পশ্চিম সুলতানপুর। ছোট্ট একটা গ্রাম। গ্রামের পূর্ব আর পশ্চিমে দিগন্ত জোড়া ধানের ক্ষেত। গ্রামটির দুটো ভাগে বিভক্ত, উত্তর পাড়া আর দক্ষিন পাড়া। এখানে একটা প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে, আর গ্রামের দক্ষিন-পূর্বে ক্ষেত পেরুলেই একটা বাজার আছে, সেখানে রয়েছে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। গ্রামের ছেলে-মেয়েরা প্রথমিক বিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে সেখানে মাধ্যমিক শ্রেনীতে ভর্তি হয়।
ডিসেম্বর মাস। শীতকাল। ধান কাটা শেষ হয়ে গেছে। গ্রামের গেরস্তরা ধান শুকোতে ব্যস্ত। আর ওদিকে বিদ্যালয়গুলোয় শেষ হয়ে গেছে সমাপনি পরীক্ষা। শুকনো ধানী জমিগুলো পরিণত হয়েছে শিশুদের খেলার মাঠে। রফিক, আরাফাত, শফিক, মনসুরসহ উত্তর আর দক্ষিন পাড়ায় অনেকেই এবার ষষ্ঠ, সপ্তম কিংবা অষ্টম শ্রেনীর সমাপনি পরীক্ষা শেষ করে নতুন শ্রেনীতে ভর্তির অপেক্ষা করছে। সারাদিন ওদের সময় কাটে গ্রামের মাঠগুলোয় ক্রিকেট খেলে। দুই পাড়ার আলাদা আলাদা মাঠ রয়েছে। আর দুই পাড়ার ছেলেদের মধ্যে যারা বয়োজ্যেষ্ঠ তারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে খেলতে পছন্দ করে। মাঠটা বেশ বড় আর স্থায়ী।
দু-পাড়ার মানুষদের মধ্যে খেলাধুলার প্রতিযোগীতার প্রবণতা রয়েছে। প্রতি বছরই গ্রামের বিভিন্ন বয়সের পুরুষরা দুটি পাড়ায় বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলার আয়োজন করে থাকে। এই আয়োজনগুলো নিয়ে সব বয়সের মানুষের মধ্যেই একটা উত্তেজনা বিরাজ করে। ছেলে-বুড়ো, পুরুষ-মহিলা সবাই একসাথে এ আয়োজনগুলো দেখতে হাজীর হয়। এই খেলার আয়োজনগুলো দুপাড়ার মধ্যে একটা বন্ধুত্ববোধ যেমন তৈরী করে তেমনি মাঝে মাঝে শত্রুতারও সূচনা ঘটায়। উত্তর পাড়ার নামে বদনাম রয়েছে, জেতার জন্যে সবসময় তারা বিভিন্ন ছুতো আর অনিয়ম অবলম্বন করে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থান উত্তর পাড়ায় হওয়ায় খেলার আয়োজনগুলোর দায়িত্বে থাকে উত্তর পাড়ার লোকজন। এতে দক্ষিন পাড়ার লোকেরা সর্বাত্নক সহায়তা করলেও মাতব্বরির সুযোগটুকু উত্তর পাড়ার লোকেরাই পায়।
উত্তর পাড়ার শফিক হঠাতই দক্ষিন পাড়ার আরাফাতের কাছে এসে একটা ক্রিকেট ম্যাচের প্রস্তাব দিল। আরাফাতও রাজী হল। ওরা দুজনেই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেনীর ছাত্র। খেলার দিন তারিখ ঠিক হল। শনিবার সকাল ১০ টায় ম্যাচ। সময়টা বড়দের জন্যে সুবিধাজনক না হওয়ায় এর আয়োজনে বড়দের হাত লাগানোর সুযোগ নাই। তাই এর দায়িত্ব এসে পড়ল হাসুবুবুর হাতে। হাসু এ গ্রামের সবচে মেধাবী মেয়ে। সে মাধ্যমিক পরীক্ষায় খুব ভাল রেজাল্ট করেছে, এখন শহরের কলেজে পড়ে। গ্রামের ছোটরা সবাই ওকে খুব পছন্দ করে, এবং তার কথা শোনে।
শনিবার সকাল ৯ টা। প্রথমিক বিদ্যালয় মাঠে উপস্থিত হয়েছে গ্রামের সব শিশু-কিশোর। খেলা শুরু হতে আরো এক ঘন্টা বাকি। দু পাড়ার ক্রিকেট টিম এসে উপস্থিত হয়েছে মাঠে। হাসুবুবু সব দেখাশোনা করছেন। তিনি বললেন, খেলা হবে আন্তর্জাতিক পদ্ধতিতে। গ্রামের প্রচলিত বিদঘুটে কোন পদ্ধতিতে খেলা হবেনা। উল্লেখ্য, গ্রামটিতে শর্ট-পিচ গেম নামে পরিমার্জিত রূপে ক্রিকেট খেলা হয়ে থাকে যেখানে ছয় রানের শটকে আউট ধরাসহ বেশ কিছু নিয়মের পরিবর্তন রয়েছে। সবাই হাসুবুবুর কথা মেনে নিল। আম্পায়ারের দায়িত্ব পেল উত্তর পাড়ার দশম শ্রেনীর ছাত্র আহাদ আর রাজু। আর থার্ড আম্পায়ারের দায়িত্ব পালন করবেন হাসুবুবু। তিনি নিজে ক্রিকেট না খেললেও টিভিতে ক্রিকেট খেলা দেখে অভ্যস্ত। পুরো গ্রামে উনাদের বাড়িতেই কেবল টিভি আছে। গ্রামে বিদ্যুত না থাকায় সোলার প্যনেলের মাধ্যমে সেই টিভি চালানো হয়।
দশটায় খেলা শুরু হল। টসে প্রথমেই ব্যাট করতে নামল উত্তর পাড়া। উত্তর পাড়া ব্যাটিং এ খুবই ভাল হল তবে বলিং এ যথেষ্ট দুর্বল। ২০ ওভার ম্যাচ। ২৩ টা চারসহ সব মিলিয়ে ১৪২ রান করল, কোন ছয় রান হয়নি। ছোট্ট একটা বিরতির পর দক্ষিন পাড়ার মনসুর আর আরাফাত ব্যাটিং এ নামল। প্রথমে ব্যাটিং শুরু করল মনসুর, প্রথম বলেই একটা ছয় মেরে দিল। একটা ছয় আর দুটো চার সহ প্রথম ওভারেই রান হল ২০ রান। পরবর্তি ওভারে আরো মনসুরের দুটো ছয় আর সাথে তিন রান নিয়ে দুওভারে মোট ৩৫ রান। তিন নম্বর ওভারের প্রথম বলেই আরাফাত আউট হয়ে গেল। আর মনসুরের ব্যাট থেকে এল আরো তিনটে ছয় আর একটা চার ও একটা একক রান। হাসুবুবুকে একটু চিন্তিত মনে হল, তিনি হঠাত আম্পায়ার দের ডেকে কি যেন বললেন। নতুন ওভার শুরু হল। তিন ওভার শেষে রান গিয়ে দাঁড়াল ৬৮। চতুর্থ ওভারের প্রথম বলেই মনসুর আবারও ছক্কা হেঁকে দিল। তবে এবার বলটা মাঠ ছেড়ে অনেক দুরে গিয়ে খালে পড়ল। বলটা খালের স্রোতে হারিয়ে গেল, আর পাওয়া গেলনা। নতুন বল কিনতে একজনকে পাঠানো হল, বল আনতে আনতে প্রায় আধঘন্টা সময় লেগে গেল। বল প্রস্তুত, কিন্তু হাসুবুবু খেলা শুরু করতে দিলেন না।
হাসুবুবু সব আম্পায়ার আর খেলোয়াড়দের কে ডেকে এক জায়গায় জড়ো করলেন। তারপর হাসুবুবু ঘোষনা দিলেন যে, এ খেলায় ছক্কা মারা নিষেধ। যদি কেউ ছক্কা মারে তাহলে আউট। সেই হিসেবে মনসুর তার প্রথম ছয়ের শটের জন্যেই আউট আর তার কোন ছয় রান দক্ষিন পাড়ার রানের সাথে যোগ হবেনা।
হাসুবুবুর ঘোষনা শুনে দক্ষিন পাড়ার সবাই প্রচন্ড কষ্ট পেল, কিন্তু উত্তর পাড়ার সবাই খুব আনন্দিত হল। আবার খেলা শুরু হল। নতুন ঘোষনা মতে দক্ষিন পাড়া তিন ওভার এক বলে রান করেছে ৩২ রান। এরপর খেলা গড়াতে গড়াতে একসময় দক্ষিন পাড়া ২০ ওভারে ৯ উইকেট হারিয়ে করল ১৩২ রান। উত্তর পাড়া জিতে গেল। ওদের সবাই আনন্দে আত্নহারা হয়ে মিছিল করতে করতে বাড়ি চলে গেল। আর দক্ষিন পাড়ার সবাই মন খারাপ করে বাড়ি ফিরে গেল। আর এভাবেই শেষ হল পশ্চিম সুলতানপূরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




