তাহিরপুর গ্রাম, সুখে দুখে ভরা একটা গ্রাম। অনেক মানুষ সেই আদ্যিকাল ধরে বসবাস করে আসছে। আজকে যারা নেই, তাদের উত্তরাধিকারীরা এখনো আছে। গ্রামের মানুষজন সবাই খেটে খাওয়া মানুষ, কামার পাড়ায় সবাই লোহা পিটিয়ে, কুমোর পাড়ায় মাটি পুড়িয়ে কিংবা কিষান শ্রেনী সারা দিন রোদে পুড়ে ফসল ফলিয়ে তবেই দুবেলা দুমুঠো খেতে পায়। সেই সাথে আছে তাঁতি পাড়ার তাঁতিরা, মাঝি পাড়ার জেলেরা, সব্বাই সারাদিন খেটে বেড়ায়। শুধু জমিদার পাড়ার জমিদারেরাই বসে খায়। তারা বসে তো খায়ই, তাদের বসে খাবার সুবিধার্থে কাউকে তারা আর বসে থাকতে দেয়না। গ্রামে ঠিক কবে থেকে এই জমিদার পাড়ার পত্তন ঘটেছে তা কারো ঠিক ঠিক মনে নেই। তবে এরা আছে, থাকবে, একে অপরের ঘাড়ে চড়ে, একে অপরকে হারিয়ে যুদ্ধ করে টিকে থাকবে।
আড়াইশ বছর আগের কথা। হঠাত করেই বিদেশি মহাজনরা গ্রামের জমিদার পাড়ায় বসবাস শুরু করল। এতে পুরোনো জমিদাররা বিচলিত হল, অনেকে পালিয়ে গেল, কাউকে কাউকে খুন করা হল।বাকিরা চুপ মেরে রইল। দুশ বছর এরাই গ্রামের সবকিছু, দুএকবার গ্রামের লোক বিদ্রোহ করেছিল বটে, কিন্তু বিনিময়ে গাছে ঝুলিয়ে মারা হয়েছে তাদের।তবে ক্রমাগত বিদ্রোহ আর সেই সাথে জমিদার পাড়ার অন্য জমিদারদের মাতব্বরিতে তাদেরকে সব ছেড়ে ছুড়ে নিজের দেশে ভেগে যেতে হয়েছে একসময়। প্রায় দু’শ বছর পর জমিদার পাড়ার নের্তৃত্বে এল আরেকদল জমিদার। এভাবে উত্থান পতন চলতেই লাগল।
তাঁতি পাড়ার হাফিজ তাঁতি পুরো গ্রাম জুড়েই বিখ্যাত। তার তাঁতেই তৈরী হয় সবচে ভাল পোষাক। সব সময়ই জমিদার পাড়ার ক্ষমতাসীন জমিদাররা তাদের জমিদারী দেখাশোনার জন্য ওর বানানো পোষাক পরে বের হয়। আর শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা সবসময়ই হাফিজ তাঁতির বানানো পোষাকই আগলে রাখে জমিদারদের। কিন্তু তবুও সব জমিদারের সব ক্ষোভই যেন এই হাফিজ তাঁতির উপর। হাফিজ তাঁতির দেয়া এই সম্ভ্রম যাতে আর কারো কাছে না পৌছায় সেই জন্যে সব জমিদারই ক্ষমতায় থেকে অত্যাচারের রোলার চালায় তার প্রতি।
সাতচল্লিশে যেবার ইংরেজী জমিদাররা চলে গেল, তারপর জমিদার পাড়ায় শৌর্যবীর্য নিয়ে দাপটের সাথে দাপিয়ে বেড়াতে শুরু করল উর্দু জমিদাররা। স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে, ধর্মের কিচ্ছা বলে তারা ঠিকই হাফিজের স্বাধীনতা চাদর গায়ে চড়াতে পারল কিন্তু তাদের সাথে ইংরেজী জমিদারদের তুলনায় ঐ ভাষাটুকু ছাড়া আর কিছু মিললনা। স্বাধীনতা পাগল হাফিজ তাঁতি তার আদরে বানানো স্বাধীনতা চাদরখানি তুলে দিয়ে নিজের কপাল নিজেই চাপড়াতে লাগল। দরিদ্র এই তাঁতি দু:খ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আবারও স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে চাইল। নতুন করে আবার সুতা যোগাড় করল, এত উৎকৃষ্ট সুতা যোগাড় করল এবার সে, তা দেখে সবাই চমকে উঠল। এবার এমন জাদুকরী হাতে একটা চাদর তৈরী হবে যা কেবল স্বাধীনতার সূর্য বুকে রাখা জমিদারই গায়ে পরতে পারবে, আর কেউ নয়। স্বাধীনতার নেশায় বুক বেঁধে হাফিজ তাঁতি আবার কাপড় বুনতে বসল। তাঁতির কাপড় বুনার শব্দ জমিদার পাড়া থেকে শুনতে পাবার কথা নয়, কিন্তু যে বিশ্বাস, চেতনা আর উদ্দীপনা হাফিজ তাঁতীর হৃদয়ে রয়েছে তার সাথে তাঁতের শব্দ মিলে বাতাসে যে হিন্দোল তৈরী হয়েছে তা লুকিয়ে রাখার মত নয়। এ যে স্বাধীনতার শব্দ, এ শব্দ শত্রুসেনার মনে ভয়ের তৈরী করে, এ শব্দ উর্দু জমিদারের হৃদয়কে প্রতিনিয়ত কাঁপিয়ে দিতে লাগল।
উর্দু জমিদার তার জমিদারি ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে চায়, চায় শাষন আর শোষনের চর্চা চিরকাল টিকিয়ে রাখতে। সে কিছুতেই হাফিজকে নতুন চাদর বানাতে দেবে না। তাই তার বাহিনীকে লেলিয়ে দিল হাফিজের তাঁতের পেছনে, তারা তাঁত ভেঙে দিল। তারা হয়ত ঠিকই তাঁত ভেঙেছে, কিন্তু হাফিজের হৃদয়ের শক্ত বিশ্বাস আর চেতনার টিকিটুকুও ছুতে পারল না স্বাধীনতার শত্রুরা। তাঁত নেই তো কি হয়েছে, হাতেই বুনবে হাফিজ সত্যিকারের স্বাধীনতার চাদর। আর পরিয়ে দেবে স্বপ্নের পুরুষকে, যিনি এ স্বাধীনতাকে এনে দেবেন এবং রক্ষা করবেন লক্ষ হাফিজের জন্য। চব্বিশ বছরের সাধনায় তৈরী হল নতুন চাদর, স্বাধীনতার চাদর, যতক্ষন এ চাদর অক্ষত থাকবে, ততক্ষন কোন স্বাধীনতার শত্রু এ চাদর গায়ে তুলতে পারবেনা, বড়ই জাদুকরী চাদর। যার হৃদয়ে পাপ আছে, গ্রামের মানুষের প্রতি বিদ্বেষ আছে, তাদের প্রতি অত্যাচারের আগ্রহ আছে এমন কেউই এ চাদর অক্ষত রেখে পরতে পারবেনা। এল সেই মহেন্দ্রক্ষন, উর্দু জমিদার বিদেয় হল, বাংলা জমিদার জমিদারী হাতে তুলে নিল, স্বাধীনতার চিকচিক আলোয় চমকিত হল হাফিজ, নতুন জমিদারকে পরিয়ে দিতে চাইল তার সাধনার স্বাধীনতার চাদর।
হাফিজ তাঁতিও গ্রামের অন্য সব খেটে খাওয়া মানুষের মতই দরিদ্র। তারা দরিদ্র ছিল, আজও দরিদ্র আছে। জমিদার পরিবর্তন হয়েছে বহুবার কিন্তু জমিদার তো জমিদারই। তারা ধনীই আছে আগের মত, তাদের সাথে গ্রামের অন্য মানুষের তুলনা আজও করা যায়না। ডিসেম্বর এলে হাফিজ তাঁতীর দুটো চাদরের কথা মনে পড়ে। শীতে তার নিজের জন্য শীত নিবারনের একটা চাদরের অভাব অনুভব করে আর সাথে সাথে তার তৈরী সেই স্বাধীনতার চাদরটির কথাও মনে পড়ে। চল্লিশ বছর পরও ঝাপসা চোখে জমিদার পাড়ার সীমানা বেড়ার ফুঁটো দিয়ে আগ্রহভরে খুঁজে বেড়ায় সেই চাদরটিকে। মাঝে মাঝে যখন তা চোখে পড়ে, তখন তার না পাওয়া বেদনার কষ্টের মাত্রা বার্ধক্যের কষ্টের সাথে মিলে অনেক বেড়ে যায়। তার সাধনার সেই চাদরটি তার হাত থেকে যাবার পর কখনোই অক্ষত ছিল, তাতে অনেক ফুঁটো, অনেক ছেড়া জায়গা তৈরী হয়েছে দিনে দিনে। বাংলা জমিদারদের লোভ আর পাপ নিজেদেরকে বাধ্য করেছে চাদরটিকে আহত করে তারপর পরিধান করতে। কোন জমিদারই স্বাধীনতার চাদরকে অক্ষত রাখতে পারেনি, কোন না কোন ভাবে আহত করেছে স্বাধীনতা আর চাদরকে।
হাফিজ এখন জীবনে শেষ লগ্নে উপস্থিত। মৃত্যুদানব এখনো তাকে ছোঁয়ার সাহস পায়না, কেননা হাফিজের হৃদয় এখনো অতৃপ্ত। অতৃপ্ত আত্না বহন করার ক্ষমতা মৃত্যুদানবের নেই। হাফিজের হৃদয় এখনো সেই স্বাধীনতার চাদরখানিকে মেরামতের আশা রাখে, স্বাধীনতার চরম সুখ পাবার আশা রাখে। হাফিজরা মরে না, হাফিজরা মরার মত করে জন্মায়নি, হাফিজ এই মহাবিশ্বেরই একটি অংশ, এই হাফিজ চিরকাল স্বাধীনতাকামী আত্না খুঁজে বেড়ায় এবং তাতে অবস্থান করে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




