somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার প্রিয় প্রাণীরা: কুকুর

২৬ শে অক্টোবর, ২০১৩ সকাল ৮:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আগের পর্বটি পড়তে চাইলে: আমার প্রিয় প্রাণীরা: হাতি

(২) কুকুর:

ছোট বেলায় আব্বুর কাছে একটি গল্প শুনতাম। কুকুরের প্রভুভক্তির ওপর গল্প, আমার ধারণা আপনাদের অনেকেরই গল্পটি জানা। এক লোক জাহাজ থেকে নদীতে পড়ে গিয়েছে। প্রবল স্রোতের মাঝে কেউই সাহস করে তাকে উদ্ধার করতে যাচ্ছেনা। এমন সময় পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার পোষা কুকুর। প্রবল স্রোতের প্রতিকূলে প্রাণপণ সাঁতরে কূলে নিয়ে আসল মনিবকে। কিন্তু প্রানান্তকর ক্লান্তিতে অবসন্ন কুকুরটি নিজেই প্রাণত্যাগ করল।

আমার বাবা বা মা যে খুব ভাল গল্প কথক ছিলেন তা নয়। তবে চঞ্চল প্রকৃতির সন্তানকে ঘুম পাড়ানোর সুতীব্র প্রয়োজনে এর চেয়ে কার্যকরী আর কোন মহৌষধ তাঁদের হয়ত জানা ছিলনা। ভান্ডারে যেহেতু খুব বেশি গল্পের পুঁজি সঞ্চিত ছিলনা, তাই একই গল্প ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শোনাতে হত। তার ফলশ্রুতিতে কুকুরের এ গল্পটিও আমার বেশ অনেকবার শোনা হয়ে যায়। আর সেই শৈশব থেকেই নিজের অজান্তে প্রাণীটির প্রতি এক ধরণের মমত্ববোধ জন্মে যায়।

শুধু সাঁতার কিম্বা প্রভুভক্তি নয়, কুকুরের রয়েছে দারুন কিছু সহজাত প্রবৃত্তি যা মানুষের জন্য খুব দরকারী। যেমন, দিনে ঘুমিয়ে রাতে পাহাড়া দেওয়া, গন্ধ শুঁকে শত্রু-মিত্র বা বিপদাপদ নির্ণয় করা, ইত্যাদি। শুনেছি তারা নাকি মনিবের ঘামের (বা ঘামের সাথে মিশে থাকা হরমোনের) গন্ধ শুঁকে তার মনোভাব ধরতে পারে। বিবিসি হরাইজনে দেখেছিলাম কুকুর কিভাবে মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে তার আবেগ বুঝতে পারে।

মানুষ তার অবচেতনে আরেকজন মানুষের বাম চোখের দিকে তাকায়, কারণ বাম চোখের মধ্যেই মানুষের আবেগ সবচেয়ে পরিষ্কার ধরা পরে। কুকুর হল সেই অল্প সংখ্যক প্রাণীদের একটি যারা মানবীয় আবেগের এই প্রাকৃতিক গুপ্ত তথ্যটি জানে। হাইস্পীড ক্যামেরায় পর্যবেক্ষণ করে দেখা গিয়েছে যে কুকুর যখন মানুষের দিকে তাকায় সে অত্যন্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণের জন্য মানুষের বাম চোখের দিকে তাকায়, এবং তার মনোভাব বোঝার চেষ্টা করে।

শুধু তাই নয়, এমনকি নানা জটিল রোগ নির্ণয়েও কুকুরের করিতকর্মতার প্রমান পাওয়া গিয়েছে। শুনলে অবিশ্বাস্য মনে হবে তবু সত্যি যে কুকুর ক্যান্সার, হৃদরোগ, মৃগীরোগ, বহুমূত্র, নারকোলেপ্সি সহ আরো নানা রোগ খুব প্রথমিক অবস্থাতেই সনাক্ত করতে পারে। এখানে কোন অলৌকিক ক্ষমতা কাজ করেনা, বরং চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং জৈবরসায়নের খুব বেসিক কিছু মেকানিজম এখানে ক্রিয়াশীল। এসব রোগ হলে এক ধরণের সাইটোকেমিকেল বা মানব কোষ থেকে বিশেষ রাসায়নিক পদার্থ রক্তের সাথে মেশে। কুকুর তার অসাধারণ ঘ্রাণশক্তির বদৌলতে এই রাসায়নিক পরিবর্তনকে অনেক আধুনিক ডায়াগনোস্টিক টেস্টের আগেই সনাক্ত করতে পারে।


ছবি: ক্রীড়া প্রিয় কুকুর

যাইহোক, কথাগুলো শেয়ার না করে পারলাম না বলে লিখলাম; কিন্তু সিরিজটির উদ্দেশ্য কিন্তু প্রাণীবিজ্ঞানের জ্ঞান দেওয়া নয়। বরং লেখাটির মূল উদ্দেশ্য ছিল আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে প্রাণীগুলো আমার অনুভূতির তন্ত্রীতে কি অনুনাদ সৃষ্টি করে তা পাঠকের সাথে শেয়ার করা। সেখানে ফিরে যাচ্ছি।

আমার পড়াশুনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে পছন্দের বিষয় হল ইতিহাস এবং নৃতত্ত্ব। এ বিষয়ে টুকটাক পড়াশুনা করতে গিয়ে দেখেছি কুকুর প্রাণীটি কি অনবদ্যভাবে মানুষের ক্রমবিকাশের ইতিহাসের সাথে নিজেকে পরম মমতায় জড়িয়ে রেখেছে। মানুষ যখন গুহাবাসী তখন কুকুর তার গুহা পাহাড়া দিয়েছে হিংস্র প্রাণী এবং শত্রুর আক্রমণ থেকে তাকে রক্ষা করতে। মানুষ যখন শিকারী জীবন শুরু করেছে তখন কুকুর তার ঘ্রাণশক্তি কাজে লাগিয়ে শিকার খুঁজতে সাহায্য করেছে। মানুষ যখন পশুপালন শিখেছে কুকুর তখন দুম্বার পালকে নানা দিক থেকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে নিয়ে এসে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেছে। শীত প্রধান অঞ্চলে কাঠের স্লেজ টেনেছে অকুণ্ঠচিত্তে। আর এখন, যখন মানুষ যন্ত্রের কল্যাণে সব কিছুতেই স্বয়ংসম্পূর্ণ, যখন কার্যত কুকুরের আর কোন ভূমিকা থাকার কথা নয় আধুনিক মানুষের দিনানুদৈনিকতায়; তখনো আশ্চর্য হয়ে দেখি এই আদি অকৃত্রিম বন্ধুটি ঠিকই মানুষের জীবনে তার নিজের অবস্থানকে ধরে রেখেছে। শুধু ধরেই রাখেনি, বরং আরো সুসংহত করেছে।

দু'বছর যাবত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছি। এমন একটি দিন নেই যেদিন লিফটের দরজা খুলতেই একটি আঘ্রাণোন্মুখ আদুরে সারমেয়র মুখ না দেখি। এদেশের বৃদ্ধদের একাকী জীবনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সঙ্গী হয়ে উঠেছে কুকুর। এমনকি অনেক তরুণ তরুণীকেই রোজ দেখি কুকুর সাথে নিয়ে জগিং করতে। এতে তাদের শরীর ভাল থাকে; এমনকি পরিসংখ্যানগত দিক থেকে নাকি কুকুরপালনকারী মানুষের গড় আয়ু অন্যান্যদের চেয়ে উল্লেখযোগ্য হারে বেশি।

কয়েকটি মজার ট্রিভিয়া দিয়ে শেষ করব সারমেয় পর্ব [বাই দা ওয়ে, 'সারমেয়' মানে কুকুর :D]।

১। কুকুর মানুষের অতি প্রিয় এবং আপন প্রাণী হলেও এর পূর্বপুরুষ কিন্তু মানুষের অত্যন্ত অপছন্দের একটি প্রাণী- নেকড়ে।

২। বর্তমানে যে পোষা কুকুরের জাত আমরা দেখি তাকে পোষ মানানোর সূত্রপাত হয়েছিল আজ থেকে ১৫,০০০ বছর পূর্বে (মতান্তরে ৮,৫০০ বছর, হু কেয়ারস :) ), সাইবেরিয়া অঞ্চলে।

৩। কুকুর একরকম বর্ণান্ধ বা কালার ব্লাইন্ড; সে কেবল হলুদ এবং নীল রঙ দেখতে পারে। কিন্তু ভিজুয়াল ডিসক্রিমিনেশন অনেক উচ্চ হওয়ায় সে গতিশীল বস্তু মানুষের চেয়ে অনেক ভালভাবে সনাক্ত করতে পারে। সেজন্যই ছুঁড়ে দেয়া ফ্রিজবি বা বল তারা সহজেই মুখে ধরে মনিবের কাছে বয়ে নিয়ে আসে। মূলত: তারা গতিশীল বস্তুকে অনেকটা স্লো মোশনে দেখতে পায়।

৪। কুকুরের মস্তিষ্কের সাইজে মানুষের মস্তিষ্কের চেয়ে অনেক কম হলেও তাদের মস্তিষ্কের ঘ্রাণ সঙ্ক্রান্ত অংশটি এতটাই শক্তিশালী যে মানুষের চেয়ে তাদের ঘ্রাণশক্তি ১০ কোটি গুণ বেশি।

৫। ফাইনালি, বাংলাদেশের একটি প্রজাতির কুকুর বেশ বিখ্যাত, যাকে বলে Sarail Hound বা সরাইলের কুকুর। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলায় প্রাচুর্যপূর্ণ এ প্রজাতিটিকে আরবের শিকারি কুকুরের সাথে গ্রেহাউন্ড, বন্যকুকুর, এবং হয়ত অন্য কোন ইউরোপীয় প্রজাতির (পরবর্তীকালে মিশ্রিত) এক ইউনিক বা অনন্য মিশ্রণের ফলে উদ্ভূত বলে ধারণা করা হয়।


ছবি: সরাইল হাউন্ড

কুকুরের অনেক গুণের কথা হল। খুঁজলে হয়ত কিছু দোষও বের করা অসম্ভব নয়। কিন্তু কুকুরের যে গুণটি তাকে মানুষের এত কাছাকাছি এনেছে এবং সহস্র বছর মানুষের জীবনের সাথে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ করেছে তা হল কুকুরের অসাধারণ বন্ধুভাবাপন্নতা, তার অপরিসীম বিশ্বস্ততা, এবং বুদ্ধিমত্তা। চিন্তা করে দেখুন, সামান্য একটু মমতা, ক্ষুধায় একটু খাবার প্রাণীটিকে কেমন কৃতজ্ঞ করে রাখে। এমন বন্ধু আর কে আছে যে নিজের জীবনকে পর্যন্ত বাজি রাখতে কার্পণ্য করেনা। আমাদের হৃদয়হীন নির্লিপ্ত বিযুক্ততার এই কালবেলায় কুকুরের কাছ থেকে তাই আমাদের অনেক কিছু শিক্ষণীয় আছে।


অসাধারণ একটি ডকুমেন্টারি: দা সিক্রেট লাইফ অফ ডগস।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে অক্টোবর, ২০১৩ সকাল ৯:১৬
৭টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেনারসী রঙে সাজিয়ে দিলাম চায়ের আসর=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫২



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনে কি পড়ে সেই স্মৃতিময় সময়, সেই লাজুক লাজুক দিন,
যেদিন তুমি আমি ভেবেছিলাম এ আমাদের সুদিন,
আহা খয়েরী চা রঙা টিপ কপালে, বউ সাজানো ক্ষণ,
এমন রঙবাহারী আসর,সাজিয়েছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজ্ঞানময় গ্রন্থ!

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪২

একটু আগে জনৈক ব্লগারের একটি পোস্টে কমেন্ট করেছিলাম, কমেন্ট করার পর দেখি বেশ বড় একটি কমেন্ট হয়ে গেছে, তাই ভাবলাম জনস্বার্থে কমেন্ট'টি পোস্ট আকারে শেয়ার করি :-P । তাছাড়া বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

অস্ট্রেলিয়ার গল্প ২০২৪-৪

লিখেছেন শায়মা, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৫


চলে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছিলো। ফুরিয়ে আসছিলো ছুটি। ছোট থেকেই দুদিনের জন্য কোথাও গেলেও ফিরে আসার সময় মানে বিদায় বেলা আমার কাছে বড়ই বেদনাদায়ক। সেদিন চ্যাটসউডের স্ট্রিট ফুড... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসের নায়িকাকে একদিন দেখতে গেলাম

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৫

যে মেয়েকে নিয়ে ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসটি লিখেছিলাম, তার নাম ভুলে গেছি। এ গল্প শেষ করার আগে তার নাম মনে পড়বে কিনা জানি না। গল্পের খাতিরে ওর নাম ‘অ’ ধরে নিচ্ছি।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

×