হিমু... রিলোডেড
=================
১.
মেসের মেম্বাররা সবাই ঈদে যার যার বাড়ি চলে গেছে। শেকড়ের টানে গ্রামে ফিরে গেছে। শেকড়। নাড়ির টান। হিমুর সকাল থেকেই মনে হতে লাগলো আমার শেকড়টা কোথায়। হিমুর মহাপুরুষ বিদ্যালয়ের কোচ তার শেকড়টা মাটি থেকে শুধু আলগাই নয়, অদৃশ্য করে রেখে দিয়ে গেছে। তার মাঝে মাঝে মায়ের কথা মনে হয়। মা থাকলে কী মায়ের কাছে যাবার জন্য হিমুও সবার মতো ট্রেন ধরতো? সরকারকে গালিগালাজ করতো পাল্লা দিয়ে।
নাকি, লঞ্চের একটা কেবিন ভাড়া করতো? রূপাকে নিয়ে হতো তার নদীপথে আনন্দময় যাত্রা! রাতে জোছনার আলোতে রূপার হাতধরে বসে থাকতো?
মহাপুরুষদের মতোন সকল শেকড়-ডালপালা থেকে মুক্ত কী সে থাকতে পারতো?
প্রবেশ করতে পারতো সংসার ধর্মের সমুদ্রযাত্রায়?
চিন্তা ভাবনার তরল বেশিদূর করতে প্রবাহিত করা গেলো না। নতুন মেসমেম্বার দুলাল ধর ব্যাগসহ একটা পলিথিন ব্যাগ নিয়ে হাজির, মাথায় গামছার ব্যান্ডেজ।
-' কিহে দুলালদা, গ্রামের বাড়িতে না গেলেন?'
-' নাগো হিমু ভাইজান, ইবার আর বাড়িত যামু ন্যা। কমলাপুরে গিয়া দেহি মাইনষের মাতা মাইনষে খায়। ট্রেনোত যাগা পাইলাম ন্যা। ছাদোত উইট্যা গেলাম। লাষ্টের বগিত। মানু উঠতে উঠতে ট্রেনের ছাদতুরি চক্ষের নিমিষে ভইরা গেলো। আছিলাম উপবাস। মাতা দিলো চক্কর। দুব্বল শইল। ভিড়ের মইধ্যে গার্মেন্টসের এক চ্যাংড়ার ঠেলায় গেলাম পইড়্যা। মাথাটা এটু কাটলেও বেশতি বেতা পাইনাই, হে হে।'
-' গামছার একটা অংশ কালো হয়ে গেছে। আর বলতেছেন বেশি ব্যথা পান নাই! হাতে আবার পলিথিনে ঐটা কি? মাছ নাকি।'
-' আজ্ঞে। টাকি মাছ। ভ্যালো পানির।'
-' ভ্যালো পানির? কোথায় পেলেন?'
- ' কমলাপুর থিকা ফেরত আসতেছি, মাছগুলা দেখলুম। ভর্তা খাবার খুব লোভ হলো। নিয়ে এলুম।'
-'বানান। ভর্তা বানান। ভালো মতো ভর্তা বানাতে পারলে পুরস্কার, মন্দ হলে তিরস্কার।'
-' আজ্ঞে ভাইজান, রোযাতো আছেন। আইজকা ইফতারি হইবো টাকি মাছের ভর্তা! আমি কাজে লেগে পরি। পুরস্কারটা কি জানবার পার্লে এট্টু এফোর্ট দিয়া বানাতুম!'
-'তিনজনের জন্য বানাবেন। আমার খালাত ভাই, বাদলও খাবে। আর পুরস্কার হবে সুক্ষ, সেটা সারপ্রাইজ হিসেবেই থাকলো।'
দুলাল ধর। প্রুফ সিকুরিটি গার্ড লিমিটেডের সুপারভাইজার। কাজ এটিএম বুথের সিকুরিটি গার্ডদের হ্যান্ডল করা। হালকা পাতলা ধরণের লোক। এই লোক কিভাবে এদের হ্যান্ডল করে সেটা এক বিরাট বিস্ময়।
আমার এখন খালুকে হ্যান্ডল করতে যেতে হবে।
খালুর টেবিলে একটা যন্ত্র।
ল্যাপটপ।
খালুর এক কাষ্টমার, নালু সাহেব, তাকে একটা লেপটপ গিফট করে। ঘুষ বললেও ভুল হবে না। কিন্তু ঐটা নাকি অফিসের কম্পিউটারের সংগে কোনো কিসুই মেলে না। খালুতো ম্যাকের রূপ দেখেই ভক্ত হয়ে গেলো। খালুর তৃপ্তি আরো বেড়ে গেলো যখন ল্যাপটপের চার্জার লাগাতে গিয়ে একটা চৌম্বকীয় আকর্ষণ বোধ করলো।
-ম্যাকবুক! আরে স্টিভ জবসের "মাল"। এদ্দিনে নালু সাহেব আপনার রুচিবোধ কিছুটা উন্নত হয়েছে বলে অনুভব করছি। গুড।
-স্যার, দুবাইয়ের ডিউটি ফৃ শপে গিয়া বেস্ট ল্যাপটপ দিতে বললাম। তারা এইটা ধরায়া দিলো। স্যার ফাইলটা যদি একটু...
-হ্যা হ্যা আমি ফাইলটা ধরছি এক্ষুণি। আর ছেড়ে দিচ্ছি ২/১দিনের মধ্যেই। আপনার বিল আপনি পেয়ে যাবেন।
অফিসের আইটির লোককে ডেকে তার পিসির ফাইল ও আউটলুক মেইল সব ম্যাকে ট্রান্সফার করতে বললেন। ২ দিনেও তাদের কোনো রেসপন্স নাই। তারা যখন ব্যর্থ বলে স্টেটমেন্ট দিলো অফিসে বসে পারসোনাল কোন কাজ তারা করবে না, আর ম্যাক বিষয়ে তাদের কোনো বিশেষ নলেজ নাই তখন খালু অগ্নিশর্মা হয়ে তাদের একটা করে মেমো ধরায়া দিলেন! তাদের প্রাইভেট ভার্সিটির কম্পু বিদ্যার চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করলেন। আর একাউন্টসে ফোন করে নালু সাহেবের বিল স্টপ পেমেন্ট করতে বললেন।
তখন আমি খালুর ওখানে আমার বাদল বিকর্ষী মাসোহারা নিতে গিয়েছিলাম।
খালু Self help is the best help টাইপের মানুষ। নিজেই গুতাতে শুরু করলেন! আইটির লোকগুলা ডাটা ট্রান্সফার করেছে ঠিকই। কিন্তু মেইলটার আর কিছু করতে পারে নাই।
-'হিমু, তোমার কম্প্যুটার জ্ঞান কেমন?'
-'হিমুরা যেমন সর্বজ্ঞানী, তেমনি সর্বঅজ্ঞানী।' বলে আমার বিখ্যাত মধুর ভংগিতে হাসিটা দিলাম।
- 'হাতি ঘোড়া গেলো তল, মশা বলে কত জল।' খালুর মুড ভালো বলে বোধ হচ্ছে না। এখন প্রবাদ বেরোচ্ছে। মাসোহারাটাও স্টপ পেমেন্ট হবে কিনা বোঝা যাচ্ছেনা। Wrong time, wrong place, ক্রসফায়ারে পড়লাম মনে হচ্ছে। গালিগালাজ অবধারিত বলে মনে হচ্ছে।
'তোমার আইটি বিদ্যা যদি টাকি মাছের আইটি বিদ্যার চেয়ে কম না হয় তবে আমি তোমার মেসে গিয়ে তিনদিন ন্যাংটু হয়ে বসে থাকবো। তুমি যা খাও, তাই খাবো। তুমি যা করো, তাই করবো। ইন জন্মদিনের পোশাক। ইয়েস, আই মীন ইট। '
-'চ্যালেন্জ নিলাম খালু সাহেব।'
-'বলো বিল গেটস কে?'
-'আপনার এই লেপটপটার কোম্পানীর মালিক!'
-'হুম!'
-'আর স্টিভ জবসটা কে।'
-'আপনার ঐ টেবিলের গণকযন্ত্র ডেল কোম্পানীর মালিক!'
আমার হাসি আকর্ণ বিস্তৃত হলো।
-'গেট লস্ট! গেট আউট! বেরো বেটা স্টুপিড আমার অফিস থেকে।'
-'খালু, এই মাসের সেলারিটা। একটু ক্রাইসিস যাচ্ছে। হাত-টাত খালি।'
-'সেলারি? কিসের সেলারি স্টুপিড? তুই কী এই অফিসের এম্প্লয়ী? তুই কোনো অফিসের ঝাড়ুদার হবারো যোগ্য না। গেট লস্ট।'
-' বাদলের সাথে অনেকদিন দেখা সাক্ষাৎ নাই...'
-'হাউ ডেয়ার ইউ, খবরদার, বাদলের নাম তুই মুখে নিবি না। এই নে তোকে চেক লিখে দিচ্ছি। খবরদার বাদলের ধারে কাছে যেনো তোকে না দেখি।'
চেকটা লিখে খালুসাহেব আমার দিকে ছুড়ে মারলেন।
হিমুদের এসব ছোটখাট বিষয় গায়ে মাখাতে নেই এবং চাইলেও মাখবে না।
বাবা বলেছিলেন, 'যে কোনো আবেগে কচুপাতা ধর্ম অবলম্নন করিবে।'
তাই আমি আরো বিস্তৃত হাসি মুখে চেকটা নিয়ে বললাম, ' জাঝাকুল্লাহ খাইরান!'
২.
বৃহস্পতিবার।
জনতা ব্যাংক জিরো পয়েন্ট শাখা।
ব্যাংকে প্রচুর ভিড়।
এতো লোক পিপড়ের ধর্ম পালন করে! চেকটা ক্যাশ করার জন্য যখন জমা দিলাম।
ব্যাংকে ঢুকে চেকটা ভাংগাতে গিয়ে শুনি ওটা একাউন্ট পেয়ি ক্রসিং দেয়া চেক!
চেকের উপরে আড়াআড়িভাবে দুটা প্যারালাল লাইন একে দেয়া। এটা থাকার কারণে আমাকে ক্যাশে টাকাটা দেয়া হবে না। আমার একাউন্ট থাকলে তাতে জমা করা যাবে।
হিমুদের কোনো ব্যাংক একাউন্ট নাই। যদিও মহাপুরুষ বিদ্যালয়ের শিক্ষক আমাকে ব্যাংক একাউন্ট করা নিয়ে কোন বাণী দিয়ে যান নি, তবে সঞ্চয় করা সম্পর্কে বাবা বাণী দিয়ে গেছেন:
"সঞ্চয় করা পিপড়ে, মৌমাছি এসব নিম্নশ্রেণীর কিন্তু অত্যন্ত সামাজিক প্রাণীদের কাজ। অনেক মানুষও ভবিষ্যতের নিরাপত্তার জন্য সঞ্চয় করে থাকে। তবে তুমি সঞ্চয় করবে শুধুমাত্র অভিজ্ঞতা, অনুভূতি, আবেগ এসব শুধু ব্ল্যাকহোলের মতোন যারা কেবল গ্রহণই করে, কিন্তু প্রকাশ করে না।"
কাউন্টারের মাঝবয়সী ভদ্রমহিলা যখন ভুরু কুচকে পান খেতে খেতে চেকের ব্যাপারটা বুঝাচ্ছিলেন তখন খেয়াল করলাম উনার কপালের টিপটা ঠিক মাঝামাঝি হয়নি। একটু ডানের দিকে সরে আছে।
-আমনের একাউন্ট আসে?
-না।
-একটা একাউন্ট খুলেন তাইলে।
-জ্বি, কিছু সমস্যা আছে।
-ও, তাইলে, আমনের চেকের ক্রসিং বাতিল করাইয়ে নিয়ে আইসেন, পরে পেমেন্ট হইবে, ক্যামন।
-হুমম। সরি ম্যাডাম।
-সরি কওন লাগবো না।
-ম্যাডাম কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি। আপনি কী জানেন আপনার টিপটা আপনার ললাটকে ঠিক সমদ্বিখন্ডিত করে নি। একটু ডানে সরে আছে।
ভদ্রমহিলা তাকালেন। তাকিয়ে হেসে ফেল্লেন। পান খাওয়া একটা মাঝবয়সী মহিলার হাসি এতো মিষ্টি হতে পারে আমার জানা ছিলোনা। এই হাসি দেখার জন্য আবার পিছনে তাকাতে ইচ্ছেটা হজম করে ফেল্লাম। আমি পিপড়া না। মিষ্টি এখন না হলেও চলবে। খালুকে আবার ধরতে হবে।
ক্যাশ কাউন্টার থেকে বের হয়ে আসার সময় দেখি একটা ব্যাংকের ভেতরে একটা কম্প্যুটার টেবিলে বসে একজন কর্মকর্তা পিসি ওয়ার্ল্ড নামের একটা ম্যাগাজিন পড়ছে। যার উপরে খালুসাহেবের ল্যাপটপ পিসি ম্যাকবুকের প্রচ্ছদ। বয়স ৩৮/৩৯ হবে। উনি কি খালুসাহেবের মেশিনের সমস্যা ঠিক করতে পারবেন। যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখো তাই, পাইলেও পাইতে পারো মানিক-রতন!
-গুড মর্নিং।
-'জ্বি গুড মর্নিং।' ম্যাগাজিন থেকে চোখ না তুলেই।
-ভাইজান ভালো আছেন।
-'জ্বে, আজ্ঞে। ভালো।' এইবার তাকালেন। আপনি...?
-আমি আপনার ব্যাংকের একজন কাষ্টমার। অফিস টাইমে বসে যে আপনি পত্রিকা পড়ছেন এটা কি ঠিক।
ভদ্রলোক আমতা আমতা করতে লাগলেন।
-জ্বি, সরি। আমার কাজ টাইপ করা। আমি একটু এখন ফৃ , তাই একটু চোখ বুলাইতেছিলাম।
-আচ্ছা ঠিক আছে, একটু অন্য বিষয়ে কথা বলি?
-জ্বে, আজ্ঞে, বসেন প্লীজ। আমার নাম সনাতন। আপনি...
-আমি হিমু।
-হিমু! আচ্ছা ঠিক আছে বলেন।
-আপনি যে বিষয়ের উপর ম্যাগাজিনটা পড়ছেন তার উপরে আপনার ধারণা কেমন?
-কোনটা? এই অ্যাপলের ম্যাকবুক? মোটামুটি তেমন কিসুই জানিনা। তবে বলেন কি জানতে চান?
-তেমন কিছু না, কিছু সমস্যা হয়েছে, আমার খালুসাহেবের এরকম একটা যন্ত্র আছে যা তাকে বেশ যন্ত্রণা দিচ্ছে। সেটা ঠিক করতে হবে। পারবেন?
-সমস্যাটা কি বলতে পারবেন?
-না।
-তাইলে তো সমস্যা।
-আপনার খালুর কোথায় থাকে। অফিস কোথায়?
-এইতো ফার্মগেইটে।
-ও, আমিতো ঢাকা শহরে এইতো দু'দিন হইলো বদলী হইয়া আসলাম। আমি একদিন ছুটির দিনে আপনার খালুর সমস্যা ঠিক করে দিয়ে আসবো'খন। আমি এখন একটু পরে লাঞ্চের সময় বাসা খুজতে বের হবো।
-আরে আপনার বাসা খুজে দেবার দায়িত্ব আমার। আপনি আমার সংগে চলেন। শোধবোধ হয়ে যাবে।
-ঠিকাছে চলেন।
টুকটাক কম্পিউটার জানার বিনয় দেখালেও আসলে উনি যে একটা জিনিস তা প্রমাণ করলেন খালুর ম্যাকবুকের সমস্যাটা সমাধান করে দিয়ে। দেখতে ও আচার আচরণে সাধারণ মনে হলেও খালুর ভাষায় উনার ভিতরে "মাল" আছে। জনতা ব্যাংক জিরো পয়েন্ট শাখার এসিস্ট্যান্ট অফিসার গ্রেড-২। কম্পিউটারে বাংলা চিঠিপত্র টাইপ করে লো প্রোফাইল মেনটেন করেন। ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট শাখা থেকে বদলি হয়ে ঢাকায়। টাঙ্গাইলের আকুর-টাকুর পাড়ায় গ্রামের বাড়ি।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ৯:০৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




