somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জাফর স্যার এর টিপায় মুখ নিয়ে কলাম.

০৫ ই জানুয়ারি, ২০১২ সকাল ১১:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের গভর্নর পদের জন্য নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন ক্লেটন উইলিয়ামস নামে এক ব্যক্তি। ভদ্রলোক নির্বাচনে জিততে পারেননি, কিন্তু পৃথিবীর অনেক মানুষ তাঁকে মনে রেখেছে তাঁর একটি উক্তির জন্য। তিনি বলেছিলেন, ধর্ষণ থেকে যদি রক্ষা পাওয়ার কোনো উপায় না থাকে, তাহলে চেষ্টা করা উচিত সেটা উপভোগ করা। (আমি যা-ই লিখি, ছোট বাচ্চারা নাকি সেটা পড়ে ফেলে—তাই ওপরের কথাগুলো লিখতে খুব খারাপ লাগছে।) ক্লেটন উইলিয়ামসের কথার মতো হুবহু একটা কথা ২৯ ডিসেম্বর ২০১১-এর প্রথম আলোয় পড়েছি। টিপাইমুখ সম্পর্কে মহিউদ্দিন আহমেদ লিখেছেন, ‘ভারত এই বাঁধ তৈরি করবেই, আমাদের কৌশল হওয়া উচিত এ থেকে আমরা কী সুবিধা নিতে পারব সেই চেষ্টা করা।’
এর কিছুদিন আগে গওহর রিজভী পত্রিকায় একটা লেখা লিখেছিলেন। সেই লেখাটিতে নানা রকম ভণিতা ছিল, দেশ, দেশের স্বার্থ—এই সব বড় বড় কথা ছিল এবং পুরো লেখাটিতে পাঠকদের উপদেশ দেওয়া হয়েছিল, তারা যেন আবেগের বশবর্তী হয়ে হঠকারী কাজকর্ম শুরু করে না দেয়। গওহর রিজভী সরকারের মানুষ, তাঁর লেখাটি পড়ে আমরা সবাই সরকারের ভূমিকাটা কী হবে, তা আঁচ করতে পেরেছিলাম।
আমি নদী বিশেষজ্ঞ নই, পানি বিশেষজ্ঞ নই, পরিবেশ বিশেষজ্ঞ নই। কিন্তু আমার গত ৫৯ বছরের অভিজ্ঞতায় একটা জিনিস শিখেছি, সেটা হচ্ছে পৃথিবীর জটিল থেকে জটিলতম বিষয়টিও কমন সেন্স দিয়ে প্রায় ৯০ ভাগ বুঝে ফেলা যায়। কাজেই বাংলাদেশের মানুষ টিপাইমুখের বিষয়টি শতকরা ৯০ ভাগ শুধু কমন সেন্স দিয়ে কিন্তু বুঝে ফেলেছে। বড় বড় বিশেষজ্ঞ কিউসেকের হিসাব, বর্ষা মৌসুম, শুষ্ক মৌসুম, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সেচব্যবস্থা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে থাকুন, আমরা সাধারণ মানুষ কিছু সাধারণ প্রশ্ন করি:
আমরা কি প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করব, নাকি প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান করব? একেবারে ছোট শিশুটিও জানে পৃথিবীতে প্রযুক্তি এখনো প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার জায়গায় পৌঁছায়নি, কোনো ভূমিকম্প থামানো যায় না, কোনো ঘূর্ণিঝড় বন্ধ করা যায় না, পাহাড় থেকে নেমে আসা পানির ঢল আটকানো যায় না। ঠিক সে রকম একটা নদীকে বন্ধ করা যায় না, গতিপথ ঘুরিয়ে দেওয়া যায় না। নির্বোধ মানুষ যে চেষ্টা করে না তা নয়, পৃথিবীর অনেক জায়গাতেই করা হয়েছে; কিন্তু সেটা মানুষের ওপর অভিশাপ হয়ে নেমে এসেছে। ভবদহের কথা আমরা ভুলিনি, ফারাক্কা আমাদের চোখের সামনেই আছে। কাজেই গওহর রিজভী কিংবা মহিউদ্দিন আহমেদের মতো বিশেষজ্ঞরা যতই বলুন ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই বাঁধ তৈরি করে’ বাংলাদেশকে সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা করে ফেলতে হবে আমি সেই কথা বিশ্বাস করি না। আমাদের দেশে কাপ্তাই বাঁধ দিয়ে বিশাল এলাকা পানিতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল, অসংখ্য অসহায় আদিবাসী মানুষকে রাতারাতি গৃহহারা করা হয়েছিল। এখন সেই চেষ্টা করা হলে বাংলাদেশের মানুষ কোনো দিন সেটা হতে দিত না, কোনো সরকারের সেই দুঃসাহস দেখানোর সাহস হতো না।
কাজেই বিশেষজ্ঞরা যতই বলতে থাকুন টিপাইমুখ বাঁধ বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত শুভ উদ্যোগ, আমি সেটা বিশ্বাস করি না। যারা প্রকৃতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, আসলে তারা পৃথিবীর ভালো চায় না। তারা বাংলাদেশের মানুষ হোক, ভারত বা চীন যে দেশেরই হোক, তাদের ধিক্কার দিতে হবে। তারা হচ্ছে পৃথিবীর দুর্বৃত্ত।
গওহর রিজভী এবং মহিউদ্দিন আহমেদ দুজনই টিপাইমুখ বাঁধের সুফল নিয়ে ভালো ভালো কথা বলেছেন, তার বেশির ভাগ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা তর্ক-বিতর্ক করতে থাকুন। আমি শুধু একটা বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাই, সেটা হচ্ছে বন্যা। তাঁরা দুজনেই দাবি করেছেন এই বাঁধ দিয়ে বন্যার প্রকোপ কমানো যাবে। আমি সিলেটে থাকি, আমার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সুরমা নদীর দূরত্ব এক কিলোমিটারও নয়। আমি এখানে ১৭ বছর ধরে আছি, শুধু একবার (২০০৪ সালে) সুরমা নদীর পানি উপচে এসেছিল, আমি তো আর কখনো সুরমা নদীর পানিকে তীর ভেঙে আসতে দেখিনি! হাওর অঞ্চল তো প্রতিবছর পানিতে ডুবে যায়, ডুবে যাওয়ারই কথা, সেটাই হচ্ছে এর প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য। সেটা তো বন্যা নয়। তাহলে তাঁরা কোন বন্যাকে ঠেকানোর কথা বলছেন? যে বন্যার অস্তিত্ব নেই, সেই বন্যার প্রকোপ থামানোর কথা বললে আমরা যদি বিশেষজ্ঞদের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাই কেউ আমাকে দোষ দিতে পারবে? এই বন্যা নিয়ে তাঁদের বিশেষজ্ঞ মতামত আমার কাছে অর্থহীন মনে হয়—ঠিক সে রকম তাঁদের অন্যান্য বিশেষজ্ঞ মতামতও যে অর্থহীন নয়, সেই গ্যারান্টি আমাকে কে দেবে?
মহিউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘ভারত এই বাঁধ তৈরি করবেই’, তিনি তার বিরোধিতা করতেও রাজি নন। কোনো রকম চেষ্টা না করে পরাজয় স্বীকার করার মধ্যে কোনো গৌরব নেই। টিপাইমুখ বাঁধ বন্ধ করার চেষ্টাকে এ মুহূর্তে তাঁর কাছে এবং সম্ভবত আরও অনেকের কাছে খুব কঠিন কাজ মনে হচ্ছে। সারা দেশে টিপাইমুখের বিরুদ্ধে একটা আন্দোলন গড়ে তোলা এই মানুষগুলোর কাছে একটা অযৌক্তিক এবং অসম্ভব কাজ বলে মনে হচ্ছে। কাজেই তাঁরা এর জন্য চেষ্টা করতেও রাজি নন।
তাঁদের সবাইকে মনে করিয়ে দেওয়া যায় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন এই দেশে গণহত্যা শুরু করেছিল তখন কোনো মানুষ যদি যুক্তিতর্ক দিয়ে বিবেচনা করত তাহলে তারা নিশ্চিতভাবেই ধরে নিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন করা একটা পুরোপুরি অবাস্তব বিষয়। মার্চ মাসে শুরু করে মে মাসের মাঝামাঝি পুরো দেশটা পাকিস্তান সেনাবাহিনী দখল করে নিয়েছিল। এখন যাদের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচার করা হচ্ছে তারা সেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পদলেহী অনুচর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মতো দেশ পাকিস্তানের পক্ষে, পৃথিবীর মুসলমান দেশগুলোও পাকিস্তানের পক্ষে, এক কোটি মানুষ দেশছাড়া, যারা দেশে আছে তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে, খুন করে সারা দেশে হাহাকার। দেশের কিছু কম বয়সী ছেলেমেয়ে মুক্তিযুদ্ধ করতে গিয়েছে, তাদের হাতে অস্ত্র নেই, যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নেই, পেশাদার বাহিনী বিশৃঙ্খল, যাঁরা নেতৃত্ব দেবেন তাঁদের মধ্যেও কোন্দল—এ রকম একটা পরিবেশ দিয়ে শুরু করে আমরা স্বাধীন একটা দেশ ছিনিয়ে আনতে পারব সেটা কি কেউ কল্পনা করেছিল? করেনি। কিন্তু তার পরও এই দেশের মানুষ দেশপ্রেমের যুক্তিহীন আবেগকে মূলধন করে এই দেশকে স্বাধীন করে ছেড়েছিল।
কাজেই যাঁরা এই দেশের হর্তাকর্তা-বিধাতা তাঁরা এই দেশের মানুষের ‘যুক্তিহীন’ আবেগকে খাটো করে দেখবেন না। প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় না, তার সঙ্গে সহাবস্থান করতে হয়। টিপাইমুখের বেলায়ও হুবহু একই কথা বলা যায়—দেশের মানুষের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করার বৃথা চেষ্টা করবেন না, তাদের সঙ্গে সহাবস্থান করুন।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল: লেখক। অধ্যাপক শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
লিঙ্কঃপ্রথম আলো
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০১২ সকাল ১১:৪০
১১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×