কয়েক বছর ধরেই নিয়মিত যাওয়া হয়নি নানা বাড়ি। বগুড়া থেকে অনেক দূর, যেতে সময় লেগে যায় আট নয় ঘন্টা, এটা বড় কারণ নয়। মন টানেনা। অথচ একটা সময় খুব যেতাম। মন টানতো। বেশ কজন মামা আর খালা নিয়ে ছিলো আমার নানাবাড়ি। অনেকখানি এলাকাজুড়ে আম গাছ, পুরনো কিছু জাম গাছ, সীমানায় নারকেল গাছ। দুইটা মিষ্টি পানির পুকুর, হাফ মাইল দুরে জোয়ার ভাটার নদী। ছুটির দিন শুরু হলেই রকেট নামক আন্তনগর ট্রেনে ভ্রমন, জমজমাট ছিলো সেই দিনগুলি।
সেবার স্কুল ছুটির পরপর নানাবাড়ি গিয়েছি। নানির ঘরে আমার ঘুমানোর বন্দোবস্ত। প্রতিবছর এই ঘরটা যেভাবে দেখে রেখে যেতাম ঠিক সেভাবেই পেতাম। নানুর ঘর পরিস্কার পরিছন্ন থাকতো সবসময়, ঘরের আসবাবে পরিবর্তন আসতনা। সেইবার দেখি বেশ পরিবর্তন। ঘরের শো-কেস দক্ষিন দেয়াল থেকে উত্তরে গিয়েছে, বিছানার চারকোণে মশারি টাঙ্গানোর স্ট্যান্ড উধাও। নতুন ভাবে একটা লম্বা আয়না সহ ড্রেসিং টেবিল যুক্ত হয়েছে। নানুর দেখাশোনার জন্য নতুন একজন মানুষ।
কাজল খালা।
সারাদিন ট্রেন জার্নি করে আমি তখন ঘুমানোর কথা ভাবছি, অচেনা এক মানুষ ঘরে এসে বললেন আগে খাওয়া তারপর ঘুম। আমি একটু অবাক হয়ে মানুষটাকে দেখছি। কাজল খালা বললেন ' তুমি আমাকে চিনবে না ভাগ্নে, আমি তোমার আম্মুর দুরের ফুফাতো বোন '। অচেনা, দুরের মানুষটি থেকে খুব চেনা, ঘরে বানানো খাটি নারকেল তেলের একটা সুগন্ধ ভেসে আসছে, নানাবাড়ি থেকে প্রতি বছরে আসা তেল আম্মু বড় বোন ব্যবহার করতেন। পরিচিত সুবাস। কাজল খালাকে আপন ভাবতে এক মুহূর্ত দেরী করেনি মন।
খালার নাম দিয়ে দিলাম কাজলা দিদি।
যতীন্দ্র মোহন বাগচীর 'কাজলা দিদি' আমার খুব পছন্দের কবিতা। কাজল খালা আমাকে শোলক শোনাতেন। ঘুম পাড়ানোর জন্য গল্প শোনাতেন। ঘুমানোর সময় 'কাজলা দিদি' শোনাতেন। স্কুল পড়ুয়া আমার অদ্ভুত লাগতো। রাতে অনেক শান্তির ঘুম হতো। শীল পাটায় মশলা বাটা শেষে সেটায় ভাত দিয়ে মজার এক মশলা ভাত মাখা তৈরী করে আমাকে খেতে দিতেন। ডাবের পানিতে মুড়ি ভিজিয়ে আনতেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষার তিনমাস ছুটিতে দ্বিতীয় মার আদর যত্ন ভালবাসা পেয়েছিলাম। কাজল খালা কতো সুন্দর করে, উদাসী কন্ঠে একদিন 'কাজলা দিদি' শোনালেন। ' কাজলা দিদি ' কবিতার সেই কাজলা দিদির জন্য শুন্যতা পূর্ণ করে দিল কাজল খালা।
আমার সেই কাজলা দিদি আত্মহত্যা করলেন।
সেবার ছুটি শেষে বাড়ি এসে কলেজে ভর্তি হয়েছি। একদিন সংবাদটা পেলাম। সংবাদ পাওয়ার পর প্রচুর কেদেছিলাম। বাসা থেকে কেউ নানাবাড়ি গেলেন না, শেষ বারের মতো কাজলা দিদি কে দেখা হলো না। একটা শুন্যতা শুরু হয়েছিল, কিন্তু কাউকে জিজ্ঞাসা করিনি কোথায় গেলেন আমার কাজল খালা। সময়ের সাথে সাথে ঘটনাটা চাপা পরে গিয়েছিল। নানাবাড়ি, আমার বাড়ির কেউ খালাকে নিয়ে আলোচনা করত না। নানাবাড়ি গেলে ছাদের উপর থেকে কাজল খালার গোলপাতার বাড়িটা দেখতাম। নানাবাড়ির উপর থেকে মন উঠে যাওয়া শুরু হয়েছিল তখন থেকেই।
সেখানে কদিন আগে ঝামেলা শুরু হলো, সম্পত্তি ভাগাভাগি সম্পর্কিত। মৃদু তর্ক বিতর্ক চলল মামা মামী খালাদের মধ্যে। আমি আমার আম্মু সহ নানাবাড়ি গেলাম। একদিন তুমুল তর্কাতর্কি চলছে, তুই অতীতে কি করেছিলি, বাবা মায়ের আদর যত্ন ভালবাসা কে বেশি দেখিয়েছেন তা নিয়ে কথায় কথায় কাটাকাটি চলছে। বড়খালা ছোটমামার উদ্দেশ্যে বললেন
তুই কি দুধে ধোয়া তুলসী পাতা ?
কি করছি বড় আপা ?
কাজল যে গলায় দড়ি দিল, কি জন্য দিল কার জন্য দিল জানি না আমি, সবাই ভুলে গেছে মনে করিস !
ঝগড়া আচমকা থমকে গেল। ছোট মামার মুখ থমথমে। বড় খালাও চুপসে গেলেন যেন। একটা চিরগোপন সত্য খানিক সময়ের জন্য সকল ঝুট ঝামেলায় ইতি টেনেছিল কি?
সে রাতের ট্রেনেই বাড়ি ফিরছিলাম । অনেক অনেকবার আম্মুকে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে হয়েছিল
' মাগো আমার শোলক্-বলা কাজলা দিদি কই? '
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মার্চ, ২০২২ রাত ১২:৫৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





