somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আপনি কে বলছেন?

০২ রা অক্টোবর, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হঠাৎ করেই আমি একদিন লক্ষ্য করলাম, সবকিছু কেমন কেমন হয়ে গেছে। কলিংবেল বাজার সাথে সাথেই এখন আর ওপাশ থেকে দরজা খোলে না কেউ। আমি লক্ষ্য করলাম, প্রায় চারবার শব্দ হওয়ার পরে মিশু দরজাটা খুললো। আমি দেখলাম মিশুকে। মিশু কবে মাঝখান থেকে সিঁথি করা শুরু করলো? আমি জিজ্ঞেস করতে যাবো, মিশু চলে গেলো ভেতরে। কোন কথা হলো না। আমিও লক্ষ্য করলাম, এমনটাই যেন স্বাভাবিক। ভেতরে এসে ব্যাগ রাখলাম। হঠাৎ করে অনেক অনেক প্রশ্ন আমার মাথায় এসে জড়ো হতে শুরু করলো একে একে। প্রশ্নগুলো বিক্ষিপ্ত, অথচ অসংলগ্ন না। আমি ঘন্টার পর ঘন্টা মিশুর সাথে এলেবেলে কথা বলে কাটিয়ে দিয়েছি রাতের পর রাত, অথচ আমি কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারলাম না। আমার কোন কথাই এলো না মুখে। ডিনার করলাম। মিশু বসে ছিলো। আমি খেয়াল করলাম, মিশু আমার সাথে খেলো না। মনে করার চেষ্টা করলাম গতকালের কথা। গতকালও মিশু আমার সাথে খায়নি। আমি উঠে যাওয়ার পর খায় বোধহয়। আমি খেয়ালও করিনি। জানতেও চাইনি। আরো আশ্চর্য হলাম এই ভেবে, আমি মনে করতে পারছি না শেষ কবে আমরা একসাথে খেয়েছিলাম। এই নিয়ে অনেক, অনেক কথা জমলো আমার ভেতর। বলতে পারলাম না। মিশু চলে গেলো রান্না ঘরে।

রাতে বিছানায় আমি অবাক হলাম মিশুকে স্পর্শ করে। কথাগুলোকে একটা প্যাটার্নে এনে আমি অপেক্ষা করছিলাম বিছানায়। মিশু আলো নিভিয়ে এসে শুয়ে পড়লো ওপাশে। আমাদের মধ্যে কম করে হলেও দশ আঙ্গুলের ব্যবধান, মিশু শুয়ে আছে ওপাশে মুখ করে। আমি শুধু ওর উন্মুক্ত পিঠটা দেখতে পাচ্ছি। ওর মেরুদন্ড বরাবর তিনটি নিখুঁত তিল কালপুরুষের কোমরবন্ধনীর কথা মনে করিয়ে দেয় বরাবর আমায়। ওই তিলে আঙ্গুল বোলাতে বোলাতে ওকে আমি শুনিয়েছিলাম নক্ষত্রমন্ডলীর কথা, গিজা পিরামিড কমপ্লেক্স নিয়ে বলতে বলতে বলেছিলাম গিজার গ্রেট পিরামিড, খফ্রুর পিরামিড আর মেঙ্কাউ-রার পিরামিড দেখতে যাওয়ার স্বপ্নের কথা। অথচ মধ্যে স্পষ্টতম সেই তিল স্পর্শ করতেই আজ মিশু শিউরে উঠলো নব্যযুবতীর প্রথম পুরুষস্পর্শের মতো, সতর্কতার শিহরন উদ্ধত করে তুললো রোমকূপেদের। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমরা কি অনেক দূরে সরে গেলাম মিশু!

মিশু তাকিয়েছিলো। মিশুর সেই চাহুনী আমায় অবাক করেছিলো চূরান্তরকমভাবে। আমি আর কিচ্ছু বলতে পারিনি। অথচ আমার ইচ্ছে হয়েছে ওকে জড়িয়ে ধরি, ওর চোখ চোখ রেখে প্রথম প্রনয়ের মতো জিজ্ঞেস করি, তুমি আমার কে হও। আর ও টুপ করে বলে দিক, জানি না।

পরের দিন আমার ঘুম ভাঙলো দেরীতে। আমি দেরীর কারন উদঘাটন করতে গিয়ে টের পেলাম, আজ আমাকে মিশু ডেকে দেয় নি। আমি অবাক হলাম না। এই অবাক না হওয়াটা আমাকে অবাক করলো পরে। আমি খুঁজলাম মিশুকে। নেই, ওয়াশরুম ফাকা। তবে ফ্লোরের পানি শুকায়নি তখনও। রান্নাঘরে পিনপতন নীরবতা। আমাকে কষ্ট করতে হয়নি বেশি। ডাইনিং টেবিলের উপরেই চিঠিটা রেখে গিয়েছিলো ও। একটা আতঙ্কের স্রোত নেমে গেলো আমার শিড়দাড়া বেয়ে। আমি হয়তো জানতাম কি লেখা আছে ওখানে। তাই কাগজটা ধরতে সময় লাগলো আমার।

কাগজের ভাজ মলীন। বেশ কয়েকদিন আগেই লেখা বোধহয়। ভাজে ভাজে দূর্বল হয়ে গেছে কানাগুলো। খুলতেই গোটা গোটা অক্ষর গুলো চোখে লাগলো। আমি কিছুই পড়তে পারলাম না প্রথমে। হাতের উলটো পিঠ চোখ রগড়ে নিতে ঝাপসা ভাব কাটলো কিছুটা। এবার লেখা গুলো বোঝা যাচ্ছে কিছুটা। মিশুর হাতের লেখা পরিষ্কার। দুটো লাইন লেখা কাগজের মাঝখানটায়।

"অনেককিছু লিখবো ভেবেছিলাম, কিন্তু লিখতে বসে আর পারলাম না। কি আশ্চর্য্য, তুমি জানতেই পারলে না আমি ছেড়ে গেছি তোমাকে!"

চোখ রগড়ে ঝাপসা দৃষ্টি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করলাম আবার। টেলিফোন বাজছিলো অনেকক্ষন থেকেই। হঠাৎই খেয়াল করলাম আমি। তারাহুরো করে মাউথপিসটা তুলে নিলাম। ওপাশ থেকে নারী কন্ঠে বললেন কেউ একজন, "সুপ্রভাত রিফাত সাহেব।"
"জ্বি বলছি, কে বলুন তো!”
" আমি আপনার সাইকিয়াট্রিস্ট, সরাসরি আমি আপনাকে একটা কথা বলার জন্য ফোন দিলাম। আপনার কি মনে আছে আজ আপনার স্ত্রীর দ্বিতীয় মৃত্যু বার্ষিকী! "
আমি কিছু বুঝলাম না ভদ্রমহিলার কথা। আমি মিশুকে কাল রাতে দেখেছি। আমরা ঘুমিয়েছি একসাথে। আমি স্পর্শ করেছি ওর পিঠের কালপুরুষ, ওর শিউরে ওঠা অনুভব করেছি, সকালে উঠে আমি মিশুর চিঠি পেয়েছি এবং মিশুকে আমি কোথাও পাচ্ছি না। এক অচেনা ভদ্রমহিলা নিজেকে সাইকিয়াট্রিস্ট পরিচয় দিয়ে আমাকে আমার স্ত্রীর মৃত্যুর কথা জানাচ্ছে, তাও দুই বছর আগের কথা। আমি বুঝলাম না কি বলা উচিত। বললাম, "আমার ডাইনিং টেবিলে আমার স্ত্রীর একটা চিঠি পেয়েছি সকালে। আপনি কি বলতে পারবেন এটা এখানে কিভাবে এলো যদি আমার স্ত্রী মারাই গিয়ে থাকে!”
ওপাশ থেকে কোন শব্দ এলোনা কিছুক্ষন। এলো না তা না, বিভিন্ন অদ্ভুত শব্দ এলো, টেবিল টানাটানি, ড্রয়ার খোলা বন্ধ করার শব্দ সম্ভবত, কিছু একটা পরে ভেঙে যাওয়ার শব্দও এলো বোধহয়। একটু পর ভদ্রমহিলা বললেন, " আপনি আমার অফিসে চলে আসেন এখনি, চিঠিটা নিয়ে।"
"কিন্তু আমি আপনার অফিস তো চিনি না।"
" চেনেন, বের হন। চিনে যাবেন। এক্ষুনি চলে আসুন।" বলে টেলিফোনটা রেখে দিলেন তিনি ওপাশ থেকে। আমি সারাঘর আরেকবার দেখে নিলাম। নাহ, কেউ নেই। চিঠিটা আরেকবার পরলাম আমি। লেখাগুলো এখন আরো স্পষ্ট। আমি অবাক হলাম, আমার বুকের মধ্যে এতক্ষন যে দমবদ্ধ কষ্টটা ছিলো, ওটা নেই। বরং আমি উত্তেজনা অনুভব করছি।

কোনরকমে গায়ে জামা দিয়ে বের হতে যাবো, সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। ওপাশ থেকে দরজা খুলে মিশু ঘরে ঢুকলো। একটা আকাশী শাড়ি পড়া, হাতে বাজারের ব্যাগ। ঢুকেই আমার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা আচ করলো বোধহয়, বললো "কই যাচ্ছো এতো ভোরে?" আমার বিস্ময় তখন চূরান্ত অবস্থানে, আমি শিশুর মতো জাপটে ধরলাম মিশুকে। হাত দিয়ে খুব ভালো ভাবে শিওর হতে চাচ্ছিলাম ওর অস্তিত্ত্ব, পাগল পাগল লাগছিলো আমার। মিশু ছাড়িয়ে নিলো না, বরং কিছুটা এলিয়েই দিলো ওর শরীর। মুখে বললো, "হয়েছেটা কি বলবে তো।"
"কোথায় ছিলে তুমি? আমাকে ছেড়ে কই চলে গিয়েছিলে?" আমার কন্ঠে আতঙ্ক।
"বাজারে, আজব! আজকে তো ছুটি তোমার, তুমি দেরী করে ওঠো, তাই আমিই ব্যাগটা নিয়ে চলে গেলাম।"
আমি বুঝতে পারছিলাম না কি হচ্ছে। কি বলবো। বললাম, "এই চিঠির কি মানে?" কাগজটা এগিয়ে দিলাম ওর দিকে। মিশুর কপালের ভাজগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠলো আস্তে আস্তে। "এটা তো আমি লিখিনি" কাগজের দিকে তাকিয়েই বললো মিশু।
"কিন্তু হাতের লেখা তো তোমার।"
"তাই তো দেখছি!"

এরপর চূরান্তভাবে বিষ্মিত আমরা কথা বললাম, কথা বললাম অনেকক্ষন। একসঙ্গে বসে থাকলাম অনেকটা সময়। অনেকদিন পরে যেন সব আগের মত হয়ে এলো সব। বিস্ময়ের প্রথম ধাক্কাটা কেটে যেতে আমাদের কথাগুলো আড্ডায় রূপ নিলো। অনেকদিন পর আমি মিশুলে হাসতে দেখলাম প্রান খুলে। অনেকদিন পর আমরা কাছাকাছি এলাম আগের মত করে। অনেকদিন পর আমাদের কথা হলো কালপুরুষ নিয়ে, পিঠের তিনটি তিলে চুমু খেতে খেতে আমি অনেকদিন পর মিশুকে ভালোবাসলাম কৈশোর পেরোনো প্রেমিকের মতো।

বিকেল নাগাদ ফোনটা এলো আবার। সেই মহিলা কণ্ঠস্বর। আমি কন্ঠস্বর চিনতে পেরেই কিছু কথা শুনিয়ে দেবো ভাবলাম, গুছিয়ে নিলাম মনে মনে। অবশ্য সে সুযোগ আমি পেলাম না, মুখ খোলার আগেই ভদ্রমহিলা জানতে চাইলেন ওপাশ থেকে, "আজ কত তারিখ রিফাত সাহেব?"
কি আশ্চর্য্য, এটা কি ধরনের প্রশ্ন? "বিশ জুলাই"
"উহু, সালটা।"
"দুহাজার সতেরো।"
"আপনার আশেপাশে কি ক্যালেন্ডার আছে?"
ঝট করে আমি পেছনের ক্যালেন্ডারের দিকে তাকালাম। "হ্যাঁ আছে, জুলাই বিশ তারিখ, সব ঠিক আছে।"
"সালটা দেখুন। "
দুহাজার উনিশ! আমি ধাক্কা খেলাম একটা। কি আশ্চর্য্য! মিশু এসে দাড়ালো দরজায়, "কে ফোন দিয়েছে?"
ওপাশ থেকে ভদ্রমহিলা জানতে চাইলো, "কে কথা বলছেন?" কন্ঠে কৌতূহল।
আমি নির্বাক বসে রইলাম। কি আশ্চর্য্য!
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা অক্টোবর, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৪৩
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=স্মৃতির মায়ায় জড়িয়ে আছে মন=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:০৯


ঘাস লতা পাতা আমার গাঁয়ের মেঠো পথ, ধানের ক্ষেত
জংলী গাছ জড়ানো লতাবতী - আহা নিউরণে পাই স্মৃতির সংকেত,
রান্নাবাটির খেলাঘরে ফুলের পাপড়িতে তরকারী রান্না
এখন স্মৃতিগুলো পড়লে মনে, বুক ফুঁড়ে বেরোয় কান্না।

ফিরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইউনুস সাহেবকে আরো পা্ঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চাই।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪৪


আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি পুরো ১৫ মাস ধরেই ছিলো। মব করে মানুষ হত্যা, গুলি করে হত্যা, পিটিয়ে মারা, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারা, পুলিশকে দূর্বল করে রাখা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৬

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

শহীদ ওসমান বিন হাদি, ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

হ্যাঁ, সত্যিই, হাদির চিরবিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার এই মুহূর্তটিতেই তার খুনি কিন্তু হেসে যাচ্ছে ভারতে। ক্রমাগত হাসি।... ...বাকিটুকু পড়ুন

'জুলাই যোদ্ধারা' কার বিপক্ষে যুদ্ধ করলো, হ্তাহতের পরিমাণ কত?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৫১



সর্বশেষ আমেরিকান ক্যু'কে অনেক ব্লগার "জুলাই বিপ্লব" ও তাতে যারা যুদ্ধ করেছে, তাদেরকে "জুলাই যোদ্ধা" ডাকছে; জুলাই যোদ্ধাদের প্রতিপক্ষ ছিলো পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, ছাত্রলীগ; জুলাই বিপ্লবে টোটেল হতাহতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?

লিখেছেন এ আর ১৫, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৩

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?


হাদিকে মারল জামাত/শিবির, খুনি নাকি ছাত্রলীগের লুংগির নীচে থাকা শিবির ক্যাডার, ডাকাতি করছিল ছেড়ে আনলো জামাতি আইনজীবি , কয়েকদিন হাদির সাথে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×