মধ্যবিত্ত পরিবারে আমার জন্ম। বিত্তের জন্য নয় মূলত সময় ও সুযোগ এর অভাবে আমার সাগর দেখা হয়ে উঠছিল না। কিন্তু এবার যখন থাটিফাস্টটা একটু বাতিক্রম ভাবে কাটাতে যখন চাইলাম। আর যখন সাথে কিছু পাগল বন্ধুর সমর্থন পেলাম, তখন ঠিক করলাম, এবার নতুন বছরটা নতুন কোথাও উদযাপন করবো। হুজুগের মাথায় স্থান ঠিক করা হল কক্সবাজার।
৩০ তারিখে কক্সবাজার যাওয়ার ভূত মাথায় চাপলো। গোছগাছ করে বের হতে হতে ৩১ তারিখ রাত সাড়ে ৯ টা বেজে গেলো। কোন কিছুর ঠিক ছিল না। শুধু মনের মধ্যে বিশ্বাস ছিল যে এই বছরের প্রথম দিনটা কাটাবো সাগরের পারে। বাড়ি থেকে ২৭ নাম্বার বাস দিয়ে আসতে আসতে একজন লোকের সাথে পরিচয় হোল। তাকে অনেক অভিজ্ঞ বাক্তি বলে মনে হল, তাঁর কাছ থেকে তাঁর মোবাইল নাম্বার নিয়ে নিলাম। এই যাত্রায় তাকেই ভরসা ধরে নিয়ে আজানার পথে হাটা দিলাম। যাই হোক সবাই মিলে সাড়ে ১০ টার দিকে কলাবাগান বাস কাউন্তারে এসে পৌছালাম। সৌভাগ্যক্রমে বাসের টিকেটও পেয়ে গেলাম। বাস একেবারে সোজা আমাদের কক্সবাজার নামিয়ে দিবে। বাস ছাড়ল রাত সাড়ে ১১ টার দিকে। জন্ম থেকে বাসে যাতায়াত করে অভ্যাস। তবে এত দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া এবারই প্রথম। কিন্তু পুরো পথটা গল্প, গানে, কবিতায় কেমনে যে রাত ভোর হয়ে গেলো আমরা কেউই বলতে পারবো না।
যাই হোক সকাল সাড়ে ৯ টার দিকে বাস আমাদের কক্সবাজার নামিয়ে দিলো। আমরাতো পারলে তখনই ছুটে যাই সাগর পারে। কিন্তু তখনও কেউ কিছু খাইনি, কই থাকবো কোন কিছুরই ঠিক নাই। তাই প্রথমে হোটেল খুঁজতে বের হলাম। অনেক খুঁজে সস্তা একটা হোটেল এ উঠে গেলাম। তারপর ফ্রেস হয়ে নাকে মুখে কিছু গুজে দিয়ে দৌড় সাগরের দিকে। গিয়ে দেখি সাগর কই? এটাতো পুরা জনসমুদ্র! কিন্তু সাগরের ঢেউগুলো যখন আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে, তখন আমাদের ফেরায় কে? সাগরের সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঝাঁপিয়ে পরলাম সাগরে। সাগরও তাঁর নতুন অতিথিদের আপন করে নিলো। ঢেউগুলো যখন আমার দিকে ধেয়ে আসে তখন মনে হচ্ছিল এইবার এই ঢেউটা বুঝি আমাকে টেনে নিয়ে গভীর সাগরে নিয়ে ফেলবে, আর বুঝি আমার ঢাকায় ফেরা হবে না। কিন্তু না। সাগর কি তাঁর আতিথিদের বিপদে ফেলতে পারে? বড়জোর দুষ্টামি করতে পারে। তাই ঢেউ গুলো জোরে ধাক্কা দিয়ে উল্টো পাড়ের দিকে নিয়ে আসছিলো। আর যাবার সময় পায়ের নিচের বালুগুলো নিয়ে যাচ্ছিলো। এতো বালি দিয়ে কি করবে আল্লাহই জানে। সাগরতলার রাজপুরীতে হয়তোবা বিশাল রাজপ্রাসাদ তৈরির কাজ চলতেছে! পুরো দিন সাগরে লাফালাফি ঝাপাঝাপি করে পার করে দিলাম। মাঝে মাঝে সাগর পাড়ে রোদে এসে বিশ্রাম নিতেছিলাম। এককথায় সাগরের জলে যেমন স্নান করতেছিলাম, তেমনি সূর্য স্নানও করতে ছিলাম। তারপর বিকেলের দিকে হোটেলে ফিরে গোছল করে আবার কিছু খেয়ে আবার ছুটে গেলাম সাগর পানে। এবার উদ্দেশ্য বছরের প্রথম সূর্যাস্ত দেখবো। যার অনেক গল্প শুনেছি, এবার নিজের চোখে প্রত্যাক্ষ করবো। সূর্য নাকি সাগরের মধ্যে টুপ করে ডুবে যায়। কিন্তু তীব্র কুয়াশার কারনে আমাদের পৃথিবীর এই সুন্দরতম দৃশ্যটি অতটা অবলোকন করা সম্ভব হোল না। কিন্তু তাতে মনের মধ্যে যে আফসোস ছিল তা মিটিয়ে দিয়েছে সাগর পাড়ের গোধূলি লগ্ন। সে এক আদ্ভুত অভিজ্ঞতা! আস্তে আস্তে দিনের আলো মিলিয়ে যাচ্ছে, ধীরে ধীরে আন্ধকার গ্রাস করে নিচ্ছে চারদিক। সবাই জানে আমার মধ্যে একটু পাগলামিভাব আছে। আমি আবার হাঁটা দিলাম সাগরের দিকে, না এবার গোছল করার জন্য নয়। সাগরের একদম ধার ঘেঁষে হাঁটছিলাম। মাঝে মাঝে জোয়ারের ঢেউ গুলো আছড়ে পড়ছিল আমার পায়ের কাছে। আমি হাঁটছিলাম এবং হাঁটছিলাম। আমার ফেলে আসা পদচিহ্নগুলো ঢেউয়ে ধুয়ে মুছে নিয়ে যাচ্ছিল। যেন আমার ফেলে আসা দুঃসহ অতীত, আমার সব ব্যার্থতা, দুঃখ, কষ্ট, হতাশা সাগর ধুয়ে মুছে নিয়ে যাচ্ছে। সাগরেরতো অনেক বড় মন, আমার ছোট মনের কুঠুরিতে যতো আবর্জনা ছিল, সব যেন ধুয়েমুছে নিজের মধ্যে নিয়ে নিলো। রাতে বিরেতে হাঁটাহাঁটির অভ্যাস আছে। কিন্তু সাগর পাড়ের এই হাঁটার অভিজ্ঞতার কোন তুলনা হয় না। তারপর রাতে খেয়ে নিয়ে হোটেলে গিয়ে কার্ড খেলতে খেলতে আর টিভি দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে গেলাম।
পরের দিন আমি একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠেছিলাম তাই সূর্যোদয়টা দুর্ভাগ্যক্রমে দেখতে পারলাম না। যাই হোক তারপর দেরি না করে সোজা দৌড় দিলাম হিমছড়ির দিকে। কিন্তু আবারও আমাদের হতাশ হতে হল। কারন বাসার শাওয়ারে যতো পানি পরে এই ঝরনায় তারচেয়ে কম পানি পরে। যাই হোক সকালবেলা ছিল বলে অনেক নিরিবিলি ছিল। আর জীবনের প্রথম টিলা দেখে এবং আরোহণ করার মাঝে নিজের জীবনের সার্থকতা খুঁজে পেলাম। আমরা যারা শহরবাসী তাঁরা অনেকটা ব্রয়লারের মুরগীর মতো। তাই টিলায় আরোহণ আমাদের জন্য অতটা আরামদায়ক না হলেও প্রচুর আনন্দদায়ক ছিল। এরপর হিমছড়ির সামনের সাগর পাড়ে গেলাম। জায়গাটা বেশ নিরিবিলি এবং আদ্ভুত সুন্দর। এখানে বেশ কিছু আনন্দদায়ক সময় কাটিয়ে ইনানী সাগর পাড়ের দিকে রওনা দিলাম। কিন্তু কোন যানবাহনই ইনানীর দিকে যেতে রাজি নয়। ভাগ্যক্রমে আর্মির একটি ট্রাক ঐ পথ দিয়েই যাচ্ছিলো, তাঁরা আমাদের লিফট দিলেন। যার প্রচলন আমাদের দেশে একেবারেই নেই এবং অকল্পনীয়। তারপর ইনানীতে এক ভিন্ন ধরনের সাগর দেখলাম। পাথুরে সাগর পাড়। একদিক দিয়ে সাগরের পানে অনেক দূর পর্যন্ত চলে গেলেও হাঁটু পানির উপর হয় না। এবার তাঁর একটু পাশেই পাড় থেকে অল্প একটু হাঁটলেই অনেক পানি। এককথায় ভয়ংকর সুন্দর। একই কথা হিমছড়ির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। টিলার উপর উঠলে নিজেকে বিজয়ী মনে হয়। এডমন্ড হিলারী, তেঁনজিং নোরেগের ছোট ভাই মনে হয়। কিন্তু সামান্য পা ফসকালেই এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে যে, ইনানি বীচে আমার ওয়ালেট সাগর’ই মেরে দিলো নাকি পকেটমার’ই নিয়ে গেলো তা বলতে পারবো না। তাই মনটা কিঞ্চিৎ খারাপ ছিল। ওয়ালেটে বেশ কিছু টাকা ছিল, ডেবিট কার্ডটাও ছিল। যাই হোক ইনানী বীচ থেকে হোটেলে ফিরে, ফ্রেশ হয়ে সোজা চলে গেলাম লাবনী পয়েন্টে, সূর্যাস্ত দেখবো বলে। কিন্তু কুয়াশার জন্য পূর্ণ সূর্যাস্তটা না দেখতে পারলেও যা দেখেছি তাও কম নয়। সূর্যাস্তর সময়তো মাগরিবের নামাজের ওয়াক্ত। আমারা মুসলমান হলেও “মসজিদে যাই বছরে দু’একবার” টাইপের মুসলমান। আমরা সগর পাড়ের আরাম কেদারাগুলতে বসে সাগর দেখছি। তখন দেখি একজন বয়স্ক লোক পশ্চিম দিকে, ঠিক সূর্যের পানে নামাজ পড়ছেন। সেই দৃশ্যও সূর্যাস্তের দৃশ্যর চেয়ে কম সুন্দর নয়! আবার রাতে কিছু সময় সাগর পাড়ে কাটিয়ে বার্মিজ মার্কেটে গেলাম। সেখানে কিছু কেনাকাটা করে রাতের খাবার খেয়ে হোটেলে ঢুকলাম। গল্প, গান, কবিতা, টিভি দেখা, কার্ড খেলে বহু রাতে ঘুমাতে গেলাম। তাই দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এবারও ভোঁরে উঠে গিয়ে আর সূর্যোদয়টা দেখা হয় না। কিন্তু যাই হোক সকালে সাগরকে এবারের জন্য শেষবারের মতো দেখে বিদায় নিয়ে এলাম, আবার আসব এই প্রতশ্রুতি দিয়েও এলাম। তারপর সাড়ে ১২টার দিকে আমরা চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা দিলাম। চট্টগ্রামে পৌছাতে পৌছাতে আমাদের আনুমানিক ৬ বা ৭ টা বেজে যায়। তাই ঐদিন আর ঘুরাঘুরি না করে সবাই আমার এক আত্মীয়র বাসায় আশ্রয় নেই, রাতটা কাটাবো বলে। তাদের আদর, আপ্যায়নে আমরা সবাই মুগ্ধ। নানা পদের সুস্বাদু সামুদ্রিক মাছ দিয়ে আমরা রাত ও দুপুরের আহার সারি। এরমধ্যে একপাক পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতটাও দেখে আসি। বিকেলে আত্মীয় আমাদের নৌবাহিনীর জাহাজগুলো ঘুরে দেখালেন, কারন তিনি নৌবাহিনীতে চাকরী করেন। এরপর রাতে আমারা আবার নানা পদের সামুদ্রিক মাছ দিয়ে একটা জটিল ভোজন করে ঢাকার উদ্দেশ্যে বের হলাম। এখন পর্যন্ত সব যাতায়াতই বাসে হয়েছে তাই যাওয়াটা ট্রেনেই হোক, এটাই চাচ্ছিলাম। কিন্তু নতুন রেল ষ্টেশন এসে দেখি সব টিকেট আগেই বিক্রি হয়েগেছে। কিন্তু মনের দৃঢ় ইচ্ছার কাছে, এই সামান্য বাধাতো কিছুই নয়। যাই হোক দাঁড়িয়ে যাওয়ার টিকেট কেটে সবাই ট্রেনে উঠে পড়ি বসার একটা না একটা জায়গা পাবোই এই বিশ্বাস নিয়ে। কিন্তু আমাদের আশায় গুঁড়ে বালি। পুরো রাত আমাদের গেটের কাছে কোনরকমে বসে আসতে হয়েছে। যদিও রাতটা মাটি হতে দেইনি। পুরো ১২ ঘণ্টার ভ্রমন। পুরো রাস্তা ম্যারেজ খেলতে খেলতে আসছি। তবে সবারই খুব কষ্ট হইছে। সবচেয়ে বেশী কষ্ট পাইছি, যখন দেখলাম টিকেট না কেটেও অনেক লোক সিটে বসে যাচ্ছে, শুধু টিটি কে ম্যানেজ করে, আর আমরা টিকেট কেটেও সিট পাইতেছি না। পরদিন ভোর ৭টা অথবা সাড়ে ৭টার দিকে এয়ারপোর্ট স্টেশনে নামার মাধ্যমে আমাদের ভ্রমণ সমাপ্ত হোল।
আমাদের এই সফল ভ্রমণের জন্য অনেককেই আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। তবে-
• প্রথমেই ধন্যবাদ জানাই আমার মাকে। তাঁর দেহের অংশ ছিলাম এককালে, তাঁর টাকায় সাগর দেখে এলাম, যদিও তাঁর নিজের এখনো সাগর দেখা হয়ে উঠেনি।
• দ্বিতীয়তো ধন্যবাদ জানাই আমার সেই বন্ধুদের, যারা আমার এবারের সফরসঙ্গী ছিল। স্বপ্ন কখনোই বাস্তবতাকে অতিক্রম করতে পারে না। কিন্তু আমাদের এবারের ভ্রমণ মনে হয় বাস্তবতাকে ছাড়িয়ে স্বপ্নকে ছুঁতে পেরেছে। তারপরও পৃথিবীতে কোন কিছুই শতভাগ নিখুঁত নয়। তাই কিছু ভুলত্রুটি থাকা স্বাভাবিক। যদি সত্যিই কোন ভুলত্রুটি থেকে থাকে তবে আন্তরিকভাবে দুঃখিত বলা ছাড়া, এই ত্রুটি মোচনের কোন পথ দেখছি না। আর আশা করছি, আমাদের পরবর্তী বান্দরবন ভ্রমণে এই ভুলগুলো হবে না।
• তৃতীয়তো ধন্যবাদ জানাই চট্টগ্রামের আমার সেই আত্মীয়কে। যাদের আন্তরিকতা ও আতিথ্য নিজের বাড়ি আর পরের বাড়ির ব্যাবধান দূর করেছিলো।
আর একজন কে ধন্যবাদ না দিলে বেঈমানি হবে তিনি হলেন সাগরভাই। কক্সবাজার যাওয়ার উদ্দেশ্যে ২৭ নাম্বার বাসে যেতে যেতে তাঁর সাথে আমাদের পরিচয়। তাঁর উপর ভরসা করেই ছিল আমাদের এই অজানার উদ্দেশ্যে যাত্রা।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




