পর্ব: - ০১
ডিসেম্বর, ১৯৬৮। যেমন কনকনে শীত তেমন ঘন কুয়াশা, এমনও দিন যাচ্ছে সারা দিনে কোনো রোদের দেখা নেই! দিনে শীত আর রাতে সেই শীত বৈরি বিদ্রোহ হয়ে বিপদসীমা ছাড়িয়ে যেতো - আমরা বলতাম “জাড়, এবারের জাড়ের চোটে মানুষ পশুপাখি সব মারা যাবে”। দাদাজানের সাথে বড় চাচা, আব্বা, মেজো চাচা, ছোট চাচা খেজুরের গুড়ের চা আর টোষ্ট খেতেন আর বলাবলি করতেন - “বাজান বরফ যুগ চলে আসবে নাকি?”! সন্তানদের কাছে এমন কথা শুনে বৃটিশ সরকারের প্রতাপশালী অবসরপ্রাপ্ত সাব রেজিস্ট্রার দাদাজান আরো চিন্তিত হতেন, তিনি কথার বিষয় অন্যদিকে মোড় নিয়ে ডোবা পুকুরের মাছ আর বিভিন্ন ফলমূল নিয়ে গল্প শুরু করতেন।
আমাদের জমির ক্রমশ ফসল উঠছে - গম, সরিষা, মাষকলাই, পেঁয়াজ, গোলআলু। বাড়ি ভর্তি ফসলের স্তূপ। - রোদের দেখা নেই। জমিতে মরিচ টমেটো শীতে জমে গেছে - পাকার নাম নেই। মা চাচীরা বাড়তি নফল নামাজ পড়ছেন, আল্লাহর কাছে দোয়া করছেন, মানত করছেন - গরিব মিসকিন খাওয়াবেন। কোনো এক ফাকে আমাদের হাতে মসজিদে লোহার সিন্দুকে খুচরা পয়সা দিচ্ছেন আমরা এক দৌড়ে লোহার সিন্দুকে পয়সা রেখে আসি, রাস্তায় কোথাও দম নিতেও দাড়াই না - যেনো দৌড়ে না গেলে শত শত বছর একই জায়গায় পরে থাকা লোহার সিন্দুক চলে যাবে অন্য কোনো দেশে! - তারপরও রোদের দেখা নেই! দাদাজান রেডিও শোনে জানান “গ্রাম, থানা, জেলা এমনকি সমগ্র বাংলাদেশে একই অবস্থা”। দাদীজান যথারিতি সবাইকে ধমক দিচ্ছেন “জমিতে ফসল ছিলো - জীবিত থাকতো, এখন সব কাটা ফসল! আমার বাড়িতে কাজের মানুষ নাই - মানুষ নামের সব কলাপাতা জমা অইছে (দাদীজানের একটি বকা বিশেষ, কলাপাতা = যা শুধু শিরনি নেওয়ার কাজে ব্যাবহৃত হয়), আল্লাহর নাম লও, আল্লাহর নাম লও”। আমরা সবাই আল্লাহর নাম লই - আল্লাহ শুনছেন কি না জানিনা!
সত্যি সত্যি এক মঙ্গলবার ভোরে আল্লাহ সবার ডাক শোনেন, সেই মঙ্গলবার ভোর থেকে শুরু হয় বাড়িতে ব্যস্ততা, আমাদের থানায় হাতেগোনা কয়েকটি টেলিফোন ছিলো। সেদিন দাদাজান টেলিফোন এক্সচেঞ্জে অনেক চেষ্টা করেও বড় চাচা ও আব্বার সাথে ফোনে যোগাযোগের লাইন না পেয়ে টেলিগ্রাম করে দেন GOOD NEWS SUNRISE. EVERYBODY WORKING. DO NOT WORRY FOR HOME, DO YOUR DUTY, I RECEIVED YOUR MONEYGRAM. দাদাজানের পছন্দের একটি কাজ ছিলো বিশেষ কোনো প্রয়োজন বা সংবাদ হলেই টেলিগ্রাম করে দেওয়া। প্রতিটি অক্ষরের জন্য পয়সা গুনতে হতো। টেলিগ্রাম অর্থ “জরুরী, অতি জরুরী” এবং খরচাবহ একটি যোগাযোগ মাধ্যম যা ২৪ ঘন্টার মধ্য ডেলিভারি নিশ্চিত করা হতো। - এই সামান্য কথায় এই বিশাল হৃদয়ের মানুষটি তাঁর সন্তানদের তাঁর আশা ভরসা স্নেহ মায়া মমতা ভালোবাসা কতোটুকু বোঝাতে পারতেন জানিনা, কিন্তু তাঁর সন্তানরা পরের সপ্তাহে চিটাগাং মেইল ট্রেন ধরে মধ্যরাতে বাড়িতে উপস্থিত হতেন, সাথে সবার হাতে দাদাজানের প্রিয় মাটির পাতিলে রসগোল্লা। সারারাত চলতো মজাদার গল্প। দাদাজান দাদীজান বটবৃক্ষ - আমরা তাঁর লতা পাতা মাত্র।।
চলবে . . . . . . . . . . .
কৃতজ্ঞতা: - সামহোয়্যারইন ব্লগ কর্তৃপক্ষ। নির্বাচিত পোস্টে “টেলিগ্রাম” ১ম পর্ব লেখাটি স্থান দেওয়াতে সামহোয়্যারইন ব্লগ কর্তৃপক্ষকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে অক্টোবর, ২০১৯ রাত ২:৪৬