এক.
''Dear General Jamshed,
My wife Khaleda is under your custody. If you do not treat her with respect, I would kill you some day.
Major Zia''
স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বেগম জিয়া পাকিস্তানীদের হাতে অন্তরীণ থাকাবস্থায় তৎকালীন পাকিস্থানী সেনাপতি মেজর জেনারেল জামশেদকে চিঠিটি লিখেছিলেন মেজর (পরবর্তীতে লেফটেন্যান্ট জেনারেল) জিয়া। 'জেড' ফোর্সের কমান্ডার এই সেনানায়ক ছিলেন একজন অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু পরবর্তীতে আমরা দেখেছি তাঁর হাতেই ছিন্ন-ভিন্ন হয়েছে আমাদের মৌলিক সংবিধান, তিনিই রাজাকারদের পুনর্বাসিত করেছেন, রাজনীতিকে কলুষিত করেছেন।
দুই.
ষোলই ডিসেম্বর সকালে ঢাকায় পাকিস্তান ইস্টার্ন কমান্ডের হেড কোয়ার্টারে ভারতীয় মেজর জেনারেল নাগরা লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজীর সঙ্গে বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকীর পরিচয় করিয়ে দেবার সময় নিয়াজী করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলে বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী এই বলে প্রত্যাখান করেন যে, ''নারী এবং শিশু হত্যাকারীদের সঙ্গে আমি করমর্দন করি না''।
মুক্তিযুদ্ধের ছত্রিশ বছর পরে যখন টেলিভিশনে তাঁকে দেখি সরকারী খাস জমি অবৈধভাবে দখল করে বাগান বাড়ি বানাতে, পত্রিকার পাতায় দেখি অর্ধ সমাপ্ত সেতুর দুর্নীতির চিত্র, তখন মুক্তিযুদ্ধের এই বীর সেনানীর জন্য আমাদের গভীর দুঃখ বোধ হয়।
তিন.
''সৈন্যরা তোমরা আমার ভাই। তোমরা ব্যারাকে থাকো, তোমাদের কেউ কিছু বলবে না। কিন্তু আর তোমরা গুলি করার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। রক্ত যখন দিতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না। ... ... এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।'' --- জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান।
যে ক্ষণজন্মা পুরুষ এই বাঙালি জাতিকে দেখিয়েছিলেন মুক্তির স্বপ্ন, শুনিয়েছিলেন গণতন্ত্রের বাণী, সেই তিনিই হত্যা করলেন গণতন্ত্রকে, এগিয়ে চললেন একনায়কতন্ত্রের পথে ! মুক্তিযুদ্ধের কান্ডারী 'নিঃসঙ্গ সারথী' তাজউদ্দীনকে বরখাস্ত করলেন।
চার.
যাঁরা ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক-মহানায়ক-স্থপতি, তাঁরাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার লাল-সবুজ ঝান্ডাকে সমুন্নত রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন -- ক্ষমতালিপ্সায়, অসততায়, ভ্রান্তিতে। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা -- কোথায় আজ সেইসব সোনালী অর্জন ? সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের দোসর হয় একাত্তুরের বিশ্বাসঘাতক পরাজিত অপশক্তি, অপরপক্ষে ধর্মনিরপেক্ষতার কাঁধে সওয়ার বিশ্ব বেহায়া, চুক্তিনামায় লাইসেন্স দেয়া হয় ফ্রী স্টাইল ফতোয়াবাজির। যুদ্ধাপরাধীর গাড়ীতে শোভা পায় জাতির আব্রু -- আমার পতাকা।
পাঁচ.
আজ এই জনপদের প্রতিটা প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে পান্ডু রোগ পীত বর্ণে। প্রতিটা সূর্যাস্তে আমার ভেতর থেকে বের হয়ে আসে চেপে রাখা হতাশার দীর্ঘশ্বাস ... ত্রিশ লক্ষ শহীদের এনে দেয়া একটি অমূল্য দিন চলে গেল, যায়, গেছে। ছত্রিশ বছর কাটল, স্বপ্নটাকে ছুঁতে পারলাম না আমি, আমরা। বিভ্রম হয় -- আদৌ কি কোন স্বপ্ন ছিল আমাদের, কখনও ? থেমে যাব বলেই কি আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম ?
ছয়.
'৭১-র পর '৯০, ঊনিশ বছরের ব্যবধানে আমাদের অর্জন গণতন্ত্র, একটি প্রজন্মের প্রতীক্ষা, আবার '৯০ থেকে '০৭, সুদীর্ঘ যন্ত্রণার দেড় যুগ, একটি বৈষম্যহীন সময়ের স্বপ্নে উত্তরণ, চলে যাচ্ছে এই প্রজন্মের মাহেন্দ্রক্ষণ ... না, হেরে যাব বলে তো স্বপ্ন দেখিনি, আমরা আর বেঁচে থাকব না নষ্ট সময়ে। প্রতারিত হতে চাই না আর নীতিহীনতায়। মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকারের চেতনা আমাদের ধমনীতে। আসুন, ঘুরে দাঁড়াই -- এবারের ব্যর্থতা আবার আমাদের ছুঁড়ে ফেলবে স্বপ্ন থেকে আরেক প্রজন্ম দূরে। আমরা আবার হারিয়ে যেতে চাই না কালের অতল গহ্বরে।
[বঙ্গবন্ধু নামের মহান মানুষটির দেশপ্রেম এবং সদিচ্ছা নিয়ে আমার কোন দ্বিধা নেই, রাজনৈতিক কর্মপদ্ধতির ব্যাপারে হয়ত মতদ্বৈধতা থাকতে পারে -- দয়া করে এই প্রসঙ্গে কেউ আমাকে ভুল বুঝবেন না।]
সূত্র :
*রক্তে ভেজা একাত্তুর -- মেজর (অবঃ) হাফিজ উদ্দিন আহমদ, বীর বিক্রম
*বাংলাদেশের তারিখ -- জাস্টিস মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
*জোছনা ও জননীর গল্প -- হুমায়ূন আহমেদ
*দৈনিক প্রথম আলো
*প্রামাণ্য চলচ্চিত্র 'তাজউদ্দীন আহমদ : নিঃসঙ্গ সারথী'
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মার্চ, ২০০৮ রাত ১০:৫৩