কেউ শুভেচ্ছা জানালে কি আপনি ভয় পান ?
আমিও পেতাম না, কিন্তু ইদানীং অন্য ধরনের একটা অনুভূতি হচ্ছে। শুভেচ্ছা, চার-রঙা শুভেচ্ছা পেয়ে ভয় পাচ্ছি, চিন্তায় পড়ে যাচ্ছি ... নিজের জন্য উদ্বিগ্ন হচ্ছি, আশ-পাশের মানুষের জন্য, অনাগত সময়ের জন্যও।
আবার সেই মুখগুলো, অতি চেনা, অতি পরিচিত, অতি ভয়ঙ্কর।
গেল ঈদে কিন্তু তাঁরা আমাদের শুভেচ্ছা জানাননি, বলা ভাল জানাবার অবকাশ পাননি। কথায় বলে, নিজে বাঁচলে বাপের নাম ... গত ঈদে নিজের মালকোঁচা সামলাতে ব্যস্ত ছিলেন তাঁরা, তাই তাঁদের প্রাণাধিক প্রিয় এলাকাবাসীকে ঈদের শুভেচ্ছার দাঁতাল হাসি উপহার দিতে পারেননি। তবে এবার ঘটনা ভিন্ন, পথে বেরোলেই এমন শুভেচ্ছা বাণী নিশ্চয়ই আপনারও চোখে পড়ছে -- চার-রঙা পোস্টার, আকর্ণ বিস্তৃত হাসি দিয়ে ঈদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন ছবির ব্যক্তিটি - স্থানীয় বিশিষ্ট নেতা-পাতি নেতা এঁরা, অনেকেই কমিশনার, মাননীয় জনপ্রতিনিধি। যাঁদের নিরলস এবং ঐকান্তিক সেবায় দু' বছর আগে অবধি আপনার-আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত ছিল। কত না সেবা করেছেন তাঁরা আমাদের ! আমার আপনার সুবিধার জন্য সরকারী রাস্তার উপর বাজার তৈরী করে দিয়েছেন, যাতে অফিস-ফেরতা মানুষের কষ্ট করে বাজারে যেতে না হয়, আবার অন্যদিকে যাতে দরিদ্র সবজিওয়ালা-মাছওয়ালা-মুদি দোকানীরা নির্বিঘ্নে সেখানে ব্যবসা করতে পারে তার জন্য দৈনিক নজ্রানার বিনিময়ে ব্যক্তিগত পেটুয়া বাহিনী দিয়ে নিরাপত্তা দিয়েছেন। কত না জনদরদী নেতা তাঁরা ! কোন জায়গা-জমি-সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ থাকলেই তা দখল করে নিজের হেফাজতে নিয়ে নিয়েছেন, তা না হলে নাদান জনগণ নিজেদের ভেতর লাঠালাঠি, মামলা-মোকদ্দমা করে ফ্যাসাদ-হাঙ্গামা করত ! তারচে' জনগণের সম্পত্তি জনপ্রতিনিধির হাতে থাকাই ভাল। কোন ঝুট-ঝামেলা নেই, শুধু কোন অর্বাচীন কিছু বলতে গেলে একটু ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করে দিতে হবে। তাঁদের জনসেবার ফিরিস্তি দিতে গেলে আরব্য রজনীর হাজার রাত পার হয়ে যাবে, তবু তা বলে শেষ করা যাবে না; সুন্দর বনের সব গাছ কেটে কলম তৈরী করে, আর বঙ্গোপসাগরের সব পানিকে কালি বানিয়েও তাঁদের কীর্তি লিখে শেষ করা যাবে না। এমনই কীর্তিমান মহামানব তাঁরা ! ভেবে দেখুন, আবাসন সমস্যার সমাধানের জন্য ব্যক্তিগত উদ্যোগে তাঁরা কত কিছু করেছেন - সরকারী জায়গা দখল করে বস্তি বানিয়ে সামান্য ভাড়ার বিনিময়ে গরীব মানুষগুলোকে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আহারে ! ব্যাংকে পড়ে থাকা অলস টাকাগুলো নিয়ে ব্যক্তিগত উন্নয়নের কাজে লাগিয়েছেন। আরে, ব্যক্তির উন্নতি মানেই তো দেশের উন্নতি, আর সরকারী ব্যাংকের টাকা মানেই তো জনগণের টাকা, নিজের টাকা, সেটা আবার ফেরত দিতে হয় নাকি ! আবার ধরেন কোন ছেলেমানুষ সন্ত্রাসী না বুঝে এক-আধটা খুন করে ফেলেছে, নয়ত ধর্ষণ। এলাকার এই কৃতি সন্তানকে রক্ষা করা তো তাঁরই কর্তব্য, তাই না ? তিনি তো সবার নেতা, সবার ভাল-মন্দ, বিপদ-আপদ তো তাঁকেই দেখতে হবে। আর এই উঠতি বয়সের সৈনিকদের একটু-আধটু হাতখরচের দরকার পড়ে না ? এলাকার সবাই মিলে ভাগ-যোগ করে দিয়ে দিলেই তো হয়ে যায়, তাহলেই আর ওদের চাঁদাবাজি করতে হয় না ! তাছাড়া প্রতিরাতেই ওরা যেয়ে তাঁর কাছে হিসাব দিয়ে আসে। বেশীটা অবশ্য তিনিই রেখে দেন, ছেলে-পেলে মানুষ, ওদের হাতে বেশী টাকা-পয়সা দেয়া ঠিক না, অভিভাবক হিসেবে এটা দেখাও তো তাঁর কর্তব্য।
যাই হোক, এই দু' বছর তাঁরা আমাদের সেবা না করতে পেরে অনেক কষ্টে ছিলেন, বিদেশ-বিভুঁইয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছেন, কেউ বা আবার কারাবিশ্র্রামে ছিলেন লাল ঘরে। তবে মূহুর্তের জন্যও তাঁরা আমাদের কথা বিস্মৃত হন নাই, কবে ফিরে আসবেন, কবে আবার নতুন করে আমাদের সেবা করা শুরু করবেন, সেই চিন্তাতেই অস্থির হয়ে ছিলেন সর্বক্ষণ। অনেক দিন তাঁদের সেবা না পেয়ে সেবা পেতে অনভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম, তাই এই নির্বাচনের মৌসুমে নতুন করে তাঁদের 'এসে গেছি মামুজান' মার্কা দাঁতাল হাসি আর ঈদ শুভেচ্ছা পেয়ে ভয় পাচ্ছি। দু' বছরের না-করা সেবা দিয়ে এবার হয়তো তাঁরা পুষিয়ে দিবেন, চার-রঙা পোস্টারের বিনিয়োগ সেই ইশারাই দিচ্ছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই অক্টোবর, ২০০৮ সন্ধ্যা ৬:১৮