(ছয়)
গ্রামের নাম সোনাডাঙ্গা
ত্রিশ বছর এক পাড়ায়। পাড়ার সবাই আত্মার আত্মীয়। উজ্জলের কিছু ছিল না। এখন সব আছে। ফুলের মত সাজানো এ গ্রাম। এখানে মন্দির, মসজিদ ও গীর্জা রয়েছে। সবাই মিলেমিশে শান্তিতে বসবাস করে। অপরূপা রূপসা নদী বয়ে চলছে আপন মনে। ঐতিহাসিক যশোর রোড ও রেল লাইন চলছে তার সমানতালে। সব সম্প্রদায়ের মিলন মেলার অপর নাম সোনাডাঙ্গা।
সরকারী বিদ্যালয়টি সুন্দরবনের গোলপাতার চাল আর বাঁেশর বেড়ার পরির্বতে লোহার রড আর কংক্রিটের ঢালাইয়ের উপর দাড়িয়ে আছে ঠায় মুর্ত্তির মতো। শুধু চেহারাটা বদলায় নাই বদলে গেছেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা। সুমি শিক্ষিকার কালো লম্বা চুলে বেণী বাধে রোদেলা দুপুরে বসে। আলু-পিয়াজ-মরিচের দাম জানা ছিল স্কুলের ছাত্র ছোট্ট খোকনের। স্যারদের সেবা যতœ করে প্রকৃত শিক্ষা পাচ্ছিল পাঠশালার গরীব ছাত্র-ছাত্রীরা।
কবি কাজী কাদের নওয়াজের ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ প্রতিষ্ঠা পায় এ সরকারী পাঠশালায়। দিল্লীর বাদশাহ আলমগীর বেচে থাকলে হয়তো পুরস্কারও দিতেন তাদের। র্দুভাগা হয় শিক্ষকরা নয় বাদশাহ।
কালিপদ স্যার বাংলা ক্লাসে, ‘অ-তে-অজগরটি ওই আসছে তেঁড়ে,
আ-তে-আমটি আমি খাবো পেড়ে,
ই-তে-ইঁদুরছানা ভয়ে মরে..........।’
সালমা আপার সুরেলা কন্ঠে জাতীয় সঙ্গীত। আজ যন্ত্রণায় ছট ফট করে মাথা কুটে কুটে মরছে স্কুলের চার দেঁয়ালে।
এখানে দুরন্ত ছাত্রদের চঞ্চলতা নদীর বুকে জেগে ওঠা চোরাডোবা চরে ধাক্কা খেয়ে ¯্রােত হারিয়ে নীরবতা দখল করে নিয়েছে অতি নীরবে। গরীব অভিভাবকদের খোঁজ নেওয়ার সময় নাই এখানে কি শিক্ষা দেয় আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় শূন্যের কোঠায়।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্তাব্যাক্তিরা স্কুল পরির্দশনে এসে মাংস-পোলাউর সাথে কোমল পানীয় স্প্রাইট খাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন অতি খায়েসী স্বভাবে। পেটটা মোটা করে কোনো মতে কষ্টে হেঁটে যান স্কুল গেটে। পিছু ছোটেন স্কুল প্রধান। যদি তিনি কিছু আজ্ঞা করেন।
কাগজে-কলমে সব ঠিকঠাক।
পরির্দশক প্রধান শিক্ষককে উদ্দেশ্যে বলেন,‘জাতীয় পতাকা আমাদের গর্ব,বুঝলেন স্যার।’
স্কুল প্রধান হাতখানা কচলাতে কচলাতে,‘জি স্যার,আমি নিজ হাতে প্রতিদিন অতি যতœ সহকারে জাতীয় পতাকা উড়াই।’
অতি কষ্টে ঘাড়টা উপরে উঠায়। দ-ায়মান বাঁেশ লাল-সবুজে পতাকা সত্যি উড়ছে কিনা সেটা দেখে এ স্কুলের দায়িত্ব বুঝে নিয়ে পরির্দশক চলে যান নিজ গন্তব্যে।
গরীব ছাত্রদের নামে আসা সরকারী সাহায্য রাজনৈতিক চেলা-চামুন্ডারা ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়ে যাচ্ছে যে যার মতো। গরীব কারা হতভাগা বস্তির ছাত্ররা না স্কুলের কমিটির সভাসদরা। যারা গায়ে আতর মেখে ঘুরে বেড়ায়। মুখে সুগন্ধি যুক্ত পান চিবোচ্ছে সারা দিন রাত।
গরীব ছাত্ররা জ্ঞানের সন্ধানে এসে অজ্ঞানতায় ভুগছে আজ এখানে। ইটে ইটে সাজানো শুধু বিদ্যালয়টিই তার পরিচয় বহন করছে ঠিকঠাক। আর সব মিছা, শুধু লোক দেখানো। শিক্ষার দৈন্যতা ফুটে ওঠে নোংরা ছেড়া স্কুল ইউনির্ফম পরিধেয় কদমাক্ত প্রতিটি চেহারায়।
স্কুল গেটে বড় বড় অক্ষরে লেখা,‘এসো জ্ঞানের সন্ধানে ফিরো যাও দেশের সেবায়।’ এই যদি হয় জ্ঞানের হাল তবে দেশের সেবা কি করবে ওরা। এ দুঃখ,দুর্দশা দেখার কেউ নাই। কাগজ-কলম সর্বস্য। কোমলমতি শিশুরা পথ চলতে হোঁচট খায় এখানে। যারা শিক্ষার প্রদীপ জ্বালাবে,তারাই তলিয়ে গেছে ঘোর অম্যাবশ্যায়। পর সবাই পর। রাস্তার ওপারের দৃশ্য একটু ভিন্ন। লাল নীল ফুলে সুশোভিত ছিলো টবগুলো। আল্পনা আকা প্রবেশ দ্বার। শ্রেণী কক্ষে মন ভোলানো টম ও জেরী,মিনা ও মিঠুর বড় বড় ছবি। ধনীর সন্তানরা সুগন্ধি গায়ে চরিয়ে গাড়ীতে চরে আসে স্কুলে। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল এটি। পায়ে কালো সু,নতুন চকচকে র্শাট-প্যান্ট আর টাই ঝুলানো গলায়। ছোট্ট মনের ছোট্ট ছেলে খোকন ন্যাংটা পায়ে স্কুল গেটে দাড়িয়ে তাকিয়ে থাকতো ইংলিশ বয়েজদের দিকে। একদৃষ্টিতে চেয়ে রয়। স্বপ্নে দোলা দেয় ওদের মতো খোকনও নতুন সু,শার্ট,প্যান্ট,টাই ঝুলিয়ে স্কুলে যাচ্ছিল। আইসক্রিম বিক্রেতার ঢং ঢং ঘন্টার শব্দে বাস্তবতায় ফিরে আসে বস্তির ন্যাংটা পা দু’টায়।
এলাকার বস্তিগুলো নেতাদের নির্বাচনের ভোট ব্যাংক হিসাবে খ্যাতছিল।সারাদিন রিক্সা,ভ্যান,ঠেলাগাড়ী ঠেলে রাতে জমে জুয়া-মদের আড্ডায়। এটা এখানকার নিত্যদিনের সংস্কৃতি। রিক্সাচালক রহমান জুয়া খেলে সব টাকা হেরে রাত দু’টার সময় মদের নেশা চোখে-মুখে নিয়ে ফিরে আসতো। সবুজ পলিথিনে ঘেরা বস্তির ভাঙ্গা ছয়ফুট পাঁচফুট ঘরের ভিতর মাটিতে বিছানো ঘর জুড়ে বিছানার একপাশে ছেলে-মেয়ে ঘুমানো অন্যপাশে বৌ। জুয়ায় টাকা হারা আর নেশায় মাতাল কন্ঠে খিট খিট মেজাজে,‘এ মাগী ঘুমাইছিস।’ বলে কাপড় তুলে মাজার জোর পরীক্ষা করল। তারপর সকাল।
পুব আকাশে সোনাডাঙ্গা সড়কের মাথায় শিল্প ব্যাংকের আড়ালে ঘুমিয়ে থাকা সূর্য্য মামা কাচা ঘুম থেকে উঠে চোখ ডলতে ডলতে লাল করে ফেলেছিল সাত সকালে।
প্রতি রবিবার সকালে ঢং ঢং ঘন্টার শব্দ প্রভূ যিশুর গীর্জায়। খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বীরা সারি বেধে প্রভূযীশুর র্গীজায় আসছিল।পাশেই মাদার তেরেজার নির্মলা শিশু ভবন অনাথ শিশুদের আশ্রয়কেন্দ্র।সাদা কাগুজে ফুলের গুল্মো লতা লোহার সিড়ি বেয়ে ঝুলে পড়ছিল গেটের সামনে। সিস্টাররা মায়ের মতো আদর যতেœ বড় করে তুলছিল অনাথ শিশুদের। গলায় ক্রুশ ঝুলানো নীল পেড়ে সাদা জমিনের শাড়ী পরিহিত সিস্টাররা মায়ের মতো যতœ সহকারে শিশুদের নতুন জামা-কাপড় পরিয়ে কচি হাতখানা ধরে নিয়ে আসতো উপসনালয়ে । সকালের শুভ্রতায় এ দৃশ্য যেন পটে আঁকা ছবি।কার সন্তান,কোথায় জন্ম, কে তার বাবা-মা।কোথায় বড় হচ্ছে কি আদব-কায়দায়।সারা দেশে হাজার হাজার শিশু সন্তান বড় হচ্ছে এভাবে। মহামতি মাদার তেরেজা না থাকলে কি হতো এসব শিশুদের জীবনে? কোথায় থাকতো এঁরা? যুদ্ধাহত দেশে হাজার হাজার নিষ্পাপ শিশু রাস্তায় দিন কাটাতো।এক যুদ্ধ কেড়ে নিয়েছে লাখ লাখ পরিবারের স্বপ্ন। তাদের সুস্থ জীবন-যাপন নিশ্চিত করেছিল মহামতি মা।
কোলকাতার স্যাঁতস্যেতে ঘিঞ্জি এলাকায় হয়তো কোনো হাড্ডিসার কোটরে পোরা অনাথ শিশুর চোখ দু’খানা তেরেজার মাতৃত্বকে জাগিয়ে দিয়েছিল। আজ সেই মা বিশ্ব জুড়ে সবার হৃদয়ে মাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ।
এক পটে কত বিচিত্র ছবি!
এক গ্রামে কত ছবি।কেউ ভালোবাসে।কেউ আঘাত করে।কেউ জোগাড় করে।কেউ উজাড় করে। কেউ দিতে চায়। অন্যজন সুযোগ খোজে লুটে-পুটে নেওয়ার। কেউ ভালো করে। কেউ মন্দ করে। একজন দেখিয়ে দেয়। অন্যরা চোখ বুজে থাকে না দেখার ভ্যান করে। একজন বলতে চায় আরেকজন কান বন্ধ করে রাখে, কারো কালোহাত সে মুখ বন্ধ করে দিচ্ছে চিরদিনের মতো।