somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মরু প্রান্তরে মরুভূমির কান্না

০৩ রা জানুয়ারি, ২০২৫ ভোর ৫:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



(১)
ব্যস্ত রাজধানী শহর ঢাকা, ব্যস্ত মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা। এরশাদ সরকারের চোখ ধাধানো সোডিয়াম লাইটের আলোয় বিশাল বিশাল ভবন আর ইমারতের রাজধানীর রাজধানী মতিঝিল। সমগ্র বাংলাদেশ সহ সমগ্র বিশ্বেই হয়তো মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা পরিচিত। মিজানুর রহমান সাহেব মতিঝিল এলাকায় একটি সরকারি ব্যাংকে সহকারি হিসাব রক্ষক হিসেবে কাজ করেন। মতিঝিল সরকারি কলোনিতে তার একটি বাসাও আছে। বৃহস্পতিবার বিকালে বাসে ট্রেনে করে গ্রামের বাড়িতে চলে যান, বাবা মা ভাই বোনের সাথে আন্তরিক সময় পার করে শনিবার ভোর সকালের বাসে করে ঢাকা ফিরে অফিস ধরেন। বাবা মা ভাই বোন নিয়ে বেশ আনন্দময় সংসার। ছেলের উন্নতিতে খুশি হয়ে বাবা মা বেশ খরচ করে বিয়ে করালেন, মিজান সাহেব নতুন বউ নিয়ে কলোনির বাসায় উঠে আসলেন। নতুন সংসার, বিকালে স্ত্রী নিয়ে মাঝে মাঝে বেড়াতে বের হোন ঘর সংসারের প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনী নানান কিছু কিনেন, সম্ভবত একেই বলে - ছিমছাম সুন্দর জীবন। মিজান সাহেবকে কি কারণে - কেনো - কি ভুতে ধরেছে জানা নেই, তিনি মতিঝিলের কোনো এক আদম অফিস ধরে মরুর দেশ সৌদি আরব চলে গেলেন। সরকারি চাকরি ছেড়ে দিলেন, নতুন স্ত্রীকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন। সময় ১৯৮৯। কি জানি - কেনো জানি মনে হলো মিজান সাহেন হয়তো বড় ধরনের ভুল করলেন।

১৯৯০ সন, আন্দোলন- আন্দোলনে দেশের অবস্থা লবডঙ্কা! মতিঝিলের অবস্থা আরোও খারাপ। দেশের এই খারাপ অবস্থায় মিজান সাহেব স্পাউজ ভিসাতে স্ত্রীকে সৌদি আরব নিয়ে গেলেন। সৌদি কোম্পানির দেওয়া ঝকঝকে সেডান কার ও কার্পেট মোড়ানো আধুনিক ফ্লাট। শাওয়ার বাথ ও মিক্সার ট্যাপ সহ প্রতিটি বেসিন ও পাকের ঘরে সব সময় ঠান্ডা গরম পানি। প্রতিটি রুমে উইন্ডো এসি, ডাইনিং রুমে ফ্রিজ, পাকের ঘরেও ফ্রিজ ওভেন এলাহি ব্যাপার। শুক্রবার সাপ্তাহিক বন্ধ, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সুপার মার্কেট হতে চার পাঁচ ব্যাগ ভর্তি বাজার করেন - অলিভ অয়েল সয়াবিন তৈল, সবজি মাছ মাংস চাল ডাল, ব্রেড চিজ বাটার, দুধ ডিম দই, আঙুর আপেল মাল্টা কলা ও আরবের খেজুর, বোতল ক্যান পেপসি সেভেন আপ, সাবান শ্যাম্পু প্রসাধনী ইত্যাদি। মিজান সাহেবের ঘর আলো করে, না ঘর আলো করে নয় - ফ্লাট আলো করে কন্যা সন্তান এলো, তিনি কন্যা সন্তানের নাম রাখলেন আরবি নামে, আরব দেশে থাকেন আরব দেশের প্রতি ভালোবাসা। ইসলামের দেশে মুসলিম হয়ে পৃথিবীতে এসে মিজান সাহেবের জীবন হয়েছে ধন্য! দুর্গম বাংলাদেশ ছেড়ে তিনি প্রবাসে এসে ভালোই করেছেন - হয়তো, অনেক বেশি ভালো করেছেন।

(২)
মিজান সাহেব ছুটি পাবেন দেড় মাসের। দেশে আসবেন, কন্যা সন্তানের বয়স এক বছর। মিজান সাহেব স্ত্রী কন্যা নিয়ে প্রতিটি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় প্রচুর বাজার করছেন, নিজের বাড়ির জন্য, শশুর বাড়ির জন্য। সোনা গয়না, সনি রঙিন টেলিভিশন, চার্জ লাইট, টর্চ লাইট, সিকো ফাইভ ঘড়ি, স্পেনিশ কম্বল, কাশ্মিরি শাল শাড়ি, কমপক্ষে পনেরো কিলো প্রসাধনী, বিখ্যাত আরব দেশের খেজুর, কিসমিস সহ ইত্যাদি। ঠিক এমনই এক বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর পর এশার নামাজের সময় দোকানপাট মার্কেট বন্ধ, মিজান সাহেব সেডানে বসে স্ত্রী কন্যার সাথে বাড়িতে যাওয়ার গল্প করছেন। আর কি কি কেনা উচিত! - উচিত, এখন নামাজে যেতে হবে! কিন্তু গাড়ির দরজা খোলার আগে দরজার সামনে সৌদি সাদা জুব্বা পরিহিত হাতের আঙুলে তসবিহ ঠোটে ফাইভ ফাইভ সিগারেট দুইজন মতুয়া পুলিশ!

মতুয়া/মুতাওয়াইন - ইসলামিক রিলিজিয়াস পুলিশ। এরা প্রান্তিক গ্রাম্য ভাষায় চিবিয়ে চিবিয়ে আরবি কথা বলে থাকে, এদের কথা বোঝা মুশকিল। মিজান সাহেব সকল ভাবে বোঝাতে ব্যর্থ হলেন যে তিনি এখনই নামাজে যাবেন! এমনকি তিনি ব্যর্থ হলেন বোঝাতে - তিনি সৌদি আরবে সৌদি প্রতিষ্ঠানে বেশ ভালো চাকরি করছেন, মিজান সাহেব ও তাঁর স্ত্রীর ইকামা আইডি, ড্রাইভিং লাইসেন্স মতুয়া জব্দ করে তাদের নিজস্ব জীপে নিয়ে উঠালেন। ড্রাইভিং সিটে আরোহিত আরো একজন মতুয়া। তিন জনেরই বয়স ৪০-৪৫। জীপ থানা বা কোনো মসজিদের দিকে না গিয়ে উড়ে চলেছে শহরের বাইরে মরুভূমির দিকে। মিজান সাহেব আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলেন তিন মতুয়া মিলে খুবই নোংরা অশালীন আরবি ভাষায় ঠাট্টা মশকরা করছে! রাস্তা ছেড়ে বালির উপর দিয়ে ছুটে চলেছে জীপ - মরুভূমির বুকে দূরে খেজুরের বাগান, মাজরা। হঠাৎ জীপ থেমে ড্রাইভিং সিটে আরোহিত মতুয়া মিজান সাহেব কে ইশারা করেন “ইয়াল্লাহ ইয়াল্লাহ সুরাহ সুরাহ, ইয়াল্লাহ বাররাহ বাররাহ” মিজান সাহেব ভেবে নেন এই হচ্ছে তাঁদের শাস্তি, এখন মরুভূমি হতে পায়ে হেটে সাবওয়ে/হাইওয়ে’তে যেতে হবে।

মিজান সাহেব জীপ হতে বাচ্চাকে নিয়ে নামার সাথে সাথে জীপ আবার ছুটে চলেছে মরুভূমির খেজুরের বাগানের দিকে। দুর্ভাগ্যবসত জীপে রয়ে গিয়েছেন মিজান সাহেবের স্ত্রী! মিজান সাহেব তাঁর বাচ্চাকে নিয়ে রাতের মরুভূমিতে ছুটে চলেছেন জীপের পেছনে পেছনে। তিনি সিনেমার নায়ক নন যে দৌড়ে জীপ ধরতে পারবেন! মিজান সাহেব ছোট এক বছরের বাচ্চাকে নিয়ে যখন খেজুরের বাগানে তাঁর স্ত্রীকে খোঁজে পেলেন ততোক্ষণে সময় পেড়িয়ে গিয়েছে প্রায় তিন থেকে চার ঘন্টা। পবিত্র দেশের তিন মতুয়া (ইসলামিক রিলিজিয়াস পুলিশ) মিলে উপর্যুপরি ধর্ষণ করে চুরান্ত আহত অবস্থায় ফেলে গিয়েছে তাঁর স্ত্রীকে। মহিলা তাঁর সন্তানকে বুকে চেপে ধরে পানি চাইলেন, মিজান সাহেব পানির জন্য চিৎকার করছেন কেউ শোনার নেই কেউ দেখারও নেই, এই মরুভূমিতে রাতে মানুষ থাকবে দূরে থাক ভুতও থাকে না। পানির তৃষ্ণার কারণে হোক আর গুরুতর আহতের কারণেই হোক ভদ্রমহিলা নিথর দেহে পড়ে রইলেন মরুভূমির বুকে। সারা রাত মিজান সাহেব দুধের বাচ্চাকে নিয়ে দিনের আলোর জন্য অপেক্ষা করলেন যদি স্ত্রী জেগে উঠেন, কোনো কারণে বেঁচে যান!

মৃত স্ত্রীকে মরুভূমির বুকে খেজুরের বাগানে ফেলে ভোর সকালে কিভাবে পাগলের মতো মিজান সাহেব বাসায় ফিরলেন তিনি নিজেও জানেন না। তাঁর বাচ্চাকে দুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে তিনি পাকের ঘরের একটি চাকু নিয়ে ছুটে গেলেন মতুয়া অফিসে। তিনজন মতুয়ার একজনকে পেয়ে চাকু হাতে ঝাপিয়ে পড়লেন।

(৩)
তার পরের ঘটনা খুবই সংক্ষিপ্ত। মিজান সাহেব হত্যার দায়ে গ্রেফতার হোন। বিকালে সিআইডি পুলিশ বাসায় এসে বাসার ফ্লোর হতে মৃত বাচ্চাকে উদ্ধার করে হাসপাতালের মর্গে প্রেরণ করেন। ঠিক দেড় মাস পর মিজান সাহেবকে এক শুক্রবার জুম্মা’র নামাজের পর পবিত্র দেশ সৌদি আরবের সরকারের আইনে শিরশ্ছেদ করা হয়। বিচারকার্য চলাকালীন সময়ে মিজান সাহেব তাঁর আত্মীয় পরিজনের সাথে জেলখানায় মাত্র একবার দেখা করতে পেরেছিলেন।






বিশেষ দ্রষ্টব্য: সত্য ঘটনা নিয়ে লেখা। সাপ্তাহিক যায়যায়দিন পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় ৯০এর দশকে লেখাটি একবার প্রকাশিত হয়েছে।



সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০২৫ রাত ১২:২৭
১৫টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাদিকে গুলি করলো কে?

লিখেছেন নতুন নকিব, ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:২৬

হাদিকে গুলি করলো কে?

ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা ৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী রাজপথের অকুতোভয় লড়াকু সৈনিক ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে গুলিবিদ্ধ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানুষের জীবনের চেয়ে তরকারিতে আলুর সংখ্যা গণনা বেশি জরুরি !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:১৭


বিজিবির সাবেক মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দেশবাসী একটা নতুন শব্দ শিখেছে: রুট ভেজিটেবল ডিপ্লোম্যাসি। জুলাই আন্দোলনের পর যখন সবাই ভাবছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইতিহাসের সেরা ম‍্যাটিকুলাস ডিজাইনের নির্বাচনের কর্মযজ্ঞ চলছে। দলে দলে সব সন্ত্রাসীরা যোগদান করুন‼️

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ ভোর ৪:৪৪



বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ব নিকৃষ্ট দখলদার দেশ পরিচালনা করছে । ২০২৪-এর পর যারা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী দিয়ে দেশ পরিচালনা করছে । তাদের প্রত‍্যেকের বিচার হবে এই বাংলার মাটিতে। আর শুধুমাত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির হত্যাচেষ্টা: কার রাজনৈতিক ফায়দা সবচেয়ে বেশি?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:১৮


হাদির হত্যাচেষ্টা আমাদের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে একটি অশনি সংকেত। জুলাই ২০২৪ আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের দ্বিধাবিভক্ত সমাজে যখন নানামুখী চক্রান্ত এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অন্তর্কলহে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আয়-উন্নতির গুরুত্বপূর্ন প্রশ্নগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি আর এমন কে

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:১৩


যখন আমি থাকব না কী হবে আর?
থামবে মুহূর্তকাল কিছু দুনিয়ার?
আলো-বাতাস থাকবে এখন যেমন
তুষ্ট করছে গৌরবে সকলের মন।
নদী বয়ে যাবে চিরদিনের মতন,
জোয়ার-ভাটা চলবে সময় যখন।
দিনে সূর্য, আর রাতের আকাশে চাঁদ-
জোছনা ভোলাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×