somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্লাস্টিক দূষণঃ দায় কি শুধু ভোক্তার না উৎপাদকেরও?

৩০ শে এপ্রিল, ২০২১ রাত ৩:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

[ক] লেখার শুরুটা করবো সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। মধ্যপ্রাচ্যের যেকোন দেশের নাম নিলে অনেকের চোখেই যে কমন চিত্রগুলো ভেসে উঠবে তার মধ্যে মরুভূমি, ঊট এগুলো বোধহয় এগিয়েই থাকবে। সংযুক্ত আরব আমিরাতে যারা পর্যটক হিসেবে বেড়াতে যান তাদের অধিকাংশই মরুভূমিতে ক্যাম্পিং করেন, দেখতে চান মরুভূমিতে চড়ে বেড়ানো ঊট। কিন্তু ক্যাম্পিং করতে গিয়ে তারা যত্রতত্র প্লাস্টিকও ফেলে আসেন। মরুভূমির বালিয়াড়ি, ছোট্ট পুকুর বা গাছের ঝোঁপে লেগে থাকা প্লাস্টিক ব্যাগগুলো কোনভাবে পৌঁছে যাচ্ছে ঊটের পেটে। আর এর ফলে ঊট মারাও যাচ্ছে। দুবাইয়ের সেন্ট্রাল ভেটেরনারি রিসার্চ ল্যাবের প্রধান ডঃ ওয়ের্নারি এবং তার টিম ২০০৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আমিরাতের ৩০০০ মৃত ঊটের পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। এই ৩০০০ ঊটের ১ শতাংশ, মানে ৩০০টি মৃত ঊটের পাকস্থলীতে বা খাদ্যনালীতে জমাটবদ্ধ প্লাস্টিক পাওয়া গেছে, যেটা এদের মারা যাবার প্রধান কারণ। এমনকি একটি ঊটের পাকস্থলীতে ২০০টি পর্যন্ত প্লাস্টিক ব্যাগ জড়ানো অবস্থায় পাওয়া গেছে [১]। কয়েক বছরে ৩০০টি ঊটের মৃত্যু সংখ্যায় নিতান্ত কম বলে হয়তো সেখানকার কর্তৃপক্ষ সহসাই প্লাস্টিকের যত্রতত্র ব্যবহার বন্ধ করবে না, কিন্তু সংখ্যাটা যদি বাড়তে থাকে, মরভূমিতে ঊটের দেখা না পেয়ে পর্যটকরা যদি ক্যাম্পিং করাই বাদ দেয়, তখন হয়তো কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসবে। কারণ এর সাথে আর্থিক বিষয় জড়িত। প্রকৃতি পরিবেশের ভারসাম্যের চেয়ে আর্থিক প্রবৃদ্ধি সবযুগেই মানুষের কাছে এভাবেই প্রাধান্য পেয়েছে।

[খ] এবার ফিরে আসি স্বদেশে। ছোটবেলায় বাজার থেকে তেল আনার জন্য আমরা বাসা থেকে বোতল নিয়ে দোকানে যেতাম। এখন প্লাস্টিকের বোতলের আর প্যাকেটজাত তেলের ব্যবহার এতোটাই বেড়েছে যে এযুগের ছেলেপেলেদের আমাদের মতো অতো কষ্ট করে বোতল জোগাড় করে তেল আনতে যেতে হয়না। তবে আমরা দোকান থেকে শুধু তেলটাই কিনে আনতাম, ওরা তেলের সাথে একটা বোতলও নিয়ে আসছে। এর সাথে নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিচ্ছে একটা খরচের বোঝা। আমাদের দেশে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কাজ করে সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভাগুলো। আমরা সিটি কর্পোরেশনকে কর দিচ্ছি, সেই করের একটা বিরাট অংশ খরচ হচ্ছে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায়, যেখানে প্লাস্টিক বর্জ্যও অন্তর্ভুক্ত। তাই তেলের বোতল বিক্রি করে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান তার লাভ ঠিকই উঠিয়ে নিচ্ছে, আর ভোক্তাকে না চেয়েও এই প্লাস্টিকের বোতলের ব্যবস্থাপনায় পরোক্ষভাবে বাড়তি একটা খরচ করতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে উৎপাদক ভোক্তার জন্য এরচেয়ে উত্তম কোন বিকল্প ব্যবস্থার সুযোগ না রাখায় ভোক্তা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে উৎপাদক এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোন দায় নিচ্ছে না। আরও দুঃখের বিষয় হল ভোক্তা এই বাড়তি খরচের বোঝা নিয়ে উপকৃতও হতে পারছে না। কারণ তেল ব্যবহারের পর যে প্লাস্টিকের বোতল রয়ে যাচ্ছে সেটা হয়তো কিছুদিন ব্যবহার হচ্ছে। নতুন আরেকটা বোতল আসলে সেটা চলে যাচ্ছে বাতিলের খাতায়, ফেলে দেয়া হচ্ছে যত্রতত্র। আমাদের এই ফেলে দেয়া প্লাস্টিকগুলোর কিছু হয়তো টোকাই ছেলেপেলে কুঁড়িয়ে নিচ্ছে, আর বেশিরভাগ থেকে পড়ে থাকছে রাস্তাঘাটে যার সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে পারছে না দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো। ২০২০ সালের সায়েন্স এডভান্সেস জার্নালের একটি গবেষনায় উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের বৃহত্তর উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ যে পরিমাণ কঠিন বর্জ্য তৈরি করে তার প্রায় ৪.৭ শতাংশ হল প্লাস্টিক। এই প্লাস্টিক বর্জ্যের প্রায় সিংহভাগ (৯৭%) যথাযথভাবে ব্যবস্থাপনা করা হয়না [২]।

[গ] উদ্ভুত পরিস্থিতিতে ভোক্তার জন্য যথাযথ বিকল্পের সংস্থান না করে প্লাস্টিক দূষণ সমস্যায় উৎপাদক তার দায় এড়াতে পারে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভোক্তার চাহিদানুযায়ী পণ্য উৎপাদনের পাশাপাশি উৎপাদককে বাড়তি দায়িত্ব দেয়া হয় যাতে পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় ভোক্তার জীবন ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বিষয়গুলো গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়, যা Extended Producer Responsibility নামে স্বীকৃত। এক্ষেত্রে উৎপাদক প্রতিষ্ঠান বারবার নতুন প্লাস্টিক বোতল তৈরির জন্য কাঁচামাল আমদানী না করে গ্রাহক থেকে সরাসরি পূর্ব ব্যবহৃত বোতল সংগ্রহ করতে পারে, গ্রাহককে এ কাজে আকৃষ্ট করার জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক বোতল সংগ্রহ ও জমাদানে উৎপাদক প্রতিষ্ঠান বিশেষ ছাড় বা আর্থিক প্রণোদনা দিতে পারে। যার ফলে প্লাস্টিকের যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার ঘটনা কমে যাবে এবং উৎপাদকের কাঁচামাল আমদানি খরচও বহুলাংশে কমে যাবে। যারা ভ্রাম্যমানভাবে (টোকাই) প্লাস্টিক দ্রব্য সংগ্রহ করছে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি ও কাঠামো তৈরি করে দিয়েও উৎপাদক প্রতিষ্ঠান তার ভূমিকা রাখতে পারে, এসব কিছুকে তাদের কর্পোরেট সোশ্যাল রেস্পন্সিবিলিটির (CSR) আওতায় এনে প্লাস্টিক দূষণ সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি তারা দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠির সামাজিক নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে পারে।

[ঘ] কেনো প্লাস্টিক নিয়ে এতো কথা বলা তার কারণ হল, সম্প্রতি এরিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির একটি গবেষনায় মানুষের ফুসফুস, যকৃত, কিডনি, প্লীহা প্রভৃতি অঙ্গের টিস্যুতে অতি ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কনিকা (মাইক্রোপ্লাস্টিক) সনাক্ত হয়েছে। গবেষকদের মতে সূক্ষ্ম প্লাস্টিকে থাকা রাসায়নিক পদার্থগুলো ডায়বেটিস, স্থুলতা, বন্ধ্যত্ব এর পাশাপাশি মানুষের দেহে ক্যান্সার সৃষ্টির কারণ হতে পারে [৩]। তাই শেষমেশ যদি আমাদের অবস্থা শুরুর ওই ৩০০ দুর্ভাগা ঊটের মতো হয় তাহলে কিন্তু বেশ বিপদই আসন্ন।

তথ্যসূত্রঃ

[১] Click This Link
[২] Click This Link
[৩] Click This Link

ছবিঃ ranakmartin.files.wordpress.com/2015/02/047.jpg

সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে এপ্রিল, ২০২১ ভোর ৪:২৪
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কর কাজ নাহি লাজ

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪


রাফসান দা ছোট ভাই
ছোট সে আর নাই
গাড়ি বাড়ি কিনে সে হয়ে গেছে ধন্য
অনন্য, সে এখন অনন্য।

হিংসেয় পুড়ে কার?
পুড়েপুড়ে ছারখার
কেন পুড়ে গা জুড়ে
পুড়ে কী জন্য?

নেমে পড় সাধনায়
মিছে মর... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাঁর বোতলে আটকে আছে বিরোধী দল

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



সেই ২০০৯ সালে তিনি যে ক্ষমতার মসনদে বসলেন তারপর থেকে কেউ তাঁকে মসনদ থেকে ঠেলে ফেলতে পারেনি। যারা তাঁকে ঠেলে ফেলবে তাদের বড়টাকে তিনি বোতল বন্দ্বি করেছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ১৬ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৪



কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?
আমার খুবই জরুরি তার ঠিকানাটা জানা,
আমি অনেক চেষ্টা করেও ওর ঠিকানা জোগাড় করতে পারছিনা।

আমি অনেক দিন যাবত ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছি,
এই ধরুণ, বিশ-একুশ বছর।
আশ্চর্য্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজকের ব্লগার ভাবনা:কথায় কথায় বয়কট এর ডাক দেয়া পিনাকীদের আইডি/পেইজ/চ্যানেল বাংলাদেশে হাইড করা উচিত কি? ব্লগাররা কি ভাবছেন?

লিখেছেন লেখার খাতা, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:১৩



অপূর্ব একজন চমৎকার অভিনেতা। ছোট পর্দার এই জনপ্রিয় মুখকে চেনেনা এমন কেউ নেই। সাধারণত অভিনেতা অভিনেত্রীদের রুজিরোজগার এর একটি মাধ্যম হইল বিজ্ঞাপনে মডেল হওয়া। বাংলাদেশের কোন তারকা যদি বিদেশী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×