্ব মানুষও নিঃস্ব করে দিয়েছে আপনজনকে।
অন্যদের কথা আমি তখন ভাবতে পারছিলাম না। ভাবছিলাম শুধু আমার আর আমার ওই দুঃখিনী মায়ের কথা।
এই দুজন মানুষ আমরা বাঁচবো কী করে?
মাথা গুঁজবো কোথায়?
খাবো কী?
পরবো কী?
বুকে কোরআন শরীফটা মা ধরেই রেখেছেন। এই অবস্থায় আমাদের একমাত্র অবলম্বন ওই পবিত্র গ্রন্থ। যেন এই গ্রন্থই যাবতীয় বিপদ আপদ থেকে, ঝড়ঝঞ্জা থেকে রক্ষা করবে অসহায় মা এবং ছেলেকে।
আমার কান্না থামে না দেখে মা আমাকে বুঝাতে লাগল, এইভাবে কান্দিস না। কান্দন থামা। এইটাও আল্লাহর একটা পরীক্ষা। আল্লাহপাক বিপদ আপদ দিয়া তার বান্দাগো পরীক্ষা করে। ধৈর্য ধর, আল্লাই পথ দেখাইবো।
ওদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছে।
কোথায় রাত কাটাবো আমরা?
চারপাশের যেকোনও বাড়িতে গিয়েই রাত কাটাতে পারি। কোনও বাড়িতেই সেভাবে লোকজন কেউ নেই। বেশির ভাগ বাড়িই খালি পড়ে আছে। যেকোনও একটাতে গিয়ে উঠলেই হয়।
মা বলল, নিজের বাড়ি ছাইড়া আমি কোনখানে যামু না।
আমি অবাক! তাইলে থাকবা কই?
এই বাড়িতেই থাকুম।
এই বাড়িতে তো ঘরদুয়ার কিচ্ছু নাই?
তারপরও এই বাড়িতেই থাকুম।
গ্রামে যখন তখন আসতে পারে মিলিটারি। গুলি করে আর বাড়িঘরে আগুন দিয়ে মারতে পারে সবাইকে। এসব শোনার পর থেকে প্রত্যেক বাড়িতেই বড় বড় গর্ত করা হয়েছিল, অর্থাৎ ট্রেঞ্চ করা হয়েছিল। থানাঅলারা আর গ্রামের নেতৃস্থানীয় লোকের বুদ্ধি পরামর্শে প্রত্যেক বাড়িতে ট্রেঞ্চ করেছিল লোকে। আমাদের বাড়িতে বড় একটা ট্রেঞ্চ করেছিলাম আমি। অনেকটা কবরের আকৃতি। বাড়ির পিছন দিকটায়। ভিতরে বসে থাকলে বাইরে থেকে দেখে মিলিটারিরা যেন কিছু অনুমান করতে না পারে এইভাবে করেছিলাম ট্রেঞ্চটা। ঝোঁপঝাড়ের ভিতরে ট্রেঞ্চ করে তার ওপর আড়াআড়ি করে বাঁশ ফেলে বাঁশের ওপর চালার মতো করে দিয়েছিলাম বাঁশের তৈরি একটা বেড়া, তার ওপর কয়েক ঝুড়ি মাটি আর মাটির ওপর কিছু ঝোঁপঝাড়। একদিককার মুখ ফাঁকা। সেই দিক দিয়ে ট্রেঞ্চে নামা যাবে। ওই মুখটার ওপর ফেলে রেখেছিলাম আলগা একটা বেড়া। ট্রেঞ্চে নেমে সেই বেড়া টেনে দিলে বোঝা যাবে না এর ভেতর মানুষ আছে কী না?
মা বলল, রাতটা আমরা ওই গর্তে কাটামু।
শুনে আমি চমকে উঠলাম। কও কী তুমি?
হ।
ওই রকম জায়গায় সারারাত বইসা থাকতে পারবা?
পারুম। তুই পারবি কী না সেইটা ক?
তুমি পারলে আমিও পারুম।
তয় আর চিন্তা নাই।
কিন্তু খাইবা কী? খাওনের তো কোনও পথ দেখতাছি না।
কাইল সকাল পর্যন্ত না খাইয়া থাকন লাগবো। পারবি না?
আমি কাতর গলায় বললাম, আমার তো অহনই খিদায় পেট জ্বইলা যাইতাছে।
মা বলল, ধৈর্য ধর বাজান, ধৈর্য ধর। একটামাত্র রাইত। পেটের খিদা চাইপা রাখি। কাইল আল্লাহপাক কোনও না কোনও ব্যবস্থা করবোই। খিদা সহ্য করতে না পারলে চাপকল থিকা পানি খাইয়া আয়।
আমাদের বাড়িতে পুরনো একটা চাপকল ছিল। সবই লুট হয়ে গেছে, চাপকলটা লুট হয়নি। আক্কাসের চোখে চাপকলটা বোধহয় পড়েইনি। পড়লে মাটির তলার পাইপ পর্যন্ত টেনে তুলে নিয়ে যেত।
মার কথায় চাপকলটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। একহাতে চাপকল টিপে, অন্যহাতে অনেকক্ষণ ধরে পানি খেলাম। গাল মুখ চটচটে হয়েছিল চোখের পানিতে। চাপকলের ঠাণ্ডা পানি দিয়ে মুখটা খুব ভালো করে ধুয়ে ফেললাম। ময়লা স্যান্ডোগেঞ্জি মুখের কাছে তুলে মুখ মুছতে মুছতে এলাম মার কাছে।
মার বুকে তখনও কোরআন শরীফ। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনাচ্ছে চারদিকে। মার হাত ধরে ট্রেঞ্চে গিয়ে নামলাম। প্রথমে নামালাম মাকে। তারপর নিজে নেমে আলগা ঝাপটা টেনে দিলাম ট্রেঞ্চের মুখে। মুহূর্তে গভীর গভীরতর এক অন্ধকার জগতে চলে গেলাম।
মৃত্যুর জগৎ কী ঠিক এই রকম না?
কবর কী ঠিক এই রকম না?
এই রকম অন্ধকার আর নির্জন?
জীবিত মানুষের কবরবাসের অভিজ্ঞতা কী রকম কেউ তা জানে কী না জানি না। আমি আমার কবরবাসের অভিজ্ঞতা টের পেলাম সেই রাতে।
ট্রেঞ্চের এককোণে বুকে কোরআন শরীফ জড়িয়ে জুবুথুবু হয়ে বসে আছে মা। মাঝখানে বিঘত পরিমাণ ব্যবধান, আমি বসে আছি। দুজন মানুষের শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ টের পাই দুজনে। কিন্তু কেউ কোনও কথা বলি না।
কবরে থাকা মানুষ কী কথা বলে?
মা সবসময় দোয়া পড়েন একটু শব্দ করে। সেই রাতে সেই কবরের অন্ধকারে বসে মা কোনও শব্দ করছিল না। বুকে জড়ানো কোরআন শরীফ নিয়ে আল্লাহকে মা ডাকছিল নিঃশব্দে। ডাকতে ডাকতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিল।
আল্লাহকে ডাকছিলাম আমিও। মায়ের মতো নিঃশব্দেই ছিল সেই ডাক। এই করে করে ঘুম এবং জাগরণের মাঝখানকার একটা অবস্থা তৈরি হলো দুজনেরই। নাকি ওই অবস্থাটাকে বলে জীবন এবং মৃত্যুর মাঝখানকার অবস্থা?
এই অবস্থা কাটলো ভোররাতের দিকে।
সারারাত আমাদের চারপাশে কোথাও কোনও শব্দ ছিল না। ছিল মাটির তলার নৈঃশব্দ। সেই প্রথম আমি আবিষ্কার করেছিলাম নৈঃশব্দের ভিতরেও থাকে এক রকম শব্দ। সেই শব্দ জীবনের শব্দ না, সেই শব্দ মৃত্যুর শব্দ।
মৃত্যুর শব্দ থেকে জীবনের শব্দে ফিরলাম ভোররাতে। বহুদূর থেকে ভোরবেলার পবিত্র হাওয়ায় আমাদের মা ছেলের কবরের ভিতরে মিহিন সুরে ভেসে এলো ফজরের আজানের শব্দ। সেই শব্দে মৃত্যুর জগৎ থেকে ফিরে এলাম আমরা। মা একটু নড়েচড়ে উঠল। আজানের শব্দ পাছ ধলা?
আমিও একটু নড়ে উঠলাম। হ মা পাই।
তয় তো ফজর হইছে?
হ।
ল তয় অহন বাইর হই।
লও।
মা ছেলে তখন আমরা কবর থেকে বেরিয়ে এলাম। খোলা জায়গায় দাঁড়াবার পর আশ্চর্য এক অনুভূতি হলো আমার। ভোরবেলার হাওয়া, পাখির ডাক আর গাছপালার গন্ধে, পায়ের তলার ঘাস মাটির গন্ধে মনে হলো এই প্রথম পৃথিবীর মাটি হাওয়াতে, ঘাসের বনে আর গাছগাছালির শীতলতায় বিশ্বব্রক্ষ্মাণ্ডের অন্যকোনও গ্রহ থেকে পৃথিবীতে এসে যেন পা দিয়েছি আমি। অথবা মৃত্যুর জগৎ থেকে এইমাত্র ফিরেছি জীবনে। সঙ্গে সঙ্গে পেটের ভিতর মুচড়ে উঠল তীব্র ক্ষুধা। কাল থেকে কিছ্ইু যে খাওয়া হয়নি, কবরের অন্ধকারে একবারও টের পাইনি সেই অনুভূতি। এখন পেলাম।
মাকে বললাম, মা আমি খিদায় মইরা যাইতাছি। যেমনে পারো আমারে কিছু খাওয়াও।
মা বলল, আমি বন্দোবস্ত করতাছি। তুই কোনও চিন্তা করিস না।
কোরআন শরীফ বুকে নিয়েই বাঁশবাগানের ওদিককার রাস্তা দিয়ে হনহন করে হেঁটে চলে গেল মা। কোথায় গেল জানি না। আমি বসে রইলাম কাল সারাদিন যেখানটায় বসেছিলাম, বাড়ির আঙিনার ঠিক সেই জায়গাটাতে। আমার তখন মাথা কাজ করছে না। চিন্তা চেতনা অনুভূতি সব লোপ পেয়ে গেছে খিদায়। ট্রেঞ্চে রাত কাটিয়েছি বলে হাত পা মুখ মাথা সব ভরে আছে ধুলোতে। নিজেকে মনে হচ্ছে গর্ত থেকে বেরিয়ে আসা খিদার কষ্টে ধুকতে থাকা মৃতপ্রায় কোনও শেয়াল।
মা ফিরে এলো বেশ তাড়াতাড়ি।
হাতে একটা এলুমিনিয়ামের হাঁড়ি। হাঁড়িতে কিছু চাল। এসেই কোরআন শরীফটা রাখল রেহালের ওপর। রেহালটা ঠিক সেই আগের জায়গাতেই ছিল।
মা তারপর চাপকলটার কাছে গিয়ে হাঁড়ির চালগুলো ধুঁয়ে পরিমাণ মতো পানি দিয়ে নিয়ে এলো। আমাদের রান্নাচালার ওদিকটাও ফাঁকা। শুধু মাটির চুলা দুটো আছে। লাকড়ি খড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চারপাশে। চুলার একপাশে ছোট্ট ন্যাকডায় জড়ানো থাকে ম্যাচ। ম্যাচটা সেভাবেই আছে। সেই ম্যাচ জ্বেলে চুলায় আগুন জ্বাললো মা।
এলুমিনিয়ামের হাঁড়িতে টগবগ করে ফুটতে লাগল চাল। জাউ রান্না করল মা। পাতলা জাউ না, থকথকে। থালা বাসন কিচ্ছু নেই। কেমন করে খাবো এই জিনিস?
একটা সময়ে দেখি নিজের অজান্তেই আমি এবং আমার মা মুঠো করে হাঁড়ি থেকে সেই থকথকে জাউ তুলছি আর পাগলের মতো খাচ্ছি। কোনও দিকেই খেয়াল নেই আমাদের।
পেটপুরে জাউ খাওয়ার ফলে শরীরের শক্তিটা আমার ফিরে এসেছিল। মাও বেশ শক্ত সামর্থ্য মহিলা। সারাদিন খেটেখুটে মা আর আমি মিলে আক্কাসের বাড়ি থেকে আনা ছয়টা টিন দিয়ে রোদ বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার মতো একটা চালা মতো করে ফেললাম। বাঁশের খুঁটিখাঁটি দিয়ে একেবারেই যেনতেন একটা ব্যবস্থা। দুজন মানুষ কোনওরকমে ঘুমাতে পারে এইটুকু মাত্র জায়গা।
আহা রে, কত জৌলুশ একদিন এই বাড়ির ছিল। আর আজ?
চালাটার দিকে যতবার তাকাই, আমার চোখ ভরে আসে জলে। বুকটা হু হু করে। আমাদের বাড়ি লুট করেছিল কেরামতের ভাই আক্কাস। আক্কাসের কথা ভেবে বুকের ভেতর হুঙ্কার ছেড়ে জেগে উঠতে চায় এক ঘুমন্ত সিংহ।
আক্কাস শুয়োরের বাচ্চাকে আমি দেখে নেবো। কোনও না কোনওদিন প্রতিশোধ ওর ওপর আমি নেবোই।
এলাকার তরুণ যুবকরা তখন মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া শুরু করেছে। আগে থেকেই যাচ্ছিল। ঈশ্বরগঞ্জে মিলিটারি আসার পর গোপনে গোপনে যাওয়া বেড়ে গেল। আমার বয়সী আমার বন্ধুরাও কেউ কেউ চলে গেল। যারা যায়, তারা কেউ কেউ গোপনে গোপনে আমার সঙ্গে দেখা করে। দেখা করে বলে, কী রে ধলা, যাবি? চল যাইগা।
মার সামনেই কেউ কেউ এরকম কথা বলে। মা তাদেরকে বলে, তোরা যা বাজান, ধলা পরে যাইবো।
কেন যে মা আমাকে এভাবে ফিরিয়ে রাখছিল আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। সবাই জানে আমাদের বাড়ি লুট হয়ে গেছে। কোনও রকমে তৈরি করা একটা টিনের চালায় মা আর আমি থাকি। ধার উধার করে মা কিছু চাল জোগাড় করে কিছু আনাজপাতি ডাল মাছ জোগাড় করে। ওই খেয়ে কোনও রকমে আমরা বাঁচি। কেরামত আলীর শত্রুতায় এই অবস্থা আমাদের। ভাইকে দিয়ে সে আমাদের বাড়ি লুট করিয়েছে। ওই যে আমার বোনকে পাঁচ নম্বর বউ বানাতে চেয়েছিল। মা রাজি হয়নি দেখে এইভাবে সে আমাদের ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছিল।
কেরামতের কথা ভাবলে আমার কখনও কখনও মনে হয় বাংলাদেশে জন্মে, বাঙালির ঘরে জন্মে, বাঙালি হয়েও কোনও কোনও মানুষ ছিল পাকিচ্চানী মিলিটারির নরপশুগুলোর চেয়েও নিকৃষ্ট।
আমার বুকটা তখন ক্রোধে জ্বলে। আমার ইচ্ছে করে মুক্তিযুদ্ধে চলে যাই। ট্রেনিং নিয়ে অস্র হাতে ফিরে আসি। পাকিস্তানী মিলিটারিগুলোর সঙ্গে গুলি করে মারি কেরামত আর আক্কাসের মতো বাংলাভাষায় কথা বলা নিকৃষ্টতম জীবগুলোকে।
মাকে বলি এইসব কথা। মা আমি মুক্তিযুদ্ধে যাই। মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ফিরে এসে এইসব অনাচারের প্রতিশোধ নিই।
মা বলে সেই এক কথা। ধৈর্য ধর, ধৈর্য ধর।
হাসিবুজি তখন পুম্বাইলে, মার সইয়ের বাড়িতে। ছোটবোন রাশেদা ঢাকায় বড় ভাইয়ের কাছে। মেজোভাইয়ের খবর নেই। কোথায় আছে কে জানে! শুনেছি বড় ভাইয়ের একটা ছেলে হয়েছে। ছেলের নাম রেখেছে মামুন। ভাই ভাবী আর তাদের একমাত্র সন্তান , সঙ্গে আছে রাশেদা, আমার ছোটবোন। কারও কোনও খবর নেই। বেঁচে আছে না মরে গেছে জানি না। শুধু তিনজন মানুষের ব্যাপারে নিশ্চিত। যে হ্যাঁ, এই তিনজন মানুষ আমরা বেঁচে আছি। মা হাসিবুজি আর আমি।
মা আর আমি দুজন অসহায় মানুষ কী যে হতাশা নিয়ে বেঁচে আছি তখন। এই হতাশা সহ্য হয় না। এই হতাশা নিয়ে বেঁচে থাকা যায় না।
মাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে ভোররাতের দিকে একদিন আমি একা একা রওনা দিলাম। মুক্তিযুদ্ধে যাবো। মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ফিরে আসবো।
মোচ্চফা আর আবুল খায়ের আগেই চলে গিয়েছিল। গিয়ে কী যেন কী কারণে আবার ফিরে এসেছে। ওদের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। শুনেছি ফিরে এসেছে কিন্তু কোথায় আছে জানি না।
আমারও শেষপর্যন্ত যাওয়া হলো না। কাঁচামাটিয়া নদী পার হয়ে আটদশ মাইল হেঁটে গিয়েছিলাম। যেতে যেতে মনে হয়েছিল, এ আমি কী করছি? আমার অসহায় মাকে আমি কার কাছে ফেলে যাচ্ছি? আমি চলে গেলে মার আর থাকলো কে?
বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। সেই ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে আক্কাস আলীর বাড়ি থেকে পাওয়া ছয়খানা টিনের নড়বড়ে চালার তলায় কুপি জ্বালিয়ে আমার আশায় বসেছিল মা। বসে বসে কোরআন শরীফ পড়ছিল। ছায়ার মতো নিঃশব্দে মায়ের পাশে এসে দাঁড়িয়েছি। কুপির আলোয় দেখি চোখের জলে ভাসতে ভাসতে মা আমার কোরআন শরীফ পড়ছে।
ঈশ্বরগঞ্জে ঢুকেই মিলিটারিরা ক্যাম্প করেছিল সরকারি ডাকবাংলোয়। আমাদের বাড়ি থেকে বেশ কাছে সেই ডাকবাংলো। দিনেরবেলায় এদিক ওদিক ছাড়িয়ে যায় পাকিচ্চান আর্মি। চারপাশের গ্রাম থেকে ধরে আনে অসহায় নিরীহ মানুষ। হিন্দুপাড়াগুলো খালি হয়েছিল আগেই। একেবারেই দরিদ্র যেসব হিন্দুপরিবার, কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই যাদের, সেইসব পরিবারের ছেলে বুড়ো যুবতী বউঝি কিশোরী মেয়ে যাকে পায় ধরে ডাকবাংলোর ক্যাম্পে নিয়ে আসে। পুরুষগুলোকে রাইফেল দিয়ে বেদম মারে। বুট দিয়ে এমন এক একটা লাথি, মাটিতে ফেলে বুটের তলায় চেপে ধরে গলা। আহা রে, সেইসব মানুষের প্রাণ ফাটানো চিৎকার। ঝোঁপজঙ্গলে আর বাঁশবনে লুকিয়ে থেকে সেইসব মানুষের মরণ চিৎকার শুনি আমি। রাগে ক্রোধে বুক জ্বলে। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই।
ক্যাম্পের কাছেই আমাদের পাড়াটা বলেই কী না কে জানে, এদিকটায় মিলিটারিরা আসেনি। তাদের ধারণা এইপাড়ার সবগুলি বাড়িই বুঝি ফাঁকা। কোনও বাড়িতেই বুঝি কোনও মানুষ নেই। মানুষ ধরতে তারা চলে যায় অন্যদিককার পাড়ায়, অন্যদিককার গ্রামে। রাতেরবেলা গভীর অন্ধকারে মায়ের পাশে শুয়ে থেকে থেকে নারীকণ্ঠের চিৎকার শুনতে পাই। ডাকবাংলো থেকে ভেসে আসে সেই চিৎকার। ওই যে রামগোপালপুর জমিদার বাড়ির কাছে একবার গিয়েছিলাম তবলার আওয়াজ আর নারীকণ্ঠের চিৎকার শোনার জন্য। এই চিৎকারও সেই চিৎকারের মতোই। যন্ত্রণায় যেন জীবনের শেষ চিৎকারটি দিচ্ছে কোনও নারী। বাবা বাবা, তুমি আমার বাবা। ছাইড়া দাও আমারে, ছাইড়া দাও।
বুঝতে পারি, ভয়ঙ্কর ভাবে চলছে নির্যাতন। ধর্ষণ। হয়তো বা পালাক্রমে চলছে। আফ্রিকার বন্যকুকুরের দল যেভাবে চারদিক থেকে ঘেরাও করে ধরে নিরীহ হরিণ, চারদিক থেকে খাবলে খুবলে ছিঁড়তে থাকে তার মাংস, এযেন ঠিক সেই রকম এক কাজ। মানুষ হয়ে মানুষের ওপরই এরকম নির্যাতন চালাচ্ছে মানুষের মতো দেখতে একশ্রেণীর বন্যকুকুর।
ক্যাম্পের আশেপাশে কোনও লাশ চোখে পড়তো না। মেরে লাশগুলো ওরা ফেলে দিয়ে আসতো দূরের বিল বাওড় কিংবা ডোবা নালায়।
আমাদের পাড়াটা বাস্তবিকই সুনসান হয়ে গেছে, নির্জন হয়ে গেছে। লোকজন বলতে গেলে নেই। আছে ওই শালারপুত আক্কাস। বউবেটি নিয়েই আছে। ওর সঙ্গে কেমন কেমন করে ভাব হয়েছে পাকিস্তান আর্মির। যে বেটা ক্যাপ্টেন, ঈশ্বরগঞ্জ থানার দায়িত্বে, ওই পুঙ্গিরপুতের সঙ্গে খাতির জমিয়েছে আক্কাস। আক্কাসের মতো এলাকার আরও দুচারজন রাজাকারের খাতায় নাম লিখিয়েছে। ততোদিনে সারা দেশেই পাকিস্তানের পক্ষের লোকগুলো রাজাকার হতে শুরু করেছে। শান্তিবাহিনীর সদস্য হতে শুরু করেছে।
এসব দেখে মা গেল ভয় পেয়ে।
পাড়ায় একমাত্র যুবক ছেলে আমি। আক্কাস যদি এই কথা মিলিটারিদের জানিয়ে দেয় তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। এর আগে থানা কম্পাউন্ডে, স্কুলের মাঠে মুক্তিযোদ্ধার প্রাথমিক একটা ট্রেনিংও নিয়েছিলাম আমি। আক্কাস এসব জানে।
মা আমাকে বলল, তুই সইরা যা ধলা। আমার যা হওনের হইব তুই তোর জান বাঁচা।
আমাদের বাড়িতে খাওয়া দাওয়ার অভাবটা তখন আর নেই। মার সইয়ের বাড়ি থেকে বিরাট একবচ্চা চাল, বেশ কয়েক সের ডাল, আনাজপাতি তরিতরকারি চারজন লোক এসে দিয়ে গেছে। যা দিয়ে গেছে দুজন মানুষের সেই খাবারে তিন চারমাস চলবে।
এদিক দিয়ে আমি খানিকটা নিশ্চিন্ত।
মা অন্তত না খেয়ে মরবে না। তাও মাকে বললাম, বেশি অসুবিধা দেখলে তুমি পুম্বাইলে চইলা যাইও। মাউই মার বাড়িতে গিয়া থাইকো। ওই বাড়িতে থাকলে ভালো থাকবা তুমি। তোমার সই তো আছেই, হাসিবুজিও আছে। আর ওইদিকে তো মিলিটারি যাওনের প্রশ্নই ওঠে না। তুমি পুম্বাইলে চইলা যাইও।
মা বলল, কইলাম না আমারে লইয়া তুই চিন্তা করিস না। তুই তাড়াতাড়ি সইরা যা।
পরনে সেই ছেঁড়া খয়রি প্যান্ট আর স্যান্ডোগেঞ্জি। আমি পথে নামলাম।
স্টেশনের ওদিক দিয়ে একটা রাস্তা আছে। ওই রাচ্চা দিয়ে কয়েক মাইল গেলে ঢুফির বাজার। ‘ঢুফি’ শব্দটার অর্থ হলো ঘুঘু। ঘুঘু পাখি। ঢুফির বাজার মানে ঘুঘুর বাজার। ওই দিকটায় শোনলাম মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প হয়েছে। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মুক্তিযোদ্ধারা। ততোদিনে দেশের এদিক ওদিক যুদ্ধ শুরু করেছে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা। সামনাসামনি যুদ্ধ করছে, গেরিলা কায়দায় যুদ্ধ করছে। টাঙ্গাইলের ওদিকে কাদের সিদ্দিকীর কাদেরিয়া বাহিনী পাকিস্তানী মিলিটারি মেরে সাফা করে ফেলছে। গোপনে গোপনে যারা স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্র শোনে তাদের কাছ থেকে এইসব খবর পাই।
ঈশ্বরগঞ্জ ডাকবাংলোর ক্যাম্পে দশ পনেরোটা আর্মির গাড়ি। প্রায়ই এই গাড়িগুলো ভরে মিলিটারিরা যায় হালুয়াঘাটের দিকে। কাদেরিয়া বাহিনী হালুয়াঘাটের ওইদিক নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকা থেকে নাকি পাকিস্তান আর্মি যাচ্ছে কাদেরিয়া বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে। কিন্তু যুদ্ধে পাকিস্তানীরা একদমই সুবিধা করতে পারছে না। কাদেরিয়া বাহিনীর হাতে বেধরক মরছে।
ঈশ্বরগঞ্জের ওই পুঙ্গিরপুত ক্যাপ্টেন কেরামত আলী আক্কাস আলীর মতো নেড়িকুত্তাগুলোকে ডেকে বলেছে, আমাদের অনেক রাজাকার দরকার। যে বাড়িতে চারজন পুরুষ আছে, সেই বাড়ির দুজনকে অবশ্যই রাজাকার হতে হবে। যারা হতে চাইবে না তাদেরকে গুলি করে মারবো।
পাকিস্তানের প্রেমে গদগদ হয়ে স্বেচ্ছায় রাজাকার হয়েছিল অনেকেই। আবার কেউ কেউ হয়েছিল প্রাণের ভয়ে, বাঁচার তাগিদে। ভিতরে ভিতরে তারা স্বাধীনতার পক্ষের মানুষ। ওপরে ওপরে রাজাকার। এই শ্রেণীর রাজাকাররা অনেক রকমভাবে আমাদের অনেক উপকার করেছে। আমি তাদেরকে রাজাকার মনে করি না। মনে করি তারাও আসলে মুক্তিযোদ্ধা। জীবন বাঁচাবার জন্য ওপরে ওপরে তারা রাজাকার, ভিতরে ভিতরে তারা মুক্তিযোদ্ধা।
এলাকার কিছু স্বচ্ছল হিন্দুও রয়ে গিয়েছিল। আক্কাসরা সেইসব হিন্দুদেরকে খুঁজে বের করেছে। মিলিটারিদের কাছে তাদের হদিস দিয়েছে। মিলিটারিরা গিয়ে ধরে এনেছে। ধরে এনে প্রথমেই কিন্তু মেরে ফেলেনি। আক্কাসরা কেউ কেউ ততোদিনে বেশ ভালো উর্দু শিখে গেছে। মিলিটারিরা তাদের মাধ্যমে প্রস্তাব দিয়েছে, হিন্দুগুলোকে বলো ওরা যদি পবিত্র ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে, ওরা যদি মুসলমান হয়, তাহলে প্রাণে বেঁচে যাবে। ওদেরকে আমরা মারবো না।
রাইফেলের নলের মুখে, প্রাণের ভয়ে রাজি হয়ে গেছে সবাই। মসজিদের ইমাম সাহেবকে আগেই এনে বসিয়ে রাখা হয়েছে ক্যাম্পে। তিনি নিয়ম মতো ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেছেন অসহায় হিন্দুদেরকে।
কিন্তু মুসলমান হতে চেয়েও বাঁচতে পারলেন না আমাদের চূর্নিখোলা হাইস্কুলের হেডমাস্টার, হরিদাস ভট্টাচার্য আমার বন্ধু রুনুর বাবা। রাতেরবেলা তাঁকে ধরে নিয়ে গেছে ক্যাম্পে। খবর পেয়ে রুনুর বড়ভাই বেনু ছুটে গেছে। তাকেও আটক করেছে মিলিটারিরা। দুজনেই রাজি হয়ে গেছে মুসলমান হতে। বলেছে, পরিবারের অন্যান্যদেরকেও মুসলমান করে ফেলবে তারা। কেরামত আর আক্কাস দুইভাই ছিল সামনে। মিলিটারিদেরকে তারা বলল, হেডমাস্টার লোক ভালো না। যতই মৌলবি ডেকে তাকে মুসলমান করা হোক, এখান থেকে বেরিয়ে গিয়েই সে ধর্মটা মানবে না, পরিবার নিয়ে রাতের অন্ধকারে উধাও হয়ে যাবে।
তাদের কথা শুনে আমার সেই প্রিয় স্যার আর তার বড়ছেলেকে, আমার প্রিয়বন্ধু রুনুর বাবা আর তার বড়ভাইকে কেরামত আর আক্কাসের চোখের সামনে গুলি করে মারলো মিলিটারিরা। সেই মৃত্যু দৃশ্য থেকে হায়েনার মতো খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসছিল কেরামত আর আক্কাস।
হেডমাস্টার স্যার আর তার বড়ছেলেকে আক্কাসরা এইভাবে হত্যা করিয়েছিল পুরনো একটা ক্রোধ মিটাবার জন্য। ঈশ্বরগঞ্জে রুনুদের ছিল অঢেল জায়গা সম্পত্তি। কেরামত লোভী চেয়ারম্যান। রুনুদের জায়গা সম্পত্তি বেশ কিছু সে দখল করেছিল। ওসব নিয়ে স্যারের সঙ্গে মামলা মোকদ্দমাও চলছিল। মামলায় জিততে পারছিল না কেরামত। অন্যদিকে আরও জমি দখলের চেষ্টা চালাচ্ছিল। স্বাভাবিক অবস্থায় তো স্যারকে খুন করা যায় না। কারণ স্যার খুবই জনপ্রিয় মানুষ। তাকে খুন করালে খুবই বিপদে পড়বে কেরামত। এইজন্য মিলিটারিদের মাধ্যমে পথের কাঁটা সরিয়ে দিল।
আমার সঙ্গে তখন একটা পয়সাও নেই।
সকালবেলা স্টেশনের ওদিক দিয়ে রওনা দিয়েছি। তার আগে আক্কাসের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। আক্কাসের বাড়ি আমাদের বাড়ির সঙ্গেই তো। সকালবেলা আমি গোসল করেছি। গামছা পরে গোসল করে ওই ছেঁড়াপ্যান্ট গেঞ্জি পরেছি। তারপর চুপচাপ পথে নেমেছি। আক্কাস কিছু বুঝতেই পারেনি।
ঢুফির বাজার জায়গাটা ঈশ্বরগঞ্জ থেকে বেশ অনেকটা দূরে। ক্ষেতখোলা বিল বাওড়ের ভেতর দিয়ে, গ্রামের ভেতর দিয়ে আঁকাবাঁকা পথ। আমি হাঁটছি, হাঁটছি। ঢুফির বাজারে পৌঁছাতে দুপুর হয়ে গেল।
ঢুুফির বাজারে গিয়ে দেখি এ যেন একেবারেই অন্যরকমের একদেশ। মানুষের কোনও চিন্তা টেনশান কিচ্ছু নেই। বাজার করছে, খাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে। চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছে। কোনও ভাবনাই নেই কারুর। দেশে যে মুক্তিযুদ্ধ চলছে, পাকিচ্চানীরা যে মানুষ মেরে শেষ করে ফেলছে এসব নিয়ে যেন মাথা ব্যথা নেই। একেবারেই স্বাভাবিক অবস্থা চারদিকে।
আমি অবাক।
এ কোন দেশে এলাম?
কোথায় আমাদের শ্বাসরুদ্ধকর ঈশ্বরগঞ্জ, আর কোথায় এই ঢুফির বাজার? হাতেরম মুঠোয় প্রাণ নিয়ে ঢুকতে হয় ঈশ্বরগঞ্জে। এই বুঝি রাজাকাররা ধরে নিয়ে গেল মিলিটারি ক্যাম্পে, এই বুঝি ক্যাম্পের পিছনে নিয়ে কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে দাঁড় করালো, এই বুঝি গুলি করে দিল বুকে।
আর ঢুফির বাজার?
ঢুফির বাজার যেন আমরা যে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি, সেই স্বাধীন এক টুকরো বাংলাদেশ।
আমার মন ভালো হয়ে গেল।
বুক ভরে গেল উচ্ছ্বাস আনন্দে।
বাজারের দিকে যাচ্ছে এমন একজন লোককে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই, এখানে মুক্তিবাহিনী কোথায় থাকে?
লোকটা সন্দেহের চোখে আমার দিকে তাকালো। কেন?
এখানকার মুক্তিবাহিনীতে আমার এক আত্মীয় আছে। আমি একটু তার লগে দেখা করুম।
তোমার আত্মীয়র নাম কী?
ঈশ্বগঞ্জের আব্দুল জব্বার আমার চে’ দুবছরের বড়। কিন্তু আমার তুই তুকারি বন্ধু। শুনেছি আগরতলা থেকে সে মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং নিয়ে এসেছে। ঢুফির বাজারের এই দিকেই আছে।
আব্দুল জব্বারের নামই আমি সেই লোকটাকে বললাম।
আব্দুল জব্বার নামটা শুনে লোকটা বেশ চঞ্চল হলো। দূরের একটা বটগাছ দেখিয়ে বলল, ওই বটগাছের ওদিক দিয়া যাও। গেলেই দেখবা বাঁশঝাড়ওয়ালা একটা বড়বাড়ি, ওই বাড়িতেই মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প।
দ্রুত হেঁটে সেই বাড়িতে গেলাম। গিয়ে দেখি আমার বয়সী, আমার চে’ বড় এরকম তিরিশ চল্লিশজন যুবক। অনেকেই আমার চেনা, অনেকেই ঈশ্বরগঞ্জের ছেলে। আব্দুল জব্বারকে পেলাম প্রথমেই। সঙ্গে আছে সাত্তার। আমাকে দেখে হইচই পড়ে গেল বাড়িতে।
জব্বার বলল, তুই আইছস ক্যান?
আমিও মুক্তিবাহিনীতে যামু। আমিও ট্রেনিং লমু।
সাত্তার বলল, তোর ট্রেনিং লওনের কাম নাই, তুই যা গা।
না আমি যামুই। তোরা আমার যাওনের ব্যবস্থা কর।
জব্বার বলল, সবাই গেলে তো হইব না। সবাই মরলে তো চলবো না। তোর যাওনের কাম নাই।
জব্বারের পরনে হাফপ্যান্ট, কোমরে মোটা বেল্ট। তার ওপর হাফহাতা শার্ট। মাথার চুল লম্বা লম্বা। মুখ দাড়িগোঁফে ভরা। চোখ দুটো টকটকে লাল। জব্বারের কাঁধে ঝুলছে স্টেনগান। গলার আওয়াজ কেমন মোটা ফ্যাফ্যাসে হয়ে গেছে। আমার সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে সঙ্গের মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নানারকম অর্ডার দিচ্ছে।
সাত্তার বলল, তুই মনে হয় বোঝস নাই ধলা। জব্বার হইল আমগ কমান্ডার।
আমি জব্বারের মুখের দিকে তাকালাম। তুই আমারে না করিস না দোস্ত। আমারে ট্রেনিংয়ে পাঠা।
জব্বার ঠাণ্ডা গলায় বলল, থাক এইখানে, পরে বুঝুম নে।
আমি থেকে গেলাম।
একজন মধ্যবয়সী মহিলা রান্নাবান্না করতো ক্যাম্পে। দুপুরবেলা খেলাম সেই মহিলার রান্না ভাত একপদের মাছ আর ডাল। রাতেরবেলা খাসির মাংস আর ভাত। বিকেলবেলা কারা যেন একটা খাসি দিয়ে গিয়েছিল। সেই খাসি জবাই করে রাতেরবেলা বিরাট খাওয়া দাওয়া। খাসির মাংসের বড় বড় টুকরা আর তেলতেলে ঝোল, কী যে আরাম করে খেলাম। মনে হলো বহুদিন পর পেটভরে খাচ্ছি।
খাওয়ার দাওয়ার পর আলাদা করে আমাকে ডেকে নিয়ে গেল জব্বার। বলল, তোর আগরতলা যাওনের কাম নাই। তোর ট্রেনিং নেওনের দরকার নাই। সবার ট্রেনিং লাগে না। তুই অন্যকাম কর।
কী কাম?
এলাকায় আর্মি আইছে না?
হ আইছে।
তোর কাম হইল ঈশ্বরগঞ্জ ডাকবাংলোর ক্যাম্প থিকা আর্মি কই যায় না যায়, এই খবর রাখন। রাজাকাররা কী করে না করে, এই খবর রাখন। সব খবর লইয়া তুই এই ক্যাম্পে আইসা আমারে জানাইয়া যাবি। তয় কামডা করতে হইব খুব সাবধানে। এইটাও কিন্তু মুক্তিবাহিনীরই কাম। এই কাম করলে তুই মুক্তিযোদ্ধা হইয়া যাবি। এইটা তোর ডিউটি। কাইল সকালেই তুই ঈশ্বরগঞ্জ চইলা যা। কাম শুরু কর।
ঢুফির বাজার ক্যাম্প থেকে আমার বন্ধু কমান্ডার জব্বারের আদেশ পালন করতে অন্যরকমের এক মুক্তিযোদ্ধা হয়ে আমি ঈশ্বরগঞ্জে ফিরে এলাম। জব্বার যেভাবে বলেছিল সেইভাবে কাজ শুরু করলাম।
ডাকবাংলোর অদূরে বিশাল এক মাঠ।
সেই মাঠে গরু চড়ায় এলাকার হতদরিদ্র কৃষকরা। এই শ্রেণীর মানুষকে মিলিটারিরাও কিছু বলে না, রাজাকাররাও কিছু বলে না। আমি গিয়ে তাদের সঙ্গে মিশে গেলাম। ছেঁড়া একটা লুঙ্গি জোগাড় করেছি, গামছা এবং মাথলা জোগাড় করেছি। জুন জুলাই মাসের রোদে পুড়ে যাচ্ছে দেশ, খোলামাঠ ঝাঁ ঝাঁ করে রোদে। হাঁটু পর্যন্ত উঁচু করে ছেঁড়া লুঙ্গি পরি। কোমরের কাছে বাঁধি পুরনো গামছা, মাথায় মাথলা দিয়ে হতদরিদ্র কৃষকদের সঙ্গে মিশে ওদের গুরুগুলো চড়াই। আমাকে পেয়ে কেউ কেউ তাদের গরু আমার জিম্মায় দিয়ে অন্যান্য কাজে চলে যায়। আমি গরু চড়াবার ফাঁকে ফাঁকে ডাকবাংলোর আর্মি ক্যাম্পের দিকে চোখ রাখি। তারা কী করে, কাকে ধরে আনে, কাকে মারে সব দেখে রাখি।
কখনও কখনও রাখালের সাজেই বাজারের দিকে যাই। বাজারের চারদিকে গিজগিজ করে রাজাকার। প্রত্যেকের কাঁধে থ্রি নট থ্রি রাইফেল। প্রত্যেকেই নিয়েছে রাজাকারি ট্রেনিং। কিন্তু ভিতরে ভিতরে অনেকেই রাজাকার না। ওই যে বলেছি জীবন বাঁচাবার জন্য রাজাকার হয়েছে কেউ কেউ। ওই শ্রেণীর রাজাকাররা সত্যিকার অর্থেই ছিল মুক্তিযোদ্ধা। কারণ তারা নানারকম ভাবে সাহায্য সহযোগিতা করছিল মুক্তিযোদ্ধাদেরকে।
প্রথম দিন আমাকে রাখালের চেহারায় দেখে ওরকম দুজন রাজাকার জিজ্ঞেস করলো, কী রে ধলা, খবর কী?
আমি শুকনো গলায় বললাম, কোন রকমে মারে লইয়া বাঁইচা আছি ভাই। তোমগ এইদিককার খবর কী?
এইরকম টুকটাক কথাবার্তার মধ্য দিয়ে আগাতে চাচ্ছি। রাজাকারের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ওইসব মুক্তিযোদ্ধা বুঝে যায়, আমি আসলে কী জানতে চাই, আমি আসলে কাদের হয়ে কাজ করছি?
ওরা আমাকে খবর দিতে শুরু করে। কাইল সকালে দুই গাড়ি আর্মি যাইবো হালুয়াঘাটে।
পরদিন ভোররাতে ওঠে আমি দৌড়ে যাই ঢুফির বাজার ক্যাম্পে। জব্বারকে দিয়ে আসি যতটুকু খবর সংগ্রহ করতে পেরেছি। দৌড়ে দৌড়ে যাই, দৌড়ে দৌড়ে আসি। তারপরও ফিরতে দুপুর পেরিয়ে যায়।
যেসব রাজাকার ভিতরে ভিতরে মুক্তিযোদ্ধা, তাদের উদ্দেশ্য একটাই, কাঁধের অস্ত্রটি আর যতগুলো সম্ভব গুলি নিয়ে ওরা একদিন উধাও হয়ে যাবে। সম্ভব হলে আর্মি ক্যাম্প থেকে অস্ত্র চুরি করে উধাও হয়ে যাবে। রাজাকার হিসাবে অস্ত্র চালানোর ট্রেনিং তো ওদের আছেই।
এরমধ্যে জনা পঁচিশেক অস্ত্র আর গুলি নিয়ে উধাও হয়েছে। সরাসরি চলে গেছে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে। যারা এভাবে পালিয়েছে, তারা নিজেরা বেঁচেছে ঠিকই কিন্তু তাদের ফ্যামিলি বাঁচেনি। তাদের বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে আর্মি। মা বাপ ভাইবোন আত্মীয় স্বজন যাকে যাকে পেয়েছে ধরে নিয়ে এসেছে। টর্চারে টর্চারে মেরে ফেলেছে। অস্ত্র নিয়ে কোথায় পালিয়েছে তাদের বাড়ির ছেলে, সেইসব খবরও বের করে ফেলেছে। কিন্তু ধরতে পারেনি একজনও মুক্তিযোদ্ধাকে।
আসল রাজাকারগুলো বাজারে আমাকে ঘোরাঘুরি করতে দেখলেই ওদের মতো রাজাকারিতে নাম লেখতে বলতো। ট্রেনিংটা ল
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই অক্টোবর, ২০০৮ সন্ধ্যা ৭:৪৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




