বাবা,
কেমন আছ?
এখন কটা বাজে জান? আনেক রাত । প্রায় দুটো বাজতে চলল । আমেরিকান রা বলবে টু এ. এম. ইন দ্যা মর্নিং । একটা গ্রাজুয়েশন পার্টি ছিল । প্রবাসী বাবা মায়ের জীবনে সব চেয়ে আনন্দের দিন গর্বের দিন । । কত কষ্টের বিনিময়ে এ বিদেশ বিভুঁই এ স্বপ্নের দেশে স্বপ্ন পুরণের ,সফলতার আনন্দ । তুমি হয়তো ভাবছ , কি এমন ঘটলো পার্টিতে ! এতটুকু অপেক্ষা করডত পারলোনা আমার মেয়ে! এইতো সেই পুরাণো গদ বাঁধা কাহিনি ।,শাড়ী গয়না পড়ে পার্টিতে যাওয়া , গল্প গুজব , খাওয়া দাওয়া খুব বেশী হলে গান বাজনা ।এ আবার নতুন করে শোনার কী আছে ? আছে বাবা আছে । আজ একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে । । আজ একটি বাচ্চা মেয়ে আমার চোখ খুলে দিয়েছে । আমার ভিতর থেকে নতুন এক সত্বাকে বের করে নিয়ে এসেছে । ও যখন হাঁটছিল, ’হাঁটছিল’ শব্দটি ঠিক হচ্ছেনা । সারা ঘরময় ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছিল , ঠিক যেন একটি ছোট্ট প্রজাপতি । উড়তে উড়তে ক্লান্ত হলে এ ডালে এ ফুলে জিরিয়ে নিচ্ছে কিছুক্ষণ । নানীর কোলে মামার কোলে বাবার বুকে । ছুটতে ছুটতে এক ফাঁকে আমার পাশে এসে বসল ।বোধ হয় টের পেয়েছে আমার আকর্ষণ । । একটি পা খোড়া । প্রস্থেটিক বা কৃত্রিম পা লাগানো হয়েছে ।ঝাঁকড়া চুল দুলিয়ে কি সুন্দর পরিপাটি ফুটফুটে একটি মেয়ে আমার পশে বসে আছে । কিন্তু বিশ্বাস কর আমি দেখতে পাচ্ছি একটি অসহায় মানব শিশু- বিকলান্গ, কোথা থেকে এসেছে কোথায় যাবে কিছুই জানে না ।ভিক্ষার থালা নিয়ে বসে আছে রাস্তার পাশে ।ফুটপাতে কুকুরের সাথে এক পাতে এক বিছানায খাচ্ছে ঘুমাচ্ছে । রোদে বৃষ্টিতে অনাহারে অর্ধাহারে ।কিম্বা শিকার কোন বিকৃত যৌণ লালসার ।
ভাবছ আমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে ? না বাবা । মাথা এখন ও ঠিকই আছে । ছ মাসের একটি শিশুকন্যাকে যখন দুস্কৃতিকারীরা ধরে নিয়ে যায় আর কোন কারণে মালবাহী ট্রেন থেকে লাফিযে পড়ার সময় ট্রেনের নীচে পড়ে শিশুটির পা কাটা যায় --তার পরিণতি তো এমনই হবার কথা !ভুল বল লাম ? ওর ক্ষেত্রে একটু ভিন্ন । ’রাখে আল্লাহ মারে কে ?’দুষ্ট লোকগুলো চলে গেলে ও গ্রামবাসী ওকে সাহায্য করেছে । চিকিতসা দিয়েছে পা দিয়েছে জীবন দিয়েছে থাকা খাওয়ার জন্য ঢাকা শহরে একটি ‘।’এতিম খানা’র ও ব্যাবস্থা করা হয়েছে ।ওর বাবা মাকে খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে ।কী জানি হয়তো ওরা বেঁচে ই নেই ।
সমাজে সবাই হায় হায় করেছে । সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সবাই । কিন্তু কেউ এসে বলেনি । আয় মা বুকে আয় । আমার চোখের তারা হয়ে থাক । আমার আঁচলে তোর ঘাম মুছাব , গান শুনিয়ে ঘুম পড়াব , পরীর দেশের ঠিকানা দেব ,কোন এক রাজ কুমারের স্বপন দেব । দেশে জনসংখ্যা এখন কত কোটি বাবা ?কেউ বলেনি ।কেউ না । এটা যদি আমেরিকায় হতো । ঘটনা টি সম্পূর্ণ্ অন্য রকম হ’তো ।এমন কি হাইতির সেই ভূমি কস্পের পর বিধ্বস্ত বাচ্চাগুলোকে ভালোবেসে দত্তক নেবার জন্য আমেরিকানদের সে কি আকুতি মিনতি । শিশুর কান্নায় কার না মন কাঁদে । তবু ও যে কোন কারণেই হোক আমাদের সংস্কৃতিতে দত্তক গ্রহণ এখন ও তেমন ভাবে প্রচলিত নয় ।
এই যে বাচ্চা মেয়েটির কথা বললাম ওর বয়স প্রায় পাঁচ হবে এখন। দু বছর ধরে আমেরিকার এই আটলান্টাতে ই আছে । আমেরিকা প্রবাসী এক বাংলাদেশী পরিবার ওকে দত্তক নিয়ে এসেছে । ওর মার কাছেই শুনলাম বাংলাদেশে ওরা এই বাচ্চার বাবা মা হতে পারেনি ।হয়েছে আইনানুগ অভিভাবক । এটাই বাংলাদেশের আইন ।এ আইন অনুযায়ী পালিত সন্তান কখনোই নিজের সন্তানের মত উত্তরাধিকারের অধিকার পায়না । ওরা যখন এখানে এসে কোর্টে গিয়ে মেয়েটির বাবা মা হ’লো সে এক অদ্ভুত অনুভূতি ! ঠিক ন বছর আগে ওর প্রথম সন্তান যখন ওর কোলে এসেছিল ঠিক তেমন । পার্থক্য শুধু একজন এসেছে হাসপাতালের বেডে আর একজন জাজের অফিসে ।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার কী জান । মা টি কেমন গর্ব্ করে বলছে -- ‘ও দেখতে ঠিক আমার মত । য়েখানে যাই সবাই বলে । ছোট বেলায় ওর মত বয়সে তোলা আমার একটি ছবি আছে ঠিক একই ভাবে ওর ও তুলেছি । বিশ্বাস করবে না মনে হচ্ছে একই ছবি । সেই মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুল, সেই হাসি ।’ এমন করে ও অনেক কিছুই বলে গেল এক নি:শ্বাসে । আর আমি শুনছি ওর চোখে মুখে অনুভবে চেতনায় শুধু একটিই কথা ’ও আমার ও আমার ’। ।আমি আমেরিকানদের মধ্যে ও ঠিক একই জিনিস দেখেছি । আমার এক সহকর্মি একবার চিন থেকে একটি মেয়ে নিয়ে এসেছিল । আমেরিকান মা আর চাইনিজ মেয়ে । মিল কিভাবে হবে বল । কিন্তু ঠিকই খুঁজে বের করেছে । চুলে মিল, হাতের আঙুলে মিল স্বভাবে মিল এমন কত কি ! ওই একই সুর ‘ও আমার ও আমার । বিধাতা , এ মহাবিশ্ব ,ওকে পাঠিয়ছে শুধু আমার ই উত্তরসুরী করে , শুধু আমার ই জন্য ।” চিরন্তন বাবা মা এর অনুভূতি ।
আমেরিকার ঘরে ঘরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ছেলেমেয়ে আছে ।ঘর হারা শিশুগুলো ঘর পেয়েছে , পেয়েছে চিকিতসা শিক্ষা আলো সর্বোপরি বাবা মা ভাইবোন ,পরিবার ।সিনেটর ম্যাককেইনের কথা মনে আছে তোমার ? ওই যে ২০০৮ এর অমেরিকার প্রেসিডেন্ট ইলেকশনে রিপাবলিকান পার্টি থেকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ছিলেন । ওঁদের ছোট মেয়েটি কিন্তু বাংলাদেশী ।খুব ছোটবেলায় তিন মাস কি ছ মাস বয়স হবে তখন থেকে পালিত কন্যা হিসেবে ম্যাককেইন পরিবারের একজন হয়ে আছে সে ।মা সিন্ডি ম্যাককেইনের সাথে বাংলাদেশে গিয়ে ঘুরেও এসেছে । তুমি ভাবছ ,এখানকার ঘরে ঘরে নিম্চয়ই আরো অনেক বাংলাদেশী শিশু আছে । রাস্তা ঘাটে এত টোকাই , এত এতিম খানা ! আসলে কিন্তু মোটেই তা নয় । ১৯৯৮ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত এখানে চিন থেকে শিশু এসেছে ৬৩৮৯৪ জন আর বাংলাদেশ থেকে এসেছে মাত্র ১০৪ জন ।
ভাবছ , আমেরিকানরা বাংলাদেশদকে ভালোবসেনা বা সুযোগ দিতে চায়না । ঘটনাটি উল্টো । বাংলাদেশ ই সুযোগ নিতে চায়না বা দিতে চায়না । তা তুমি এটাকে যেভাবে দেখ । বাংলাদেশ থেকে বাচ্চা দত্তক নিতে চইলে ’বাংলাদেশী’ হতে হবে । বাংলাদেশী আমেরিকানদের দ্বৈত নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে হয় । অবশ্য সম্ভাব্য বাবা মার একজনার বাংলাদেশী পাসপোর্ট্ থাকলেই চলে । অন্য জন য়ে কোন দেশের পাসপোর্ট্ ধারী বা বংশোদ্ভুত হতে পারে । ব্যাপারটি আমার কাছে খুবই অযৌক্তিক মনে হয়। নিশ্চয়ই আমরা আমাদের সংস্কৃতিকে লালন করার জন্য এমনটি করছি না । বাবা কিম্বা মা এখানে অন্য সংস্কৃতির হতেই পারে । আর নিরাপত্তা? এটা হলো এক্ষেত্রে সবচেয়ে হাস্যকর যুক্তি আমার কাছে । কেননা আমেরিকাতে যখন একটি শিশু বাবা মার সন্তান হয়ে আসে সে আমেরিকান ‘গ্রিন কার্ড’ নিয়েই ঢোকে ।আমেরিকান সরকারের দায়িত্ব সে । তাই এখানে একজন বাবা মা একটি বাচ্চা পালক নিতে চাইলে বহু পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হয় । মানসিক শারীরিক, অথনৈতিক সামাজিক ।এটাকে বলা হয় ‘হোম স্টাডি’ ।যারা কিনা সমস্ত কাগজ পত্র জমা দেবার পর ও তিন তিন বার ভিন্ন ভিন্ন বৈঠকে মৌখিক পরীক্ষা বা সাক্ষাতকার নিয়ে থাকেন সমভাব্য বাবা মা এর এফ বি আই সহ দু দুবার ফিংগারপ্রিন্ট নেয়া হয় ।এত কিছুর পর ইমিগ্রেশন আবেদন মন্জুর করে ।মূলত সেই হোমস্টাডি রিপোর্ট্ আর ইমিগ্রেশনের দেয়া কাগজটির উপর ভিত্তি করেই পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এমনকি বাংলাদেশ থেকে ও বাচ্চা পালক নেবার অনুমুতি দেয়া হয় । তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ব্যাতিক্রম হলো প্রার্থীকে আবশ্যই বাংলাদেশী পাসপোর্ট্ ধারী হতে হবে ।আর হ্যাঁ এন.ও.সি (নো অবজেক্শন সার্টিফিকেট ) দেবার সময় স্বরাষট্য মন্ত্যণালয় একটি পুলিশ রিপোর্ঠ করে। সেটা যে কেমন রিপোর্ট তা তুমি জান । যে আমেরিকাতে ই স্থায়ীভাবে থাকে । আমেরিকান সিটিজেন এবং সেখানেই তার পুলিশ রিপোর্ট , ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করা হয়ে গিয়েছে । বাংলাদেশে কোন কিছু পাওয়ার ও কথা না । শুধুই লৌকিকতা। আবার সেই পুরাণো কাসুন্দি -আমেরিকার রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই অনুমুতি দেয়া । তোমার কি ধারণা আমেরিকান হোমস্টাডি কিম্বা ইমিগ্রেশন সব দেশীয় বংশোদ্ভুত আমেরিকানদের জন্য একইভাবে কাজ করে না? তাই আমরা যদি শুধুমাত্র বাংলাদেশী আমেরিকান দের কে বাবা মা হবার সুযোগ না করে দিয়ে অন্যান্য আমেরিকানদের জন্য ও এ উন্মুক্ত করতাম এ সুযোগ কী এমন ক্ষতি হত ! আমি শুনেছি বাংলাদেশের খারাপ অভিগ্ঞতা হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশের সাথে । সে সব দেশের নিয়মকানুন সম্পর্কে আমার ধারণা নেই । আমি শুধু আমেরিকার কথা বলছি । আমার খুব ভালো লাগত যদি প্রতিবার দেশে গিয়ে এসব, অনাহারী লান্চিঞত বন্চ্ঞিত শিশু ও শিশু শ্রমজীবি না দেখে বরং আমেরিকার স্কুল কলেজে খেলার মাঠে ওদের হাসিমাখা মুখগুলো প্রতিদিন দেখতে পেতাম।
এরপরে যা শুনলাম সে তো আরো ভয়াবহ ।শুধু মাত্র বাংলাদেশীরা গ্রহণ করতে পারবে এখনেই কাহিনীর শেষ নয় ।মুসলিম বাবা মা হিন্দু বাবা মার সন্তান বা অন্য কোন ধর্মজাত সন্তানকে পালক হিসাবে কিম্বা হিন্দু ধর্মালম্বীরা মুসলিম কিম্বা খ্রীষ্টান ধর্মের মানব সন্তানকে দত্তক নিতে পারবেনা ।অর্থাত পালক বাবা মা এর ধর্ম ও জন্মদাতা বাবা মা এর ধর্ম্ এক হতে হবে । এতে করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে না?আইন করে এমন কিছু বাধ্যতা মূলক করা কি দত্তক প্রথাকে অনুতসাহিত করার ই আর এক নাম নয়? একটি শিশুর আবার ধর্ম্ কি? শৈশব । অদর ভালোবাসা বাবা মা । কোন ধর্মের দোহাই দিয়ে আমরা তার শৈশব তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিচ্ছি ?। তা ছাড়া একটি শিশুকে যখন কোথাও কুড়িয়ে পাওয়া হয় তখন তার ধর্ম্ কোন নীতিমালা বা আইন দিয়ে নির্ধারণ করা হয় আমার জানা নেই ।আমরা নিজেদেরকে ’সেকুলার ‘ বলে দাবী করি । সেকুলার শব্দের অর্থ্ ধর্ম্ নিরপেক্ষতা নয় । রাষ্ট্রকে ধর্ম্ থেকে আলাদা করার নাম ই সেকুলারিজম । কিন্তু এখন ও ’শরীয়া’ অনুযায়ী চলে আমাদের পারিবারিক আদালত ।মনটা খুবই খারাপ এসব ভেবে ।তোমাকে লিখে কিছুটা হাল্কা লাগছে ।
আমার মত আমাদের প্রতিটি শিশুর হোক একটি মা দিবস বাবা দিবস । এ ই হোক আমাদের এবারের বাবা দিবসের অংগীকার ।
ভালো থেকো
অটলান্টা
জুন ১, ২০১০ ।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




