ভাতের সাথে লেবু পছন্দ করেন না এমন বাঙালী পাওয়া বিরল বিষয়। আর এই উষ্ণ গরমে এক গ্লাস লেবুর শরবত যে কোনো মানুষের সকল ক্লান্তি দূর করে দিতে পারে নিমিষে। একসময় গ্রাম এলাকায় প্রায় প্রতিটি বাড়িতে দুই চারটি লেবু গাছ ছিলো। গ্রামের বাড়ির লেবুর মধ্য অন্যতম ছিলো কাগজি লেবু আর বাতাবি লেবু। কারোও কারোও বাড়িতে এলাচি লেবুর গাছও ছিলো। যার ফলে বাড়ি ঘরের প্রয়োজন সহ মেহমান আপ্যায়নে বাড়ির লেবুই যথেষ্ট ছিলো। জনসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে বেড়েছে বাড়িঘর দালানকোঠা আর নির্বিচারে কাটা পরেছে ফলের গাছ, ঔষধি গাছ সহ পরিবেশ বান্ধব মমতাময়ী বিশাল বিশাল বৃক্ষ।
বৃক্ষ নিধনের পাশাপাশি জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে লেবু চাষ শুরু হয়েছে, বলতে হবে বেশ ভালোভাবেই চাষ হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে যে লেবুগুলো পাওয়া যাচ্ছে তার মধ্য অন্যতম হচ্ছে “কাগজি লেবু, বারি জাত কাগজি লেবু, বাতাবি লেবু, সিলেটি লেবু (পাহাড়ি লেবু নামে পরিচিত) পাতিলেবু, শরবতি লেবু, এলাচি লেবু, কলম্বো লেবু” এবং বিদেশী জাতের লেবুর মধ্যে আছে “জামির লেবু বা জারা লেবু, ও বর্মা লেবু”। জারা লেবুর জাতটি সিলেটে যদিও তবে এটির মূল আবাসভূমি আসাম। সিলেটের যে কোনো বাজার থেকে শুরু করে দরগাহ গেটের সামনে ফেরি করে জারা লেবু বিক্রয় হয়। বর্মা জাতের লেবু বাংলাদেশে আসার অন্যতম কারণ বৃটিশ শাসনামলে বাংলাদেশের প্রচুর লোকজন বার্মাতে ব্যবসা ও চাকরি করতেন। সে সুবাদে বর্মা লেবুর আগমন ঘটে বাংলাদেশে। আর কলম্বো লেবুর নামে অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন এটি শ্রীলংকান জাতের তাই এর নাম কলম্বো লেবু! আসলে তা নয়। কলম্বো লেবুর নামকরণের কারণ এটি কলম করে তৈরি করা হাইব্রিড জাতিয় লেবুর একটি জাত উৎপাদন করা হয়েছে। যার আসল মাতাপিতা “বাতাবি লেবু ও এলাচি লেবু”। আর এই কলম্বো লেবুর জাত তৈরির পেছনে আছেন আমাদের দেশের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহ এর একদল মহান পাগলা শিক্ষক ও তাঁদের একদল ছাত্রছাত্রী (এরাই আমাদের দেশের সম্পদ)। বাতাবি লেবু ফলন কম হওয়ার কারণে বাতাবি লেবু বানিজ্যিকভাবে চাষ করা হয় না। তবে গ্রামের বাড়িতে শখ করে বাতাবি লেবু গাছ রোপণ করে থাকেন অনেকে। দেশের মাটি পানি ও আবহাওয়া ভেদে প্রতিটি লেবুর এলাকা ভেদে আকারে রঙে ও স্বাদে ভিন্নতা আছে।
লেবু সঙ্কট ও তাঁর কারণঃ আপনারা হয়তো লক্ষ্য করেছেন বর্তমানে সমগ্র বাংলাদেশে লেবু সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বাজারে যে সকল লেবু আছে তাতে রস বলতেই নেই বা শুকনো মনে হবে এমন কিছু। মূল সমস্যা হচ্ছে বৃষ্টি। এ বছর শীত সিজন শেষে এখন পর্যন্ত পর্যাপ্ত পরিমাণ দূরের কথা! নূন্যতম বা যতোটুকু বৃষ্টি না হলেই না তেমন কোনো বৃষ্টি আমরা পাইনি। আর লেবু চাষ হয় সাধারণত অসমতল জমিতে যেখানে সেচের ব্যবস্থা করা মোটামোটি ব্যায় সাপেক্ষ। তারপরও আমরা যারা লেবু চাষের সাথে কমবেশী সম্পৃক্ত আছি - লেবু ক্ষেতে ও লেবু বাগানে টিউবওয়েলে মটরপাম্প ফিট করে রাবার পাইপ দিয়ে পানি সরবরাহ করে যাচ্ছি। তাতে করে গাছগুলো বেঁচে থাকার জন্য, জীবনের জন্য সামান্য পানি পেয়ে যাচ্ছে মাত্র। আর এই পানির অভাবে বিশেষকরে বৃষ্টির পানির অভাবে লেবু এখনও রসালো হয়ে উঠতে পারেনি। লেবুর জমি সাধারণত ধানের জমি থেকে বেশ দূরে ও অসমতল হওয়াতে পানির ব্যবস্থা করা দূরহ ও ব্যয়বহুল ব্যাপারও বটে। আশা করছি আগামী কয়েক দিনের মধ্য বৃষ্টি হবে তাতে করে বৃষ্টির পাঁচ থেকে সাত দিনের মধ্য লেবু রসালো হয়ে যাবে এবং পুরোদমে চাহিদা অনুযায়ী মানসম্মত ও পর্যাপ্ত পরিমাণ লেবু বাজারে সরবরাহ হতে থাকবে।
রপ্তানি খাতঃ বর্তমানে বাংলাদেশে লেবু একটি রপ্তানি পণ্য। আশার বিষয় বাংলাদেশ থেকে প্রচুর লেবু মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাজ্যে সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বেশ সুনামের সাথে রপ্তানি হচ্ছে।
লেবুর তৈলঃ বাংলাদেশে লেবু থেকে তৈল তৈরির প্রক্রিয়া এখনো বানিজ্যিকভাবে শুরু হয়নি। আশা করছি অদূর ভবিষ্যতে লেবুর বাকল থেকে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও মূল্যবান এই তৈল তৈরি হবে যা ঔষধি গুণে ও মানে ভরপুর। ঔষধ, সাবান, বেকারি পেস্ট্রি এবং অন্যান্য সুগন্ধি প্রসাধনী তৈরিতেও সুগন্ধি উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে লেবুর তৈল।
রেসিপিঃ সামান্য পরিমাণ লেবু পাতা, লেবুর বাকল যে কোনো মাছের তরকারি ও মাংসের তরকারিতে খুব মজাদার স্বাদ তৈরি করতে সাহায্যে করে। তাছাড়া পাকা পেপের ফালিতে সামান্য লেবুর রস দিলে পেপে খাবারের স্বাদ মনে রাখার মতো।
উপসংহার ও আত্মকথাঃ গাছ অক্সিজেন হিসেবে শুধু মানুষের জীবন দানই করে না, জীবন জীবিকার জন্য বানিজ্যিকভাবে সহযোগিতা ছাড়াও আপনার বাড়ির বিছানার পাশের জানালার কাছে যদি একটি লেবু গাছ থাকে রাতে আপনার ঘুম হবে খুবই আরামদায়ক ও শান্তিময় (এটি পরিক্ষিত সত্য)। ***বুদ্ধিমান ব্লগারগণের কাছে প্রশ্ন থাকবে লেবু গাছ জানালার পাশে থাকলে ভালো ঘুম হবার কারণ কি?
ছবিঃ লেবুর রস দিয়ে পেপে খাবারে অতুলনীয় স্বাদ
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ সামহোয়্যারইন ব্লগ। নির্বাচিত পোষ্টে “উক্ত লেখাটি” স্থান দেওয়াতে সামহোয়্যারইন ব্লগ কর্তৃপক্ষকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মে, ২০২১ বিকাল ৩:১৩