somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জমিদার ও স্বাধীনতার চাদর

১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১০ সকাল ৮:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তাহিরপুর গ্রাম, সুখে দুখে ভরা একটা গ্রাম। অনেক মানুষ সেই আদ্যিকাল ধরে বসবাস করে আসছে। আজকে যারা নেই, তাদের উত্তরাধিকারীরা এখনো আছে। গ্রামের মানুষজন সবাই খেটে খাওয়া মানুষ, কামার পাড়ায় সবাই লোহা পিটিয়ে, কুমোর পাড়ায় মাটি পুড়িয়ে কিংবা কিষান শ্রেনী সারা দিন রোদে পুড়ে ফসল ফলিয়ে তবেই দুবেলা দুমুঠো খেতে পায়। সেই সাথে আছে তাঁতি পাড়ার তাঁতিরা, মাঝি পাড়ার জেলেরা, সব্বাই সারাদিন খেটে বেড়ায়। শুধু জমিদার পাড়ার জমিদারেরাই বসে খায়। তারা বসে তো খায়ই, তাদের বসে খাবার সুবিধার্থে কাউকে তারা আর বসে থাকতে দেয়না। গ্রামে ঠিক কবে থেকে এই জমিদার পাড়ার পত্তন ঘটেছে তা কারো ঠিক ঠিক মনে নেই। তবে এরা আছে, থাকবে, একে অপরের ঘাড়ে চড়ে, একে অপরকে হারিয়ে যুদ্ধ করে টিকে থাকবে।

আড়াইশ বছর আগের কথা। হঠাত করেই বিদেশি মহাজনরা গ্রামের জমিদার পাড়ায় বসবাস শুরু করল। এতে পুরোনো জমিদাররা বিচলিত হল, অনেকে পালিয়ে গেল, কাউকে কাউকে খুন করা হল।বাকিরা চুপ মেরে রইল। দুশ বছর এরাই গ্রামের সবকিছু, দুএকবার গ্রামের লোক বিদ্রোহ করেছিল বটে, কিন্তু বিনিময়ে গাছে ঝুলিয়ে মারা হয়েছে তাদের।তবে ক্রমাগত বিদ্রোহ আর সেই সাথে জমিদার পাড়ার অন্য জমিদারদের মাতব্বরিতে তাদেরকে সব ছেড়ে ছুড়ে নিজের দেশে ভেগে যেতে হয়েছে একসময়। প্রায় দু’শ বছর পর জমিদার পাড়ার নের্তৃত্বে এল আরেকদল জমিদার। এভাবে উত্থান পতন চলতেই লাগল।

তাঁতি পাড়ার হাফিজ তাঁতি পুরো গ্রাম জুড়েই বিখ্যাত। তার তাঁতেই তৈরী হয় সবচে ভাল পোষাক। সব সময়ই জমিদার পাড়ার ক্ষমতাসীন জমিদাররা তাদের জমিদারী দেখাশোনার জন্য ওর বানানো পোষাক পরে বের হয়। আর শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা সবসময়ই হাফিজ তাঁতির বানানো পোষাকই আগলে রাখে জমিদারদের। কিন্তু তবুও সব জমিদারের সব ক্ষোভই যেন এই হাফিজ তাঁতির উপর। হাফিজ তাঁতির দেয়া এই সম্ভ্রম যাতে আর কারো কাছে না পৌছায় সেই জন্যে সব জমিদারই ক্ষমতায় থেকে অত্যাচারের রোলার চালায় তার প্রতি।

সাতচল্লিশে যেবার ইংরেজী জমিদাররা চলে গেল, তারপর জমিদার পাড়ায় শৌর্যবীর্য নিয়ে দাপটের সাথে দাপিয়ে বেড়াতে শুরু করল উর্দু জমিদাররা। স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে, ধর্মের কিচ্ছা বলে তারা ঠিকই হাফিজের স্বাধীনতা চাদর গায়ে চড়াতে পারল কিন্তু তাদের সাথে ইংরেজী জমিদারদের তুলনায় ঐ ভাষাটুকু ছাড়া আর কিছু মিললনা। স্বাধীনতা পাগল হাফিজ তাঁতি তার আদরে বানানো স্বাধীনতা চাদরখানি তুলে দিয়ে নিজের কপাল নিজেই চাপড়াতে লাগল। দরিদ্র এই তাঁতি দু:খ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আবারও স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে চাইল। নতুন করে আবার সুতা যোগাড় করল, এত উৎকৃষ্ট সুতা যোগাড় করল এবার সে, তা দেখে সবাই চমকে উঠল। এবার এমন জাদুকরী হাতে একটা চাদর তৈরী হবে যা কেবল স্বাধীনতার সূর্য বুকে রাখা জমিদারই গায়ে পরতে পারবে, আর কেউ নয়। স্বাধীনতার নেশায় বুক বেঁধে হাফিজ তাঁতি আবার কাপড় বুনতে বসল। তাঁতির কাপড় বুনার শব্দ জমিদার পাড়া থেকে শুনতে পাবার কথা নয়, কিন্তু যে বিশ্বাস, চেতনা আর উদ্দীপনা হাফিজ তাঁতীর হৃদয়ে রয়েছে তার সাথে তাঁতের শব্দ মিলে বাতাসে যে হিন্দোল তৈরী হয়েছে তা লুকিয়ে রাখার মত নয়। এ যে স্বাধীনতার শব্দ, এ শব্দ শত্রুসেনার মনে ভয়ের তৈরী করে, এ শব্দ উর্দু জমিদারের হৃদয়কে প্রতিনিয়ত কাঁপিয়ে দিতে লাগল।
উর্দু জমিদার তার জমিদারি ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে চায়, চায় শাষন আর শোষনের চর্চা চিরকাল টিকিয়ে রাখতে। সে কিছুতেই হাফিজকে নতুন চাদর বানাতে দেবে না। তাই তার বাহিনীকে লেলিয়ে দিল হাফিজের তাঁতের পেছনে, তারা তাঁত ভেঙে দিল। তারা হয়ত ঠিকই তাঁত ভেঙেছে, কিন্তু হাফিজের হৃদয়ের শক্ত বিশ্বাস আর চেতনার টিকিটুকুও ছুতে পারল না স্বাধীনতার শত্রুরা। তাঁত নেই তো কি হয়েছে, হাতেই বুনবে হাফিজ সত্যিকারের স্বাধীনতার চাদর। আর পরিয়ে দেবে স্বপ্নের পুরুষকে, যিনি এ স্বাধীনতাকে এনে দেবেন এবং রক্ষা করবেন লক্ষ হাফিজের জন্য। চব্বিশ বছরের সাধনায় তৈরী হল নতুন চাদর, স্বাধীনতার চাদর, যতক্ষন এ চাদর অক্ষত থাকবে, ততক্ষন কোন স্বাধীনতার শত্রু এ চাদর গায়ে তুলতে পারবেনা, বড়ই জাদুকরী চাদর। যার হৃদয়ে পাপ আছে, গ্রামের মানুষের প্রতি বিদ্বেষ আছে, তাদের প্রতি অত্যাচারের আগ্রহ আছে এমন কেউই এ চাদর অক্ষত রেখে পরতে পারবেনা। এল সেই মহেন্দ্রক্ষন, উর্দু জমিদার বিদেয় হল, বাংলা জমিদার জমিদারী হাতে তুলে নিল, স্বাধীনতার চিকচিক আলোয় চমকিত হল হাফিজ, নতুন জমিদারকে পরিয়ে দিতে চাইল তার সাধনার স্বাধীনতার চাদর।

হাফিজ তাঁতিও গ্রামের অন্য সব খেটে খাওয়া মানুষের মতই দরিদ্র। তারা দরিদ্র ছিল, আজও দরিদ্র আছে। জমিদার পরিবর্তন হয়েছে বহুবার কিন্তু জমিদার তো জমিদারই। তারা ধনীই আছে আগের মত, তাদের সাথে গ্রামের অন্য মানুষের তুলনা আজও করা যায়না। ডিসেম্বর এলে হাফিজ তাঁতীর দুটো চাদরের কথা মনে পড়ে। শীতে তার নিজের জন্য শীত নিবারনের একটা চাদরের অভাব অনুভব করে আর সাথে সাথে তার তৈরী সেই স্বাধীনতার চাদরটির কথাও মনে পড়ে। চল্লিশ বছর পরও ঝাপসা চোখে জমিদার পাড়ার সীমানা বেড়ার ফুঁটো দিয়ে আগ্রহভরে খুঁজে বেড়ায় সেই চাদরটিকে। মাঝে মাঝে যখন তা চোখে পড়ে, তখন তার না পাওয়া বেদনার কষ্টের মাত্রা বার্ধক্যের কষ্টের সাথে মিলে অনেক বেড়ে যায়। তার সাধনার সেই চাদরটি তার হাত থেকে যাবার পর কখনোই অক্ষত ছিল, তাতে অনেক ফুঁটো, অনেক ছেড়া জায়গা তৈরী হয়েছে দিনে দিনে। বাংলা জমিদারদের লোভ আর পাপ নিজেদেরকে বাধ্য করেছে চাদরটিকে আহত করে তারপর পরিধান করতে। কোন জমিদারই স্বাধীনতার চাদরকে অক্ষত রাখতে পারেনি, কোন না কোন ভাবে আহত করেছে স্বাধীনতা আর চাদরকে।

হাফিজ এখন জীবনে শেষ লগ্নে উপস্থিত। মৃত্যুদানব এখনো তাকে ছোঁয়ার সাহস পায়না, কেননা হাফিজের হৃদয় এখনো অতৃপ্ত। অতৃপ্ত আত্না বহন করার ক্ষমতা মৃত্যুদানবের নেই। হাফিজের হৃদয় এখনো সেই স্বাধীনতার চাদরখানিকে মেরামতের আশা রাখে, স্বাধীনতার চরম সুখ পাবার আশা রাখে। হাফিজরা মরে না, হাফিজরা মরার মত করে জন্মায়নি, হাফিজ এই মহাবিশ্বেরই একটি অংশ, এই হাফিজ চিরকাল স্বাধীনতাকামী আত্না খুঁজে বেড়ায় এবং তাতে অবস্থান করে।


২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামাত কি দেশটাকে আবার পূর্ব পাকিস্তান বানাতে চায়? পারবে?

লিখেছেন ঋণাত্মক শূণ্য, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:২৮

অন্য যে কোন সময়ে জামাতকে নিয়ে মানুষ যতটা চিন্তিত ছিলো, বর্তমানে তার থেকে অনেক বেশী চিন্তিত বলেই মনে করি।



১৯৭১ এ জামাতের যে অবস্থান, তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৬


যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?

যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!

যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×