৭. বিষাক্ত ছোবলে লাশের নগরী (শেষ অংশ)
শিউলি অনেক রাতে বাড়ী ফিরলো।
রাজ্জাক,‘এতো রাত প্রর্যন্ত কোথায় ছিলা?’
ক্লান্ত শিউলি, ভাঙ্গা কন্ঠে, নিচু স্বরে,‘কাজ পাইছি একটা, আসতে দেরী হলো। প্রথম দিন তো অনেক কাজ ছিল।’
রাজ্জাকের নাক খাড়া হয়ে ওঠলো শিউলির শাড়িতে সুবাস পায়,জিগায়,‘কি কাজ গো?’
‘অফিসের কাজ’,জবাব দিল শিউলি।অভাবের সংসার আর প্রশ্ন আসলো না রাজ্জাকের মনে।
রাজ্জাক মনে মনে ভাবল,‘কষ্ট করছে,এতো রাতে আসে।’ ক্লান্তদেহে শিউলি ঘুমিয়ে পড়লো।
মা না থাকলে দুনিয়া আধার। যার মা নাই, সেই কেবল বোঝে এই না থাকার বেদনা । মা-হারা শিশু পৃথিবীর সবচেয়ে অভাগা।
পাশা,দিশেহারা।
পল্লল ঘরছাড়া। যেখানে রাত সেখানে কাত।
নেশায় জড়িয়ে ধরেছিল। হাড়ে হাড়ে। শিরায় শিরায়। ঠাওর পায় নাই। নেতারা কি বলতো আর কি করতো।
নীতি নৈতিকতার ধার ধারে কে। বড় খাবারটা মুখ্য।কে কার আগে গ্রাস করবে।কে এল কে গেল খবর রাখে কে। রাজা থাকেন মহাসুখে অট্টালিকা করে।উজির করেছে রাজ্য শাসন প্রজা মেরে মেরে।ভবিষ্যৎ সে তো ধুলায় গড়াগড়ি খায়।গানজা,হেরোইন,ফেনসিডিল ও ইয়াবাতে বুদ আগামীর নেতা।
পল্লল নেতার নামে দোকান থেকে চান্দা তুলতো,মিছিল করতো। যে টাকা পায় রাতে যশোর থেকে গান্জা,ফেনসিডিল, হেরোইনের পুড়িয়া,ইয়াবা এনে খেতো। সারা রাত কাটায়। সাথে আরো চেলারা। এক ঝাঁক।চেলাদের দিয়ে এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করা। শেষ।
নীতি নাই, নীতি থাকলে বড় নেতা হওয়া যায় না।
ওরা খায় পাহাড়-পর্বত,নদী-নালা,বন-জঙ্গল।
চোখ ওদের অনেক বড়, মনটাও!
চেলারা খায় চান্দা।
কুড়িতে পল্লল।চেহারায় ভয়ংকর চিত্র।
এদেশ তার ললাটে লেপা!
এরা মানচিত্র খাবে না তো কি করবে।
শিউলির হাতে নতুন মোবাইল ফোন। ঘন্টায় ঘন্টায় বেজে উঠছিল।এ ঘর ছেড়ে অন্য পাড়ায় ঘর ভাড়া করল শিউলি। সেখানে কুসুমকলি মাঝে মাঝে বেড়াতে আসতো। কুসুমকলি শিউলির মেয়ে রুকসানাকে বিদেশে কাজ করতে বলতো। অনেক টাকা।
বলল,‘মা আর কত দিন কাজ করবে। ঘরে বসে কি হবে।’
রুকসানা মনে মনে ভাবতো মা এতো সাজে কেনো, এতো রাতে বাড়ী আসে কেনো,দু-তিন দিন ঘরের বাহিরে থাকে কেনো,এতো টাকা কে দিতো। শিউলি সপ্তাহ খানেকের জন্য শহরের বাহিরে ভাড়ায় চলে গিয়েছিল।
তখন রুকসানাকে মতি মিয়ার কাছে নিয়ে আসলো কুসুমকলি।
রুকসানা ষোড়শী কন্যা।ঠোঁট যেন গোলাপের লাল দুটি পাপড়ী,চোঁখ মৃগ নয়নী,হস্তযুগল লাউয়ের ডগার মতো বাড়ন্ত।সারাদেহে মৃগের ন্যায় মায়ার খেলা। মায়াবী জ্যোতি ছড়াচ্ছিল আধারে হীরক খন্ডের মতো। মতি মিয়ার চোখ আটকে যেতে লাগলো এ দেহে। মতি মিয়ার বড্ড ভালো লেগেছিল তাকে। রুকসানার লাবণ্যে মুগ্ধ হয়ে কামক্রিয়ায় মত্ত হয়েছিল রাস্তার কুকুরের মতো। বুকের উপড় উঠে দাপিয়েছিল লম্বা মাংসলপিন্ড তাতিয়ে নিয়ে।মতি মিয়া নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করল আজ অনেক দিন পর এক কুমারী,লজ্জাশীলা,সতীসাধ্বী মেয়ের সাথে তার মিলন হয়েছে।সেই প্রথম।মতি মিয়া তৃপ্তি ভরে যৌন বাসনা পূর্ণ করল।
এক সপ্তাহ পর।তার নতুন নাম রাখলো ‘কামিনী’। ‘তুমি এ শহরের কামিনী।’ সে কামিনীকে কাছে বসিয়ে খুব আদর-যতœ করছিল। রাতে ষোড়শী কামিনীর নিলাম হাকলো শহরের বড় বড় দেহ ব্যবসায়ীরা। গভীর রাতে নিউ হোটেলের চার দেয়ালের মাঝে এক সপ্তাহের জন্য বিক্রি হয়েছিল এ শহরের আগামী প্রজন্ম। তার প্রতিটি অঙ্গ চেটে চেটে খাচ্ছিল কামুকরা। কামনার ঝড়ে কেপে উঠছিল হোটেলের কামরার গ্লাস,চেয়ার,টেবিল,খাট-পালঙ্ক। নেশায় মাতাল কামুকরা যেন মুরগীর রান দু’হাতে টেনে ছিড়ে ছিড়ে খাচ্ছিল।কামিনীর ছোট কচি স্তন ব্যথ্যায় লাল হয়ে উঠল।যৌনাঙ্গে ব্যথ্যায় কাতরাছিল সে। মতি মিয়া কামিনীকে অতি যতœসহকারে রাখে। সোনার ডিমপারা হাঁসের মতো। কাচের গ্লাসে ভোদকার ভেতর ঘুমের ট্যাবলেট গুলে আদর করে খাইয়ে দিল তাকে।গভীর ঘুমে কামিনীর দু’চোখ ভেঙ্গে পড়লো।এক মাস পর কামিনী দুবাইয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। কামিনীর শীতল সুবাস ছড়িয়ে পড়ছিল সবুজে ঘেরা শিল্প নগরী থেকে পাহার আর মরূভুমির তপ্তবুকে। বালুর তপ্ত বাতাসে শীতল ছোঁয়া। ঢাকা, মোম্বে, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, দুবাই কামিনীর মধুচন্দ্রিমায় মধুময়।
এক বছর পর।রাজ্জাকের ছেলে রিপন আর পল্লল নেশায় ডুবে থাকতো সারাদিন। সোলায়মান রিপনের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছিল।রিপন কন্ট্রাক্ট কিলার।অর্থের বিনিময়ে কিলিং মিশন পরিচালনা করতো।সোলায়মান তার রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য রিপন ও পল্ললকে ব্যবহার করতো।
রাজনৈতিক দলের নেতারা নগরীর ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে ব্যস্ত।একদল অন্যদলের নেতা-কর্মীদের খুন করছিল।গুম করছিল।সোলায়মান ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছিল।লড়াই চলছিল রাতের আধারে।
রাতের আঁধারে চিংড়ি মাছের ঘের দখল করছিল তার বাহিনী।
হুক একজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও মাটি নামক স্থানীয় পত্রিকার প্রকাশক ছিল।
মাসা তথ্য সংগ্রহ করছিল সোলায়মান গ্রুপের। সোলায়মান শহরের দখল নিতে চায় যে কোনো মূল্যে।মাসা,সোলায়মানের নিউ হোটেলের গোপন ব্যবসার তথ্য পেয়েছিল। সে নারী পাচার করতো বিভিন্ন দেশে।অবৈধ ব্যবসা ছিলো।শহরে মাদক ব্যবসার বড় ডিলার সে। গাজা,ফেন্সিডিল,হেরোইন ও ইয়াবার বড় বড় চালান রাতের আধারে আসছিলো এ শহরে।
অস্ত্রের ঝলকানিতে,বারুদের গন্ধে সেসময় ছেয়ে গেছিলো এ নগরী।
ধ্বংস করে দেবে এ শহর।
মাদকের নেশায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল যুব সমাজ।
দু’দলের কোন্দলের শিকার সাধারণ জনগন।প্রতিদিন খুন হচ্ছিল।রাত নামার সাথে সাথে শহরের সর্বত্র নীরবতা।
দিনটি ছিল শুক্রবার মাটি পত্রিকার পাতায় সোলেমানের অবৈধ ব্যবসার গোপন তথ্য প্রকাশিত হলো।
শনিবার রাতে রিপনকে মোবাইলে সুপারী দিয়েছিল সোলায়মান। হুক ও মাসাকে মেরে ফেলার সুপারী।
রাতে প্লান করেছিল রিপন তার বাহিনী নিয়ে।আগে মাসাকে হত্যা করবে পরে হুককে।
রবিবার সকালে বেড়িয়েছিল মিশন সাকসেস করতে।সকাল সাতটা থেকে মাসার বাড়ির সামনে ওরা ওঁত পেতেছিল চায়ের দোকানে।কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসলো।আজ মাসা ভোরে বাহিরে বেরিয়েছিল।
হুক ও মাসা বেঁচে থাকলে তার গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে যাবে। সোলায়মানের মাথা নষ্ট।ওরা তখনো বেঁচে ছিলো।
সোলায়মানের স্বপ্ন সে এ শহরের হর্তাকর্তা হবে।তার হুকুম চলবে।সে স্বপ্নে লালায়িত।
সোলায়মানের জন্ম পার্শ্ববর্তী শহরের নাচনপুর নামক গ্রামে।বাবা ক্ষেত-খামারী করতো।সোলায়মান তার গ্রামে জমির জের ধরে একজনকে হত্যা করে সুইডেন ছিল অনেক বছর।মামলার মিমাংসা করেছিল। টাকার বিনিময়ে।
সোলায়মান নিজে আসে নাই এ শহরে তাকে পাঠিয়েছিল টপ লিডার।তাকে দিয়ে কন্ট্রোল করবে এ শহরের চাবি-কাঠি।সোলায়মানকে সব শিখিয়ে পাঠিয়েছিল। টপ লিডার সেন্টার থেকে অর্ডার দিতো।
খুলনা শহরে দশ-বার বছর ব্যবসা ও রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।এ শহরে অনেক ব্যবসা।মোংলা সমুদ্র বন্দর,স্থল বন্দর, এয়ার র্পোট, মিল-কারখানা, সুন্দরবন অনেক কিছু আছে। সম্পদে ভরপুর।
সোলায়মান নিখুতভাবে কাজ করতো।ছোট ছোট করে কথা বলতো।দেখতে কালো গায়ের বর্ণ।ছ’ফুট এক ইঞ্চি লম্বা।মুখে একটা কাটা বড় দাগ যেন জোঁকের মতো দেখাচ্ছিল।অন্ধকারে লুকিয়ে ছিলো। সাদা লম্বা পাঞ্জাবী-পাজামা পড়ে থাকতো সবসময়।
সোলায়মানকে সবাই ভাই বলে ডাকতো।
জরুরী খবর আসছিলো রিপনের ফোনে। প্রেসক্লাবে সংবাদ সন্মেলন ছিলো ঐদিন দুপুর বারোটায়। দু’টা প্রর্যন্ত চলবে। মাসা এখানে আসবে খবর নিশ্চিত করে রিপন তার বাহিনীর সাথে নতুন প্লান করে যে যার স্থান নিয়েছিলো আবার। প্রথমে রিপন গ্রেনেড ছুরে মারবে। মাসার মৃত্যু নিশ্চিত করবে। স্পট ডেড করবে। দু’জন মুন্না ও মিলন তাকে ব্যাক আপ করবে। ওরা ভালো শুটার। নিশানা মিস করে না। ওদের কাছে জার্মানীর তৈরী দুটি পিস্তল ছিলো। সিলিন্ডারের চেম্বার লোড করা ছিলো ছয়টি গুলিতে সিলিন্ডার ঘুরিয়ে দেখে নিয়ে মুন্না বলল,‘ঠিক আছে।’ ঘটনা ঘুরে গেলে সার্পোট দিবে ওরা। স্পট ডেড নিশ্চিত করতে ওরা সাহায্য করবে। মিশা রাস্তায় থাকবে পথচারীদের মাঝে ফাঁকা স্থানে হাত বোমা মেরে আতঙ্ক সৃষ্টি করবে। মিশার পাশে মিশু শুন্যে গুলি ছুরে ফাঁকা আওয়াজ করবে। সে সময়ে রিপনও পথচারীদের সাথে নিরাপদ দূরত্বে চলে যাবে। অন্যরা যে যার মতো পরিকল্পনা মোতাবেক ঘটনা স্থল থেকে দ্রুত চলে যাবে নির্দিষ্ট গন্তবে। প্রাইভেট গাড়ী নির্দিষ্ট স্থানে অপেক্ষায় থাকবে ড্রাইভার কালু। মিশনে মোট সাতজন অংশ নিয়েছিলো। আরেক জন থাকবে প্রেসক্লাবের ভিতরে সে ঘটনার গতি প্রকৃতি কিছু জানবে না সব গোপন থাকবে তার কাছে,তাকে দিয়ে মাসাকে কৌশলে একা বাহিরে ডেকো আনবে।
সংবাদ সন্মেলন শেষ হতে হতে হুক গাড়ী নিয়ে চলে এসেছিলো। মাসাকে নিয়ে যাবে অফিসে।ওদের পরিকল্পনা ভেস্তে গেলো। কিন্তু রিপন অন্য রকম।ও যা চিন্তা করে তাই করে।পরের চিন্তা পরে। সবাই যে যার স্থানে রিপনের ইশারার অপেক্ষা করছিল। মাসা প্রেসক্লাব থেকে বের হয়ে হুকের সাথে কথা বলতে বলতে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো। ওঁত পেতে থাকা রিপন হ্যান্ড গ্রেনেডের পিন খুলে পর পর দুটি ছুড়ে মেরেছিলো ঠিক মাসা ও হুকের মাঝে। এদিকে মুন্না ও মিলন নল তাক করে বসে ছিলো রেঞ্জের মধ্যে। পিয়াসের ডাকার আগেই মাসা বেরিয়ে এসেছিলো বাহিরে। একটুর জন্য প্রাণে প্রাণে বেঁচে গেল পিয়াস। এতো সময় ছিল না রিপনের হাতে। মাসা ও হুকের মাথা ছিন্ন-ভিন্ন। রক্ত-মগজ ছিঁটকে দেঁয়ালে জমে গেছিলো। মাথার খুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিলো মাটিতে। রক্তে থক থকে লাল হয়েছিলো মাটি। মাসা ও হুকের হাত-পা ছট ছট করতে করতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো একে অপরের দেহের উপর। বিকট শব্দে কেপে উঠছিলো সবাই। সাথে সাথে মিশা রাস্তার উপর হাত বোমা নিক্ষেপ করল। আশপাশের সবাই দৌড়াচ্ছিলো ভয়ে। রাস্তা খালি। রিপনের কাছে দুটি গ্রেনেড ছিল। গ্রেনেডের বিকট আওয়াজে দোকান পাট সব বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। আতঙ্কিত শহরবাসী। সন্ত্রাসীরা যে যার মতো বোমা ফাটিয়ে সটকে পড়ছিলো। নীরবে ওরা গা ঢাকা দিয়েছিলো সেসময়।
ওরা নীরবে সরব ছিল পত্রিকার পাতায় পাতায়। তারা চলছিল আপন পথে। তাদের পথ একটা,তাতে অনেক কন্টক। রক্তে রাঙ্গা এ রাজ পথ। তবুও চলতে হয় আপন মনে। কত প্রাণ অকাল করেছে দান নিত্য এ রাজপথে।তবু শেষ হয় না।যেখানে শেষ সেখানে শুরু।মৃত্যুতে জন্মে নবপ্রাণ।নব উদ্দ্যোমে গায় আগামীর গান। অসীম সাহসী,ওরা আগামীর সেতু তৈরীতে ব্যস্ত। ঝড়,বৃষ্টি উপেক্ষা করে চলছিল।কোনো বাধাই সে পথ রুখতে পারে না।ওরা বাধাহীন,রাজপথের পথিক।ওরা সবার,সবাই এদের।এরা বিরাজ করে সব প্রাণে।এরা মৃত্যুহীন প্রাণ নিয়ে আসে প্রকৃতিতে।প্রকৃতি যেমন উদার হস্তে দান করছে।এরা তেমনি প্রকৃতির সন্তানরূপে নিজেকে বিলিয়ে দেয় প্রকৃতির মাঝে।
রাস্তার ভিক্ষারিটা ভাঙ্গা থালায় কাগজের দু’ টাকার নোটের উপড় এক টাকার চার পাঁচটা কয়েন সাজিয়ে নিয়ে বসেছিল সকাল থেকে।মুখে আওড়াচ্ছিল,‘আল্লাগো মোরে এট্ট্যা ট্যাহা দেন,ভাত খামু।আল্লাগো মোরে এট্ট্যাা ট্যাহা দেন,ভাত খামু.........।’বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলচ্ছিল যাতে সত্যি মনে করে সবাই।গ্রেনেডের বিকট শব্দে ওর মুখ বন্ধ।একটা শব্দের অর্ধেক বর্ণ বাহিরে অর্ধেক বর্ণ মুখ থেকে গলার ভিতরে গিলে ফেলেছিল।হাওয়া বের হল না।পূর্ণতা পেলো না ‘মোরে’ মো-তে থেমে গেলো।চলন্ত গাড়িতে ডান পায়ে কষে ব্রেক চাপার মতো জায়গায় ব্রেক কষলো ওষ্ঠদ্বয়।ওর কান খাড়া হয়ে উঠেছিল।ভিক্ষারি তাড়াতাড়ি নিজেকে গুটিয়ে নিলো।শুঁয়াপোকা যেমন কোনো কিছুর টের পেয়ে শরীর গুটিয়ে গোল হয়ে পড়ে থাকে চুপচাপ,তেমনি ভিক্ষারিটি মুর্হূতে থালাটা নিয়ে চুপচাপ কেটে পড়লো।
পিয়াসের দেহে গ্রেনেডের স্পিন্টার বিঁেধ ছিল অনেকগুলো।তাজা রক্ত ঝরছিল।যন্ত্রণায় কাতর। ওকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে গেলো এ্যাম্বুলেন্সে করে।
সোলায়মানের খাস লোক পল্লল ঘটনার খুব কাছ থেকে সব পর্যবেক্ষণ করছিল।ভা’য়ের মোবাইলে রিং করে সাথে সাথে খবর পৌছে দিল পল্লল একটু নিচু স্বরে,‘হ্যালো ভাই,ডেড।কাজ ফিনিসড।ডেড,সাংবাদিক দু’জন ডেড।’
সোলায়মান,‘রিপনকে দূরে পাঠিয়ে দে।শহরের বাহিরে।লোক চক্ষুর অন্তরালে থাকতে বল।কিছু দিন পরে আসবে।সব ঠান্ডা হলে।’
সোলায়মান তার টপ লিডারকে বলল,‘ভাই,কাজ শেষ।’
ওপার থেকে মোবাইলে উত্তর আসলো,‘ওকে,আই নো,আই সি।’
সোলায়মান লিডারের কথা শুনে বুঝলো সে আগেই খবর পেয়েছিল। কে যেন তাকে খবর পৌছে দিয়েছিল আমার আগে।
মুর্হূতে সংবাদের শিরোনাম হয়ে গেলো হুক ও মাসা। যে সংবাদ সংগ্রহ করতো সে আজ সংবাদের শিরোনাম হয়েছে। সারা শহর নিশ্চুপ। সর্বত্র পুলিশের ভ্যান ছুটে বেড়াচ্ছিল। সন্দেহ জনক ব্যক্তিকে রাস্তা থেকে থানায় তুলে নিয়ে যাচ্ছিল পুলিশ।
এ শহরকে মেধা শুন্য করার নীল নক্সা তৈরী করছিল কুচক্রি মহল। ডজন খানেক হত্যা করেছিল রিপন। ওর কারো জন্য মায়া-মমতা হয় না।
বাবা অর্ধ মৃত্যু।
পরিবারের কারো সাথে তার দেখা নাই।
সবাই যে যার মতো।
মিল বন্ধের কারণে এ শহরের হাজার হাজার পরিবার আজ ছিন্ন-ভিন্ন।লাশের নগরীতে পরিনত হয়েছে এ শহর।
কর্মপ্রিয় মানুষগুলোর ব্যস্ততা কেড়ে নিল মিলের অতি লোভী কিছু অসৎ কর্মকর্তা ও দুষ্ট রাজনীতিবিদরা।যে যেভাবে পারে লুটে-পুটে খেয়েছিল। নোংরা রাজনীতি,শখের করাতের মত। এরা সব দিকের সুবিধাভোগী। রাজনীতির বিষাক্ত ছোবলে এ শহরের মিল কারখানাগুলোর রন্ধে রন্ধে দলীয়করণে মেতে উঠেছিল এক শ্রেণীর শ্রমিক-কর্মকর্তারা। দুষ্ট রাজনীতিবিদদের লালসার চোখ পড়ে এ মিলগুলোতে খেটে খাওয়া মানুষগুলোর পেটের উপড়। দুষ্ট রাজনীতির নোংরা খেলায় আর সরকারের অবহেলায় বৃহৎ বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলো ধরাশায়ী হয়ে পড়লো এক নিমিষে। দুষ্ট রাজনীতির সূক্ষ্মজালে খুলনা টেক্সটাইল মিলের চাকা ঘোরা বন্ধ হয়ে গেলো চিরতরে।কর্মপ্রিয় মানুষগুলোর ভাগ্যাকাশে নেমে আসলো ঘোর অমাবমস্যার রাত। নিউজপ্রিন্ট মিল,জুট মিল ও দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরী সহ প্রায় সব মিলগুলো লোকসান দিতে দিতে বন্ধ হল চিরতরে। সরকারের উদাসীনতা ও মাথাভারী প্রশাসনের দায়ে খুলনা হারালো তার প্রাণ চাঞ্চল্য। খুজে পেলো নীরবতা।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্র নাই।
কারো সদ ইচ্ছা নাই। নাই কোনো ভালো উদ্দ্যোগ।
অন্ন নাই ঘরে, ক্ষুর্ধাত অবুঝ শিশুকে মা সান্ত¡না দেয় উনুনে আগুন জ্বেলে। দুঃখিনী মায়ের অন্তরে বিষের জ্বালা,নয়নে অশ্রু।
ছয়মাস পর রিপন পুলিশের সাথে ক্রশ ফায়ারে নিহত হল। সোলায়মানকে সন্ত্রাসীরা হত্যা করেছিল দিনে দুপুরে।
এ লাশের নগরীতে কর্মহীন মানুষ ছুটছে কর্মের নেশায়।
তিন রাস্তার বটের ডালে কাকের কর্কশ সমাবেশ।কত উচ্চ্য-বাচ্চ্য,কত মিছিল-মিটিং।
রাজনৈতিক ব্যানারে ঢাকা বটবৃক্ষের মুখখানী।সে বলতে চায় কিছু বলতে পারে না।
আজ রমনীর সাজে সেজেছে এ বিধ্বস্ত নগরী।প্রতিটি নাগরিকের মন জ্বলছে তুষের আগুনের মতো। প্রতিদিন শতফুল ফোটে সরণির কোল জুড়ে। নিশিতে বইছে কামিনীর সুবাস। সুউচ্চ অট্টালিকায় দুষ্টুরা নিশি যাপন করে কামিনীর মুগ্ধতায়।
সে-ই কোলাহল নাই,নাই ব্যস্ততা। বাঁশি আজ বাজে না গো।
আজ আঁধারে শুধু জোনাকিরা খেলা করে।