(১)
যতোদুর পর্যন্ত চোখ যায় শুধু বালি আর বালি আর পাথুরে পাহাড়! পাহাড়ের ঐ পাড়ে কি আছে? - বালি আর বালি আর পাথুরে পাহাড়! রোদ্রের আলোতে বালি চিক চিক করে! দেখে মনে হতে পারে পরিস্কার ঝকঝকে পানি টলমল করছে! পথ ধরে সারাবেলা হাটার পরও সেই পানির দেখা মেলে না। জনমানবহীন মরুপ্রান্তর। পাহাড়ের কুল ঘেষে একদল মানুষ বাস করে। তামাটে গায়ের রঙ, জরাজীর্ণ শরীর ঠিক গুচ্ছগ্রাম নয় এরা যাযাবর, বেদুইন। সামান্য পানির খোঁজে দিনের পর দিন মাসের পর মাস বছরের পর বছর মরুভূমির একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত ছুটে বেড়ায়। বালিমাটি খুড়ে এক ধরনের আলু পাওয়া যায়, যা থেকে অত্যন্ত কৃপণতার সাথে পানির তেষ্টা মেটে। মরুপ্রান্তরের পশুর সাথে লড়াই করে পশুর জীবন যাপন করাই এদের দৈনন্দিন জীবন। সময় ১০,০০০ বিসি।
বেদুইন দলের দলনেতা অসুস্থ। দলনেতা জুম্মা মারা গেলে সত্যি সত্যি এই বেদুইন দলটি পথহারা দিশেহারা হয়ে পড়বে। দলের সকলে গত তিন রাত ধরে অগ্নিপূজা করে যাচ্ছেন। ফলাফল শূন্য। দলের নারী পুরুষ থেকে শুরু করে শিশু পর্যন্ত আশাহীনতায় দিন গুনছেন। চতুর্থ রাত চতুর্থ প্রহরে নিভু নিভু আগুনের আলোতে দেখা যায় দুর থেকে একজন অপরিচিত আগন্তুক বেদুইনদের আস্তানার দিকে এগিয়ে আসছেন! বেদুইন দলের নারী পুরুষ তটস্থ হয়ে অস্ত্র হাতে নেন - তীর ধনুক, ধারালো পাথর, গুলতি। দলনেতার অপ্রাপ্তবয়স্ক একমাত্র পুত্র মাকুবা আগুনের মশাল হাতে মারমুখী উদ্যত হয়ে দাড়ায়। আগন্তুক দুইহাত তুলে প্রমাণ দেন তিনি নিরস্ত্র। ডান কাঁধে ভেড়ার চামড়ার ছোট পোটলা তাতে বেশ বড় আকারের টকটকে লাল একটি বেদানা! আগন্তুক হাতের পোটলাটি দলনেতার পুত্র মাকুবার হাতে তুলে দেন। এই ফল খেলে আপনার পিতা সুস্থ হতে পারেন! মাকুবা ছুটে যান তাঁর মৃত্যুপথযাত্রী পিতার কাছে।
জ্বলন্ত মশালের আগুনের আলোতে বেদানার দানাগুলো লাল চুনি পাথরের মতো ঝকঝক করে উঠে। বেদুইন দলের সকলে ঝুঁকে পড়েন ফলের দিকে, তাঁদের জীবনে এমন ফল খাবেন অনেক দুর দুরান্তের কথা - এমন ফল না কেউ কোনোদিন দেখেছেন আর না কেউ কোনোদিন শুনেছেন। দলনেতা জুম্মা অদ্ভুৎ আশ্চর্য আর অত্যন্ত পুষ্টিদায়ক মজাদার ফলের কিছু দানার রস খেয়ে চোখ মেলেন! - দলনেতা জুম্মার কাছে এটি স্বর্গীয় ফল মনে হয়! পুষ্টির কারণেই হোক আর অত্যন্ত স্বাদের জন্যই হোক, অথবা হতে পারে শেষ রাতের সেই আগন্তুকের হাতেই হয়তোবা যাদু ছিলো। এ যাত্রা দলনেতা জুম্মা বেঁচে গেলেন।
(২)
রাজ্যহারা হুমায়ূন জীবন বাঁচাতে পালাতে পালাতে এসেছেন রাজস্থানের যোধপুরের শেষ সীমানায়। সাথে আছেন তাঁর স্ত্রী হামিদা বানু, আর বিখ্যাত বৈরাম খাঁ। অর্থের অভাব, খাবারের অভাব, পানীয় পানির অভাব তারপরও কিছু সৈন্য আর কয়েকজন আমীর রয়ে গিয়েছেন তাঁদের সাথে। মধ্যরাতে কিভাবে যেনো সামান্য গম যোগারযন্ত্র হয়েছে, এখন তাই লবন পানি দিয়ে সিদ্ধ হচ্ছে। ভাবতেও কষ্ট হয় হিন্দুস্থানের সম্রাট বাদশাহ হুমায়ূন আর হিন্দুস্থানের সম্রাাজ্ঞী হামিদা বানু গম সিদ্ধ খাবেন! ভগ্নহৃদয় হুমায়ূন দেখতে পেলেন হামিদা বানু কি যেনো খুব আরাম করে খাচ্ছেন অথচ হামিদা বানুর কাছে কোনো খাবার থাকার কথা নয়! হুমায়ুন জানতে চান - হামিদা কি খাচ্ছেন? হামিদা বানু উত্তর দেন - খুব বেদানা খেতে ইচ্ছে করছে তাই তিনি বেদানা খাচ্ছেন। হুমায়ূন হতবাক হয়ে লক্ষ্য করেন হামিদা বানুর হাতে কিছুই নেই, তিনি জানতে চান - বেদানা কোথায়? হামিদা বানু অশ্রুসজল চোখে উত্তর দেন - তিনি কল্পনায় বেদানা খাচ্ছেন!
বিস্ময়কর একটি ঘটনা - তখন রাতের চতুর্থ প্রহর, একজন অপরিচিত আগন্তুক হুমায়ূনকে কুর্নিশ করে জানান তিনি ডাকাত দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত একজন বণিক। কিন্তু তাঁর কাছে একটি বড় বেদানা আছে যা বাদশাহের সন্মানে তিনি এটি উপহার দিতে চান। বাদশাহ কি দয়াকরে তাঁর উপহার গ্রহণ করবেন? হিন্দুস্থানের সম্রাাজ্ঞী অনেক দুঃখে কেঁদেছেন আজ বেদানা হাতে তিনি আনন্দে কাঁদছেন! হামিদা বানু অন্তঃসত্ত্বা। হামিদা বানু সিন্ধ রাজ্যের অমরকোটে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। তাঁর নাম রাখা হয় আকবর। পৃথিবীর ইতিহাসে এই আকবর তাঁর স্থান করে নেন “আকবর দ্য গ্রেট” হিসেবে। সময় ১৫৪২ সন।
(৩)
ডিসেম্বরের কনকনে শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকার রাত। ১৯৮২ এফজে-৪০ মডেলের লক্কর ঝক্কর একটি ল্যান্ড ক্রুজার নিয়ে ছুটে চলেছেন একজন প্রহরী। গায়ে জ্যাকেট পায়ে ভারী ডিউটি বুট, পাশের সিটে রাখা কেইনউডের ওয়াকিটকি রেডিও। গরম পানিতে হাত ধুয়ে হাতমোজা পড়েছেন তারপরও বরফ শীতল বাতাসে হাত জমে যাচ্ছে, স্টিয়ারিং ধরে রাখতে রিতিমতো কষ্ট হচ্ছে। দুর দুরান্ত পর্যন্ত কোনো বাড়িঘর নেই, জনমানবহীন মহাসড়কের দুই পাশে গাছ আর সবুজ প্রকল্পের জিয়া খাল। মহাসড়কের সঙ্গী মাঝে মাঝে দেখা দিয়ে হুস করে চলে যাচ্ছে মালবোঝাই হলুদ রঙা সমগ্র বাংলাদেশ পাঁচ টন ট্রাক। প্রহরী খুবই আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করেন মহাসড়কের পাশে তিনজন নারী পুরুষ হারিকেন হাতে দাড়িয়ে আছেন! রাতের চতুর্থ প্রহর, এই সময়ে মহাসড়কে নারী পুরুষ বিপদে পড়ে দাড়িয়ে আছেন নাকি এটি কোনো ট্র্যাপ! প্রহরী দ্রুত চিন্তা করেন, তিনি কি দাড়াবেন নাকি চলমান গতিতে চলে যাবেন? আকস্মিক আক্রমণ ও নিরাপত্তার কথা ভেবে অস্ত্র হিসেবে ড্রাইভিং সিটের নিচ থেকে স্টেইনলেস স্টিলের শিকল বের করে ডান হাতে পেঁচিয়ে তিনি ল্যান্ড ক্রুজার পাশ করেন। না, তিনজন নারী পুরুষ নন এখানে চারজন। অল্প বয়স্ক অন্তঃসত্ত্বা এক মেয়ে সড়কের পাশে শুয়ে হিচকি দিয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছেন সাথে অন্তঃসত্ত্বা মেয়ের মাতাপিতা ও একজন গ্রাম্য ধাত্রী। তাঁরা জানান আত্মীয় পরিজনের কলহের কারণে তাঁরা বসতবাড়ি ছেড়ে গ্রামের বাইরে বাড়ি করেছেন আর আজ দুর্দিনে পাশে কেউ নেই। এখানে সদর হাসপাতালে যেতেই তারা মহাসড়কে দাড়িয়ে আছেন!
প্রহরীর রাস্তা ফুরোয় না। তিনি রোগীনি ও তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে যথাসম্ভব দ্রুতগতিতে ল্যান্ড ক্রুজার নিয়ে ছুটেন। রোগীনির নাম আলেয়া। আলেয়া হিচকি বন্ধ করে দিয়েছেন। দেখে মনে হচ্ছে আলেয়া গভীর ঘুমে অতলে তলিয়ে যাচ্ছেন। প্রহরী আলেয়াকে বারবার ডাকেন, আলেয়ার মাতাপিতাকে বলেন - আলেয়ার সাথে আপনারা কথা বলুন। আলেয়া অনেক কষ্টে চোখ খুলে আবারও চোখ বন্ধ করেন। প্রহরী গাড়ীর ড্যাশবোর্ড খুলে প্রমাণ সাইজের লাল টকটকে একটি বেদানা বের করেন। বেদানাটি পেয়েছেন প্রবাস থেকে ফিরে আসা একজন সিনিয়রের কাছে। প্রহরী না খেয়ে এটি রেখে দিয়েছেন তাঁর মাতাপিতা ও সন্তানদের জন্য। তিনি আলেয়ার মায়ের হাতে বেদানা দিয়ে বলেন - ভাঙ্গুন, মেয়ের মুখে দানা চিপে রস দিন। প্রহরী স্টিয়ারিং হাতে আলেয়ার সাথে কথা বলেন - আলেয়া মা, আপনার সন্তান অনেক সাহসী হবে। আপনার সন্তান আপনার বাবা মায়ের চাইতেও দেখতে সুন্দর হবে - - - । সময় ১৯৯৩ সন।
পরিশিষ্টঃ সদর হাসপাতালের মসজিদে মুয়াজ্জিন ফজরের আযান দিচ্ছেন। হাসপাতালের লম্বা করিডোরে সবাই ক্লান্ত - অবসন্ন - অপেক্ষারত। একজন নার্স এসে জানিয়েছেন আলেয়া একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। মা পুত্র ভালো আছেন। ডাক্তার লেবার রুম থেকে বাইরে আসতে সময় লাগবে, কারণ তাঁদের অক্সিজেন দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালে পৌছাতে কিছু দেড়ি হলে হয়তো মা সন্তানকে বাঁচানো যেতো না। কান্নারত আলেয়ার পিতা প্রহরীকে গভীর মমতায় জড়িয়ে ধরে জানতে চান - এখন চারোদিকে ফজরের আযান হচ্ছে, তাঁর নাতী হয়েছে, তাঁর কি আযান দিতে হবে? প্রহরী প্রবল আত্মবিশ্বাসের সাথে জানান - আপনার আযান দিতে হবে। আপনি আযান দিন।
ফজরের আযানকে ছাপিয়ে আরো একটি আযান হাসপাতালের চিকিৎসক নার্স ও বোর্ডার’রা শুনতে পান। হাসপাতালের করিডোরে আলেয়ার পিতা আযান দিচ্ছেন -
আল্লাহু আকবার - আল্লাহু আকবার
আল্লাহু আকবার - আল্লাহু আকবার
আশহাদু-আল লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ
আশহাদু-আল লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ
উৎসর্গঃ নাটক সিনেমায় কখনো কখনো মূল চরিত্রের চেয়েও পার্শ্ব-চরিত্রের খুব জোড়ালো শক্ত ভূমিকা থাকে। ব্লগেও এমন আছেন। তেমনই জোড়ালো ভূমিকার একজন স্বামী বিশুদ্ধানন্দ ভাই। তিনি হয়তো পোস্ট কম দিয়েছেন কিন্তু তাঁর মন্তব্যগুলো খুবই প্রয়োজনীয় ও লেখালেখির জন্য প্রেরণাদায়ক। আজকের সামান্য লেখাটি স্বামী বিশুদ্ধানন্দ ভাইকে উপহার।
মুঘল সালতানাত বাদশাহ হুমায়ূন তথ্যসূত্রঃ
তাজকিরাতুন ওয়াকিয়াত।
ক্যামব্রিজ হিস্টরি অব ইন্ডিয়া।
হুমায়ূন নামা।
বাদশাহ নামদার।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই নভেম্বর, ২০২১ রাত ১০:৩৫