১.
আমাদের খিদা লেগেছিল।আমার,মেজবোন লিনুর,বড়বোন মিউকার,ছোটভাই বেবুনের।এমনকি বাবা,মা আর দাদীরও।কিন্তু বাসায় কোন খাবার ছিল না।কারখানাটা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মা ও বাবার চাকরি চলে গিয়েছিল।তাই খাবার কিনবার টাকাও ছিলনা।আমরা জানতাম আমাদের বাবা-মা পৃথিবীর সেরা বাবা মা।কারণ তারা আমাদের কথা দিয়েছিল,তারা আমাদের আনন্দে রাখবে।তাই এমন অবস্থায় বাবা মাকে বললাম-আমি আনন্দ পাচ্ছি না।আনন্দ করার জন্য শক্তি দরকার।কিন্তু গত কয়েকদিন খাবারের নিদারূন অভাবে আমার পেটে চিলিক মেরে ব্যথা করছে।লিনু আর বেবুন শুকিয়ে দূর্বল হয়ে ধূসর চাদর বিছানো বিছানার উপর শুয়ে আছে।
দাদি বলল-হারামি!তরা তগো বাপ মার কষ্ট বুঝবি না!খালি ফূর্তি করবার চাস!আমার মাইয়া হইলে আইজকা তরে জুতাইতাম!বাপ মার দু্্খের দিনে সমবেদনা তো নাই-ই,আবার 'আনন্দ' করতে চায়....
কিন্তু মা বলল-হ্যাঁ,তিনু।আমি চাই অন্তত আনন্দ নিয়ে বাঁচতে।বিলাস নয়,আনন্দ!এমন কঠিন অবস্থায়ও আনন্দ করার পথ আছে।চলো আমরা আগে আমাদের জানালার পর্দাগুলো সরিয়ে দেই।এতে সূর্যের আলো আমাদের ঘরে ঢুকবে।
অন্যদিকে বাবা মেউকা,লিনু আর বেবুনকে ডেকে তুলল।
তারপর বসল একটা সত:স্ফুর্ত মিটিং।মিটিঙে সিদ্ধান্ত নেয়া হল আমরা পারিবারিক চোর হব।অর্থাৎ সবাই মিলে চুরি করতে যাব।তবে আমরা কেবল খাবার চুরি করব।
দাদি এতে আপত্তি জানাল।বলল-আমি পুলিশে ধরায়ে দিব।
এতে আমরা সবাই মিলে দাদিকে খেয়ে ফেললাম।কারন দাদি ছিল একটা গরু!
২.
চুরি করতে অনেক থ্রিল হয়।মজাও হয়।কিন্তু মা একবার ধরা পড়ে গেল।ফলে মা এখন জেল এ।
বাবা বলল-কোরিয়ানরা কুকুর খায়।চাইনীজরা সাপ,ব্যাঙ,তেলাপোকা খায়।আমরাও খাব।
বছর খানেকের মধ্যে তেলাপোকা ধরে ধরে খাওয়াতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেলাম।ফলে বাবা,মেউকা,লিনু,আমি আর বেবুন পাঁচজন মিলে একটা গ্রুপ খুললাম।যার কাজ কম টাকার বিনিময়ে বাসায় বাসায় গিয়ে সব তেলাপোকা খেয়ে ফেলা।এতে দুই পক্ষেরই দারুণ উপকার হত।
৩.
একদিন ঘুম ভেঙ্গে দেখি পাশের বাড়ি থেকে আমাদের দরজার নিচ দিয়ে ঈশ্বর আমাদের বাসায় আসল।এসে বলল-আমি ঈশ্বর।পাশের বাড়ির ধর্মগ্রন্থ থেকে বের হয়ে এসেছি।কারণ আমি লক্ষ করেছি তোমরা নিয়ম ভঙ্গ করে উল্টাপাল্টা আনন্দ করছো।রাত ভরে গান গেয়ে গেয়ে নাচো।দাদিকে খেয়ে ফেলেছো।চুরি করেছো।এগুলো ঠিক না।তোমরা মানসিকভাবে অসুস্থ।বিকৃত।
আমি বললাম-তাতে কি!আপনার নিয়ম মানতে হবে এরকম কোন কথা নাই।আমরা আপনারে বেইল দেই না।
লিনু বলল-কিন্তু আমি একটু একটু ভাল।আমার ভাল লাগে আপনারে।তাই,আমি আপনারে লাগাব।
-'মানে!লাগাবে মানে কী?' অবাক হয় ঈশ্বর।
-যেমুন গাছ লাগায় তেমনি!
ফলে ঈশ্বরকে লাগানো হল প্লাস্টিকের বালতিতে মাটি ফেলে।সুন্দর ফুটল ঈশ্বরের ফুল।কিন্তু ধার্মিকরা ঝামেলা করল।বলল,ঈশ্বরকে এক জায়াগায় লাগায় রাখা যাবে না।এই ঝামেলা মিটাতে আমরা সবাইকে একটা করে ঈশ্বরের ফুল দিতাম।এতে তারা ধন্য হত।
৪.
একদিন বেবুনকে দেখলাম অঙ্ক করছে।
বললাম-অঙ্ক করছ্ ক্যান?
বলল-মজা লাগতাছে।তুইও কর্!
আমিও খাব্লা দিয়ে পেন্সিল এনে যোগ বিয়োগ আর সহজ সহজ অঙ্ক করলাম।আমিও মজা পেলাম।
পৃথিবীর সব সংখ্যাকে বাক্সে ভরে আমি যখন তখন সেগুলোকে যোগ দিতাম আর বিয়োগ দিতাম।এতে মজার মজার ফল বের হত।
কিন্তু স্কুল ছেড়ে দেওয়ায় এটাও জানতাম না যে আমার যোগ-বিয়োগ গুলাও ভুল হচ্ছে।এমনকি বেবুনের শখের অঙ্কেও রয়েছে একগাদা ভুল।এইসব ভুলের কথা জানতে পারি মা জেল থেকে ফিরে আসলে।আমার আর বেবুনের খাতাগুলো নিয়ে বসে মা অঙ্কের ভুলগুলো বের করেছে আর দম ফাটিয়ে হেসেছে।
-হে হে হে!এগুলা কি!
আমি আর বেবুন ময়লা চুলে দাঁড়িয়ে থাকলাম।পরে সিদ্ধান্ত নিলাম যে,ব্যক্তিগত অঙ্ক কাউকে দেখানো উচিৎ না।
৫.
জীবনে একটার পর একটা প্যাঁচ লাগতেছে।
মেউকা আমাদের ছেড়ে তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে অন্য শহরে চলে গেল।এতে আমি,লিনু আর বেবুন থতমত খেলাম।বাবা বিটিভির আঁতেলদের মতো করে বলল-মেউকা বড় হয়ে গেছে।ওর একটা প্রেম ও যৌনতার জীবন থাকা সাভাবিক।
আমি,লিনু আর বেবুন মেউকার প্রেম ও যৌনতার জীবনকে নিজেদের মতো করে অভিশাপ দিলাম।
বড় প্যাঁচ লাগল,যখন বাবা-মা তাদের কারখানার কাজের জগৎ এ ফিরে গেল।নতুন একটা কারখানায় কাজ পেল।সারাদিন একঘেঁয়ে কাজ করে তাদের জীবনটা মাটি হয়ে গেল। আমাদেরও সেই জগৎএ যেতে বলল।কিন্তু আমি যেতে অস্বীকার করলাম।বললাম-তোমরা যেখানে যাচ্ছো পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ সেখানে গিয়েছে।পুরানো জায়গায় আমি যাব না।আমি এমন জায়াগার সন্ধান জানি যেখানে আগে কখনো কেউ যায় নি।
তাই তারা ভ্যান গাড়িতে করে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিল।লিনু আর বেবুন সস্তা ভ্যানে উঠতে অসম্মতি জানাল।ফলে তাদেরকে আমার পাশে দাঁড় করিয়ে রেখে ভ্যানটি কিরকির করতে করতে চলে গেল চোখের বাইরে!
....
৬.
আমার ঢিলঢিলে প্যান্টের পকেটে তখনো কয়েকটা ফ্রেশ তেলাপোকা ফড়ফড় করছিলো।
....
৭.
আমরা শহরের বিভিন্ন অংশে হাঁটলাম।কয়েক জায়গায় দৌড়ালাম।আর কয়েকটা দিন ফুরফুরে হাওয়ার ভিতর শুয়ে থাকলাম।
.......
৮.
মেউকা একদিন আমাদের জন্য একটা উপহার পাঠালো।বাক্স খুলে দেখা গেল সেটা একটা এয়ার ফ্রেশনারের বোতল।বোতলের গায়ে একটা নোট 'বাস্তবতার বোতল' ।নতুন জিনিস পেয়ে লিনু ,আমি আর বেবুন খাবলা-খাবলি করে যে যতটুকু পারলাম একে অন্যকে স্প্রে করলাম।কিন্তু কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম বাস্তবতার বিটলা গন্ধে আমার বমি আসছে!শুধু তাই না,নিঃশ্বাসও বন্ধ হয়ে আসছে।একসময় আমি হড়বড় করে বমি করে দিলাম!বাস্তবতার কাল ধোঁয়ায় ঘরের ভেতর থাকা যাচ্ছিল না।তাই লিনু আর বেবুনকে খামচি দিয়ে ধরে বাইরে নিয়ে আসতে গেলাম।কিন্তু কোথায় লিনু!কোথায় বেবুন!ওদের পুরানো কঙ্কাল ধূসর চাদর বিছানো বিছানায় খুঁজে পেলাম স্টেডিয়াম মার্কেট থেকে কেনা টর্চলাইটের সাহায্যে ।আমি পৃথিবীর সবাইকে চিৎকার করে ডাকলাম!কিন্তু রাতের শেয়ালদের ডাকের ভেতরে কেউ আমার চিৎকার শুনতে পারল না।
আমার রাগ লাগল মেউকার উপরে।অভিশপ্ত মেউকা আমার মেজাজ খারাপ করে দিল।ভ্রু কুঁচকে আমি গা ঝাড়া দিলাম।জামা-কাপড়ও ঝেড়ে নিলাম।
৯.
রাত অনেক গভীর হলে আমি বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম।এটা কমলালেবুর মতোন গোল এই পৃথিবীর একটা বারান্দা।আর আমার দুই চোখ বড় বড় করে দেখলাম,বয়ে যাচ্ছে সুখের পিছলা বাতাস !!

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




