বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস প্রায় হাজার বছরের। এই ভাষা অনেক কঠিন বলে অবজ্ঞা করলেও; এই ভাষা পৃথিবীর সাহিত্যের দরবারে অনেক সম্মান পাওয়া ভাষা। এর প্রমাণ পাওয়া চর্যাপদ থেইকা। এই চর্যাপদ রচিত যেই পদাবলীর পান্ডুলিপি পাওয়া গেল; বিংশ শতাব্দীর শুরুতে নেপালের এক বৌদ্ধ গ্রন্থাগার থেইকা এই চর্যাপদ আবিস্কারের পরেই তা প্রমাণ কইরা দেয় যে এই ভাষায় সাহিত্য চর্চার ইতিহাস হাজার বছরের । এই দেশে মুসলমানদের আগমনের পরে কিছুদিন সাহিত্যচর্চা বন্ধ ছিল বইলা অনেকেই নানান কথা আওরায় কিন্তু মধ্য যুগে এর বিস্তারের আরও প্রমাণ আমরা সাহিত্য থেইকাই পাই।
যেমন মুসলমান আমলেই শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বা মঙ্গলকাব্য। রাধা-কৃষ্ণ অথবা চাঁদ সওদাগরের গল্প আমরা এই যুগ থেইকাই পাই। তাছাড়া মুসলমান আমলেই ব্রজবুলি ভাষার উত্থাপন। প্রথম মহাকাব্য ও কবিগান আমরা খুঁইজা পাই এই সময়েই । আবার মুসলমান কবিরাও পিছাইয়া ছিলেন না যেমন কবি আলাওল, বাহরাম খান, শাহ মুহাম্মদ সগীর এবং আমার অজানা এইরকম বিখ্যাত আরও অনেকে। অর্থাৎ, সাহিত্যের মধ্যে তখন মুসলমান-হিন্দু বইলা কিছু ছিল না। যদিও ধর্ম নিয়া মানুষের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি আমাগো মধ্যে ব্রিটিশরাই কইরা গেছিল। সাহিত্য সেইখান থেইকা মুক্তি পায় নাই।
কোনো সাহিত্যিক বা কবি আরাকান অঞ্চল থেইকা লিখে বিখ্যাত হইয়া যাইতো আবার কেউ বর্ধমান থেইকা লেইখা বিখ্যাত হইতো। এখানে কোনো অঞ্চলভিত্তিক লড়াই ছিল না। মানে কলকাতার বইমেলায় বাংলাদেশের প্রকাশকদের স্টল দিতে দিত না বা আমন্ত্রণ জানাইতো না, এইটা তখন ছিল না। বা বাংলাদেশের সাহিত্যেকরা কলকাতার সাহিত্যিকদের কুম্ভিলকবৃত্তি নিয়া অত মাথা ঘামাইতো না। কারণ, সবকিছুই ছিল আসল। বাল্মিকির রামায়ণকে কাশীরাম দাস পদ্যতে অনুবাদ করেছিলেন। অথবা অন্যান্য লেখকরা আরবের লিখিত লায়লি-মজনু বা ইউসুফ-জুলেখার গল্পকে অনুবাদ করছিলেন।
আবার ধরাযাক মধ্যযুগে যখন কেউ কবিতা বা পদাবলি লিখতো তখন তাদের লেখা গনহারে সবাই পড়তে পারতো না। বিশেষ লেখা রাজা-বাদশারা পড়তো ঠিকই কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই লেখা ছড়াইয়া পড়তো না। লেখক বা কবির কাব্য একটি বা কয়েকটি পান্ডুলিপি থাকতো। পাঠকরা লেখক বা কবির আশেপাশের গন্ডির মধ্যেই সেই লেখা পড়তো। পাঠক পড়ার সময় ও পরে যেই বিশেষ অনুভূতি প্রকাশ করত তা লেখক বা কবি দেইখা অনেক আনন্দিত হইতো। এর সাথে কোনো বানিজ্য জড়িত ছিল না। ছাপাখানার অভাবে হয়তো অসংখ্য অজস্র বিখ্যাত কাব্য হারাইয়া গেছে। যদিও এইগুলা আসলে পুরাপুরি হারায় নাই লোকসাহিত্যের মধ্যে এইগুলা অবস্থান করে। অনেকটা আমাদের চারপাশে থাকা অক্সিজেনের মতো; আছে, আমরা টের পাই এবং প্রতিনিয়ত একে গ্রহণ করতাছি। অর্থাৎ, আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির আজ যেই পর্যায়ে আইসা পৌছাইছে তা লোকসাহিত্যেরই একধরনের ধ্বংসাবশেষ। আমাদের চিন্তার মনন পাঠে লোকসাহিত্য পরোক্ষভাবে প্রভাব রাইখা আসছে।
সাহিত্যের বিপ্লব বাংলা ভাষায় প্রথম ঘটছিল ঊনবিংশ শতকের শুরুতে। এই বিপ্লব ঘটে দুই কারণে। প্রথম কারণ এই শতকেই বাংলা ভাষায় গদ্য লেখার প্রচলন শুরু হয়। দ্বিতীয় কারণ, এই শতকেই ছাপাখানা আবিষ্কার হয়। বাংলা ভাষায় এই চরম অস্ত্র পাইয়াই সাহিত্যরে বারোটা বাজাইছে সাহিত্যের বনিকেরা। লেখক আগে লিখত নিজের মনের খোরাক মেটানোর কারণে। আর এখন লিখে পাঠকের মনের খোরাক মেটানোর লেইগা।
আগে যেমন ধর্ম, জাতি, অর্থ দিয়া সাহিত্য করা হইতো না, এখন সেই চর্চা প্রবলভাবেই হয়। তবে কেউ কেউ এইসবের উর্ধ্বে ছিল। যেমন জীবনানন্দ দাস। এখনও হয়তো কেউ কেউ লেখেন, যারা হয়তো পুরা জীবনে একটা বা দুইটা বই লিখছে।
মোদ্দাকথা হইলো- সবকিছুর মধ্যেই একটা বানিজ্যিক চিন্তাভাবনা ঢুইকা গেছে। অর্থ ছাড়া আর কিছু চিন্তা করতে পারে না কেউ। অনেক চাটুকাররা হয়তো বলবে অর্থের দরকার আছে পৃথিবীতে। তো সেই জাতির মানসিক বিকাশ করার দায়ভার হয়তো আব্দুল্লাহ আবু সাঈদের মতোন ব্যক্তি নিতে পারে কোনো স্বার্থ ছাড়া, কিন্তু সামনে আর কোনো আবু সাঈদ আসবে কিনা সেইটাই ভাববার বিষয়। কারণ আলোর পৃথিবী ফুরাইয়া যাইতেছে। ধরণীর বুকে নাইমা আসছে অন্ধকারের ঘনঘটা। এর প্রমাণ এই বইমেলা, যেখানে বই বিক্রেতার থেকে নাকি ফুড স্টলের বিক্রেতারা বেশি লাভবান হইছে। যদিও আমি বিশ্বাস করি না। তবে এই কথার চার ভাগের এক ভাগ সত্য হইলেও এইটা লজ্জাকর।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মার্চ, ২০২৩ ভোর ৫:২৬