somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তিনি ছিলেন গরিবের অর্থমন্ত্রী

২৭ শে জানুয়ারি, ২০১৬ ভোর ৬:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আজ বাংলাদেশের সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০৫ সালের এই দিনে এই গর্বিত বাঙালিকে বোমাবাজ, সহিংস, সন্ত্রাসীরা তার সংসদীয় এলাকা হবিগঞ্জের বৈদ্যের বাজারে জনসভায় বক্তৃতা দেয়ার সময় গ্রেনেড নিক্ষেপ করে হত্যা করে। তখন তিনি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন। পাঠক নিশ্চয়ই জানেন, ২০০১ সালের ১ অক্টোবর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অল্প সংখ্যক সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এর মধ্যে শাহ কিবরিয়া একজন ছিলেন। কিবরিয়া হত্যার ভেতর দিয়ে তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের আওয়ামী লীগ নিধনের হিংস্র মূর্তি প্রকাশ পেয়েছিল। তৎকালীন সরকার গ্রেনেড হামলায় আহত, রক্তাক্ত কিবরিয়ার সঙ্গে যে বৈরী আচরণ করেছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। এর ঠিক ৪ মাস আগে, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার জনসভায় সন্ত্রাসীরা গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছিল তাকে হত্যা করার জন্য। ওই জনসভায় ২৪ জন লোক নিহত হয়েছিলেন। সেই জনসভায়ও পুলিশের দায়িত্বহীনতা এবং বৈরী আচরণ জাতি লক্ষ্য করেছিল। শেখ হাসিনা দৈবক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন। নীলনকশা ব্যতীত পর পর এত বড় দুটি হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে না।
১৯৭১ সালে আলবদর বাহিনী নীলনকশা মোতাবেক বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে বিভিন্ন ডান-বাম চরম মতাদর্শের সশস্ত্র পন্থীরা অসংখ্য, অগণিত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীকে হত্যা করেছে। ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ যশোরে উদীচী অনুষ্ঠানে শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণ থেকে শুরু করে ২০০১ এবং ১ অক্টোবরের নির্বাচন-পূর্ব কালের ও পরবর্তী কালের যে বর্বর হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তার টার্গেট ছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব খতম করা। এটা স্পষ্ট যে, আওয়ামী লীগের মেরুদণ্ড গুঁড়িয়ে দেয়ার জন্য শাহ কিবরিয়ার মতো যোগ্য নেতা ও চিন্তাবিদ, অর্থনীতিবিদকে হত্যা করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। বাংলাদেশে যে নীতিভ্রষ্ট রাজনীতি, অপরাজনীতি, অসাংবিধানিক রাজনীতি, জঙ্গি ও হিংসাত্মক রাজনীতির জন্ম হয়েছে তার টার্গেট হয়েছে আওয়ামী লীগ। প্রতিহিংসার ছোবল আইভি রহমান, আহসান উল্লা মাস্টার, মঞ্জুরুল ইমাম, মমতাজ উদ্দীন ও শাহ কিবরিয়াকে হত্যা করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। স্বয়ং শেখ হাসিনাকে হত্যা করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে ২৪ বার। মুফতি হান্নানরা বঙ্গবন্ধুর মাজার উড়িয়ে দেবার পরিকল্পনা করেছিল, শেখ হাসিনাকে টুকরো টুকরো করে ফেলার লক্ষ্যে ৭০ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রেখেছিল, রাজশাহীর বাগমারায় বাংলা ভাইরা বেছে বেছে আওয়ামী লীগ দলের লোকদের হত্যা করেছে। সেই ধারায় শাহ কিবরিয়াকেও হত্যা করেছে বাংলাদেশকে একটি ‘পাক-বাংলা’ বা ‘মুসলিম বাংলা; না হয় তালেবান শাসিত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য। একটি পাকি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা জঙ্গিদের বরাবরের লক্ষ্য, তারা এই লক্ষ্য পূরণের কৌশল হিসেবে জিয়াউর রহমানের বিএনপিকে ব্যবহার করে যাচ্ছে। জিয়া মুক্তিযোদ্ধার দলে নাম লিখিয়েছিলেন বলে তাকে ব্যবহার করা সুবিধাজনক। লক্ষ্য করার বিষয়, কারা ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানবিরোধী, কারা ভাস্কর্য নিধন করছে, শহীদ মিনার অবমাননা করছে, সিনেমা হলে বোমাবর্ষণ করেছে, যাত্রার প্যান্ডেলে আগুন দিয়েছে, বুদ্ধিজীবী হত্যার হুমকি অব্যাহত রেখেছে। তারাই শাহ কিবরিয়ার মতো মৃদুভাষী বিদ্বানকে হত্যা করেছে। এদের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্ক অস্পষ্ট নয়। শাহ কিবরিয়া তো প্রচলিত গলাবাজ রাজনীতিক ছিলেন না। তিনি ছিলেন ভদ্র কালচারের প্রতীক, তিনি ছিলেন রেনেসাঁর মানস পুত্র। তিনি ছিলেন আদর্শনিষ্ঠ, বিনয়ী। উগ্রতা, অন্ধত্ব, উন্মত্ততা, বর্বরতাবিরোধী এক শিষ্ট শালীন মূল্যবোধের প্রতীক। বৈদ্যের বাজারে সর্বশেষ যে বক্তৃতা তিনি দিচ্ছিলেন, সেখানে সমকালীন রাজনীতির নৈরাজ্যিক চিত্রের যৌক্তিক বিশ্লেষণ দিচ্ছিলেন।
তিনি অর্থমন্ত্রী ছিলেন। হিসাবটা তারই ভালো জানা থাকার কথা। তিনি দেশপ্রেমিক দৃষ্টিতে পরিকল্পিতভাবে দ্রব্যমূল্যের দাম সহনশীলতায় নিয়ে এসেছিলেন। খাদ্যে দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার ক্ষেত্রে তার পদক্ষেপ ও পরিকল্পনা কাজে লেগেছিল। তিনি যখন বলেন, ‘তেল, মরিচ, লবণ, বিদ্যুৎ, কেরোসিন, ডিজেল কোন জিনিসের দাম বাড়েনি? অথচ মানুষের আয় বাড়েনি।’ তখন বোঝা যায় তিনি কোন চিন্তাধারা থেকে অর্থমন্ত্রিত্ব করে দেশকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। শুদ্ধ বাংলায় অশুদ্ধ গুরুচণ্ডালি উচ্চারণে বাগাড়ম্বর করা তার স্বভাব ছিল না। তিনি বলেছেন, ‘চালের দাম যখন আমাদের সময়ে বন্যার পর কিছু বাড়ার উপক্রম হয়েছিল, তখন আমরা সস্তা দামে চাল বিক্রি করেছি। আমরা গ্রামে বিনামূল্যে চাল বিতরণ করেছিলাম। ১৯৯৮ সালে বন্যার পর আমরা ৪২ লাখ পরিবারকে সাত মাস বিনামূল্যে খাদ্য দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিলাম।’
এসব কি মিথ্যা পরিসংখ্যান? কিবরিয়া সাহেব কি মিথ্যা বড়াই করার লোক ছিলেন? এরপর বলেছেন, ‘অন্ততপক্ষে আপনাদের সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে আমার লক্ষ্য ছিল প্রতিদিন সকালে উঠে আমি এবং আমার সহকর্মী মন্ত্রীরা দ্রব্যমূল্যের দিকে নজর দিতাম। চালের দাম এখন কেমন? তেল, সবজি, মাছ, মাংস, এসবের দাম কী রকম অবস্থায় আছে? কারণ রিজার্ভে কত টাকা আছে সাধারণ মানুষের এসব নিয়ে মাথা ঘামাবার দরকার হয় না। তারা রিজার্ভ নিয়ে কী করবে? রিজার্ভ যদি দুই মিলিয়ন থাকে বা তিন মিলিয়ন থাকে, এটা একটা কথার কথা। তার জন্য সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে সে যখন বাজারে গিয়ে চালটা কিনবে তখন টাকাটা দিতে হবে। সেটাই তার জন্য জরুরি।’ এই অভিভাষণের মধ্যে কিবরিয়া সাহেবের কোনো গুরুগম্ভীর পাণ্ডিত্য নেই। এটা এক ধরনের মেঠো বক্তৃতাই। আছে সরলতা, স্পষ্টতা। অর্থনীতির সূত্রগুলোকে তিনি লোকজ ভাষায় ব্যক্ত করেছেন। তার কর্মের জবাবদিহিতা করেছেন।
জবাবদিহিতার ভেতর দিয়ে জনগণের প্রতি তার দায়বদ্ধতা ফুটে উঠেছে। এরপর বলেছেন, ‘তারা দেশের অর্থনীতিকে ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না। এর ফলে যে দাম এখন আছে তার চেয়ে আরো বাড়বে। দেশের অবস্থা আরো খারাপ হবে। কেন এত খারাপ হচ্ছে -এ প্রশ্নটা আপনারা করতে পারেন। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জিনিসপত্রের দম এত কম ছিল, এখন কেন এত বেশি? এখন বেশি তার একটা কারণ হচ্ছে দুর্নীতি। দুর্নীতি যে কী পরিমাণে হচ্ছে, তার বর্ণনা করলে আমার সমস্ত রাত শেষ হয়ে যাবে। অথচ দেখেন, প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন সরকারের প্রধান। সরকার প্রধানের ছেলে তারেক রহমান হাওয়া ভবন করেছেন। একটা বাড়িতে তিনি বসেন। দেশের প্রত্যেকটি এলাকার সরকারের পক্ষ থেকে যেসব কন্ট্রাক্ট বা চুক্তি হয় তার জন্য টাকা দিতে হয়।
তার জীবনের শেষ ভাষণটিতে তিনি চারদলীয় জোট সরকারের আমলে দেশের বেহাল চিত্রটা কত গঠনমূলকভাবে তুলে ধরেছিলেন। রোঁমারোঁলা তার ‘মহাত্মা গান্ধী’ বইতে বলেছিলেন যে, গান্ধীজীর অহিংসা বা সত্যাগ্রহ কোনো কাপুরুষতা নয়, নিরস্ত্র পন্থায় অন্যায্য সরকারকে অস্বীকার করা।’ অনুরূপ কিবরিয়া সাহেবের মৃদুভাষণও আপসমূলক পাঁচালি নয়, দুঃশাসনের সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরতে সাহসের ঘাটতি দেখাননি। তার বলার ও লেখার ধরন মৃদৃ বা মোলায়েম হলেও তার দৃষ্টি ছিল লক্ষ্যভেদী। তিনি জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আপসহীন ছিলেন, তাই তাকে জঙ্গিরা হত্যা করেছে।
বাঙালির হৃদয়ে শাহ এ এম এস কিবরিয়া চির অমর হয়ে থাকবেন। জয়বাংলা।
সূত্র
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জানুয়ারি, ২০১৬ ভোর ৬:৩৮
৪টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অহনা বলেছিল, তুমি হারাবে না

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ১১ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৫

অহনা বলেছিল, তুমি হারাবে না
অহনা বলেছিল, আমি জানি আমি তোমাকে পেয়েছি সবখানি
আমি তাই নিশ্চিন্তে হারিয়ে যাই যখন যেখানে খুশি

অহনা বলেছিল, যতটা উদাসীন আমাকে দেখো, তার চেয়ে
বহুগুণ উদাসীন আমি
তোমাকে পাওয়ার জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিয়াল ফিলিস্তিনীরা লেজ গুটিয়ে রাফা থেকে পালাচ্ছে কেন?

লিখেছেন সোনাগাজী, ১১ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১০



যখন সারা বিশ্বের মানুষ ফিলিস্তিনীদের পক্ষে ফেটে পড়েছে, যখন জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে সাধারণ সদস্য করার জন্য ভোট নিয়েছে, যখন আমেরিকা বলছে যে, ইসরায়েল সাধারণ ফিলিস্তিনীদের হত্যা করার জন্য আমেরিকান-যুদ্ধাস্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাফসানের মা হিজাব করেন নি। এই বেপর্দা নারীকে গাড়ি গিফট করার চেয়ে হিজাব গিফট করা উত্তম।

লিখেছেন লেখার খাতা, ১১ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩


ছবি - সংগৃহীত।


ইফতেখার রাফসান। যিনি রাফসান দ্যা ছোট ভাই নামে পরিচিত। বয়স ২৬ বছর মাত্র। এই ২৬ বছর বয়সী যুবক মা-বাবাকে বিলাসবহুল গাড়ি কিনে দিয়েছে। আমরা যারা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ এঁটেল মাটি

লিখেছেন রানার ব্লগ, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৫৬




শাহাবাগের মোড়ে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম, মাত্র একটা টিউশানি শেষ করে যেন হাপ ছেড়ে বাঁচলাম । ছাত্র পড়ানো বিশাল এক খাটুনির কাজ । এখন বুঝতে পারি প্রফেসদের এতো তাড়াতাড়ি বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

পাইলট ফিস না কী পয়জনাস শ্রিম্প?

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১২ ই মে, ২০২৪ সকাল ৭:৪০

ছবি সূত্র: গুগল

বড় এবং শক্তিশালী প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পাশে ছোট ও দূর্বল প্রতিবেশী রাষ্ট্র কী আচরণ করবে ? এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধিক্ষেত্রে দুইটা তত্ত্ব আছে৷৷ ছোট প্রতিবেশি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×