(ছবিঃ অজ্ঞাতজনের)
রুদ্রর নানু যেদিন চলে গেলেন পৃথিবী থেকে, ঠিক সেদিন...সেই মুহূর্তে আমি তৈরি হচ্ছিলাম কোথাও যাওয়ার জন্য। চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে কয়েকবারই নানুর কথা মনে হয়েছিলো, এমনিই। ভাবছিলাম, 'রুদ্র বলেছিলো- এই মানুষটা ওর কতটা কাছের। ভাবতে ভাবতে এও চিন্তা করলাম, যদি মানুষটা না থাকে তাহলে রুদ্রর কী হবে? কেমনভাবে মেনে নেবে সে সেটাকে?' (দীর্ঘশ্বাস) ভালো লাগে না- কেন যে হঠাৎ করে এসব উদ্ভট কথারা আমার মাথার ভেতরে আসে! আর কেউ আশ্রয় দেয় না নাকি?
জুতোজোড়া পড়লাম। ঘর থেকে বেরিয়ে কেবল দরজাটা লাগাতেই যাবো, এমন সময়ে ফোনে মেসেজ এলো। রুদ্রর। তাতে লেখা-
'নানু নেই। আজ...'
আমি হতভম্বের মতো হয়েও হলাম না, শুধু দাঁড়িয়ে রইলাম দরজার লক ধরে। আমরা সবকিছুর সাথে স্বাভাবিক হতে শিখে যাই, কারণ আমাদের অস্বাভাবিক অবস্থাকে গ্রহণ করবার মতো জায়গা ব্যস্ত সময়ের কাছে থাকে না। দরজা লাগিয়ে আমি তাই সিঁড়ি বেয়ে নেমে পড়লাম। উদ্দেশ্যকে আমার প্রতীক্ষায় রাখবার মতো কোনো কারণ ছিলো না, তবুও আমার প্রতিটা পদক্ষেপ ভারী হয়ে গেলো এই ভাবনায় যে- আমার কি কিছুই আসলো গেলো না?! কথা হয় না, যোগাযোগ নেই- বুঝলাম সব; কিন্তু অনুভূতি? তাকে কে-ই বা কোথায় আটকে রেখেছে? বুঝে নিলাম- আমি হয়তো সেই অতীতকে এখনোও ক্ষমা করতে পারিনি- কী অকাট্য সত্য! আর কিছু ভাবতে পারলাম না, শুধু মনে হোল- আজ হঠাৎ নানুর কথা কেন যে মনে পড়েছিলো।
বাইরের কাজ শেষে বাড়ি ফিরলাম। রুদ্রকে একটা রিপলাইও দিলাম। দিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করলাম। 'জীবনটা অদ্ভুত; তুমি সবকিছুই শুরু করো, কিন্তু শেষ করতে পারো না।' আর শেষ যদি করতে না-ই পারো, তাহলে শেষের আগে কোন পর্যায়ে নিজেকে থামিয়ে রেখেছো? 'পর্যায়'...। হাহ, এতো ভাল্লাগে না। এইসমস্ত চিন্তার বাড় বেড়ে যাচ্ছে দিনদিন। মাঝেমাঝে মনে হয়, স্মৃতিশক্তি চলে গেলে বেশ হতো! কাউকে নিয়ে আর কিছু ভাবতে হতো না। কিন্তু সবাই জানে, নিউটনের সেই তত্ত্বের কথা- প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। যত্তোসব! (আমি এটাও ভাবি, যে স্মৃতিশক্তি চলে গেলে কী কী সমস্যায় আমাকে পড়তে হতে পারে!) নিজের মনকে শান্ত করলাম এবং বললাম- ঠিকাছে। হ্যাঁ, আমি ওকে ক্ষমা করিনি। হ্যাঁ, আমি আমাকেও ক্ষমা করিনি। কিন্তু তাতে কী?! আমি ওকে একটা কল দিতেই পারি! কথা বলতেই পারি! ও মেসেজই বা দিয়ে খবরটা আমাকে জানানোর প্রয়োজন কেন মনে করলো, সেটা এতো যাচাই-বাছাই করে আমার কী কাজ?!
সেদিন রাতও হয়ে গিয়েছিলো। আমি কল দেইনি। পরের পরদিন, ভোরবেলা; ঘুমটা কেবল ভেঙেছে। চোখ খুলেছি, আর ফোনটা বেজে উঠলো। রুদ্র কল দিচ্ছে। আমি ধরবো কি ধরবো না- ভেবে ধরলাম না। ২ সেকেন্ড পর আবার কল এলো। একটা দম নিয়ে আমি কলটা রিসিভ করলাম-
'হ্যালো?'
'তানি...'
'কেমন আছিস?'
'এইতো, যেমন থাকার। তুই?'
'ঘুম থেকে উঠলাম, এখনও জানিনা কেমন আছি।'
(ওপাশ থেকে একটা ম্লান হাসির শব্দ) 'আচ্ছা। ...'
'......চুপ থাকবি?'
'না, কেমন আছিস তুই?'
'মাত্র বলেছি, জানিনা। নানুকে কোথায় মাটি দিয়েছিস?'
'গ্রামে।'
'তোর মন খারাপ?' (জেনেবুঝেই একটা অকারণ প্রশ্ন করলাম)
(একটু হেসে) 'জানিনা...।'
'দেখা করবি?'
'কোথায়?' ('কার সাথে', এই প্রশ্নটা ও কখনই করবে না- আমি জানতাম)
'উমম...দেখি, (আমার আরও একঘণ্টা ঘুম দরকার- মনে মনে ভাবলাম) তোকে ৯ টায় কল দিয়ে জানাই?'
'আচ্ছা।'
'ঠিকাছে। রাখছি।'
'ওকে।'
এতোদিন পরে, আমি আবার...নাহ! এতোকিছু মাথায় আসলে চলবে না। জীবন চলবে না। যেটাই হোক, যেভাবেই হোক...অজুহাতেরা অসম্পূর্ণ অবস্থাকে পূর্ণ করবার জন্য পিঠে পিঠ লাগিয়ে আসতে থাকে। সেগুলোকে শুধু ধীরমনা হয়ে সামনা করতে হয়, নয়তো...
আমি ৯ টায়ই উঠলাম! উঠেই কল দিলাম রুদ্রকে-
'আমি ঠিক জানিনা কোথায় দেখা করবো। তুই বল।'
'মাঠে আসবি?'
'এতোদূর এখন আসতে ভালো লাগছে না। নদীর ওদিকে যাওয়া যায়, দুজনেরই কাছাকাছি হবে।'
'আচ্ছা। কখন বের হবি?'
(আমি মনে মনে হাসলাম, কারণ সময়ের ব্যাপারে আমি বরাবরই উদাসীন ছিলাম। 'ছিলাম', এখন আর নই) '১১ টায় থাকবো।'
'শার্প?'
'হম!'
'ওকে, টাটা।'
'হম, ...।'
নদীর পাড়ে ভীষণ বাতাস। এ বাতাস হেমন্তের বাতাস। চারিদিকের সবকিছু বৈরাগী হয়ে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমি মিনিট ১০ আগেই এসে নদীর ধারে বসেছিলাম। অনেকদিন হয়েও গেছে, আমি এখানে আসিনা। না, অতীতের কথা আমাকে তাড়িয়ে বেড়াবে- এই শঙ্কায় নয়। আসলে আমি নিজেই সময় করিনি আর। আমার অনেক প্রিয় একটা জায়গা এটা, মন খারাপ হলেই চলে আসতাম। রুদ্রকে এই জায়গাটায় আমিই প্রথম এনেছিলাম। তবুও... আমার আসা হয়নি, সেই দিনটার পর থেকে। 'সেদিন।' সেদিন আমাদের বন্ধুত্ব ভাঙেনি, ভেঙেছিল বিশ্বাস। আস্থা। আর পরস্পরের প্রতি থাকা শ্রদ্ধাবোধ। কিন্তু শ্রদ্ধার প্রশ্নে আমি কখনোই এটা মানতে পারিনি যে- ওর প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধটা হারিয়ে গিয়েছিলো। বড়জোর, একটু কমে গিয়েছিলো এবং সেটাও ওর ব্যবহারের কারণেই। আমি হাতঘড়ির দিকে তাকালাম। ১১ টা বেজে ৫ মিনিট। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে চাইতেই ভুলে গেলাম, যা মাথায় অল্পের জন্য হলেও এসেছিলো- অতীত!
আমার ফোন বেজে উঠলো। রুদ্র। ধরলাম। ধরতেই-
'ওটা তুই?!' (কণ্ঠে কিছুটা সন্দেহ এবং একইসাথে অবাক হওয়ার সুর)
(আমি পেছনে না তাকিয়েই বললাম) 'আর কে হতে পারে?'
'তোর চুল অনেক লম্বা হয়ে গেছে।'
'তুই সামনে আসবি? নয়তো আমি চললাম!'
'আরে দাঁড়া...'
হাঁপাতে হাপাতে...রুদ্র এসে আমার পাশে বসলো (নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে)
'কোত্থেকে দৌড়ে এলি?'
'যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম।'
'কোথায় দাঁড়িয়ে ছিলি?'
'যেখান থেকে কল দিলাম।'
'কোত্থে... (থেমে গেলাম, কারণ রুদ্র ইতিমধ্যেই হাসতে শুরু করেছিলো। এককালে আমরা এভাবেই উত্তরকে পেছনে রেখে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে কথা বলতাম। অতীত একলা নিজের কাছে এলে সামাল দেওয়া যায়, কিন্তু একইসময়ে নির্দিষ্ট দুজনের কাছে এলে তখন কেমন যেন অস্বস্তি লাগে। মেনে নেওয়া যায় না)...ভালো।'
'কী ভালো?'
'জানিস না মনে হয়?!'
'কী জানি?'
'যেটা করছিস।'
'কী করছি?'
'যেটা আমি দেখছি।'
'তুই কী দেখছিস?'
'যেটা তুই দেখাচ্ছিস।'
'আমি কী দেখাচ্ছি?'
'ওইতো বললাম...জানিস।'
''না, আমি কিছু জানিনা। তুই আমাকে বল।'
'রুদ্র, মশকরা করিস না। অনেক দিন!... এটা অনেক দিন!'
... (কিছুক্ষণ কারো মুখেই কথা নেই)
রুদ্রই মুখ খুললো- 'এভাবে আর কতোদিন চলবে, বলতে পারিস?'
'উহু।' (বাতাসে দু'একটা চুল উড়ে আমার মুখের ওপর চলে এলো)
'তোর চুল।'
'কী?'
'মুখের ওপর।'
(আমি মাথা নামিয়ে, সেগুলোকে হাত দিয়ে সরিয়ে দিলাম। কেন যেন একরকম অস্বস্তিও লাগলো)
'আমি সরি।'
'কেন?'
'এই যে, তোর সামনে এভাবে আসতে হোল। আমাদের তো আর দেখা হবার কথা ছিল না, তাই না?'
(আমি ওর কথাগুলোকে উড়িয়ে দিলাম) 'হাহ, কে বসে থাকে কথা ধরে?'
'তুই।'
'আমি! কক্ষনোই না!' (প্রচণ্ড বিরক্ত হলাম)
'জানি।'
'তবে?! বললি কেন?'
'এমনিই। ...তোকে অনেকদিন রাগ করতে দেখি না।'
'আমি এখন আর রাগ করি না। বিরক্ত হই।'
'নাহ, বিরক্তি তোকে একদম মানায় না!'
'তোর সাথে ঠাট্টা করতে আমি এখানে আসিনি!'
'তো কীজন্য এলি?!'
(কী বেয়াদব ছেলে! যেটার উত্তর সে নিজেও জানে না, সেই প্রশ্ন আমাকে করে! দাঁড়া দেখাচ্ছি) 'প্রেম করতে। করবি?!'
'হ্যাঁ তো।'
'উফফ!'
(রুদ্র হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লো) 'তুই একদম বদলাসনি, এখনও বাচ্চাদের মতো রাগ করিস!'
'না, আমি করি না। ভেবে বসো না যে খুব চান্স পেয়ে গেছো। আমি কিছু বলছি না, তার মানে এই না যে আগের মতোই সবকিছু চুপচাপ শুনে যাবো।' (একদমে বললাম)
(রুদ্র থেমে গেলো)
(তারপর) '...কিছুই আর আগের মতো নেই রে। তুইও না। আমিও না। দেখনা, কেবল এজন্যই তোর সামনে আসতে পারলাম। সময় সবকিছু কেমন যেন করে দিয়ে যায়..., 'ঠিক।''
'...(আমার কিছু বলতে ইচ্ছে করছিলো না, তবুও বললাম) 'ঠিক' করে দিয়ে যায় সময় সবকিছু। হয়তো। কিন্তু ক্ষত সারবার আগে, আমরা কেউই তো সেই একই জায়গায় স্পর্শ করবার সাহস পাই না। তাই নয় কি?'
'হ্যাঁ, তাই। (পানির দিকে তাকিয়ে ছিলো ও। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো) ক্ষত যদি 'কষ্ট' হয়, জায়গা যদি 'মন' হয়, আর 'সময়' যদি সাহসটা জুগিয়ে দিয়ে যায়, তাহলে 'স্পর্শটা' কী?'
''কথা বলা?'' (আমি বললাম)
'হম। কিন্তু কখন বলবো- সেটা কি করে বুঝবো?'
'এইযে, অজুহাত!'
'উহু, আরও নির্দিষ্ট করে বল।'
'মনে পড়া।'
'কী মনে পড়বে?'
'(আর একবার না ভেবেই আমি বললাম) নানু যেদিন চলে গেলেন...সেইদিন আমার তোর কথা মনে পড়েছিলো। তুই কিছু জানানোর আগে, এমনি এমনিই।'
'...তারপর?'
'তারপর যা হচ্ছে...এটাই 'কথা বলা।''
(ও চুপ)
'আমি তোকে খুব মিস করি রুদ্র, আমার বন্ধু রুদ্রটাকে। এমন কেন করলি তুই?! আর কেনইবা এতোসব আগাম চিন্তা করে থাকিস?!'
(তখনও চুপ)
'...তুই জানিস, মাঝে মাঝে এমনকিছু হয়, তখন আমার তোকে খুব মনে পড়ে। আর কিচ্ছু না! মনে হয়, তুই থাকলে তোর বুকে পড়ে অনেকক্ষণ কাঁদতাম। দুঃখ থেকে বারবার এতো কষ্ট আর নিতে হতো না। আর কিছুই না, মাঝে মাঝে শূন্যতারা এমনভাবে ঘিরে ধরে- তখন মনে হয় একটা আলিঙ্গনই যথেষ্ট। একজন বন্ধুর, একটা বিশ্বস্ত মনের- যে দশপাঁচ না ভেবে কেবল ওই মুহূর্তটাতে বুকে চেপে ধরে রাখবে তার প্রিয় মানুষটাকে। আর ততক্ষণ ছাড়বে না, যতক্ষণ না দুজনের কেউই চাইবে। কোথায় ছিলি...?!' (আমি খেয়ালও করিনি, কখন কাঁদতে শুরু করেছিলাম)
'তানি... (পেছন থেকে আমার ঘাড়-হাত সবকিছু চেপে ধরে আমার পিঠে মাথা রেখে রুদ্র বলতে লাগলো) আমি তোকে ছেড়ে কোথাও যাবো না রে! আর কখনো না! আর কখনো হুটহাট কথা বলা বন্ধ করবো না!'
'ছাড় আমাকে।'
'না!'
'ছাড় আমাকে!'
'না তো!'
*রুদ্র-তানি, তারা কেউ হয়তো কখনো কারো ভালো বন্ধু হয়ে দেখেনি। তার আগেই, প্রেমে পড়ে গিয়েছিলো। একটা সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সেটা সবসময় আবেগের হাতে ছেড়ে দিতে হয় না। যাক না, যেতে দাও তাকে। বুঝতে দাও আগে। তারপর না হয়, সময় নিয়ে কথা বলো। সেটাই বলো, যেটা তোমার মন বলে। এমন না যে, ভালোবাসা সম্পর্ককে বন্ধুত্বের পর্যায় থেকে আরও গভীর পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে না। অবশ্যই পারে, যদি মনের দিক থেকে সেই ভাবনার আলোড়নগুলো সৎ হয়ে থাকে। ভয়ের কী? যার জন্য অনুভূতি, তাকেই বলতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বরং, প্রত্যেকটি মানুষেরই আছে স্বাধীনতা, নিজ নিজ অনুভূতিকে প্রকাশ করার। 'কিন্তু এমনটা হোল কেন' কিংবা 'হতে পারে না' -এভাবে ভেবে নিজের মনকে আর নিজেকে দোষ দেওয়াটা, আপন অনুভূতির প্রতিই জুলুম করা নয় কি? তারপর, সম্পর্কটা তো গড়েই না। যা ছিলো, তা-ও নষ্ট হয়ে যায়।
বন্ধুরা ভালো থাকুক। বন্ধুত্ব ভালো থাকুক। আর তারপর সব সম্পর্কই ভালো থাকুক, যেখানে 'ভালোবাসা' ভালো থাকতে চায়।
- পেন আর্নার
২২ শে আগস্ট, ২০১৪