বর্তমান সময়ের বহুল আলোচিত বিষয় ইভটিজিং। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে খবরের কাগজে চোখ বুলাতেই চোখে পড়বে ইভটিজিংয়ের ভয়াবহ ফল—যার নাম আত্মহত্যা। ইভটিজিং এক মারাত্মক সামাজিক ব্যাধি। অনেক মেয়েকে আত্মাহুতি দিতে হয়েছে, হচ্ছে এই ইভটিজিংয়ের কারণে। আত্মহত্যার মতো জঘন্য কাজ করতে বাধ্য করায় ইভটিজিং। ইভটিজিং বলে বিষয়টিকে ছোট করে না দেখে এটাকে আমরা অন্য নাম দিতে পারি। নারী নির্যাতনের পর্যায়ে পড়ে বলে একে নারী উত্ত্যক্তকরণ বললে মন্দ হবে না। এই তো কিছুদিন আগে দেশের নামকরা একটি সংবাদপত্রে বিশেষ সাক্ষাত্কারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধা সুলতানা কামাল বলেছেন—‘ইভটিজিংয়ের মধ্যে একটা হালকা ভাব আছে; মনে হয়, এটা গুরুতর কোনো বিষয় নয়, সামান্য খুনসুটির মতো ব্যাপার আছে। কিন্তু আসলে এটা কোনো হালকা ব্যাপার নয়, মেয়েদের জন্য এটা একটা গুরুতর বিষয়, এটা নারী নির্যাতনেরই একটা বিশেষ ধরন। আমরা এটাকে বলছি নারীদের উত্ত্যক্তকরণ।
ইভটিজিং বা নারী উত্ত্যক্তকরণ যাই হোক না কেন, বিষয়টা ক্যান্সারে ধারণ করেছে। তাই এটাকে স্বমূলে উত্পাটন করতে হবে। হতে হবে ঐক্যবদ্ধ। অনেকে বলেন, বখাটেরা একটু উত্পাত করল তার জন্য নিজের জীবন দিয়ে দিতে হবে? এটা ধ্রুবতারার মতো সত্য যে, আমাদের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। মানুষ যেদিন জন্মগ্রহণ করে সেদিন থেকেই নাকি তার মৃত্যু প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে যায়। একইভাবে একথা নির্মমভাবে সত্য যে, কেবল যারা আত্মহত্যা করে বা ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় তারা ছাড়া কেউই জানে না যে কখন কার মৃত্যু হবে। প্রত্যেক মানুষের জীবন দর্শন হচ্ছে, ‘মৃত্যুর চেয়ে কষ্ট করে কোনো রকমে বেঁচে থাকাও শ্রেয়।’ এজন্য কবি বলেছেন— ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে।’
কেউই চায় না পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে, সে সদ্যজাত শিশু থেকে অশীতিপর বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। এ থেকেই বোঝা যায় একজন মানুষ তথা একজন নারী কিংবা একটা মেয়ে কখন তার নিজের জীবন নিজে দিয়ে দেয়। ইভটিজিংয়ের ক্ষেত্রে প্রতিবাদটাকে অনেকে খারাপ চোখে দেখেন আবার অনেকে প্রতিবাদী হতে উদ্বুদ্ধ করেন। কিন্তু এ তো শাঁখের করাত। প্রতিবাদ করলে বিপদ বাড়ে বৈ কমে না, আর না করলে তো কথাই নেই।
এই তো কিছুদিন আগে আগৈলঝাড়ায় ইভটিজিংয়ের প্রতিবাদ করায় বখাটেরা রিমা নামের একটি মেয়েকে নৃশংসভাবে খুন করে, শুধু কি তাই? লাশটা গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখে। আবার ইভটিজিংয়ের প্রতিবাদ করায় কালিয়াকৈরে বিদ্যালয়ে হামলা করে। এছাড়াও অহরহ ঘটছে নানা ঘটনা যার কিছুটা আমাদের জানা আর বাকিগুলো অজানা।
চতুর্থ শ্রেণীর সেই কিশোরীটির কথা মনে আছে নিশ্চয়ই—জীবনের শুরুই হয়নি তার সেও রক্ষা পায়নি তথাকথিত ইভটিজিং থেকে, বাধ্য হয়েছে পুকুরে ঝাঁপ দিতে। অনেকে বলেন, ইভটিজিং নাকি সেই স্বর্গের আদম-হাওয়ার সময় থেকেই প্রচলিত, কিন্তু পৃথিবীতে এই শব্দটির বহুল ব্যবহার মাত্র কয়েক বছর থেকে। তাহলে কি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর নামকরণ বদলেছে, বদলেছে ইভটিজিংয়ের স্টাইলও। আশির দশক বা তারও আগে ষাটের দশকের তরুণীদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, তখনও বখাটেরা উত্পাত করত। কিন্তু সে উত্পাত আর কি—রকে বসে আড্ডাবাজি, গার্লস স্কুল-কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা, শিস দেয়া, আর গান গাওয়া, ওহ! আরেকটা কাজ তারা করত, তা হলো এক চোখ বন্ধ করে এক চোখে টিপ মারা। যাকে চোখ মারা বলা হতো। অথবা খুব বেশি হলে প্রেমপত্র দেয়া। ঘরের দেয়ালে, গাছের গুঁড়িতে নামের প্রথম অক্ষর বা নাম দিয়েও যোগ করে রাখত যেমন আর+এল কিংবা নামটা না হয় নাই বলি।
সময় বদলেছে, বদলেছে ইভটিজিংয়ের ধরন, এখন সরাসরি ওড়না ধরে টান মারে, মা-বাবাকে ভয় পায় না এমন কি পুলিশকেও তোয়াক্কা করে না। প্রেমে বা বিয়েতে রাজি না হলে সেই ভালোবাসার মানুষটির সুন্দর মুখে এসিড মারতে এতটুকু কুণ্ঠিত হয় না বখাটেরা। এমন কি পেট্রোল ঢেলে আগুনও জ্বালিয়ে দেয়। এই কি ভালোবাসার নমুনা! কিন্তু ভালোবাসার জ্বলন্ত উদাহরণ ‘দেবদাস’ সেও কিন্তু কম জ্বালায়নি পার্বতীকে। সবাই বলে দিন বদলেছে, এসেছে প্রযুক্তির সময় তাই মানুষগুলোও যান্ত্রিক হয়ে গেছে। যেমন বাংলা সিনেমার নাম ‘খোঁজ দি সার্চ’ কিংবা ‘ভালোবাসা দিবি কিনা বল’। না দিলে কি করবে সে তো বোঝাই যাচ্ছে। সিনেমা জগেক দোষ দিয়ে আর কি হবে।
আমরা এ কোন সমাজে বাস করছি? আমাদের মন-মানসিকতাই বা কীভাবে গড়ে উঠছে? সবকিছুর মধ্যে বল প্রয়োগের প্রবণতা যেন গোটা সমাজকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সব ক্ষেত্রেই এক অস্থিরতা বিরাজ করছে। শ্রদ্ধা, সম্মান, ভালোবাসা, স্নেহ, মায়া-মমতা, সহিষ্ণুতা, পরোপকারিতা সবকিছুই যেন আজ বিলীন হতে চলেছে। নৈতিক এই অবক্ষয়ের শুরু হয়েছে একটি পরিবার থেকে। পরিবার হচ্ছে নীতি-শিক্ষার প্রাথমিক ক্ষেত্র। মা-বাবা ও পরিবারবর্গের আচার-আচরণের মধ্যে শিশু যদি নৈতিকতা-সহিষ্ণুতা, শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা দেখতে পায় তবে সেও সেভাবেই বেড়ে উঠবে। তাই আমাদের পরিবারের লোকদের বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হবে এই নারী উত্ত্যক্তকরণ প্রতিরোধে।
এটা যেহেতু একটি সামাজিক ব্যাধি, তাই সবাইকে সমানভাবে সোচ্চার হতে হবে। আইনের দিকে তাকিয়ে না থেকে সামাজিকভাবে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষার চাহিদা মাথায় রেখে দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণগত পরিবর্তনের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। গণমাধ্যমগুলোকে আরও বেশি বেশি করে ইভটিজিংয়ের নানা বিষয় প্রচারে উদ্যোগী হতে হবে। আর সর্বোপরি সচেতন হতে হবে নারীদের, তাদের এমনভাবে চলতে হবে যেন ‘সাপও মরে লাঠিও না ভাঙে।’ অর্থাত্ চতুরতার সঙ্গে বিষয়টাকে কব্জা করে পুলিশের সাহায্য নিতে হবে। পুলিশদেরও এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে, নাহলে আবার শেয়ালের কাছে মুরগি রাখার দশা হবে। আরে বাবা রক্ষক হয়ে ভক্ষক হবেন না। পুলিশদেরও এমন নজির যে একেবারে নেই, তা কিন্তু সবারই জানা। তবে ওই যে কথায় আছে ‘হাতের পাঁচ আঙুল সমান হয় না।’ আবার ‘হাঁড়ির একটা ভাত টিপলে সব ভাতের খবরও যে বোঝা যায়’। সে যাই হোক সর্বোপরি আমরা চাই আর যেন কোনো ইভটিজিং না হয়, আর যেন কোনো নারী উত্ত্যক্তকরণ না হয়। আর কোনো আত্মাহুতি নয়। নর-নারী একই খোদার সৃষ্টি, তাই নরদের খারাপ পথ থেকে ভালো পথে আনতে নারীদের ভূমিকা অনস্বীকার্য, তেমনি নারীর আত্মাহুতিকে প্রতিহত করতে নরদেরও ভূমিকা রাখা উচিত নয় কি? ওই যে কবি আবারও বলেছেন—বিশ্বের যা কিছু মহান চির-কল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’
একজন নরের জন্যই নারী জীবন দিচ্ছে কিন্তু নর কি কখনও ভেবেছে নারী ছাড়া সে কতটা অসহায়? তাই আর নয় ইভটিজিং, আর নয় আত্মহত্যা।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই অক্টোবর, ২০১০ সকাল ৭:১৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।






