সময় এসেছে বাঁধ ভেঙ্গে, দুর্গম পথ অতিক্রম করে নারীদের সামনে এগিয়ে চলার। একথা অনস্বীকার্য যে, সকল সফলতার পেছনেই থাকে শত বাঁধা-বিপত্তি আর অসম পথ। তেমনি নারী অগ্রযাত্রার ক্ষেত্রেও রয়েছে শত বাঁধা। তাই বলে তো আর উন্নতির ধারা থেমে থাকবে না। বাঁধাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে সামনের দিকে। ভয় কে জয় করে, নিজ শক্তিতে পাড়ি দিতে হবে কন্টকাকীর্ণ পথ।
তবে এই ভয় আর বাঁধা আমাদের নারী সমাজকে চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী করে রাখতে পুরোপুরি সক্ষম হয়নি। আমাদের বাংলাদেশের নারীরা আজ এভারেস্ট জয় করছে, রাজনীতিতে স্বমহিমায় ইতিহাস রচনা করছে। প্রথমবারের মতো নারী মেয়র নির্বাচিত হয়ে সুনাম কুড়াচ্ছে সারা বিশ্বের কাছে।
বাংলাদেশে নারী অগ্রযাত্রায় যদি মহীয়সী নারীদের নাম স্বরণ করি তাহলে চোখ বন্ধ করে স্বরণ করতে হয় আলোর পথ দেখানো বেগম রোকেয়া এবং বেগম সুফিয়া কামালকে। স্বপ্রতিভা আর নিজ মহিমায় নারীদের শত বাঁধা পেরিয়ে নিজ অধিকার আদায়ের জন্য সামনে চলার আহ্বান জানিয়ে গেছেন এই দুই মহীয়সী নারী।
রাজনীতি, অর্থনীতি, সাংবাদিতকার মতো চ্যালেঞ্জিং পেশাতে সন্তোষজনক হারে এগিয়ে রয়েছে আমাদের বাংলাদেশের নারীরা। ২০১২ সালের ৯ জুলাই বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত, দক্ষিণ এশিয়ার নারী সাংসদদের আঞ্চলিক সম্মেলনে, প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী বলেন, "২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ১৯ জন নারী সরাসরি নির্বাচিত হন ও ৪৫ জন সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন পান। বাংলাদেশের সাংসদদের ১৯ শতাংশ নারী। প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, সংসদ উপনেতা এবং গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করছেন নারীরা। সব মিলিয়ে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব বিকাশে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ ‘পাইওনিয়ার’ বা পথপ্রদর্শক।" (দৈনিক প্রথম আলো: ৯ জুলাই, ২০১২তে প্রকাশিত)
এদিকে, "বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ ২০১০-এ দেখা গেছে, দেশে পাঁচ কোটি ৪১ লাখ লোক কর্মরত রয়েছে। এর মধ্যে নারীকর্মীর সংখ্যা এক কোটি ৬২ লাখ, যা ২০০৫ সালের জরিপে ছিল এক কোটি ১৩ লাখ। এক দশক আগে পোশাক খাতে ১৮ লাখ শ্রমিক কাজ করত। এখন তা হয়েছে ৩৬ লাখ। আর এই শ্রমিকদের মধ্যে সব সময় ৮০ শতাংশের বেশি ছিলেন নারী শ্রমিক।" (দৈনিক কালের কন্ঠ পত্রিকায়, ২০১২ সালের ৮ মার্চ 'তৈরি পোশাক শিল্পে ৮০ শতাংশই নারীকর্মী' শিরোনামে, প্রকাশিত)। নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন সমসাময়িক কালের সবচেয়ে বড় অর্জনগুলোর একটি। কিছুকাল আগেও গদবাধাঁ কিছু কাজের মধ্যেই তারা আবদ্ধ হয়ে থাকতো। কিন্তু এখন সময় পরিবর্তন হয়েছে, নারীরা কর্মক্ষেত্রে নিজ পরিসরের বাইরে এসে তাদের মেধাকে প্রমাণ করছে। প্রচলিত কাজের বাইরে শুধু চ্যালেঞ্জিং কাজই নয়, চ্যালেঞ্জিং অনেক সিদ্ধান্তই আসছে নারীর কাছ থেকে এখন।
তবে নারীরা নির্ভয়ে শত বাঁধা পেড়িয়ে যেমন সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে তেমনি একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, বাংলাদেশে শিক্ষা ক্ষেত্রে এখনো নারীদের অংশগ্রহণ আশানুরূপ নয়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় লিঙ্গ বৈষম্য কেটে গেলেও নারীদের ঝরে পড়ার হার এখনো বেশি। এছাড়া উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ খুব একটা সন্তোষজনক নয়। "শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা বোর্ডগুলোর এক হিসাবে দেখা গেছে, চলতি মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে দুই বছর আগে নবম শ্রেণীতে নিবন্ধন করেও অংশ নেয়নি প্রায় সোয়া চার লাখ নিয়মিত শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ছাত্রীদের সংখ্যাই বেশি, অর্থ্যাৎ দুই লাখ ৫৯ হাজার ৯৮৭ জন। ছাত্রীদের ঝরে পড়ার হার ৩৪ দশমিক ৬৭, আর ছাত্রদের ঝরে পড়ার হার ২৩ দশমিক ৪২ শতাংশ। প্রাথমিক ও উচ্চমাধ্যমিকেও ঝরে পড়াদের মধ্যে ছাত্রীর সংখ্যা বেশি বলে গত কয়েকটি পরীক্ষায় প্রতীয়মান হয়েছে। শিক্ষা কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, মূলত আর্থসামাজিক কারণেই তারা ঝরে পড়ার তালিকায় নাম লিখিয়েছে।"(দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় ২০১১ সালের ৮ মার্চ প্রকাশিত)
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংবিধানে নারী-পুরুষের সমঅধিকার স্বীকৃত থাকলেও বিবেচনার বিষয় হলো যে তা কতখানি বাস্তবায়ন হচ্ছে! এছাড়াও, সংবিধানের ১০, ১৯ (১) এবং ২৮ (২) ধারায় জাতীয় জীবনের সকল স্তরে নারীর সমঅংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার রয়েছে। যদিও সমঅংশগ্রহণ সর্বক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয় না।
এছাড়াও ঘরে-বাইরে, কর্মক্ষেত্রে, গণ পরিবহণে প্রতিনিয়ত নানা নির্যাতন-নিপীড়ন, বৈষম্য আর লাঞ্ছনা-গঞ্জনার স্বীকার হচ্ছে নারীরা। "জাতিসংঘের হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট প্রতিবেদন অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই ধর্ষণের হার সবচেয়ে বেশি। সরকারি তথ্য অনুযায়ী ২০০১ থেকে ২০১২ সালের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশে সর্বমোট এক লাখ ৭৪ হাজার ৬৯১ জন নারী ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়। অতি সম্প্রতি জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি প্রদত্ত তথ্যে জানা যায়, বিগত এক বছরে দেশে ৩১৭ জন নারী ও শিশু খুন হয়েছে, যাদের মধ্যে অনেকেই ধর্ষিত হয়েছিল। এ ছাড়া ৮৮ জন নারী ও কিশোরী যৌন হয়রানি ও ইভ টিজিংয়ের শিকার হয় এবং নির্যাতনের মাধ্যমে প্ররোচিত হয়ে আত্মহত্যা করেছে ৪৭ জন। এ পরিসংখ্যান আংশিক হওয়া সত্ত্বেও এ ধরনের অমানবিক অপরাধের গতিধারা ঊর্ধ্বমুখী, তাতে সন্দেহ নেই। আমাদের দেশে চাঞ্চল্যকর কিছু ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হলেও তা মূলত সীমাবদ্ধ থেকেছে নারী সংগঠন বা স্থানীয় গোষ্ঠীর মধ্যে। সমাজের মূলধারা, বিশেষত সুশীল সমাজ ও রাজনৈতিক নেতৃত্বে এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়নি। সে কারণে বাংলাদেশে শক্তিশালী এবং প্রতিবাদমুখর নারী আন্দোলন গড়ে উঠলেও পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনৈতিক জবাবদিহির মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসেনি।" (দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায়, ২০১৩ সালের ০৩ জানুয়ারি, 'দিল্লি থেকে টাঙ্গাইল: কোথাও নিরাপদ নয় নারী' শিরোনামে প্রকাশিত)
এরপরও নারীদের সামনে এগিয়ে যেতেই হবে। সমাজের বেঁধে দেওয়া নির্দিষ্ট বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নিজের অধিকার নিজেকেই বুঝে নিতে হবে। নারীর বিরুদ্ধে সকল সহিংসতার প্রতিবাদ নারীকেই করতে হবে। সমঅধিকার ও সর্বস্তরে সমঅংশগ্রহন বাংলাদেশে একদিন নিশ্চত হবেই। এ লক্ষ্যে সকলকে সজাগ থাকতে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মার্চ, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:০৮