মা,
কেমন আছ ? আজ অনেকদিন পর তোমাকে লিখছি । তোমার মনে আছে ছোটবেলায় আমি কেমন লাজুক স্বভাবের ছিলাম !খুব সম্ভব তখন আমি ক্লাশ ফাইভে পড়ি আমাকে ক্লাশের ছেলেমেয়েরা কিছু একটা বলে ক্ষেপিয়েছিল আমি বাসায় এসে সেকি কান্না কিছুতেই বলছিলাম না কি হয়েছে ! তুমি কত কষ্ট করে আমার মুখ থেকে রহস্য টা বের করে স্কুলে নালিশ নিয়ে যেতে চেয়েছিলে !আমি যেতে দেইনি তোমাকে । এমন ভীতুর ডিম আর লাজুক ছিলাম আমি । এমন প্রায়ই হতো আমার ! তুমি জানতে ও না । আজ ফোবি কে দেখে আমার সে ই সব দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। এই তো আমি । আমার ও তো এমন পরিণতি হতে পারতো ।ভাগ্যিস তখন ফেসবুক , হাতে হাতে মোবাইল ফোন টেক্সট মেসেজ পাঠানোর সুযোগ ছিলনা । ও তোমাকে তো বলাই হয়নি ফোবি কে ?ফোবি, আমেরিকার ম্যসাচুসেটস শহরের সাউথ হাডলী হাই স্কুলের ছাত্রী । বয়স ? মাত্র ১৫ বছর । কি করেছে ? আত্মহত্যা । অতটুকুন মেয়ে সহপাঠীদের তির্য্ক বাক্য বাণে অতিষ্ঠ হয়ে এ বছর ২০১০ সালের জানুয়ারী মাসের ১৪ তারিখ এমন সাংঘাতিক একটা কাজ করে ফেলল । একদিন আর দুদিন নয় তিন তিন টি মাস ধরে ই চলছিল এই অত্যাচার । মানুষের মুখের কথা যে কতটা বিষাক্ত হতে পারে ! এক চন্চ্ঞল কিশোরী যার দুচোখ জুড়ে স্বপ্ন থাকার কথা জীবনের সিঁড়িতে পা না দিতেই সে পড়ে গেল পা পিছলে । মেযেটি চেষ্টা করেনি তা কিন্তু না ।বাঁচতে কে না চায় বলো ! ডুবন্ত মানুষ খড়কুটো পেলে ও জড়িয়ে ধরে । ও ও ঠিক তেমনি গিয়েছিল স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে জানুয়ারী মাসের ৭ তারিখ । কাজ হযনি ।এমনকি যেদিন এ ঘটনাটি ঘটলো সেদিন সকালে লাইব্রেরীতে শিক্ষকদের সামনে ই ঘটেছে মৌখিক নির্যাতন ।বন্ধুদেরকে বলেছে স্কুল দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে ।এভাবেই ১৪ তারিখে তার নি:সার দেহ ঝুলে থাকতে দেখা গেল তার এপার্টমেনেটর সিঁড়িতে । কী করুণ । ওর মার কথা একবার ভেবে দেখ । ১২ বছরের ছোট বোন যে কি না প্রথম দেখতে পেয়েছিল ফোবির দেহ ।মাত্র সেদিন, ২০০৯ সালে ওরা আমেরিকাতে এসেছে । ওরা অভিবাবকরা ওকে এদেশে আর রাখেনি চিরদিনের জন্য আইযারল্রান্ডের মাটিতে নিয়ে রেখে এসেছে । একটি সভ্য দেশে এ কী অবস্থা ! ঠিক আমাদের দেশের মতই তো তা ই না মা? না । একটু ভুল হলো । আমাদের দেশে বখাটেদের অত্যাচারে যখন মানুষ মারা যায় তখন কি বিচার হয় ? নাকি পেশীর জোরে পার পেয়ে যায় ? এখানে কি ন্তু বিচার হযেছে তদন্ত বিচার কিছুই বাদ যায়নি । স্কুলের অভিভাবকরা মিলে একটি কমিটি গঠন করেছেন যেন ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে তার জন্য ।
কিন্তু কেন এমন হয় ? কেন আমরা একে অন্যকে নিয়ে মজা করতে পছন্দ করি ?আমরা কি আমাদের বাচ্চাদের ছোটবেলা থেকেই শিখাতে পারি না নিজেকে এবং অন্যকে সন্মান করতে? তবে হ্যাঁ । আমরা বড়রা ও অনেক সময় বাচ্চাদেরকে নিয়ে ’মজা’ করতে পছন্দ করি । সেটা খুবই সাংঘাতিক । প্রথমত : ওই কচি বয়সেই ওর মধ্যে হীনমন্যতা এসে ভর করে । আর অন্যকে ছোট করে মজা কুড়াণোটা এক স্বাভাবিক অভ্যাসে পরিণত হয় । একটি সুন্দর অনুভূতির মৃত্যুই একটি কৌতুকের জন্ম দেয় ।
আমার কানে আজও বাজে ফোবির মায়ের কান্না । সাথে সাথে সেই সব অভিযুক্তদের অভিভাবকদের অপরাধবোধ ও হতাশা । ওরা ও কি ফেলেনি দু এক ফোঁটা অশ্রু ফোবির জন্য ? যেখানেই থাক ,যতদূরে থাক ফোবি শান্তিতে থাক ।
পৃথিবীর কোন প্রান্তেই যেন জন্ম না হয় আর কোন ফোবির । আমাদের দেশে পথে ঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে হাজারো ফোবি । আজে বাজে উক্তি তো ’ভাত মাছ’- ছেলেরা তো অমন বলবেই-এটাই স্বাভাবিক ধরে নেয়া হয় । শুধু কি তাই ওড়ণা ধরে টান দেয়া, গায়ে হাত দেবার মত জঘণ্য অপরাধ ও ঘটছে অহরহ । মেয়েগুলোর কি অস্বাভাবিক ধৈর্য্ । কেমন নিরবে সহ্য করে যায় । প্রতিবাদ করার কথা ভেবে ও দেখে না । কেন? মান সন্মানের কথা ভেবে । একটি ছেলে তার বালক বেলা থেকেই জেনে যায় তার পৌরষত্বের দাপট। ’তার গায়ে কোন কাদা লাগবে না ‘ আর একটি মেয়ে যেন তার জন্ম লগ্নেই জেনে যায় তার অসহায়ত্বের কথা । সে যে ’মেয়ে মানুষ’ -’যত দোষ নন্দ ঘোষ ‘ । বখাটেদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ মেয়েটি বেছে নেয় আত্মহননের পথ ।কেন? পরিবারের মান সন্মানের কথা ভেবে । এই ’মান সন্মান’ আসলে কি? সামাজিক মূল্যবোধ । বখাটে ছেলের ও পরিবারের মান সন্মান ঠিকই থাকে । ভেবে দেখ মা, ওই মেয়েটি কি আমি হতে পারতাম না ? কেমন লাগতো তোমার ? হতে পারতো সমাজের যে কারো সন্তান । যাদের কাছে সন্মান হারাণোর ভয়ে, ভ্রুকুটির ভয়ে পালিয়ে বেঁচেছে ও । অমন মান সন্মান বড় না মেযের জীবন বড়? আমার তো মনে হয় আমাদের ও সময় এসেছে বিষযটির দিকে নজর দেবার । বখাটে দের দমন তো করতে ই হবে সাথে সাথে মূল্যবোধের পরিবর্তণ্ । ন্যায় অন্যায় এর মাপকাঠি ছেলে মেয়ের জন্য আলাদা হওয়া উচিত নয় । এসো আমরা সবাই মিলে এখন ই ছোট ছোট মেয়েগুলোর কানে কানে বলি --’আমি তোমাকে ভালোবাসি । আমি গর্বিত তোমার জন্য । তোমার মুখের হাসি ই আমার পৃথিবী ।তুমি অসুন্দরকে ভয় পেওনা । এসো আমরা সবাই মিলে অশুভর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই ।”
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মে, ২০১০ রাত ১০:৫৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




