আজ আমার মিথ্যার বসন টুকুও খসে গেল। একেবারে নাঙ্গা হয়ে গেলাম। ইজ্জত বলে কখনো কোনো সম্পদ আমার ছিল না। তার পরও যা আমার কল্পনা ছিল, অথবা ভবিষ্যতের টার্গেট সেই ভাবনা টুকুও দুর্গন্ধ ভরা বমির মতো মাথা ছেড়ে নেমে গেল। সুস্পষ্ট করে আজ ৫টি বছর পর আমার শাশুরি জানলেন তার মেয়ে সংসার জীবনে সুখী হতে পারেননি। একটা মিথ্যার দায় থেকে আমি নেমে গেলাম, কিন্তু যে আসনটি ছেড়ে গেলাম সেখানে আর কোনো মায়াজাল থাকবে না। প্রতিষ্ঠিত ভালবাসার ঘ্রাণ এখন তাঁর নাকে বদবু হয়ে ধরা দিবে। জানিনা টাইফয়ের্ড জ্বরে যাদের চোখ নষ্ট হয়ে যায় তারা ফুল পাখি আর প্রিয়ার মুখের পাশাপাশি কোনো দীঘির জলে ভাসতে থাকা লাশের খন্ড ভাবে কিনা। দেখিনা বলে শুধু ভালই দেখতে চাই এমনটা অনেকের বেলাতেই হয়তো সত্যি নয়। আমি সব চাই, একটা ক্যামেরা, একটা সিগারেটও।
আমার বউমনি আমার অনেক ভাল লাগার আশ্রয়। তাকে অন্ধের মতো ভালবাসার এক পর্যায়ে সেটি অত্যাচার বলে তিনি নিলেন। ১৯৯৯-এ আমার এক কলিগের সাথে তাদের গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেলাম। প্রসঙ্গত: তার কিছুদিন আগে আমার মা মারা যান। মা, আমার এ দুনিয়ার সবচে আপনজন। ছিলেন বলিনি ইচ্ছে করেই। মা আমার আজো আছেন। মাথার কাছে তিন ছেলের এক ছেলে আমি। আমার হাতে মায়ের মাথা। মেজো ভাইয়া কবরে। যে খাটে করে মাকে নিয়ে আসলাম সেখান থেকে এবার কবরে নামানোর পালা। মায়ের মাথা এবার আমার হাতে। কাফনের কাপড় ভিজে চুলের ভাঁজ গুলো এখনো যেনো মুঠো বন্ধ করলেই অনুভব করি। মায়ের আর সব কথা আজ আর নাই বললাম। একদিন তখন মা বারডেমে ভর্তি আছেন। আমি পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামে চাকরি করি তখন। সেগুনবাগিচায় অফিস। কুমিল্লা বার্ডে একটা বিশেষ কনফারেন্সের আয়োজন চলছে অফিসে। বিশাল ব্যাস্ত সবাই। আমি মাকে দেখতে যাব হাসপাতালে। মা’রকাছে থাকব রাতে তার সেবা করতে। তার মুখের গন্ধ নিতে। মাঝে মাঝে মাকে বলতাম- মা আমার কি যেনো হইছে, ভাল্লাগে না। আমারে একটা ফু দিয়া দেন। মা আমার পান আর জর্দার খুশবু মিশায়ে আমার মুখে চোখে ফু দিতেন। আমি বুক ভইরা নিশ্বাস নিতাম। কনফারেন্সের ব্যস্ততায় আমি সময় পাচ্ছিনা। তাই চাকরিটা ছেড়ে দিলাম। কিছুতেই যেনো আমার কিছু যেতো আসতো না। মোস্ট রিসেন্ট যাচ্ছে আসছে।
সেই দিনগুলো আমার নিজের হাতে কবরে শুইয়ে রাখলাম। মাকে না। সপ্তাহে দু’ একবার মার সাথে দেখা হয় আমার। মাকে অস্থীর দেখলে সপ্তাটা ভাল কাটে না। মনে শক্তি পাইনা। বাবার কথা বলা হবে আবার কোনো আলাপে। আল্লাহ পাকের মায়ায় তিনি এখনো আছেন বেশ। স্বাস্থ্য ভাল না। তবুও আছেন।
মা আমাকে ছেড়ে গেলেন। মনে হতো মাঝে মাঝে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে আমার ফাজলামো গান- মাগো মা, ওগো মা, আমায় বানাইলি তুই দিওয়ানা। অনেকদিন মা ডাকিনা। অনভ্যাসে আমার একটুও বিদ্যা হ্রাস হয়নি। এখনো মা ডাক শুনলে ফিরে দেখি, কোন সে শিশু আমার কথাটি বলে।
যাহোক, ৯৯-এ গেলাম আমার সে কলিগের সাথে তাদের গ্রামের বাড়িতে। আমার ছবি তোলার বাজে নেশা থেকেই সেখানে যাওয়া। আমাকে স্তম্ভিত করে দিয়ে সেই কলিগ রাত সাড়ে দশটায় গ্রমের নির্জন নিশব্দের মধ্যে চিৎকার করে ডাকতে লাগলেন - মা, ঐ মা, দুয়ার খোল্, আমি আইছি। টিনসেডের ঘর থেকে একজন মা বেরুলেন। আমাকেও অনেক মায়া করলেন। এক বছর পর সে ঘরেই আমার বিয়ে করা। আমার এক্সকলিগ এখন আমার সমন্ধি। খালাম্মা আজো খালাম্মা। উনাকে শাশুরি আম্মা বা এ জাতীয় কিছু বলতে পারিনি আমার মায়ের জন্যে। যাতে উচ্চারণেও তার মতো কাউকে না লাগে। এক বছর শুধু দেখেছি। একদিন সময় করে বলেছিলাম তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালে তোমার আপত্তি হবে? ও শুধু বলেছিল -না। দ্যাটস্ অল। নো প্রেম, নো হাংকিপাংকি। স্কুইডের মতো গভীর জলে যে যায়নি কখনো সে বুঝবেনা আমি ওকে কতো গভীরে রেখেছিলাম। ওর ভালবাসা আর ওকে আমার ভালবাসা পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। ভালবাসার তীক্ষèতায় কেটে ফেল ফেল হয়ে যাচ্ছিল ওর বোনেরা। আমার বন্ধুরা। অন্য সবাই। আরো অনেকে।
কোনো এক ঈদে প্রথম আমাদের মধ্যে ব্যবধান বাড়তে লাগল।
একটা মার্কেটে ওকে না জানিয়ে গেলাম কিছু কিনব বলে। থ্রি পিস বা শাড়ি। কয়েকটা নিলামও আমার পছন্দে। এনে দেয়ার পর ওর মন্তব্য আমাকে চপেটাঘাৎ করল। এগুলো ওল্ড মডেল, রং টেকেনা, আমাকে বোকা পেয়ে এসব অচল মাল ধরিয়ে দিয়েছে- এই সব... এই সব...। আমি বুঝালাম- নো প্রবলেম, ফেরৎ আনা যাবে এই শর্তেই আমি এগুলো কিনেছি। ও বুঝল। ওকে নিয়ে গেলাম দোকানে। যাবার আগে খুব নম্র করে বুঝিয়ে বললাম- ওল্ড মডেল জাতীয় কিছু বলোনা এখানে। দোকানটা আমার এক ছাত্রের। এসব বললে ও খুবই আনইজি ফিল করবে। ঠিক আছে বলে ভিতরে ঢুকল। কিন্তু না, কিছুই ঠিক ছিল না সে দিন। না আমার বুঝানো পার্ফেক্ট ছিল না ওর বুঝা।
এর পর আমাকে পেয়ে বসে ভয়। আমি আর কিছুই কিনতে সাহস পেলাম না। না কোনো উপহার না øো পাউডার। ও না থাকলে ফোন করে জেনে নিতাম কোনটা পছন্দ। অথবা ও আমার সাথে। এভাবে এভাবে ৫ বছর। ভাল লাগা ভালবাসা মনের মধ্যে থাকলেও ভিতরটা মুলি বাঁশের মতো ফাঁপা। একটু আচরণেই ভুল বুঝা, রাগ, গোস্বা। আমাকে বুঝা, আমার ভুল বুঝা, সব কিছু ওকে নিয়ে যায় মাইল্ড স্ট্রোকে। আর আমি একলার দিকে। না পারি বুঝতে না পারি বুঝাইতে।
এবার তার নিস্তার হলো বলে। এতোদিন কেউ আমাদের ভিতরের ফারাগের কথা জানতো না। এবার স্বয়ং খালাম্মাকে আমার বউমনি খোলাসা করে সব ভেঙে বলছেন। তোমরা যা জানো সেটা মিথ্যা। ওর অত্যাচার অযত্নেœ আর অভাবে আমি আর টিকতে পারি না। আমি বাড়ি চলে যাব। এখানে ওর সাথে আর না।
আইনকে আমি শ্রদ্ধা করি। কোথাও লাইনে দাঁড়িয়ে বাসে চড়তে হলে আমি কখনো টেকনিক খাটিয়ে আগে যেতে চেষ্টা করি না। তাই বিচার কার্যে সহায়তাকল্পে বলছি- আমার ছবি তুলার হাত খারাপ না। পদ্ধতিটা এখনের মতো ছবি তুলেই মনিটরে দেখার মতো এতো সহজ ছিল না। বেশ কয়েকটা এসএলআর নিয়ে চাকরির বাইরে সখে ছবি তোলার মানে কি পরিমান বাজে খরচ ধারণা করতে আপনার কষ্ট হবে যদি আপনি ফটোগ্রাফির সাথে পরিচিত না থাকেন। তাই বলছিলাম আমাকে বিচার করতে হলে জানতে হবে আমার স্বচ্ছলতা তেমন ছিলনা (এখনো)। টাকা হলে কিছু ফিল্ম কিনতাম। ছবি তুলে রেখে দিতাম। আবার টাকা হলে প্রিন্ট করতাম ইত্যাদি ইত্যাদি খরচ। সংসারে মনযোগ কম ছিল আগে থেকেই। খুব একটা সামাজিক না আমি। বিয়ে শাদি পার্টি চটপটি কোনোটাতেই আমার নেশা নেই এখনো। ক্যামেরা, গ্রাফিক ওয়ার্ক আর সিগারেট। আর কিছুই না।
বউমনি এসবের কিছুই ভালবাসেন না। গ্রাফিক ওয়ার্ক চাকুরি বলে মেনে নিলেও বাকি সবকে মনে তোলেন না ভুলেও। ইনি সব ভেবে- সব অর্থ সব, ঘর সংসার স্বাদ আহ্লাদ আর স্বামী ছেলে, সব ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন- আমার সাথে আর না। এইতো কিছুক্ষন আগে আমাকে না জানিয়ে আমার পাশ থেকে ওর বালিশ নিয়ে চলে গেলেন পাশের রুমে। জানি না আমি জেগে নাকি ঘুমানো ও জেনেছিলেন কিনা। চলে যাওয়ার পরেই লিখতে শুরু করলাম। মাঝখানে ছেলেটা ঘুমচোখে মাকে হাতড়ে বেরাল। আমি ভুলেও আর ওকে আমার পাশে খুঁজতে চাই না। ঘুমের ঘোরে কাউকে খোঁজার প্রবণতা কাটাতে চাই। কাউকে বেড়াজালে আটকানোর মন এখন নাই। কি বলেন? কাবিন নামার শর্ত পুরণ এখনি সবচে ইমপর্টেন্ট নয় কি?
ওকে ঠকানোর কথা আমি এক বাক্যে স্বীকার করি
ওকে ভালবাসার কথাও আমার জোরালো
আমি ওকে আটকাতে চাই না। যে কষ্ট এতো ৫ বছর দিলাম ... তোমার জন্যে জীবনের শেষ লোন এবার বেতন এ্যাকাউন্ট থেকে তুলব। না হলে আমার যে খরচের হাত, তোমার দেন মোহরের একলাখ দশ হাজার টাকা আমার পক্ষে এক সাথে জোগানো কঠিন। তোমাকে আর কষ্ট দিতে চাই না...
ডোন্ট লাইক টু মেইক ইট প্রলংগড।
হ্যাভ এ নাইস ডে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




