প্রথম আলো ও উটপাখি
১. গত ২৭-১২-২০১২ বৃহস্পতিবার আনুমানিক দুপুর দেড়টার দিকে আমি আমার বাসা থেকে বের হয়ে মসজিদের দিকে যাচ্ছিলাম। তখন জোহরের নামাজ শেষ হয়ে গেছে। পথে আমার বন্ধুদের একটি রেস্তোরাঁর কাজ চলছিল এবং আমি সেখানে ডেকোরেশনের কাজ দেখছিলাম। তখনই জানতে পারলাম ওই রোডের একটি বাড়িতে অর্থাত্ মিরপুর-১, ডি-ব্লক, ৭নং রোডের ১৯নং বাড়ির উচ্ছেদ অভিযানে ম্যাজিস্ট্রেট এসেছে পুলিশ নিয়ে। এরপর আমি দোকানের বাইরে এসে দৃশ্যপট দেখার চেষ্টা করি। ঠিক তখনই পুলিশ লাঠি দিয়ে সাধারণ মানুষকে তাড়ানোর চেষ্টা করছিল। আমার কাছে তাদের আচরণ গরু পেটানোর মতো মনে হয়েছে। আমি এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ করি। তখন একজন সিপাহী আমার দিকে বন্দুক তাক করে বলে ‘তোকে গুলি করবো’। এরপর সে বন্দুক উল্টো করে ধরে আমার মাথায় আঘাত করতে আসে। আমি বলি, মানুষকে গরু-ছাগল ভাবার কারণ নেই। এরপর একজন এসআই আমাকে আশ্বস্ত করেন এবং বলেন, আপনি শান্ত হোন। আমিও চুপচাপ চলে যাই এবং ওই রোডের অপর প্রান্তে বসে চা খাচ্ছিলাম। তখনি দেখি, যে বাড়ি উচ্ছেদ করতে এসেছে সেই বাড়ির এক ভাড়াটিয়া ছেলেকে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে কুকুরের মতো টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং ছেলেটি চিত্কার করে বলছে, আমি গার্মেন্টে চাকরি করি। তখন আমি আবার পুলিশের মুখোমুখি হই এবং তাদের জিজ্ঞাসা করি ওর অপরাধ কী? উত্তরে পুলিশের এসআই আমাকে বলে, আপনার পরিচয় কী? উত্তরে আমি বলি, আমি মানুষ এবং এই দেশের নাগরিক। হালকা বাকবিতণ্ডা হয় ওই এসআইয়ের সঙ্গে। তারপর ওই গার্মেন্ট শ্রমিকের কী হয় আমি জানি না।
২. কিছুক্ষণ পর শুনি আওয়াজ এবং চোখ জ্বলছিল। আমি বুঝতে পারি টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করেছে এবং ওই বাড়ির দুটি ছেলেকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। আমি মূল ঘটনাস্থল ১৯নং বাসার সামনে যাই এবং জানতে পারি ওই বাড়ির ভেতরে তিনটি টিয়ারশেল এবং বাইরে একটি মোট চারটি টিয়ারশেল নিক্ষেপ করা হয়েছে। টিয়ারশেলের ধোঁয়া সহ্য করতে না পেরে আনুমানিক ৬৫ বছর বয়সী বৃদ্ধা প্রাণপণ চেষ্টায় একতলার ছাদে উঠতে চেষ্টা করেন কিন্তু উঠতে গিয়ে একতলার ছাদ থেকে পড়ে যান এবং কোমরের হাড় ভেঙে যায়। আমি তখন ম্যাজিস্ট্রেটকে খুঁজতে থাকি। অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর তাকে পাই। গ্যাসের তীব্রতা সহ্য করতে না পেরে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আরেকটি নির্মাণাধীন বাড়ির নিচে অবস্থান করছিলেন। সেই ম্যাজিস্ট্রেট টিপু সুলতান, গণপূর্ত বিভাগের সহকারী পরিচালক—তাকে আমি প্রশ্ন করি আপনি মানুষ না অন্য কিছু। কিভাবে নির্দেশ দিলেন টিয়ার গ্যাস মারার, যা আপনি নিজেও সহ্য করতে পারছেন না। তিনি আমাকে প্রথমে বলেন, আমি নির্দেশ দেইনি। তখন আমি তাকে বলি, তাহলে লিখিত দিন। তখন তিনি স্বরূপে ফিরে এসে বলেন, নির্দেশ দিয়েছি তো কি হয়েছে। আপনারা চলে যান, না হলে গুলির নির্দেশ দেব। আমি তীব্র প্রতিবাদ করি। এক পর্যায়ে বেশ বড় জনমত সৃষ্টি হয়। আমি বার বার ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশকে বলতে থাকি, এটি অত্যন্ত বড় মাপের মানবতা লঙ্ঘন। পাল্টা জবাবে তারা বলতে থাকে, আমরা প্রয়োজনে সবাইকে গ্রেফতার করব এবং গুলির নির্দেশ দেব। এতে আমার সঙ্গে তাদের বাক-বিতণ্ডার সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে তারা আমার নাম জানতে চাইলে তাদের আমার নাম বলি। তখনকার পরিস্থিতি টের পেয়ে ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশ নিয়ে উচ্ছেদ অভিযান রেখে চলে আসেন। এর মধ্যে কিছু ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ক্যামেরা আসায় উচ্ছেদ অভিযানকারীরা চলে যান। এরপর ম্যাজিস্ট্রেট থানায় গিয়ে বাড়িতে বর্তমান অবস্থানকারী সবাই এবং আমাকে আসামি করে মামলা দেন।
৩. ২৮-১২-২০১২ ইং রোজ শুক্রবার আমি প্রথম আলো পত্রিকাটি দেখে বিস্মিত হই। ২১নং পৃষ্ঠায় বেশ গুরুত্বের সঙ্গে এই খবরটি ছাপা হয়। শিরোনাম করা হয় ‘মিরপুরে হামলার মুখে পিছু হটলেন ভ্রাম্যমাণ আদালত’। এই রিপোর্টটির মধ্যে যা লেখা ছিল তা প্রথম আলো যে চেতনায় মানুষকে উদ্দীপ্ত করে তার সঙ্গে যায় না। আমি খুব মনক্ষুণ্ন হই এবং বিশ্বাস করতে থাকি নিশ্চয়ই প্রথম আলো রিপোর্ট/খবরটিকে পরিবর্তন করবে। এই বিশ্বাস নিয়ে রাতে বেশ নিশ্চিত হয়ে ঘুমাতে যাই এবং শুয়ে শুয়ে চিন্তা করতে থাকি, আগামীকাল প্রথম আলোর অফিসে যাব এবং তাদের বিষয়টি গোচরীভূত করলে তারা নিশ্চয়ই সংবাদটি সংশোধন করবেন। আমি ২৯-১২-২০১২ শনিবার আনুমানিক সকাল সাড়ে ১১টার দিকে প্রথম আলোর অফিসে যাই এবং যেহেতু সামান্য কিছু পত্রিকা পড়ার অভ্যাস আছে, বিশেষ করে প্রথম আলো, সেহেতু আমি আশা করেছিলাম সোহরাব হাসান সাহেব প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখবেন। নিরাপত্তা কর্মীদের জিজ্ঞাসা করলে তারা বলেন, স্যার লিফটের ৫-এ গেলে দেখা করতে পারবেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমি তাকে পাইনি, তিনি প্রেস ক্লাবে ভোট দিতে চলে গেছেন। তখন আমি ওই ফ্লোরের রিসিপশনের ভদ্রমহিলার সঙ্গে আলোচনা করি, কার সঙ্গে এই খবরটির ব্যাপারে কথা বললে ভালো হয়। তিনি আমাকে আবদুল কাইয়ুম সাহেবের নাম বলেন। আমি আবদুল কাইয়ুম সাহেবকে বিষয়টি খুলে বলার চেষ্টা করলে তিনি আমার কথা না শুনে আমাকে ২য় তলায় নিউজ রুমে যিনি খবরটি তৈরি করেছেন তার কাছে পাঠান। আমিও তার কথামতো তাই করি। যে রিপোর্টার সংবাদটি তৈরি বা সংগ্রহ করেছেন তাকে বলার চেষ্টা করি। আমি প্রথম আলোর পাঠক হিসেবে মনে করি শিরোনাম হওয়া উচিত ছিল ‘মিরপুরে বাড়ি উচ্ছেদে টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ ও একজন বৃদ্ধা গুরুতর আহত’। এ কথায় তিনি আমার ওপর মারমুখী হয়ে আসেন এবং ধমকাতে থাকেন—বেরিয়ে যান, না হলে পুলিশ ডেকে আপনাকে ধরিয়ে দেব। উত্তরে আমি বলি, আপনার ক্ষমতা আছে দিন ধরিয়ে, আমরা তো নিরীহ মানুষ। তিনি তক্ষুণি ফোন বের করলেন কিন্তু ফোন করলেন না। তিনি বলতে থাকলেন, তোর এলাকার পুলিশের ডিসি ও এসিকে ফোন করে তোকে শায়েস্তা করব। আমি ক্ষুব্ধ ও অপমানিত হয়ে আবার সিঁড়ি বেয়ে আবদুল কাইয়ুম সাহেবের কাছে যাই এবং বিষয়টি বলি। তিনি আমাকে আশ্বস্ত করেন, বিষয়টি তিনি দেখবেন। আমি বলি, স্যার, আপনাদের বলে বলীয়ান হয়ে আমরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করি। আপনারা বলেন ‘উটপাখি নয়, মানুষের জীবন চাই’। এরপর উনি দু’ দু’বার আমাকে রিসিপশনে বসিয়ে রেখে ভেতরে যান এবং বলে যান, মতি ভাই (সম্পাদক মতিউর রহমান)-এর সঙ্গে আপনার সাক্ষাত্ করাতে পারি কিনা। ২য় বার উনি এসে বললেন, বিষয়টি আমিই দেখব, মতি ভাই মিটিংয়ে আছেন। ৩০-১২-২০১২ রোববার আনুমানিক সকাল সাড়ে ৯টায় কলিংবেলের আওয়াজ শুনে আমার স্ত্রী দরজা খোলে। আমার স্ত্রী এসে আমাকে বললো কারা যেন তোমাকে ডাকছে। আমি গেলাম দরজার কাছে, আমাকে একজন জিজ্ঞাসা করলো আপনি কি ইমরুল। আমি বললাম হ্যাঁ, আমি ইমরুল। তারা বলল, আপনাকে গ্রেফতার করা হবে কারণ আপনি প্রশাসনের কাজে বাধা প্রদান করেছেন। তারা আমাকে থানায় না নিয়ে সরাসরি ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট হাজতে তাদের মাইক্রোবাস যোগে নিয়ে যায়। যেতে যেতে পুলিশ আমাকে বলছে, আপনি তো অনেক সাহসী। ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে বেয়াদপি করলেন ভালো কথা কিন্তু সাংবাদিকের সঙ্গে কিভাবে বেয়াদপি করলেন? আপনার অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে। ধারা যা দিয়েছি তাতে দুই মাসেও বেল/জামিন পাবেন না। আমি মনে করেছিলাম বিষয়টি আন্দাজে তারা বলছেন। এরপর সিএমএম আদালতে জামিন মঞ্জুর না করে আমাকে হাজতে পাঠানো হলো। মোটামুটি যত ধারা দেয়া যায় সব ধারাই প্রয়োগ করল পুলিশ। আমি তখন জেলে, আমার স্বজনরা আমাকে জানালো প্রথম আলো পত্রিকায় গ্রেফতারের খবরটি ছাপা হয়েছে। যাক, ৩-১-২০১৩ বৃহস্পতিবার আমার জামিন মঞ্জুর হয় এবং আমি জেল থেকে মুক্ত হই।
৪. এসব ঘটনাপট ও আমার হাজতবাসের কষ্ট থেকে আমি নিজেকে কোনোভাবেই আলাদা করতে পারছি না। মনে হচ্ছে আমি স্বাধীন দেশের নাগরিক নই, প্রথম আলো ও পুলিশের প্রজা। কোনোভাবেই ঘুমাতে পারি না যখন চিন্তা করি ‘উটপাখী নয়, মানুষের জীবন চাই’ অথবা ‘বদলে যাও বদলে দাও’ কিংবা ‘যা কিছু ভালো তার সাথে প্রথম আলো’; এ সব স্লোগান দিয়ে কিভাবে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হয়। কাকে বলে তথ্য অধিকার আমি যখন আবদুল কাইয়ুম সাহেবের কাছে ওই রিপোর্টারের নাম জানতে চাইলাম অত্যন্ত বিনম্রভাবে, তিনি আমাকে বললেন, নাম দিয়ে আপনি কী করবেন? আমি বললাম, জীবনে যদি কখনও আত্মজীবনী লিখি তবে প্রয়োজন হতে পারে। আমার কাছে মনে হচ্ছে টাঙ্গাইলের ধর্ষিতা মেয়েটিকে বাঁচাতে গিয়ে যদি কেউ প্রতিরোধ করত এবং ধর্ষণকারী আহত হতো প্রথম আলো প্রতিরোধকারী ব্যক্তিকে সন্ত্রাসী বানিয়ে দিত। আমার এই সময়টিতে খুব বেশি মনে পড়ছে একটি অকাট্য সত্য কথা যা বলেছিলেন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহার লিংক ‘যা কিছু কালো, তার সাথে প্রথম আলো।’
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ২:৩৫